alt

উপ-সম্পাদকীয়

ধর্মীয় স্বাধীনতা ও কঠিন চীবরদান

মিথুশিলাক মুরমু

: শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪

বাংলাদেশের প্রধান চারটি ধর্মÑ ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান। এছাড়া আরো কতগুলো ধর্ম রয়েছে, যার অনুসারীরা সংখ্যায় কম। সাম্প্রতিক সময়ে বৌদ্ধধর্মের প্রধান ধর্মীয় উৎসব কঠিন চীবরদান উৎসব এ বছর বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। ঘোষণাটি এসেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্মিলিত ভিক্ষু সংঘ থেকে। ৬ অক্টোবর রাঙামাটি শহরের মৈত্রী বৌদ্ধ বিহারের উপাসনালয়ে (ধর্ম উপদেশ কক্ষে) এ ঘোষণা দেয়া হয়। চলতি অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে মাসব্যাপী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব কঠিন চীবরদান অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। চট্টগ্রাম সম্মিলিত ভিক্ষু সংঘের উদ্যোগে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উঠে এসেছে এরূপ সিদ্ধান্তের কারণসমূহ। বলা হয়েছে, ‘এ যাবত যত সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে, তার কোনোটির বিচার হয়নি। এসব ঘটনায় নামমাত্র তদন্ত কমিটি করা হয়, যা আলোর মুখ দেখে না। এ কারণে বৌদ্ধ সমাজ ও ভিক্ষু সংঘ উদ্বিগ্ন।’ এমন নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চয়তার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের সব বিহারে কঠিন চীবরদান না করার ঘোষণা দেন পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের সভাপতি শ্রদ্ধালঙ্কার মহাথের। এদেশে বৌদ্ধরা সংখ্যার বিচারে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পরেই, তারপরে রয়েছে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা। যে বিষয়টি বলা হয়েছেÑ তা হলো সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দৃষ্টান্তমূলক বিচার সম্পন্ন হয় নাই। অবস্থাদৃষ্টে দৃষ্টান্তমূলক বিচার দেশবাসী পর্যবেক্ষণ করে নাই সত্যি; কিন্তু কেন? বিগত বছরগুলোতে বহুল আলোচিত সাম্প্রদায়িক ঘটনার কোনোটিরই সঠিক ও নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দোষী ব্যক্তিবর্গের শাস্তির ঘটনা চোখে পড়েনি। অভিযোগ রয়েছে, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী অপশক্তি রাষ্ট্র, সরকার, প্রশাসন, রাজনীতি, সমাজসহ সব ক্ষেত্রে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেছে। অপরদিকে সংবিধানের ৪১ অনুচ্ছেদে বর্ণিত রয়েছে, ‘প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে।’ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব বর্জনের ডাক রাষ্ট্রের দায়িত্ব অবহেলার দিকেই অঙ্গুুলি নির্দেশ করে। আমরা ভেবেছিলাম অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়কালে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উৎসবাদিতে থাকবে উচ্ছ্বাসতা, আনন্দ ও সাবলীল নিরাপত্তা। এ নিরাপত্তা কোনোক্রমেয় পুলিশ, র‌্যাব কিংবা সেনাবাহিনীর উপস্থিতি নয়। কোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থেকে নয়, একেবারেই গণমানুষের সচেতনায়, একে-অপরের ভালোবাসায়, দায়িত্ববোধ কিংবা পিতৃপুরুষদের ঐতিহ্যের আবহে যুক্ত হয়েই উৎসবমুখর পরিবেশের বিনির্মাণ করা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব পালনকালেও বিগ্রহ ভাঙা ও মন্দির আক্রমণের ঘটনা চলমান রয়েছে, বন্ধ হয়নি। অর্থাৎ আমাদের প্রতিবেশীরা প্রতিবেশীমূলক আচরণ ও দায়িত্ববোধ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। সৃষ্টির সেরা জীব, আশরাফুল মাকলুকাত হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছি। ধর্ম নিয়ে মানুষ নয় কিন্তু মানুষ নিয়েই ধর্মÑ সেই সত্যটি উপলব্ধি করতে পারিনি। সেন্টার ফর অল্টারনেটিভস (সিএ) এবং বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরি (বিপিও)-এর প্রতিবেদনে অনুযায়ী, ‘সহিংসতার ৫৯ ভাগই ঘটে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি ও ধর্মীয় স্থান ধ্বংসের মাধ্যমে। আর ১১ শতাংশ সরাসরি ভূমিকেন্দ্রিক বিরোধকে ঘিরে। সহিংসতার ২৭ শতাংশ ক্ষেত্রে শারীরিক নিগ্রহ বা হত্যার ঘটনা ঘটে। মোট ২ শতাংশ লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, আর ১ শতাংশ নির্বাচনভিত্তিক।’ অতীতে চারণ কবিদের কণ্ঠে শোভা পেয়েছেÑ গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান, মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম, আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম। আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন কল্পকাহিনী না হয়, অতীতে যেমন বিদ্যমান ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে; সেটি আমাদের প্রাণের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন। ৫ আগস্টের পরবর্তীতে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরাও আতঙ্কিত হয়েছেন। চার্চের নিয়মমাফিক আচার-অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে গিয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারীতে দুজন যাজক স্থানীয় উগ্রবাদীদের দ্বারা অপদস্ত ও অসম্মানিত হয়েছেন। একদল উগ্রবাদী ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টিতে তৎপর কিন্তু কিছু লোকজন স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় আইনে সোপর্দ করে। পুলিশের সঙ্গে কথা বলে যেটি উপলব্ধি করেছি, খ্রিস্টান ধর্মযাজকদ্বয় দোষী না হয়েও দোষের স্বীকারোক্তি দিয়েছেন; প্রাণে বেঁচেছেন। পরের দিন আদালতের মাধ্যমে জামিনে বেরিয়ে এসেছেন। এবারই দেখছি, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরবর্তীতে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা ও খ্রিস্টানুসারীদের নির্যাতন-অত্যাচার; পূর্বের সব রেকর্ড ভেঙেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা অস্বীকার করেননি, ধর্মীয় উপাসনালয়ে আক্রমণের বিষয়ে বলেছেন, ‘বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ঘটতে পারে, রাতের আঁধারে কেউ উপাসনালয় অপবিত্র করতে পারে।’ সরকারের পক্ষ থেকে যে কোনো ধর্মের উপাসনালয় হামলার ঘটনা জানলে তড়িৎ অ্যাকশান নিতে একটি সমন্বয় কেন্দ্র সার্বক্ষণিক তৎপর রয়েছে। ইতোমধ্যে ঘোষণা এসেছে, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্থান এবং সুফি মাজারগুলোর বিরুদ্ধে যে কোনো বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এবং এগুলোর ওপর হামলার বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেয়ার। এসব হামলায় জড়িত অসাধু শক্তিগুলোকে আইনের আওতায় আনতে এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কাজ করছে সরকার। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ছাড়াও রয়েছে আদিবাসীদের নিজস্ব ধর্ম ও বিশ^াস। কোনো কোনো জায়গা থেকে জানা যাচ্ছে, স্থানীয়রা তাদের ঐতিহ্যগত বিশ^াস ও ধর্মকে উপেক্ষা করে। বিশেষ করে সিলেট বিভাগের চা বাগান ও তার আশপাশগুলোতে; চলতে পথে চোখে পড়বে গাছের গোড়ায় সিঁন্দুর, ছোট্ট বিগ্রহ কিংবা ছোট্ট করে পূজোর স্থান। প্রত্যেকটি ধর্ম নিজের কাছে নিরাপদ ও শ্রেষ্ঠ। পৃথিবীতে মানুষের যেমন বৈচিত্র্য রয়েছে, ধর্মের ক্ষেত্রেও সীমাহীন বৈচিত্র্য। প্রয়োজন একে-অপরের ধর্মকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করা, ধর্মের মানুষকে শ্রেষ্ঠতর জ্ঞান করা। ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ রাজশাহীতে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ একটি বৈচিত্র্যময় দেশ। এদেশে নানা ধর্মের লোক থাকবে। গীর্জায় ঘণ্টাধ্বনি হবে, মন্দিরে উলুধ্বনি হবে, মসজিদ হতে আজানের ধ্বনি উচ্চারিত হবেÑ আমরা এরূপ সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে চাই। যতদিন দায়িত্বে আছি, ততদিন আমি হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানÑ সকল ধর্মাবলম্বীর পাশে থাকব।’ আমরা বিশ^াস করি, উপদেষ্টা যর্থাথই বলেছেন; ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিতের মাধ্যমেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাকবে।

[লেখক : কলামিস্ট]

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ধর্মীয় স্বাধীনতা ও কঠিন চীবরদান

মিথুশিলাক মুরমু

শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪

বাংলাদেশের প্রধান চারটি ধর্মÑ ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান। এছাড়া আরো কতগুলো ধর্ম রয়েছে, যার অনুসারীরা সংখ্যায় কম। সাম্প্রতিক সময়ে বৌদ্ধধর্মের প্রধান ধর্মীয় উৎসব কঠিন চীবরদান উৎসব এ বছর বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। ঘোষণাটি এসেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্মিলিত ভিক্ষু সংঘ থেকে। ৬ অক্টোবর রাঙামাটি শহরের মৈত্রী বৌদ্ধ বিহারের উপাসনালয়ে (ধর্ম উপদেশ কক্ষে) এ ঘোষণা দেয়া হয়। চলতি অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে মাসব্যাপী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব কঠিন চীবরদান অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। চট্টগ্রাম সম্মিলিত ভিক্ষু সংঘের উদ্যোগে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উঠে এসেছে এরূপ সিদ্ধান্তের কারণসমূহ। বলা হয়েছে, ‘এ যাবত যত সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে, তার কোনোটির বিচার হয়নি। এসব ঘটনায় নামমাত্র তদন্ত কমিটি করা হয়, যা আলোর মুখ দেখে না। এ কারণে বৌদ্ধ সমাজ ও ভিক্ষু সংঘ উদ্বিগ্ন।’ এমন নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চয়তার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের সব বিহারে কঠিন চীবরদান না করার ঘোষণা দেন পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের সভাপতি শ্রদ্ধালঙ্কার মহাথের। এদেশে বৌদ্ধরা সংখ্যার বিচারে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পরেই, তারপরে রয়েছে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা। যে বিষয়টি বলা হয়েছেÑ তা হলো সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দৃষ্টান্তমূলক বিচার সম্পন্ন হয় নাই। অবস্থাদৃষ্টে দৃষ্টান্তমূলক বিচার দেশবাসী পর্যবেক্ষণ করে নাই সত্যি; কিন্তু কেন? বিগত বছরগুলোতে বহুল আলোচিত সাম্প্রদায়িক ঘটনার কোনোটিরই সঠিক ও নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দোষী ব্যক্তিবর্গের শাস্তির ঘটনা চোখে পড়েনি। অভিযোগ রয়েছে, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী অপশক্তি রাষ্ট্র, সরকার, প্রশাসন, রাজনীতি, সমাজসহ সব ক্ষেত্রে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেছে। অপরদিকে সংবিধানের ৪১ অনুচ্ছেদে বর্ণিত রয়েছে, ‘প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে।’ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব বর্জনের ডাক রাষ্ট্রের দায়িত্ব অবহেলার দিকেই অঙ্গুুলি নির্দেশ করে। আমরা ভেবেছিলাম অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়কালে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উৎসবাদিতে থাকবে উচ্ছ্বাসতা, আনন্দ ও সাবলীল নিরাপত্তা। এ নিরাপত্তা কোনোক্রমেয় পুলিশ, র‌্যাব কিংবা সেনাবাহিনীর উপস্থিতি নয়। কোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থেকে নয়, একেবারেই গণমানুষের সচেতনায়, একে-অপরের ভালোবাসায়, দায়িত্ববোধ কিংবা পিতৃপুরুষদের ঐতিহ্যের আবহে যুক্ত হয়েই উৎসবমুখর পরিবেশের বিনির্মাণ করা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব পালনকালেও বিগ্রহ ভাঙা ও মন্দির আক্রমণের ঘটনা চলমান রয়েছে, বন্ধ হয়নি। অর্থাৎ আমাদের প্রতিবেশীরা প্রতিবেশীমূলক আচরণ ও দায়িত্ববোধ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। সৃষ্টির সেরা জীব, আশরাফুল মাকলুকাত হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছি। ধর্ম নিয়ে মানুষ নয় কিন্তু মানুষ নিয়েই ধর্মÑ সেই সত্যটি উপলব্ধি করতে পারিনি। সেন্টার ফর অল্টারনেটিভস (সিএ) এবং বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরি (বিপিও)-এর প্রতিবেদনে অনুযায়ী, ‘সহিংসতার ৫৯ ভাগই ঘটে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি ও ধর্মীয় স্থান ধ্বংসের মাধ্যমে। আর ১১ শতাংশ সরাসরি ভূমিকেন্দ্রিক বিরোধকে ঘিরে। সহিংসতার ২৭ শতাংশ ক্ষেত্রে শারীরিক নিগ্রহ বা হত্যার ঘটনা ঘটে। মোট ২ শতাংশ লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, আর ১ শতাংশ নির্বাচনভিত্তিক।’ অতীতে চারণ কবিদের কণ্ঠে শোভা পেয়েছেÑ গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান, মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম, আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম। আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন কল্পকাহিনী না হয়, অতীতে যেমন বিদ্যমান ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে; সেটি আমাদের প্রাণের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন। ৫ আগস্টের পরবর্তীতে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরাও আতঙ্কিত হয়েছেন। চার্চের নিয়মমাফিক আচার-অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে গিয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারীতে দুজন যাজক স্থানীয় উগ্রবাদীদের দ্বারা অপদস্ত ও অসম্মানিত হয়েছেন। একদল উগ্রবাদী ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টিতে তৎপর কিন্তু কিছু লোকজন স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় আইনে সোপর্দ করে। পুলিশের সঙ্গে কথা বলে যেটি উপলব্ধি করেছি, খ্রিস্টান ধর্মযাজকদ্বয় দোষী না হয়েও দোষের স্বীকারোক্তি দিয়েছেন; প্রাণে বেঁচেছেন। পরের দিন আদালতের মাধ্যমে জামিনে বেরিয়ে এসেছেন। এবারই দেখছি, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরবর্তীতে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা ও খ্রিস্টানুসারীদের নির্যাতন-অত্যাচার; পূর্বের সব রেকর্ড ভেঙেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা অস্বীকার করেননি, ধর্মীয় উপাসনালয়ে আক্রমণের বিষয়ে বলেছেন, ‘বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ঘটতে পারে, রাতের আঁধারে কেউ উপাসনালয় অপবিত্র করতে পারে।’ সরকারের পক্ষ থেকে যে কোনো ধর্মের উপাসনালয় হামলার ঘটনা জানলে তড়িৎ অ্যাকশান নিতে একটি সমন্বয় কেন্দ্র সার্বক্ষণিক তৎপর রয়েছে। ইতোমধ্যে ঘোষণা এসেছে, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্থান এবং সুফি মাজারগুলোর বিরুদ্ধে যে কোনো বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এবং এগুলোর ওপর হামলার বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেয়ার। এসব হামলায় জড়িত অসাধু শক্তিগুলোকে আইনের আওতায় আনতে এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কাজ করছে সরকার। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ছাড়াও রয়েছে আদিবাসীদের নিজস্ব ধর্ম ও বিশ^াস। কোনো কোনো জায়গা থেকে জানা যাচ্ছে, স্থানীয়রা তাদের ঐতিহ্যগত বিশ^াস ও ধর্মকে উপেক্ষা করে। বিশেষ করে সিলেট বিভাগের চা বাগান ও তার আশপাশগুলোতে; চলতে পথে চোখে পড়বে গাছের গোড়ায় সিঁন্দুর, ছোট্ট বিগ্রহ কিংবা ছোট্ট করে পূজোর স্থান। প্রত্যেকটি ধর্ম নিজের কাছে নিরাপদ ও শ্রেষ্ঠ। পৃথিবীতে মানুষের যেমন বৈচিত্র্য রয়েছে, ধর্মের ক্ষেত্রেও সীমাহীন বৈচিত্র্য। প্রয়োজন একে-অপরের ধর্মকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করা, ধর্মের মানুষকে শ্রেষ্ঠতর জ্ঞান করা। ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ রাজশাহীতে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ একটি বৈচিত্র্যময় দেশ। এদেশে নানা ধর্মের লোক থাকবে। গীর্জায় ঘণ্টাধ্বনি হবে, মন্দিরে উলুধ্বনি হবে, মসজিদ হতে আজানের ধ্বনি উচ্চারিত হবেÑ আমরা এরূপ সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে চাই। যতদিন দায়িত্বে আছি, ততদিন আমি হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানÑ সকল ধর্মাবলম্বীর পাশে থাকব।’ আমরা বিশ^াস করি, উপদেষ্টা যর্থাথই বলেছেন; ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিতের মাধ্যমেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাকবে।

[লেখক : কলামিস্ট]

back to top