alt

উপ-সম্পাদকীয়

বর্ষা পেরিয়ে যাওয়ার পরও ডেঙ্গু আতঙ্ক

মাহতাব হোসাইন মাজেদ

: মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪

বর্তমানে এক আতঙ্কের নাম ডেঙ্গু। স্ত্রী এডিস মশার কামড়ে এ রোগ হয়। এ বছর বর্ষা পেরিয়ে যাওয়ার পরও ডেঙ্গু হচ্ছে। এডিস মশাবাহী ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ অব্যাহত রয়েছে। গত শনিবার (২ নভেম্বর ২০২৪) ২৪ ঘণ্টায় এই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন আরও ১০ জন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন কমপক্ষে ৩১০ জন। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ৬৩ হাজার ১৬৫ জন।

২০২৩ সালের জুন মাস থেকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। গেল বছর দেশে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন। এর মধ্যে ঢাকায় এক লাখ ১০ হাজার ৮ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন দুই লাখ ১১ হাজার ১৭১ জন। এর আগে ২০১৯ সালে দেশব্যাপী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন। ওই সময় চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীসহ প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। ওই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এছাড়া ২০২২ সালে ডেঙ্গু নিয়ে মোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ওই বছর মশাবাহিত রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে ২৮১ জন মারা যান।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব এখনো পরিলক্ষিত হচ্ছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় জনসম্প্রদায়কে একযোগে কাজ করতে হবে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় উন্নততর গবেষণা, মশা নিয়ন্ত্রণের টেকসই পদ্ধতি এবং রোগ প্রতিরোধে টিকাদান কর্মসূচি আরও বিস্তৃত করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেমন- সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কিছু সফল উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশেও উন্নত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা যেতে পারে।

ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে মশার ঘনত্ব নির্ধারণ, জেনেটিক্যালি মডিফাইড ব্যবহার ইত্যাদি কার্যকর পদ্ধতিগুলো বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। তবে সঠিক রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা নিলেই অধিকাংশ রোগই সেরে যায়। আবার কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে সহজেই এসব রোগ প্রতিরোধ করা যায়। শুধুমাত্র বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের ব্যবস্থা করলে এবং আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখলেই বেশিরভাগ রোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।

ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা খুবই বাঞ্ছনীয় ডেঙ্গুরোগ থেকে মুক্ত থাকার জন্য। বাড়ির আশপাশে জমে থাকা পানি সরিয়ে ফেলতে হবে। ফুলের টব, পানির পাত্র, প্লাস্টিকের বোতল বা যেকোনো জলাধার নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। ব্যাঙ ও কিছু মাছ এবং পাখি সরাসরি মশা খেয়ে মশার বংশ বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সে কারণে ব্যাঙের বংশবৃদ্ধি এবং তারা যাতে নিরাপদে বেঁচে থাকতে পারে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এরা নিয়মিতভাবে মশার ডিম, লার্ভা ইত্যাদি ভক্ষণ করে মশার বৃদ্ধিকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখে। ফলে স্বাভাবিকভাবে মশা মানুষকে কম কামড়াবে।

রাতে মশারির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। দিনে বাইরে যাওয়ার সময় শরীরে মশারোধক লোশন বা স্প্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। পোশাক পরিধানের বেলায় লম্বা হাতাওয়ালা পোশাক ও মোজা পরা উচিত, যাতে মশা কামড়াতে না পারে।

সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত মশা নিধনের কার্যক্রম পরিচালনা এবং জনগণকে ডেঙ্গু প্রতিরোধের পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনসাধারণকে মশার কামড় থেকে সুরক্ষার পাশাপাশি মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংসের বিষয়ে সচেতন করতে হবে। মনে রাখতে হবে- ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য প্রতিটি ব্যক্তিরই ভূমিকা রয়েছে। মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারিভাবে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা কর্মসূচি পরিচালনা করা যেতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন প্রিন্টিং ও ইলেকট্রনিক মাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডেঙ্গু বিষয়ে সর্বসাধারণকে সচেতন করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন এবং এ কার্যক্রম সারা বছরই চলমান রাখা দরকার। গণমাধ্যমেও ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য ব্যাপক ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।

ডেঙ্গুজ্বরের চিকিৎসা প্রধানত উপসর্গনির্ভর। এখনো এর কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই এবং ডেঙ্গুর ভ্যাকসিনও সবার জন্য সহজলভ্য নয়। তাই রোগের উপসর্গ অনুযায়ী সঠিক সময়ে চিকিৎসা নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারিভাবে হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বিশেষ সেবা এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসাসামগ্রী সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। তবে শহরের হাসপাতালগুলোর পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধা তৈরি করা জরুরি।

আর দশটা ভাইরাস জ্বরের মতো ডেঙ্গুজ্বরও নিজে থেকে সাত দিনের মধ্যে সেরে যায়। কিন্তু ডেঙ্গুর সংকটকাল শুরু হয় জ্বর ছাড়ার পর ২৮-৪৮ ঘণ্টা। এ সময় হঠাৎ রক্তচাপ কমে যাওয়া ও অন্যান্য জটিলতা দেখা দিতে পারে। জটিলতাগুলো হলো শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্লিডিং (ডেঙ্গু-হেমোরেজ), প্লাজমা লিকেজ বা রক্তনালি থেকে জলীয় অংশ বের হয়ে রক্তচাপ কমে যাওয়া (ডেঙ্গু শক সিনড্রোম)। এসব ক্ষেত্রে উপযুক্ত চিকিৎসা না দিলে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে।

ডেঙ্গু রোগের বেশ কিছু লক্ষণ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- জ্বর ১০১-১০৪ ডিগ্রি, শরীর ব্যথা, তীব্র মাথা ব্যথা, চোখ ব্যথা, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, ক্ষুধামন্দা, বমি বমি ভাব, বমি করা, গলাব্যথা, কাশি ইত্যাদি। শরীরে র‌্যাশ দেখা দিতে পারে। তীব্র ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ হলো প্রচ- পেটব্যথা, ক্রমাগত বমি, অনিয়ন্ত্রিত পাতলা পায়খানা, রক্তক্ষরণ, দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া, নিস্তেজ হওয়া, বিরক্তি ও অস্থিরতা।

বর্তমানে ঢাকা ও অন্যান্য বড়ো শহরের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের চাপ অত্যন্ত বেশি। ফলে প্রায়ই পর্যাপ্ত চিকিৎসা সামগ্রী ও শয্যার অভাবে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তাই চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি ও ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড স্থাপন করা সময়ের দাবি। প্রয়োজনীয় পরীক্ষার সুবিধা ও প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর অভাবও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বাধা সৃষ্টি করে। স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের ঘন ঘন রক্ত পরীক্ষা করতে হয়। পরীক্ষাগুলো বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিকে বেশি করা হয়। পরীক্ষাগুলোর জন্য অতিমাত্রায় মূল্য ধার্য করায় রোগীদের ওপর ব্যাপক চাপ পড়ে। পরীক্ষাগুলো খুবই সাধারণ পরীক্ষা। ইচ্ছা করলেই খরচ সাধারণ মানুষের জন্য একটু কম রাখা যেতে পারে; কিন্তু ক্লিনিকগুলো তা কখনই করে না। এ সময়ে রোগীদের ওষুধ-পথ্য এবং আনুষঙ্গিক সবকিছুর দামও ব্যবসায়ীরা অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেয়।

জলবায়ু পরিবর্তন ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবকে আরও বৃদ্ধি করছে। বৃষ্টিপাতের সময়সীমা ও তাপমাত্রার পরিবর্তন ডেঙ্গু মশার জীবনচক্র ও প্রজনন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মশার বংশবিস্তারও দ্রুত ঘটে, যা ডেঙ্গুর প্রকোপকে বাড়িয়ে দেয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে ডেঙ্গুজ্বর আরও দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

[লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি]

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বর্ষা পেরিয়ে যাওয়ার পরও ডেঙ্গু আতঙ্ক

মাহতাব হোসাইন মাজেদ

মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪

বর্তমানে এক আতঙ্কের নাম ডেঙ্গু। স্ত্রী এডিস মশার কামড়ে এ রোগ হয়। এ বছর বর্ষা পেরিয়ে যাওয়ার পরও ডেঙ্গু হচ্ছে। এডিস মশাবাহী ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ অব্যাহত রয়েছে। গত শনিবার (২ নভেম্বর ২০২৪) ২৪ ঘণ্টায় এই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন আরও ১০ জন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন কমপক্ষে ৩১০ জন। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ৬৩ হাজার ১৬৫ জন।

২০২৩ সালের জুন মাস থেকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। গেল বছর দেশে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন। এর মধ্যে ঢাকায় এক লাখ ১০ হাজার ৮ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন দুই লাখ ১১ হাজার ১৭১ জন। এর আগে ২০১৯ সালে দেশব্যাপী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন। ওই সময় চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীসহ প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। ওই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এছাড়া ২০২২ সালে ডেঙ্গু নিয়ে মোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ওই বছর মশাবাহিত রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে ২৮১ জন মারা যান।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব এখনো পরিলক্ষিত হচ্ছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় জনসম্প্রদায়কে একযোগে কাজ করতে হবে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় উন্নততর গবেষণা, মশা নিয়ন্ত্রণের টেকসই পদ্ধতি এবং রোগ প্রতিরোধে টিকাদান কর্মসূচি আরও বিস্তৃত করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেমন- সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কিছু সফল উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশেও উন্নত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা যেতে পারে।

ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে মশার ঘনত্ব নির্ধারণ, জেনেটিক্যালি মডিফাইড ব্যবহার ইত্যাদি কার্যকর পদ্ধতিগুলো বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। তবে সঠিক রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা নিলেই অধিকাংশ রোগই সেরে যায়। আবার কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে সহজেই এসব রোগ প্রতিরোধ করা যায়। শুধুমাত্র বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের ব্যবস্থা করলে এবং আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখলেই বেশিরভাগ রোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।

ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা খুবই বাঞ্ছনীয় ডেঙ্গুরোগ থেকে মুক্ত থাকার জন্য। বাড়ির আশপাশে জমে থাকা পানি সরিয়ে ফেলতে হবে। ফুলের টব, পানির পাত্র, প্লাস্টিকের বোতল বা যেকোনো জলাধার নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। ব্যাঙ ও কিছু মাছ এবং পাখি সরাসরি মশা খেয়ে মশার বংশ বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সে কারণে ব্যাঙের বংশবৃদ্ধি এবং তারা যাতে নিরাপদে বেঁচে থাকতে পারে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এরা নিয়মিতভাবে মশার ডিম, লার্ভা ইত্যাদি ভক্ষণ করে মশার বৃদ্ধিকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখে। ফলে স্বাভাবিকভাবে মশা মানুষকে কম কামড়াবে।

রাতে মশারির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। দিনে বাইরে যাওয়ার সময় শরীরে মশারোধক লোশন বা স্প্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। পোশাক পরিধানের বেলায় লম্বা হাতাওয়ালা পোশাক ও মোজা পরা উচিত, যাতে মশা কামড়াতে না পারে।

সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত মশা নিধনের কার্যক্রম পরিচালনা এবং জনগণকে ডেঙ্গু প্রতিরোধের পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনসাধারণকে মশার কামড় থেকে সুরক্ষার পাশাপাশি মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংসের বিষয়ে সচেতন করতে হবে। মনে রাখতে হবে- ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য প্রতিটি ব্যক্তিরই ভূমিকা রয়েছে। মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারিভাবে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা কর্মসূচি পরিচালনা করা যেতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন প্রিন্টিং ও ইলেকট্রনিক মাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডেঙ্গু বিষয়ে সর্বসাধারণকে সচেতন করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন এবং এ কার্যক্রম সারা বছরই চলমান রাখা দরকার। গণমাধ্যমেও ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য ব্যাপক ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।

ডেঙ্গুজ্বরের চিকিৎসা প্রধানত উপসর্গনির্ভর। এখনো এর কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই এবং ডেঙ্গুর ভ্যাকসিনও সবার জন্য সহজলভ্য নয়। তাই রোগের উপসর্গ অনুযায়ী সঠিক সময়ে চিকিৎসা নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারিভাবে হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বিশেষ সেবা এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসাসামগ্রী সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। তবে শহরের হাসপাতালগুলোর পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধা তৈরি করা জরুরি।

আর দশটা ভাইরাস জ্বরের মতো ডেঙ্গুজ্বরও নিজে থেকে সাত দিনের মধ্যে সেরে যায়। কিন্তু ডেঙ্গুর সংকটকাল শুরু হয় জ্বর ছাড়ার পর ২৮-৪৮ ঘণ্টা। এ সময় হঠাৎ রক্তচাপ কমে যাওয়া ও অন্যান্য জটিলতা দেখা দিতে পারে। জটিলতাগুলো হলো শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্লিডিং (ডেঙ্গু-হেমোরেজ), প্লাজমা লিকেজ বা রক্তনালি থেকে জলীয় অংশ বের হয়ে রক্তচাপ কমে যাওয়া (ডেঙ্গু শক সিনড্রোম)। এসব ক্ষেত্রে উপযুক্ত চিকিৎসা না দিলে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে।

ডেঙ্গু রোগের বেশ কিছু লক্ষণ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- জ্বর ১০১-১০৪ ডিগ্রি, শরীর ব্যথা, তীব্র মাথা ব্যথা, চোখ ব্যথা, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, ক্ষুধামন্দা, বমি বমি ভাব, বমি করা, গলাব্যথা, কাশি ইত্যাদি। শরীরে র‌্যাশ দেখা দিতে পারে। তীব্র ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ হলো প্রচ- পেটব্যথা, ক্রমাগত বমি, অনিয়ন্ত্রিত পাতলা পায়খানা, রক্তক্ষরণ, দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া, নিস্তেজ হওয়া, বিরক্তি ও অস্থিরতা।

বর্তমানে ঢাকা ও অন্যান্য বড়ো শহরের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের চাপ অত্যন্ত বেশি। ফলে প্রায়ই পর্যাপ্ত চিকিৎসা সামগ্রী ও শয্যার অভাবে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তাই চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি ও ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড স্থাপন করা সময়ের দাবি। প্রয়োজনীয় পরীক্ষার সুবিধা ও প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর অভাবও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বাধা সৃষ্টি করে। স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের ঘন ঘন রক্ত পরীক্ষা করতে হয়। পরীক্ষাগুলো বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিকে বেশি করা হয়। পরীক্ষাগুলোর জন্য অতিমাত্রায় মূল্য ধার্য করায় রোগীদের ওপর ব্যাপক চাপ পড়ে। পরীক্ষাগুলো খুবই সাধারণ পরীক্ষা। ইচ্ছা করলেই খরচ সাধারণ মানুষের জন্য একটু কম রাখা যেতে পারে; কিন্তু ক্লিনিকগুলো তা কখনই করে না। এ সময়ে রোগীদের ওষুধ-পথ্য এবং আনুষঙ্গিক সবকিছুর দামও ব্যবসায়ীরা অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেয়।

জলবায়ু পরিবর্তন ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবকে আরও বৃদ্ধি করছে। বৃষ্টিপাতের সময়সীমা ও তাপমাত্রার পরিবর্তন ডেঙ্গু মশার জীবনচক্র ও প্রজনন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মশার বংশবিস্তারও দ্রুত ঘটে, যা ডেঙ্গুর প্রকোপকে বাড়িয়ে দেয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে ডেঙ্গুজ্বর আরও দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

[লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি]

back to top