মতিউর রহমান
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে যুব সম্প্রদায়ের শহরমুখী অভিবাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উন্নত জীবনের আশা, কর্মসংস্থান, এবং আধুনিক জীবনযাপনের আকাক্সক্ষা যুবসমাজকে ক্রমশ শহরের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এই অভিবাসন একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে যুবকরা শহরে গিয়ে নিজেদের জন্য একটি নতুন ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে, তাদের অভাব গ্রামীণ সমাজ ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে যুব সম্প্রদায়ের শহরমুখী অভিবাসনের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সুযোগের অভাব, অবকাঠামোগত উন্নয়নের ঘাটতি এবং আধুনিক জীবনের সুযোগ-সুবিধার প্রতি আকর্ষণ অন্যতম। গ্রামের অধিকাংশ যুবক শহরে উচ্চ আয়ের চাকরি, উন্নত শিক্ষা ও চিকিৎসা, এবং আধুনিক জীবনযাপনের পরিবেশে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্য নিয়ে অভিবাসিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর, যা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের প্রধান ক্ষেত্র হলেও আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে এটি পর্যাপ্ত আয় এবং কর্মসংস্থান প্রদান করতে পারছে না। ফলে যুব সমাজ শহরের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে, যেখানে নির্মাণ, উৎপাদন, এবং সেবা খাতে তুলনামূলকভাবে অধিক বেতনের কাজ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এর ফলে গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসনের প্রবণতা ক্রমাগত বাড়ছে।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে যুব সম্প্রদায়ের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তরুণ প্রজন্ম মূলত কৃষি, পশুপালন এবং অন্যান্য ছোট ব্যবসায় জড়িত থেকে গ্রামীণ অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে তোলে। কিন্তু যখন তারা শহরে অভিবাসিত হয়, তখন গ্রামীণ অর্থনীতিতে শ্রমের ঘাটতি সৃষ্টি হয়। এর ফলে কৃষিকাজ এবং অন্যান্য উৎপাদনশীল কার্যক্রম ব্যাহত হয়। প্রায়শই এই অভাবে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায় এবং গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এছাড়া, শহরমুখী অভিবাসনের কারণে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ক্রয় ক্ষমতার হ্রাস ঘটে, যা স্থানীয় বাজারে ক্রেতার সংখ্যা কমিয়ে দেয় এবং ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলোর আয় কমে যায়। এর ফলে স্থানীয় অর্থনীতির প্রবাহ এবং টেকসই অর্থনৈতিক বিকাশের সম্ভাবনা দুর্বল হয়ে পড়ে। যুবসমাজের শহরে যাওয়ার ফলে গ্রামের উপার্জনের একটি বড় অংশ শহরে চলে যায়, যার ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মাত্রাও হ্রাস পায়।
শহরে অভিবাসনের ফলে পরিবারের কাঠামোতেও পরিবর্তন আসে। বাংলাদেশে
পরিবার প্রায়ই যৌথ আকারে গঠিত, যেখানে পরিবার সদস্যরা একত্রে বসবাস করে এবং পারস্পরিক সহযোগিতা ও দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু যখন পরিবারের যুব সদস্যরা শহরে চলে যায়, তখন যৌথ পারিবারিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পরিবারে বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয়।
যেসব পরিবারে পিতা বা পরিবারের প্রধান শহরে গিয়েছেন, সেসব পরিবারের মা ও বাচ্চারা গ্রামে থেকে যায়। এই প্রক্রিয়ায় নারীদের ওপর বাড়তি দায়িত্বের চাপ পড়ে। তারা একা বাড়ির যাবতীয় দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য হয় এবং সন্তানদের দেখাশোনা থেকে শুরু করে পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যন্ত তাদের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ে। এর ফলে মহিলাদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসে এবং তাদের মানসিক চাপও বেড়ে যায়। এছাড়া, বাবার অভাবের কারণে অনেক শিশু তাদের শিক্ষায় মনোযোগ দিতে পারে না এবং পরিবারে পরিপূর্ণ নিরাপত্তার অভাব অনুভব করে। বাবার নির্দেশনা ও সান্নিধ্য ছাড়া বড় হওয়া শিশুদের সামাজিক এবং মানসিক বিকাশও প্রভাবিত হয়। তারা প্রায়শই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং পারিবারিক সম্পর্কের আন্তরিকতা হারিয়ে ফেলে।
শহরমুখী অভিবাসনের প্রভাবে গ্রামীণ সমাজের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যারা শহরে গিয়ে ফিরে আসে, তারা প্রায়শই একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসে, যা স্থানীয় সামাজিক প্রথার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। তারা আধুনিক জীবনধারা, আধুনিক চিন্তাভাবনা এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে তারা স্থানীয় সমাজের রীতিনীতি এবং ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ হারায় এবং সামাজিক সম্পর্কের প্রতি এক ধরনের উদাসীনতা প্রদর্শন করে। এতে গ্রামীণ সমাজে প্রজন্মের মধ্যে মতপার্থক্য এবং সাংস্কৃতিক সংঘাত দেখা দেয়। বয়স্করা প্রচলিত মূল্যবোধকে ধরে রাখতে চায়, কিন্তু নতুন প্রজন্ম শহরের প্রভাবিত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই মূল্যবোধকে পরিবর্তন করতে চায়। এর ফলে সামাজিক সংহতির অবক্ষয় ঘটে এবং সমাজে অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। শহরমুখী অভিবাসনের ফলে নারীরা পরিবারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালনে একধাপ এগিয়ে আসে, যা নারীদের ক্ষমতায়নের পথ উন্মুক্ত করে। যখন একজন পুরুষ শহরে কাজ করতে যান, তখন পরিবারের অন্যান্য আর্থিক চাহিদা পূরণ এবং পরিবারের দেখাশোনা করার দায়িত্ব নারীদের উপর পড়ে। অনেক নারী কৃষিকাজ, ক্ষুদ্র ব্যবসা, এবং অন্যান্য উদ্যোগে নিজেকে সম্পৃক্ত করে এবং পরিবারের আয়ের সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এই পরিবর্তন নারীদের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কিন্তু একই সঙ্গে তাদের ওপর বাড়তি কাজের চাপ এবং শারীরিক ও মানসিক চাপ তৈরি হয়। তারা প্রায়শই একাধারে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, যা তাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
নারীদের অর্থনৈতিক দায়িত্ব বাড়লেও প্রায়ই তারা সমাজে সমান মর্যাদা এবং সুযোগ পায় না, যা তাদের জন্য এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। শহরমুখী অভিবাসনের ফলে গ্রামীণ এলাকায় অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। অনেক যুবক শহরে গিয়ে নতুন জীবনে অভ্যস্ত হতে না পেরে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং অবৈধ কাজে জড়িয়ে পড়ে। এই ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা- প্রায়ই গ্রামে ফেরত আসে, যার ফলে গ্রামীণ এলাকায় অপরাধের প্রবণতা বাড়ে। মাদকাসক্তি, চাঁদাবাজি, এবং স্থানীয় সংঘর্ষের মতো অপরাধমূলক কর্মকা- সমাজে নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দেয় এবং সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি করে।
অনেক সময় অভিভাবকহীনতার কারণে কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতাও বেড়ে যায়। অভিবাসনজনিত কারণে পিতামাতার তত্ত্বাবধান ছাড়া বড় হওয়া শিশুরা প্রায়শই খারাপ প্রভাবের মধ্যে পড়ে এবং অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়তে পারে।
যদিও শহরমুখী অভিবাসনের ফলে গ্রামীণ সমাজে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে, তবু এটি কিছু নতুন সম্ভাবনাও সৃষ্টি করেছে। শহরে কর্মরত যুবকরা তাদের আয়ের একটি অংশ গ্রামে প্রেরণ করে, যা পরিবারের আয় বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে সহায়ক হয়। অনেকেই গ্রামে ফিরে এসে নতুন ব্যবসা শুরু করে বা গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে অবদান রাখে, যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বা রাস্তা নির্মাণে বিনিয়োগ করে।
সরকারের পক্ষ থেকে গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বাড়ানোর মাধ্যমে শহরমুখী অভিবাসনের নেতিবাচক প্রভাব কমানো সম্ভব। কৃষি ও ক্ষুদ্র শিল্পে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং পর্যটন খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান বাড়ানো যেতে পারে। এছাড়া শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নও যুবসমাজকে গ্রামে থেকে উন্নত জীবনের সুযোগ করতে সহায়ক হবে। বাংলাদেশের যুব সম্প্রদায়ের শহরমুখী অভিবাসন একটি দ্বিমুখী প্রভাব বিস্তারকারী প্রক্রিয়া। এর ফলে তারা শহরে কর্মসংস্থান ও উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ লাভ করছে, তবে গ্রামীণ অর্থনীতি এবং পারিবারিক কাঠামো এর নেতিবাচক প্রভাবের মুখোমুখি হচ্ছে। এর ফলে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হচ্ছে। শহরমুখী অভিবাসনের সমস্যা সমাধানে কার্যকর নীতি প্রণয়ন, গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি, এবং পারিবারিক কাঠামোর সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ।
[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী ]
মতিউর রহমান
বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে যুব সম্প্রদায়ের শহরমুখী অভিবাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উন্নত জীবনের আশা, কর্মসংস্থান, এবং আধুনিক জীবনযাপনের আকাক্সক্ষা যুবসমাজকে ক্রমশ শহরের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এই অভিবাসন একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে যুবকরা শহরে গিয়ে নিজেদের জন্য একটি নতুন ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে, তাদের অভাব গ্রামীণ সমাজ ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে যুব সম্প্রদায়ের শহরমুখী অভিবাসনের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সুযোগের অভাব, অবকাঠামোগত উন্নয়নের ঘাটতি এবং আধুনিক জীবনের সুযোগ-সুবিধার প্রতি আকর্ষণ অন্যতম। গ্রামের অধিকাংশ যুবক শহরে উচ্চ আয়ের চাকরি, উন্নত শিক্ষা ও চিকিৎসা, এবং আধুনিক জীবনযাপনের পরিবেশে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্য নিয়ে অভিবাসিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর, যা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের প্রধান ক্ষেত্র হলেও আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে এটি পর্যাপ্ত আয় এবং কর্মসংস্থান প্রদান করতে পারছে না। ফলে যুব সমাজ শহরের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে, যেখানে নির্মাণ, উৎপাদন, এবং সেবা খাতে তুলনামূলকভাবে অধিক বেতনের কাজ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এর ফলে গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসনের প্রবণতা ক্রমাগত বাড়ছে।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে যুব সম্প্রদায়ের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তরুণ প্রজন্ম মূলত কৃষি, পশুপালন এবং অন্যান্য ছোট ব্যবসায় জড়িত থেকে গ্রামীণ অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে তোলে। কিন্তু যখন তারা শহরে অভিবাসিত হয়, তখন গ্রামীণ অর্থনীতিতে শ্রমের ঘাটতি সৃষ্টি হয়। এর ফলে কৃষিকাজ এবং অন্যান্য উৎপাদনশীল কার্যক্রম ব্যাহত হয়। প্রায়শই এই অভাবে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায় এবং গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এছাড়া, শহরমুখী অভিবাসনের কারণে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ক্রয় ক্ষমতার হ্রাস ঘটে, যা স্থানীয় বাজারে ক্রেতার সংখ্যা কমিয়ে দেয় এবং ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলোর আয় কমে যায়। এর ফলে স্থানীয় অর্থনীতির প্রবাহ এবং টেকসই অর্থনৈতিক বিকাশের সম্ভাবনা দুর্বল হয়ে পড়ে। যুবসমাজের শহরে যাওয়ার ফলে গ্রামের উপার্জনের একটি বড় অংশ শহরে চলে যায়, যার ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মাত্রাও হ্রাস পায়।
শহরে অভিবাসনের ফলে পরিবারের কাঠামোতেও পরিবর্তন আসে। বাংলাদেশে
পরিবার প্রায়ই যৌথ আকারে গঠিত, যেখানে পরিবার সদস্যরা একত্রে বসবাস করে এবং পারস্পরিক সহযোগিতা ও দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু যখন পরিবারের যুব সদস্যরা শহরে চলে যায়, তখন যৌথ পারিবারিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পরিবারে বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয়।
যেসব পরিবারে পিতা বা পরিবারের প্রধান শহরে গিয়েছেন, সেসব পরিবারের মা ও বাচ্চারা গ্রামে থেকে যায়। এই প্রক্রিয়ায় নারীদের ওপর বাড়তি দায়িত্বের চাপ পড়ে। তারা একা বাড়ির যাবতীয় দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য হয় এবং সন্তানদের দেখাশোনা থেকে শুরু করে পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যন্ত তাদের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ে। এর ফলে মহিলাদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসে এবং তাদের মানসিক চাপও বেড়ে যায়। এছাড়া, বাবার অভাবের কারণে অনেক শিশু তাদের শিক্ষায় মনোযোগ দিতে পারে না এবং পরিবারে পরিপূর্ণ নিরাপত্তার অভাব অনুভব করে। বাবার নির্দেশনা ও সান্নিধ্য ছাড়া বড় হওয়া শিশুদের সামাজিক এবং মানসিক বিকাশও প্রভাবিত হয়। তারা প্রায়শই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং পারিবারিক সম্পর্কের আন্তরিকতা হারিয়ে ফেলে।
শহরমুখী অভিবাসনের প্রভাবে গ্রামীণ সমাজের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যারা শহরে গিয়ে ফিরে আসে, তারা প্রায়শই একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসে, যা স্থানীয় সামাজিক প্রথার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। তারা আধুনিক জীবনধারা, আধুনিক চিন্তাভাবনা এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে তারা স্থানীয় সমাজের রীতিনীতি এবং ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ হারায় এবং সামাজিক সম্পর্কের প্রতি এক ধরনের উদাসীনতা প্রদর্শন করে। এতে গ্রামীণ সমাজে প্রজন্মের মধ্যে মতপার্থক্য এবং সাংস্কৃতিক সংঘাত দেখা দেয়। বয়স্করা প্রচলিত মূল্যবোধকে ধরে রাখতে চায়, কিন্তু নতুন প্রজন্ম শহরের প্রভাবিত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই মূল্যবোধকে পরিবর্তন করতে চায়। এর ফলে সামাজিক সংহতির অবক্ষয় ঘটে এবং সমাজে অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। শহরমুখী অভিবাসনের ফলে নারীরা পরিবারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালনে একধাপ এগিয়ে আসে, যা নারীদের ক্ষমতায়নের পথ উন্মুক্ত করে। যখন একজন পুরুষ শহরে কাজ করতে যান, তখন পরিবারের অন্যান্য আর্থিক চাহিদা পূরণ এবং পরিবারের দেখাশোনা করার দায়িত্ব নারীদের উপর পড়ে। অনেক নারী কৃষিকাজ, ক্ষুদ্র ব্যবসা, এবং অন্যান্য উদ্যোগে নিজেকে সম্পৃক্ত করে এবং পরিবারের আয়ের সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এই পরিবর্তন নারীদের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কিন্তু একই সঙ্গে তাদের ওপর বাড়তি কাজের চাপ এবং শারীরিক ও মানসিক চাপ তৈরি হয়। তারা প্রায়শই একাধারে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, যা তাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
নারীদের অর্থনৈতিক দায়িত্ব বাড়লেও প্রায়ই তারা সমাজে সমান মর্যাদা এবং সুযোগ পায় না, যা তাদের জন্য এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। শহরমুখী অভিবাসনের ফলে গ্রামীণ এলাকায় অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। অনেক যুবক শহরে গিয়ে নতুন জীবনে অভ্যস্ত হতে না পেরে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং অবৈধ কাজে জড়িয়ে পড়ে। এই ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা- প্রায়ই গ্রামে ফেরত আসে, যার ফলে গ্রামীণ এলাকায় অপরাধের প্রবণতা বাড়ে। মাদকাসক্তি, চাঁদাবাজি, এবং স্থানীয় সংঘর্ষের মতো অপরাধমূলক কর্মকা- সমাজে নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দেয় এবং সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি করে।
অনেক সময় অভিভাবকহীনতার কারণে কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতাও বেড়ে যায়। অভিবাসনজনিত কারণে পিতামাতার তত্ত্বাবধান ছাড়া বড় হওয়া শিশুরা প্রায়শই খারাপ প্রভাবের মধ্যে পড়ে এবং অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়তে পারে।
যদিও শহরমুখী অভিবাসনের ফলে গ্রামীণ সমাজে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে, তবু এটি কিছু নতুন সম্ভাবনাও সৃষ্টি করেছে। শহরে কর্মরত যুবকরা তাদের আয়ের একটি অংশ গ্রামে প্রেরণ করে, যা পরিবারের আয় বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে সহায়ক হয়। অনেকেই গ্রামে ফিরে এসে নতুন ব্যবসা শুরু করে বা গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে অবদান রাখে, যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বা রাস্তা নির্মাণে বিনিয়োগ করে।
সরকারের পক্ষ থেকে গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বাড়ানোর মাধ্যমে শহরমুখী অভিবাসনের নেতিবাচক প্রভাব কমানো সম্ভব। কৃষি ও ক্ষুদ্র শিল্পে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং পর্যটন খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান বাড়ানো যেতে পারে। এছাড়া শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নও যুবসমাজকে গ্রামে থেকে উন্নত জীবনের সুযোগ করতে সহায়ক হবে। বাংলাদেশের যুব সম্প্রদায়ের শহরমুখী অভিবাসন একটি দ্বিমুখী প্রভাব বিস্তারকারী প্রক্রিয়া। এর ফলে তারা শহরে কর্মসংস্থান ও উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ লাভ করছে, তবে গ্রামীণ অর্থনীতি এবং পারিবারিক কাঠামো এর নেতিবাচক প্রভাবের মুখোমুখি হচ্ছে। এর ফলে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হচ্ছে। শহরমুখী অভিবাসনের সমস্যা সমাধানে কার্যকর নীতি প্রণয়ন, গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি, এবং পারিবারিক কাঠামোর সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ।
[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী ]