কামরুজ্জামান
দেশে একসময় প্রচুর পরিমাণে হাওর-বাঁওড়, পুকুর-ডোবা ও প্রাকৃতিক জলাশয় ছিল। এসব প্রাকৃতিক জলাশয়ে প্রচুর দেশীয় মাছও পাওয়া যেত। এখন দেশীয় জাতের মাছ অনেক কমে এসেছে। প্রাকৃতিক জলাশয়ও কমছে। নদী, খাল, বিল, ডোবা, হাওর, পুকুর ইত্যাদি জলাভূমি দখল ও দূষণের কবলে পড়ছে এবং অনেকাংশে দখল ও দূষণ হয়েও গেছে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো বেশির ভাগই নদী-খালবেষ্টিত।
আমাদের দেশের মাছের উৎসকে দুটো ভাগে ভাগ করা হয়। এক, অভ্যন্তরীণ মৎস্যক্ষেত্র। দুই, সামুদ্রিক মৎস্যক্ষেত্র। অভ্যন্তরীণ মৎস্যক্ষেত্রের উৎস হচ্ছেÑ পুকুর, ডোবা, নদী, খাল, হাওর, বাঁওড়সহ অসংখ্য বিল-ঝিল।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক জলাভূমির দেশ। কবি সাহিত্যিকদের ভাষায় এদেশ তেরশ নদীর দেশ। বইপুস্তকের ভাষায় এদেশে রয়েছে প্রায় সাতশটি নদী। আর বাস্তবচিত্র হচ্ছেÑ এদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ২৩০টি নদনদী প্রবাহিত রয়েছে। উপনদী, শাখানদীসহ বাংলাদেশের নদনদীর মোট দৈর্ঘ্য হলো প্রায় ২২,১৫৫ কিলোমিটার। নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় একসময় এদেশে প্রচুর পরিমাণে দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। এজন্য একটা সময় পর্যন্ত আমাদের বলাই হতো মাছে-ভাতে বাঙালি।
বাংলাদেশের প্রদান নদী, শাখা নদী ও উপনদীগুলো অভ্যন্তরীণ মাছের প্রধান উৎস। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলী, সুরমা, কুশিয়ারা, ধলেশ্বরী, সাঙ্গু, মাতামুহুরি, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যাসহ অসংখ্য নদনদী বাংলাদেশের দেশীয় জাতের বড় ও ছোট মাছের উৎসক্ষেত্র। নদীর পরেই মাছের প্রাকৃতিক আধার হচ্ছে বিল।
প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোর অন্যতম হচ্ছে বিল। বাংলাদেশের ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ১০০০ বিল রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান বিলগুলো হলোÑ
চলন বিল : পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী অঞ্চলজুড়ে অবস্থিত। যার আয়তন ২০৭২ বর্গ কিমি.।
লালা শাপলার বিল (গোপালগঞ্জ-খুলনা বিল) :
গোপালগঞ্জ ও খুলনা অঞ্চলে অবস্থিত। আয়তন ১১৬০ বর্গ কিমি.।
আড়িয়াল বিল : মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলায় অবস্থিত। আয়তন ১৩৬ বর্গ কিমি.।
ডাকাতিয়া বিল : খুলনা জেলার পূর্বাঞ্চলে ফুলতলা উপজেলায় অবস্থিত। আয়তন ১২১.৪ বর্গ কিমি.।
গাজনার বিল : পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলায় অবস্থিত। আয়তন ৩১ বর্গ কিমি.।
বাইক্কা বিল : মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলায় অবস্থিত, আয়তন ১ বর্গ কিমি.। এছাড়া সিংগুয়া বিল (সিলেট), চাতলা বিল (সিলেট), বড় বিল (পীরগঞ্জ), তাগরাই বিল (কুড়িগ্রাম), লুনিপুকুর (রংপুর), বড় মির্জাপুর (নড়াইল) ও কেশপাথার বিলসহ (বগুড়া) সব বিলই অভ্যন্তরীণ দেশীয় মাছের গুরুত্বপূর্ণ উৎসস্থল। এছাড়া আমাদের দেশে হাওরেও প্রচুর পরিমাণে দেশীয় মাছ পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুসারে দেশে মোট ৪১৪টি হাওর রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলোÑ
নিকলী হাওর : ২২,০৫৬ একর জায়গা নিয়ে অবস্থান। কিশোরগঞ্জের নিকলী, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও ইটনা, সোয়াইজনী, ঘোরাউত্রা নরসুন্দা, ধনু ও রোদা নদী এলাকায় অবস্থিত।
ইটনার হাওর : কিশোরগঞ্জের ইটনায় অবস্থিত। ধনু নদী, সানিয়া বিল, বাঁকা বিল, ফিরাই গাং এর অন্তর্গত।
টাঙ্গুয়ার হাওর : ১২,৬৫৫ হেক্টর জায়গাজুড়ে অবস্থিত। সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা ও তাহিরপুর এলাকা এর অন্তর্ভুক্ত। এর পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সুরমা নদী।
হাকালুকি হাওর : ১৮,১১৫ হেক্টর জায়গাজুড়ে অবস্থিত। মৌলভীবাজারের বড়লেখা, জুড়ী ও কুলাউড়া, সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার এলাকা এর অন্তর্ভুক্ত। এ হাওরের পাশ দিয়েও বয়ে চলেছে সুরমা নদী। এসব হাওর দেশীয় মাছের প্রজনন ও প্রধান উৎসক্ষেত্র।
দেশীয় জাতের মাছের আবার বহুবিধ প্রকার রয়েছে। এগুলো ছোট এবং বড় আকৃতির হয়ে থাকে। দেশীয় জাতের ছোট মাছগুলো হলোÑ চ্যাপিলা, বইচা, চাুঁয়া, নাপতানি, চাঁদা, নামা চাঁদা, গোল চাঁদা, আইড়, গুলশা, পাবদা, দেশি পুঁটি, সরপুঁটি, তিত পুঁটি, বাইলা, মেনি, ভেদা, শিং, মাগুর, গুতুম, বাইন, কই, টাকি, তেলা টাকি, ফলি, চেলি, মলা, ঢেলা, কানপোনা, দারকিনাসহ নাম না জানা অসংখ্য প্রজাতির দেশীয় মাছ। এর মধ্যে কিছু আবার বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অনেকগুলো বিলুপ্তির পথে। তবে এখন এসব দেশীয় জাতের ছোট মাছ প্রাকৃতিক জলাশয়ে খুবই কম পাওয়া যায়। এগুলোর কয়েক প্রজাতি এখন কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে খামারে উৎপাদন করা হচ্ছে।
দেশীয় জাতের বড় মাছগুলো হলোÑ কাতল, বোয়াল, রুই, ইলিশ, আইড়, গজার, শোল, কালবাউশ, চিতল, ঘাসকাপ, সিলভারকাপ, মৃগেল ইত্যাদি বড় আকৃতির মাছগুলো এখনও দেশের অভ্যন্তরের নদী-খাল-বিল ও প্রাকৃতিক জলাশয়ে পাওয়া যায়। তবে পরিমাণে কম। বড় আকৃতির মাছগুলো কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে খামারে বেশি উৎপাদন হচ্ছে।
এখন কথা হলো দেশীয় জাতের ছোট ও বড় আকৃতির মাছগুলো প্রাকৃতিক জলাশয়ে দিন দিন কমে আসছে কেন, এর কারণ খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
অভ্যন্তরীণ মাছ কমে আসার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয় দূষণ ও দখল। আমাদের দেশের অনেক নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয় শিল্পের তরল বর্জ্য ও নানারকম কঠিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যরে মাধ্যমে আজ দূষণের কবলে পড়েছে। এর ফলে মাছের নিরাপদ আবাস ও প্রজননক্ষেত্র দুটোই নষ্ট হচ্ছে। ফলে মাছ উৎপাদন ও বেড়ে ওঠা দুটোই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া অনেক খাল ও নদী দখল হয়ে গেছে। আরও দখলের কবলে রয়েছে। এসব দখলকৃত নদী, খালে গড়ে উঠেছে নানা রকম স্থাপনা। মাছ কমে আসার এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
কৃষিজমিতে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহার। একটা সময় আমাদের দেশে কৃষি ফসল উৎপাদন হতো প্রাকৃতিক উপায়ে। ছোট আয়তনের এই দেশে জনসংখ্যা অধিক হওয়ায় খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে কৃষিজমিতে প্রচুর সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। কেমিক্যাল মিশ্রিত এই সার ও কীটনাশক শেষ পর্যন্ত গিয়ে মিশে নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয়ের পানিতে। ফলে প্রত্যক্ষভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশীয় মাছের প্রজনন ও নিরাপদ বিচরণে।
বৃষ্টিপাত কম হওয়া ও সময়মতো বৃষ্টিপাত না হওয়ার ফলে মাছের বংশবৃদ্ধি ও বেড়ে ওঠা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের দেশে দেশীয় ছোট মাছের ডিম থেকে বাচ্চা হওয়ার সময় হচ্ছে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস। এই সময় পরিমাণ মতো ও সময়মতো বৃষ্টিপাত হলে মাছের প্রজনন ভালো হয়। বর্ষার বৃষ্টির পানিতে নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয় পানিতে পরিপূর্ণ হলে মাছেরা প্রচুর খাবার খেতে পারে এবং দ্রুত বেড়ে উঠতে পারে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন বৃষ্টিপাত যেমন সময়মতো হয় না তেমনি পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতও হয় না। আর এ কারণে মাছের স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে।
নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে মাছ উৎপাদন দিন দিন কমে আসছে।
মাছ ধরার আধুনিক ও কারেন্ট জাল দেশীয় জাতের ছোট মাছের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর একটি মাধ্যম। কারেন্ট জাল দিয়ে খুব ছোট ছোট মাছও ধরে ফেলা হয় যা খুবই দুঃখজনক। ছোট মাছগুলো একটু বড় হয়েই আবার প্রজননে অংশগ্রহণ করে। এরা যদি বড়ই হতে না পারে নতুন প্রজনন হবে কীভাবে। দেশীয় বড় মাছের জন্য প্রয়োজন নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয়ে পানির গভীরতা। এখন সর্বত্রই পানির গভীরতা কমছে। এর ফলে বড় মাছগুলো টিকে থাকতে পারছে না এবং প্রজননও কমছে।
দেশীয় মাছ কমে আসার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছেÑ মাছের প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা এবং জেলেদের বিকল্প কর্মের ব্যবস্থা গ্রহণ না। আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়গুলোতে সারা বছরই মাছ ধরা হয়। এর ফলে ডিম দেয়া মাছগুলো ধরে ফেলা হয়। আর এ কারণে আস্তে আস্তে দেশি মাছের উৎপাদন কমে আসছে। আরও নানাবিধ কারণ রয়েছে যেগুলো দেশীয় মাছের প্রজনন ও বেড়ে ওঠার জন্য ক্ষতিকর।
অভ্যন্তরীণ দেশীয় মাছের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রাকৃতিক জলাশয়ের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
আমাদের বাংলাদেশে আহরিত মাছের দুই তৃতীয়াংশ আসে প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে। তাছাড়া পানির রাসায়নিক উপাদান নিয়ন্ত্রণ ও অতিরিক্ত পুষ্টি উপাদান শোষণ করে পানির গুণাগুণ বৃদ্ধিতে সহায়তার মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ দূষিত পানি বিশুদ্ধকরণেও জলাভূমি ভূমিকা রাখে। এছাড়া বিপন্ন ও বিলুপ্তপ্রায় মৎস্য প্রজাতি সংরক্ষণেও সংরক্ষিত জলাভূমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্ষার সময় অতিরিক্ত পানি ধারণ করে বন্যা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে জলাভূমি। সাধারণত জলাভূমির পানির মধ্যে জলজ বাস্তুসংস্থানের প্রাথমিক খাদ্য উৎপাদক তৈরি হয়ে থাকে, যা ধারাবাহিক গতিতে জন্ম দেয় খাদ্যের অন্যান্য শৃঙ্খল। খাদ্য উৎপাদনশীলতার হিসাবে পৃথিবীর মোট উৎপাদনের ২৪% নিয়ন্ত্রণ করে থাকে জলাভূমি, যা মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর প্রয়োজনীয় খাদ্যের প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করে।
প্রাকৃতিক জলাভূমি সুরক্ষার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর ও প্রশাসনকেই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয় দখল ও দূষণমুক্ত করতে হবে। নদীর নাব্য বজায় রাখার জন্য সীমানা নির্ধারণ করে খননকাজ করতে হবে। দেশীয় মাছের প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হবে। এই সময়ে জেলেদের বিকল্প কাজের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। কারেন্ট জাল ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আবাসিক ও কলকারখানা থেকে নির্গত তরল বর্জ্য প্রাকৃতিক জলাশয়, নদী, খালে ফেলা বন্ধ করতে হবে। প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বেশি করে গাছ লাগাতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছেÑ জলাভূমির সুরক্ষায় জনমনে সচেতনতা বাড়াতে হবে। তবেই রক্ষা পাবে আমাদের দেশীয় জাতের সব ধরনের মাছ।
[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, গাজীপুর]
কামরুজ্জামান
শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪
দেশে একসময় প্রচুর পরিমাণে হাওর-বাঁওড়, পুকুর-ডোবা ও প্রাকৃতিক জলাশয় ছিল। এসব প্রাকৃতিক জলাশয়ে প্রচুর দেশীয় মাছও পাওয়া যেত। এখন দেশীয় জাতের মাছ অনেক কমে এসেছে। প্রাকৃতিক জলাশয়ও কমছে। নদী, খাল, বিল, ডোবা, হাওর, পুকুর ইত্যাদি জলাভূমি দখল ও দূষণের কবলে পড়ছে এবং অনেকাংশে দখল ও দূষণ হয়েও গেছে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো বেশির ভাগই নদী-খালবেষ্টিত।
আমাদের দেশের মাছের উৎসকে দুটো ভাগে ভাগ করা হয়। এক, অভ্যন্তরীণ মৎস্যক্ষেত্র। দুই, সামুদ্রিক মৎস্যক্ষেত্র। অভ্যন্তরীণ মৎস্যক্ষেত্রের উৎস হচ্ছেÑ পুকুর, ডোবা, নদী, খাল, হাওর, বাঁওড়সহ অসংখ্য বিল-ঝিল।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক জলাভূমির দেশ। কবি সাহিত্যিকদের ভাষায় এদেশ তেরশ নদীর দেশ। বইপুস্তকের ভাষায় এদেশে রয়েছে প্রায় সাতশটি নদী। আর বাস্তবচিত্র হচ্ছেÑ এদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ২৩০টি নদনদী প্রবাহিত রয়েছে। উপনদী, শাখানদীসহ বাংলাদেশের নদনদীর মোট দৈর্ঘ্য হলো প্রায় ২২,১৫৫ কিলোমিটার। নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় একসময় এদেশে প্রচুর পরিমাণে দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। এজন্য একটা সময় পর্যন্ত আমাদের বলাই হতো মাছে-ভাতে বাঙালি।
বাংলাদেশের প্রদান নদী, শাখা নদী ও উপনদীগুলো অভ্যন্তরীণ মাছের প্রধান উৎস। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলী, সুরমা, কুশিয়ারা, ধলেশ্বরী, সাঙ্গু, মাতামুহুরি, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যাসহ অসংখ্য নদনদী বাংলাদেশের দেশীয় জাতের বড় ও ছোট মাছের উৎসক্ষেত্র। নদীর পরেই মাছের প্রাকৃতিক আধার হচ্ছে বিল।
প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোর অন্যতম হচ্ছে বিল। বাংলাদেশের ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ১০০০ বিল রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান বিলগুলো হলোÑ
চলন বিল : পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী অঞ্চলজুড়ে অবস্থিত। যার আয়তন ২০৭২ বর্গ কিমি.।
লালা শাপলার বিল (গোপালগঞ্জ-খুলনা বিল) :
গোপালগঞ্জ ও খুলনা অঞ্চলে অবস্থিত। আয়তন ১১৬০ বর্গ কিমি.।
আড়িয়াল বিল : মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলায় অবস্থিত। আয়তন ১৩৬ বর্গ কিমি.।
ডাকাতিয়া বিল : খুলনা জেলার পূর্বাঞ্চলে ফুলতলা উপজেলায় অবস্থিত। আয়তন ১২১.৪ বর্গ কিমি.।
গাজনার বিল : পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলায় অবস্থিত। আয়তন ৩১ বর্গ কিমি.।
বাইক্কা বিল : মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলায় অবস্থিত, আয়তন ১ বর্গ কিমি.। এছাড়া সিংগুয়া বিল (সিলেট), চাতলা বিল (সিলেট), বড় বিল (পীরগঞ্জ), তাগরাই বিল (কুড়িগ্রাম), লুনিপুকুর (রংপুর), বড় মির্জাপুর (নড়াইল) ও কেশপাথার বিলসহ (বগুড়া) সব বিলই অভ্যন্তরীণ দেশীয় মাছের গুরুত্বপূর্ণ উৎসস্থল। এছাড়া আমাদের দেশে হাওরেও প্রচুর পরিমাণে দেশীয় মাছ পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুসারে দেশে মোট ৪১৪টি হাওর রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলোÑ
নিকলী হাওর : ২২,০৫৬ একর জায়গা নিয়ে অবস্থান। কিশোরগঞ্জের নিকলী, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও ইটনা, সোয়াইজনী, ঘোরাউত্রা নরসুন্দা, ধনু ও রোদা নদী এলাকায় অবস্থিত।
ইটনার হাওর : কিশোরগঞ্জের ইটনায় অবস্থিত। ধনু নদী, সানিয়া বিল, বাঁকা বিল, ফিরাই গাং এর অন্তর্গত।
টাঙ্গুয়ার হাওর : ১২,৬৫৫ হেক্টর জায়গাজুড়ে অবস্থিত। সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা ও তাহিরপুর এলাকা এর অন্তর্ভুক্ত। এর পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সুরমা নদী।
হাকালুকি হাওর : ১৮,১১৫ হেক্টর জায়গাজুড়ে অবস্থিত। মৌলভীবাজারের বড়লেখা, জুড়ী ও কুলাউড়া, সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার এলাকা এর অন্তর্ভুক্ত। এ হাওরের পাশ দিয়েও বয়ে চলেছে সুরমা নদী। এসব হাওর দেশীয় মাছের প্রজনন ও প্রধান উৎসক্ষেত্র।
দেশীয় জাতের মাছের আবার বহুবিধ প্রকার রয়েছে। এগুলো ছোট এবং বড় আকৃতির হয়ে থাকে। দেশীয় জাতের ছোট মাছগুলো হলোÑ চ্যাপিলা, বইচা, চাুঁয়া, নাপতানি, চাঁদা, নামা চাঁদা, গোল চাঁদা, আইড়, গুলশা, পাবদা, দেশি পুঁটি, সরপুঁটি, তিত পুঁটি, বাইলা, মেনি, ভেদা, শিং, মাগুর, গুতুম, বাইন, কই, টাকি, তেলা টাকি, ফলি, চেলি, মলা, ঢেলা, কানপোনা, দারকিনাসহ নাম না জানা অসংখ্য প্রজাতির দেশীয় মাছ। এর মধ্যে কিছু আবার বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অনেকগুলো বিলুপ্তির পথে। তবে এখন এসব দেশীয় জাতের ছোট মাছ প্রাকৃতিক জলাশয়ে খুবই কম পাওয়া যায়। এগুলোর কয়েক প্রজাতি এখন কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে খামারে উৎপাদন করা হচ্ছে।
দেশীয় জাতের বড় মাছগুলো হলোÑ কাতল, বোয়াল, রুই, ইলিশ, আইড়, গজার, শোল, কালবাউশ, চিতল, ঘাসকাপ, সিলভারকাপ, মৃগেল ইত্যাদি বড় আকৃতির মাছগুলো এখনও দেশের অভ্যন্তরের নদী-খাল-বিল ও প্রাকৃতিক জলাশয়ে পাওয়া যায়। তবে পরিমাণে কম। বড় আকৃতির মাছগুলো কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে খামারে বেশি উৎপাদন হচ্ছে।
এখন কথা হলো দেশীয় জাতের ছোট ও বড় আকৃতির মাছগুলো প্রাকৃতিক জলাশয়ে দিন দিন কমে আসছে কেন, এর কারণ খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
অভ্যন্তরীণ মাছ কমে আসার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয় দূষণ ও দখল। আমাদের দেশের অনেক নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয় শিল্পের তরল বর্জ্য ও নানারকম কঠিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যরে মাধ্যমে আজ দূষণের কবলে পড়েছে। এর ফলে মাছের নিরাপদ আবাস ও প্রজননক্ষেত্র দুটোই নষ্ট হচ্ছে। ফলে মাছ উৎপাদন ও বেড়ে ওঠা দুটোই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া অনেক খাল ও নদী দখল হয়ে গেছে। আরও দখলের কবলে রয়েছে। এসব দখলকৃত নদী, খালে গড়ে উঠেছে নানা রকম স্থাপনা। মাছ কমে আসার এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
কৃষিজমিতে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহার। একটা সময় আমাদের দেশে কৃষি ফসল উৎপাদন হতো প্রাকৃতিক উপায়ে। ছোট আয়তনের এই দেশে জনসংখ্যা অধিক হওয়ায় খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে কৃষিজমিতে প্রচুর সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। কেমিক্যাল মিশ্রিত এই সার ও কীটনাশক শেষ পর্যন্ত গিয়ে মিশে নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয়ের পানিতে। ফলে প্রত্যক্ষভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশীয় মাছের প্রজনন ও নিরাপদ বিচরণে।
বৃষ্টিপাত কম হওয়া ও সময়মতো বৃষ্টিপাত না হওয়ার ফলে মাছের বংশবৃদ্ধি ও বেড়ে ওঠা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের দেশে দেশীয় ছোট মাছের ডিম থেকে বাচ্চা হওয়ার সময় হচ্ছে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস। এই সময় পরিমাণ মতো ও সময়মতো বৃষ্টিপাত হলে মাছের প্রজনন ভালো হয়। বর্ষার বৃষ্টির পানিতে নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয় পানিতে পরিপূর্ণ হলে মাছেরা প্রচুর খাবার খেতে পারে এবং দ্রুত বেড়ে উঠতে পারে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন বৃষ্টিপাত যেমন সময়মতো হয় না তেমনি পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতও হয় না। আর এ কারণে মাছের স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে।
নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে মাছ উৎপাদন দিন দিন কমে আসছে।
মাছ ধরার আধুনিক ও কারেন্ট জাল দেশীয় জাতের ছোট মাছের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর একটি মাধ্যম। কারেন্ট জাল দিয়ে খুব ছোট ছোট মাছও ধরে ফেলা হয় যা খুবই দুঃখজনক। ছোট মাছগুলো একটু বড় হয়েই আবার প্রজননে অংশগ্রহণ করে। এরা যদি বড়ই হতে না পারে নতুন প্রজনন হবে কীভাবে। দেশীয় বড় মাছের জন্য প্রয়োজন নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয়ে পানির গভীরতা। এখন সর্বত্রই পানির গভীরতা কমছে। এর ফলে বড় মাছগুলো টিকে থাকতে পারছে না এবং প্রজননও কমছে।
দেশীয় মাছ কমে আসার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছেÑ মাছের প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা এবং জেলেদের বিকল্প কর্মের ব্যবস্থা গ্রহণ না। আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়গুলোতে সারা বছরই মাছ ধরা হয়। এর ফলে ডিম দেয়া মাছগুলো ধরে ফেলা হয়। আর এ কারণে আস্তে আস্তে দেশি মাছের উৎপাদন কমে আসছে। আরও নানাবিধ কারণ রয়েছে যেগুলো দেশীয় মাছের প্রজনন ও বেড়ে ওঠার জন্য ক্ষতিকর।
অভ্যন্তরীণ দেশীয় মাছের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রাকৃতিক জলাশয়ের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
আমাদের বাংলাদেশে আহরিত মাছের দুই তৃতীয়াংশ আসে প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে। তাছাড়া পানির রাসায়নিক উপাদান নিয়ন্ত্রণ ও অতিরিক্ত পুষ্টি উপাদান শোষণ করে পানির গুণাগুণ বৃদ্ধিতে সহায়তার মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ দূষিত পানি বিশুদ্ধকরণেও জলাভূমি ভূমিকা রাখে। এছাড়া বিপন্ন ও বিলুপ্তপ্রায় মৎস্য প্রজাতি সংরক্ষণেও সংরক্ষিত জলাভূমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্ষার সময় অতিরিক্ত পানি ধারণ করে বন্যা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে জলাভূমি। সাধারণত জলাভূমির পানির মধ্যে জলজ বাস্তুসংস্থানের প্রাথমিক খাদ্য উৎপাদক তৈরি হয়ে থাকে, যা ধারাবাহিক গতিতে জন্ম দেয় খাদ্যের অন্যান্য শৃঙ্খল। খাদ্য উৎপাদনশীলতার হিসাবে পৃথিবীর মোট উৎপাদনের ২৪% নিয়ন্ত্রণ করে থাকে জলাভূমি, যা মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর প্রয়োজনীয় খাদ্যের প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করে।
প্রাকৃতিক জলাভূমি সুরক্ষার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর ও প্রশাসনকেই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয় দখল ও দূষণমুক্ত করতে হবে। নদীর নাব্য বজায় রাখার জন্য সীমানা নির্ধারণ করে খননকাজ করতে হবে। দেশীয় মাছের প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হবে। এই সময়ে জেলেদের বিকল্প কাজের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। কারেন্ট জাল ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আবাসিক ও কলকারখানা থেকে নির্গত তরল বর্জ্য প্রাকৃতিক জলাশয়, নদী, খালে ফেলা বন্ধ করতে হবে। প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বেশি করে গাছ লাগাতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছেÑ জলাভূমির সুরক্ষায় জনমনে সচেতনতা বাড়াতে হবে। তবেই রক্ষা পাবে আমাদের দেশীয় জাতের সব ধরনের মাছ।
[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, গাজীপুর]