এম এ হোসাইন
মায়ানমারের সামরিক জান্তা দেশের নৃগোষ্ঠী মিলিশিয়াগুলোর বিরুদ্ধে একটি অন্তহীন গৃহযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের অধিকাংশ এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর পরেও সামরিক শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা ধরে রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মায়ানমার বর্তমানে সামাজিক, রাজনৈতিক, জাতিগত এবং অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে ডুবে রয়েছে। ফেব্রুয়ারি ২০২১ সালে মায়ানমারের সামরিক বাহিনী বেসামরিক নেতা অং সান সুচির নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে হাজার হাজার মানুষ সহিংস সংঘর্ষে নিহত হয়েছে এবং তিরিশ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তাদের মধ্যে রোহিঙ্গারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত নৃগোষ্ঠী।
ফেব্রুয়ারি ২০২১ সালে, সামরিক বাহিনী অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত এনএলডি সরকারকে উৎখাতের মাধ্যমে মায়ানমারের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এক নাটকীয় মোড় নেয়। এই অভ্যুত্থানটি দেশের দীর্ঘদিনের জাতিগত সংঘাতকে আরও উসকে দেয় এবং দেশকে আরও বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেয়। অভ্যুত্থানের পর থেকে মায়ানমারে ব্যাপক সহিংসতা শুরু হয়, যেখানে সামরিক বাহিনী বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং বিরোধী মিলিশিয়াদের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছে।
এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ (৩বিএ), যার মধ্যে রয়েছে আরাকান আর্মি, মায়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) এবং তা‘আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ)। এই জোটটি বিশেষ করে মায়ানমারের উত্তর ও সীমান্ত অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য আঞ্চলিক সাফল্য অর্জন করেছে। বহিঃশক্তির, বিশেষত চীনের সম্পৃক্ততা, এই সংঘাতকে আরও জটিল করেছে, কারণ আঞ্চলিক শক্তিগুলো চলমান সংঘাতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
কৌশলগত কারণে দীর্ঘদিন ধরে মায়ানমারের সামরিক শাসকদের সমর্থন দিয়ে আসা চীন গোপনে জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকেও সহায়তা করছে। বলা হয়, চীন যুদ্ধবিরতি সৃষ্টিতে মধ্যস্থতা করেছে এবং সংঘাতের গতিবিধিতে প্রভাব রাখছে। এই ভূ-রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাগুলো মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের সঙ্গে জড়িত বৃহত্তর আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্বার্থকে উন্মোচন করে।
মায়ানমারের জাতিগত সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুর্দশা, যারা প্রধানত রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী একটি মুসলিম নৃগোষ্ঠী। কয়েক দশক ধরে রোহিঙ্গারা নিয়মিত বৈষম্য, প্রান্তিককরণ এবং সহিংসতার শিকার হয়েছে। ২০১৭ সালে একটি নৃশংস সামরিক অভিযানে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়, যা বিশ্বব্যাপী নিন্দা ও গণহত্যার অভিযোগের জন্ম দেয়।
জাতিসংঘ ২০১৭ সালের এই অভিযানের ঘটনাকে ‘জাতিগত নির্মূলের পাঠ্যপুস্তক উদাহরণ’ হিসেবে বর্ণনা করেছে, যেখানে সম্পূর্ণ গ্রাম ধ্বংস করা হয়েছে এবং অসংখ্য রোহিঙ্গা নিহত বা বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বর্তমানে রোহিঙ্গারা শোচনীয় অবস্থায় শরণার্থীশিবিরে বসবাস করছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের কক্সবাজারে, যা বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী আবাসন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতার জন্য মায়ানমারকে জবাবদিহি করার প্রচেষ্টা সীমিত সাফল্য পেয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আইনি পদক্ষেপটি গ্রহণ করে গাম্বিয়া, যা ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পক্ষে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মায়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ দায়ের করে। তবে এ প্রক্রিয়ার অগ্রগতি অত্যন্ত ধীর এবং রোহিঙ্গা সংকটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়াও যথেষ্ট অপর্যাপ্ত।
চলমান সহিংসতার মধ্যে রোহিঙ্গা সংহতি সংস্থা (আরএসও), একটি রোহিঙ্গা অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে সংগ্রামী গোষ্ঠী, যা এই অঞ্চলে ক্রমান্বয়ে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। তবে মায়ানমারের সামরিক জান্তা সরাসরি আরএসওর ওপর আক্রমণ করছে না বরং তাদের মূল লক্ষ্যবস্তু রাখাইন জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে লড়াইয়ে বেশি মনোযোগী। এই জাতিগত উত্তেজনাকে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করা সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা রক্ষার নীতির একটি অংশ হিসেবে দেখা যায়।
মায়ানমারের ক্রমবর্ধমান সংকটের প্রতিক্রিয়ায় দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় জাতিসমূহের সংস্থা (আসিয়ান) ২০২১ সালের এপ্রিলে একটি ‘পাঁচ দফা ঐকমত্য’ প্রস্তাব দেয়। এই পরিকল্পনায় সহিংসতা বন্ধ করা, রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করা এবং মানবিক সহায়তা প্রদানের ওপর জোর দেয়া হয়েছিল, যার মাধ্যমে মায়ানমারের সংঘাতের সমাধান চাওয়া হয়েছিল। তবে মায়ানমারের সামরিক জান্তা আসিয়ানের প্রস্তাবের প্রতি নিষ্ঠার সহিত সাড়া না দেয়ায় এই উদ্যোগটি কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ছে এবং আঞ্চলিক সংস্থার প্রভাব সীমিত হয়েছে।
একইভাবে রোহিঙ্গা সংকট এবং মায়ানমারের সামগ্রিক সংঘাত সমাধানে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাগুলো যথেষ্ট নয়। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে, তবে তাদের পদক্ষেপের কার্যকারিতা মোটেও তাৎপর্যপূর্ণ নয়। বাস্তবে দ্রুত পরিবর্তিত পরিস্থিতি, বিশেষ করে চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে, আরও শক্তিশালী ও দীর্ঘমেয়াদি আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন।
বাংলাদেশ, যা বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের বিশাল সংখ্যাকে আশ্রয় দিয়ে, এই সংকটের সমাধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ঢাকায় বর্তমান সরকারকে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদাগুলোকে সামাল দেয়ার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তনের জন্য আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে আরও কার্যকরী সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করতে হবে।
রোহিঙ্গাদের মায়ানমারে ফিরে যেতে হলে, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ এবং তাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ধরনের ব্যবস্থা ছাড়া, দেশে ফিরে যাওয়ার পর পুনরায় নিপীড়ন ও সহিংসতার আশঙ্কা রয়েছে। সফল প্রত্যাবাসনের জন্য মায়ানমারের সরকার, আঞ্চলিক শক্তি যেমন আসিয়ান, এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে সহযোগিতা প্রয়োজন, যাতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয় এবং রোহিঙ্গাদের অধিকার সুরক্ষিত হয়।
মায়ানমারের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত অনিশ্চিত, কারণ সামরিক জান্তা ক্ষমতা ধরে রাখতে চেষ্টা করছে এবং জাতিগত মিলিশিয়া ও বিরোধী শক্তির ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছে। আপাতত গৃহযুদ্ধের সমাধানের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, এবং শান্তির সম্ভাবনা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে।
মায়ানমারের সামগ্রিক জাতিগত সংঘাত এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সমাধানের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ গভীরভাবে জড়িত। রোহিঙ্গাদের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়বিচারমূলক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে শুধু আন্তর্জাতিক চাপই যথেষ্ট নয়; এটি মায়ানমারের গৃহযুদ্ধের মূল কারণগুলো সমাধানের জন্যও একটি সমন্বিত প্রক্রিয়ার প্রয়োজন, যার মধ্যে জাতিগত বৈষম্য, সামরিক আধিপত্য এবং রাজনৈতিক নিপীড়ন অন্তর্ভুক্ত।
রোহিঙ্গা সংকট মায়ানমারের মানবিক বিপর্যয়ের একটি কেন্দ্রীয় উপাদান হলেও, এটি একটি বৃহত্তর ও গভীরভাবে প্রোথিত সংঘাতের অংশ, যা বহুমুখী এবং দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের দাবি রাখে। সামরিক স্বৈরাচার, জাতিগত বিভাজন এবং রাজনৈতিক নিপীড়নের অন্তর্নিহিত সমস্যা সমাধান করা মায়ানমারের সব জনগণের জন্য, বিশেষত রোহিঙ্গাদের জন্য, একটি স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অপরিহার্য। টেকসই আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা এবং ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতির মাধ্যমেই মায়ানমার তার কয়েক দশকের অস্থিরতা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পেতে পারে।
[লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক]
এম এ হোসাইন
সোমবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪
মায়ানমারের সামরিক জান্তা দেশের নৃগোষ্ঠী মিলিশিয়াগুলোর বিরুদ্ধে একটি অন্তহীন গৃহযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের অধিকাংশ এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর পরেও সামরিক শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা ধরে রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মায়ানমার বর্তমানে সামাজিক, রাজনৈতিক, জাতিগত এবং অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে ডুবে রয়েছে। ফেব্রুয়ারি ২০২১ সালে মায়ানমারের সামরিক বাহিনী বেসামরিক নেতা অং সান সুচির নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে হাজার হাজার মানুষ সহিংস সংঘর্ষে নিহত হয়েছে এবং তিরিশ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তাদের মধ্যে রোহিঙ্গারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত নৃগোষ্ঠী।
ফেব্রুয়ারি ২০২১ সালে, সামরিক বাহিনী অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত এনএলডি সরকারকে উৎখাতের মাধ্যমে মায়ানমারের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এক নাটকীয় মোড় নেয়। এই অভ্যুত্থানটি দেশের দীর্ঘদিনের জাতিগত সংঘাতকে আরও উসকে দেয় এবং দেশকে আরও বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেয়। অভ্যুত্থানের পর থেকে মায়ানমারে ব্যাপক সহিংসতা শুরু হয়, যেখানে সামরিক বাহিনী বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং বিরোধী মিলিশিয়াদের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছে।
এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ (৩বিএ), যার মধ্যে রয়েছে আরাকান আর্মি, মায়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) এবং তা‘আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ)। এই জোটটি বিশেষ করে মায়ানমারের উত্তর ও সীমান্ত অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য আঞ্চলিক সাফল্য অর্জন করেছে। বহিঃশক্তির, বিশেষত চীনের সম্পৃক্ততা, এই সংঘাতকে আরও জটিল করেছে, কারণ আঞ্চলিক শক্তিগুলো চলমান সংঘাতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
কৌশলগত কারণে দীর্ঘদিন ধরে মায়ানমারের সামরিক শাসকদের সমর্থন দিয়ে আসা চীন গোপনে জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকেও সহায়তা করছে। বলা হয়, চীন যুদ্ধবিরতি সৃষ্টিতে মধ্যস্থতা করেছে এবং সংঘাতের গতিবিধিতে প্রভাব রাখছে। এই ভূ-রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাগুলো মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের সঙ্গে জড়িত বৃহত্তর আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্বার্থকে উন্মোচন করে।
মায়ানমারের জাতিগত সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুর্দশা, যারা প্রধানত রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী একটি মুসলিম নৃগোষ্ঠী। কয়েক দশক ধরে রোহিঙ্গারা নিয়মিত বৈষম্য, প্রান্তিককরণ এবং সহিংসতার শিকার হয়েছে। ২০১৭ সালে একটি নৃশংস সামরিক অভিযানে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়, যা বিশ্বব্যাপী নিন্দা ও গণহত্যার অভিযোগের জন্ম দেয়।
জাতিসংঘ ২০১৭ সালের এই অভিযানের ঘটনাকে ‘জাতিগত নির্মূলের পাঠ্যপুস্তক উদাহরণ’ হিসেবে বর্ণনা করেছে, যেখানে সম্পূর্ণ গ্রাম ধ্বংস করা হয়েছে এবং অসংখ্য রোহিঙ্গা নিহত বা বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বর্তমানে রোহিঙ্গারা শোচনীয় অবস্থায় শরণার্থীশিবিরে বসবাস করছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের কক্সবাজারে, যা বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী আবাসন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতার জন্য মায়ানমারকে জবাবদিহি করার প্রচেষ্টা সীমিত সাফল্য পেয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আইনি পদক্ষেপটি গ্রহণ করে গাম্বিয়া, যা ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পক্ষে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মায়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ দায়ের করে। তবে এ প্রক্রিয়ার অগ্রগতি অত্যন্ত ধীর এবং রোহিঙ্গা সংকটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়াও যথেষ্ট অপর্যাপ্ত।
চলমান সহিংসতার মধ্যে রোহিঙ্গা সংহতি সংস্থা (আরএসও), একটি রোহিঙ্গা অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে সংগ্রামী গোষ্ঠী, যা এই অঞ্চলে ক্রমান্বয়ে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। তবে মায়ানমারের সামরিক জান্তা সরাসরি আরএসওর ওপর আক্রমণ করছে না বরং তাদের মূল লক্ষ্যবস্তু রাখাইন জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে লড়াইয়ে বেশি মনোযোগী। এই জাতিগত উত্তেজনাকে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করা সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা রক্ষার নীতির একটি অংশ হিসেবে দেখা যায়।
মায়ানমারের ক্রমবর্ধমান সংকটের প্রতিক্রিয়ায় দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় জাতিসমূহের সংস্থা (আসিয়ান) ২০২১ সালের এপ্রিলে একটি ‘পাঁচ দফা ঐকমত্য’ প্রস্তাব দেয়। এই পরিকল্পনায় সহিংসতা বন্ধ করা, রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করা এবং মানবিক সহায়তা প্রদানের ওপর জোর দেয়া হয়েছিল, যার মাধ্যমে মায়ানমারের সংঘাতের সমাধান চাওয়া হয়েছিল। তবে মায়ানমারের সামরিক জান্তা আসিয়ানের প্রস্তাবের প্রতি নিষ্ঠার সহিত সাড়া না দেয়ায় এই উদ্যোগটি কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ছে এবং আঞ্চলিক সংস্থার প্রভাব সীমিত হয়েছে।
একইভাবে রোহিঙ্গা সংকট এবং মায়ানমারের সামগ্রিক সংঘাত সমাধানে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাগুলো যথেষ্ট নয়। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে, তবে তাদের পদক্ষেপের কার্যকারিতা মোটেও তাৎপর্যপূর্ণ নয়। বাস্তবে দ্রুত পরিবর্তিত পরিস্থিতি, বিশেষ করে চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে, আরও শক্তিশালী ও দীর্ঘমেয়াদি আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন।
বাংলাদেশ, যা বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের বিশাল সংখ্যাকে আশ্রয় দিয়ে, এই সংকটের সমাধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ঢাকায় বর্তমান সরকারকে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদাগুলোকে সামাল দেয়ার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তনের জন্য আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে আরও কার্যকরী সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করতে হবে।
রোহিঙ্গাদের মায়ানমারে ফিরে যেতে হলে, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ এবং তাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ধরনের ব্যবস্থা ছাড়া, দেশে ফিরে যাওয়ার পর পুনরায় নিপীড়ন ও সহিংসতার আশঙ্কা রয়েছে। সফল প্রত্যাবাসনের জন্য মায়ানমারের সরকার, আঞ্চলিক শক্তি যেমন আসিয়ান, এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে সহযোগিতা প্রয়োজন, যাতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয় এবং রোহিঙ্গাদের অধিকার সুরক্ষিত হয়।
মায়ানমারের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত অনিশ্চিত, কারণ সামরিক জান্তা ক্ষমতা ধরে রাখতে চেষ্টা করছে এবং জাতিগত মিলিশিয়া ও বিরোধী শক্তির ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছে। আপাতত গৃহযুদ্ধের সমাধানের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, এবং শান্তির সম্ভাবনা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে।
মায়ানমারের সামগ্রিক জাতিগত সংঘাত এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সমাধানের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ গভীরভাবে জড়িত। রোহিঙ্গাদের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়বিচারমূলক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে শুধু আন্তর্জাতিক চাপই যথেষ্ট নয়; এটি মায়ানমারের গৃহযুদ্ধের মূল কারণগুলো সমাধানের জন্যও একটি সমন্বিত প্রক্রিয়ার প্রয়োজন, যার মধ্যে জাতিগত বৈষম্য, সামরিক আধিপত্য এবং রাজনৈতিক নিপীড়ন অন্তর্ভুক্ত।
রোহিঙ্গা সংকট মায়ানমারের মানবিক বিপর্যয়ের একটি কেন্দ্রীয় উপাদান হলেও, এটি একটি বৃহত্তর ও গভীরভাবে প্রোথিত সংঘাতের অংশ, যা বহুমুখী এবং দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের দাবি রাখে। সামরিক স্বৈরাচার, জাতিগত বিভাজন এবং রাজনৈতিক নিপীড়নের অন্তর্নিহিত সমস্যা সমাধান করা মায়ানমারের সব জনগণের জন্য, বিশেষত রোহিঙ্গাদের জন্য, একটি স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অপরিহার্য। টেকসই আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা এবং ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতির মাধ্যমেই মায়ানমার তার কয়েক দশকের অস্থিরতা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পেতে পারে।
[লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক]