নাইমুর রহমান
অন্তর্র্বর্তী সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে; যেমন এলিট বায়াস বা অভিজাত শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলন মোকাবেলা, ফুটপাতের হকার উচ্ছেদ, ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ন্ত্রণে সরকারের আচরণকে মোটেও সাধারণ ও নিম্ন মধ্যবিত্তবান্ধব বলা যাবে না। সেই সঙ্গে আলাদা মাত্রা যুক্ত করেছে নিত্যপণ্যের দাম। প্রতি কেজি আলু ৮০ থেকে ৯০ টাকা কবেনাগাদ খেয়েছিলেন বলুন তো? আপনি হয়তো নিশ্চয়ই ভাবছেন গত বছরের কথা। সেই তুলনা করলে তো এই সরকারও ব্যর্থ হয়েছে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে। এ দায় কী সরকারের নাকি সিন্ডিকেটের কিংবা নির্ধারকদেরÑ অনেকে হয়ত বলবে খুচরা বিক্রেতাদের সেই প্রশ্নের উত্তর আজকে খুঁজতে যাব না।
কিছুদিন আগে গার্মেন্টস কর্মীদের আন্দোলন হয়েছে, এখনও কিছু জায়গায় চলমান। পোশাক কারখানার মালিকদের শোষণ ও নিপীড়নের গল্প আমরা সবাই জানি। তাই পোশাক শ্রমিকেরা যখন তাদের বঞ্চনা নিরসনের দাবিতে রাস্তায় নেমে এলেন তখন সরকারের উচিত ছিল তাদের যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নেওয়া; কিন্তু সরকার এ আন্দোলনকে আওয়ামী লীগ ও বিদেশি ষড়যন্ত্র ভেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে দমন করার চেষ্টা করেছে; অথচ শ্রমিকদের দাবিগুলো ছিল সুনির্দিষ্ট কিছু অধিকারকে কেন্দ্র করে, যাকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার কোন সুযোগ নেই।
দাবিগুলোর মধ্যে ছিল বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ৫ শতাংশ থেকে বাড়ানো, প্রভিডেন্ট ফান্ড চালু, পিতৃতান্ত্রিক ছুটি, টিফিন বিল ৩৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ টাকা করা, মাতৃকালীন ছুটি বাড়িয়ে ছয় মাস করা, বেতনের সমান ঈদ বোনাস দেওয়া, ছুটি বাড়ানো, মাস শেষে ৫ কর্ম দিবসের মধ্যে মজুরি প্রদান করা ইত্যাদি।
কিন্তু এগুলোর গুরুত্ব না দিয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া কতটুকু যৌক্তিক ছিল? যদিও সরকার ব্যর্থ হয় এবং গত ২৪ সেপ্টেম্বর অন্তর্র্বর্তী সরকার, শ্রমিক ও মালিকদের নিয়ে একটি বৈঠকের মাধ্যমে শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়; কিন্তু কাজের কাজ কিছু না হওয়ায় তিন মাস থেকে বেতন না পাওয়া নিরুপায় শ্রমিকরা আবারো বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তখন সরকার আবারও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে জোরপূর্বক আন্দোলন বন্ধ করার চেষ্টা করে। ফলে পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন নিহত হয় এবং অনেকে আহত হয়ে পরিবারের বোঝায় পরিণত হয়, যদিও দায়িত্ব নেওয়ার কথা তাদেরই ছিল।
ঠিক একইভাবে কোন ধরনের পুনর্বাসন ছাড়াই কারওয়ানবাজার, ফার্মগেট, গুলিস্তান থেকে হকার উচ্ছেদ করা হয়েছে। যৌথ বাহিনীর অভিযানে কোন বাজারের দুই পাশ ও ফুটপাত থেকে এবং ১২ নভেম্বর গুলিস্তান ও ফার্মগেটের ফুটপাত থেকে শত শত হকারকে উচ্ছেদ করা হয়। এখানে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে- প্রয়োজনের তাগিদেই তারা রাস্তায় দোকান দিয়েছিল। অর্থনীতির এমন বৈষম্যমূলক হালচালের জন্যই ক্ষতবিক্ষত গ্রামীণ কৃষি থেকে উচ্ছেদ হয়ে বা নদীভাঙনের কিংবা শহুরে জীবনের চাকচিক্য দেখে মানুষ শহরে এসে আর কোন কর্মসংস্থান না পেয়ে হকারি করে। তাও যেন তাদের জীবনে শান্তি নেই। তাদের চাঁদা দিতে হয়, পুলিশের হয়রানির শিকার হতে হয়, সংগ্রাম করে জীবনে টিকে থাকতে হয়। অথচ এখানেও গল্পটা ভিন্ন হতে পারতো।
ঠিক ইন্দোনেশিয়ায় যেমন হকারদের স্থানীয়ভাবে পেডাগাং ক্যাকি লিমা সরকার নির্ধারিত এলাকায় ব্যবসা করার অনুমতি দেয়। কিছু শহরে তাদের কর দিতে হয়। হকারদের সামাজিক সুরক্ষা এবং প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ রয়েছে। পাইকারিভাবে হকারদের উচ্ছেদ না করে অন্তর্র্বর্তী সরকার হকারদের নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষা দেয়ার জন্য এরকম একটি উদ্যোগ নিতে পারত।
বিগত সরকারের সময় ব্যাপক প্রবৃদ্ধির কথা বলা হলেও বাস্তবে অনেক খাতে মানসম্মত কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায় দেশের কর্মজীবীদের ৮৫% অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। এদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হলো ফুটপাতের হকার বা রিকশাচালক। দেশে কর্মসংস্থানের সমস্যার সমাধান না করে এদের রাস্তা থেকে উচ্ছেদ করে কিসের বার্তা দিলেন? আবার হকার উচ্ছেদ ছাড়া আরও একটি হলো ব্যাটারিচালিত রিকশা জব্দ করে নিলামে তুলে বেচে দেওয়া।
৭ নভেম্বর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অভিযানে ৭৮টি অটোরিকশা এবং ৩১৫টি ব্যাটারি নিলামের মাধ্যমে ১০ লাখ ৫ হাজার টাকায় এবং ১১ নভেম্বর ১০২টি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ৩৭৬টি ব্যাটারি ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়।
এভাবে যানজট নিয়ন্ত্রণের নামে দরিদ্র রিকশাচালকদের রিকশা জব্দ করে নিলামে বেচে দেওয়াটা কতটা ন্যায্য আচরণ হলো? ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে রিকশা ও ব্যাটারি ক্রয়কারী রিকশাচালকের ঋণ পরিশোধ কিভাবে হবে আর তার সংসারই বা কিভাবে চলবে? ঢাকা শহরে যানজটের জন্য কি শুধু ব্যাটারি রিকশাই দায়ী? আইন ভঙ্গ করার দায়ে ব্যাটারি রিকশা যেভাবে নিলামে তোলা হলো, ঢাকার রাস্তায় যত্রযত্র যাত্রী উঠিয়ে যানজট সৃষ্টিকারী মেয়াদোত্তীর্ণ লক্কড়ঝক্কড় বাস কিংবা কোনো সামর্থ্যবান ব্যক্তির প্রাইভেটকারের বেলায় কি একই আচরণ করা সম্ভব হতো। অথচ মাত্র ৬ শতাংশ যাত্রী বহন করে রাস্তার ৭৬ শতাংশ জায়গা দখল করে থাকে এসব ব্যক্তিগত গাড়ি। তারপরও এলিট শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গিতে যানজট সমস্যার কারণ হিসেবে শুধু রিকশাকেই দায়ী করা হয়। অথচ প্রাইভেটকারের তুলনায় রিকশা কম জায়গা দখল করে এবং সস্তায় বহু মানুষকে পরিবহন করে। সেদিকে সরকারের যেন কোনো খেয়ালই নাই।
গণপরিবহন ব্যবস্থা অপর্যাপ্ততার কারণেই মানুষ সামর্থ্য অনুযায়ী প্রাইভেটকার বা মোটরসাইকেল বা রিকশায় যাতায়াত করেন। গণপরিবহন ব্যবস্থা ঠিকঠাক করে রাস্তায় প্রাইভেটকার চলাচল নিষিদ্ধ করা হলে, রাস্তা থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা তুলে দেওয়াও হবে। সরকারের প্রয়োজন ছিল বৈধ লাইসেন্সের মাধ্যমে এলাকাভেদে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা, আধুনিক যন্ত্রপ্রকৌশলের মাধ্যমে এগুলোর নিরাপত্তা বাড়ানো, যান্ত্রিক কৌশলে এগুলোর গতি বেঁধে দেওয়া, ব্যাটারিচালিত যানবাহনকে লাইসেন্সের আওতায় নিয়ে আসা, চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং অর্থের বিনিময়ে নির্দিষ্ট স্থানে চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা করা। অথচ সরকার এখানেও ব্যর্থ। ফলে নিম্নবিত্তের মুখে হাসি ফোটেনি।
জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্র্বর্তী সরকারের কাছে দেশের সাধারণ মানুষের অন্যতম প্রত্যাশা হলো নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ; কিন্তু অন্তর্র্বর্তী সরকারের তিন মাস পার হলেও নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে তেমন সফলতা দেখা যাচ্ছে না। সরকার বিভিন্ন নিত্যপণ্যের শুল্ক কমিয়ে আমদানি উৎসাহিত করে মূল্য কমানোর চেষ্টা করছে; কিন্তু এই কৌশল কতটা কাজ করছে সেটি নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে সরকার আলু আমদানির শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে এবং ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে। এরপর কিছু পরিমাণ আলু আমদানিও হয়; কিন্তু এর ফলে আলুর দাম কমেনি। গত দুই সপ্তাহে আলুর দাম কেজিতে ১৫ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে কেজিপ্রতি ৭০ থেকে ৭৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আলুর দাম গত বছরও এ রকম বেড়েছিল; তবে সেটি ডিসেম্বরে। অর্থাৎ এ বছর বেশ আগেই আলুর দাম বাড়ল।
শুল্ক কমালেই যে আমদানি বাড়বে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যেমন গত এক বছরে প্রায় ৫০টি প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে ৩৩ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হলেও মাত্র একটি প্রতিষ্ঠান ১০ লাখ মুরগির ডিম আমদানি করেছে। শুল্ক কমানো হলেও নানা ধরনের অশুল্ক বাধার কারণে ব্যবসায়ীরা ডিম আমদানিতে উৎসাহবোধ করেন না।
কাজেই সুদের হার বাড়ানো বা শুল্ক কমানোর মতো পদক্ষেপ বাজার নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন বাজারে অদৃশ্য হাতের কারসাজি বন্ধ করা। চাহিদা ও সরবরাহের সঠিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করা, মজুতদারি প্রতিরোধ এবং কার্যকর রেশন-ব্যবস্থা চালু করা ইত্যাদি।
এসব উদ্যোগ নেওয়া হলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন আরেকটু সহজ হতে পারত; যা তাদের কাছে আশীর্বাদ হতো। অন্তর্র্বর্তী সরকার যা এখনো তাদের উপহার দিতে পারেনি। বাজার খরচ মেটাতে হিমশিম, বাধ্য হয়ে টিসিবির লাইনে চাকরিজীবীÑ এই যদি হয় অবস্থা তাহলে বুঝতে বাকি থাকে না যে, নিম্ন আয়ের মানুষরা ভালো নাই।
[লেখক : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]
নাইমুর রহমান
শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪
অন্তর্র্বর্তী সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে; যেমন এলিট বায়াস বা অভিজাত শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলন মোকাবেলা, ফুটপাতের হকার উচ্ছেদ, ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ন্ত্রণে সরকারের আচরণকে মোটেও সাধারণ ও নিম্ন মধ্যবিত্তবান্ধব বলা যাবে না। সেই সঙ্গে আলাদা মাত্রা যুক্ত করেছে নিত্যপণ্যের দাম। প্রতি কেজি আলু ৮০ থেকে ৯০ টাকা কবেনাগাদ খেয়েছিলেন বলুন তো? আপনি হয়তো নিশ্চয়ই ভাবছেন গত বছরের কথা। সেই তুলনা করলে তো এই সরকারও ব্যর্থ হয়েছে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে। এ দায় কী সরকারের নাকি সিন্ডিকেটের কিংবা নির্ধারকদেরÑ অনেকে হয়ত বলবে খুচরা বিক্রেতাদের সেই প্রশ্নের উত্তর আজকে খুঁজতে যাব না।
কিছুদিন আগে গার্মেন্টস কর্মীদের আন্দোলন হয়েছে, এখনও কিছু জায়গায় চলমান। পোশাক কারখানার মালিকদের শোষণ ও নিপীড়নের গল্প আমরা সবাই জানি। তাই পোশাক শ্রমিকেরা যখন তাদের বঞ্চনা নিরসনের দাবিতে রাস্তায় নেমে এলেন তখন সরকারের উচিত ছিল তাদের যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নেওয়া; কিন্তু সরকার এ আন্দোলনকে আওয়ামী লীগ ও বিদেশি ষড়যন্ত্র ভেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে দমন করার চেষ্টা করেছে; অথচ শ্রমিকদের দাবিগুলো ছিল সুনির্দিষ্ট কিছু অধিকারকে কেন্দ্র করে, যাকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার কোন সুযোগ নেই।
দাবিগুলোর মধ্যে ছিল বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ৫ শতাংশ থেকে বাড়ানো, প্রভিডেন্ট ফান্ড চালু, পিতৃতান্ত্রিক ছুটি, টিফিন বিল ৩৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ টাকা করা, মাতৃকালীন ছুটি বাড়িয়ে ছয় মাস করা, বেতনের সমান ঈদ বোনাস দেওয়া, ছুটি বাড়ানো, মাস শেষে ৫ কর্ম দিবসের মধ্যে মজুরি প্রদান করা ইত্যাদি।
কিন্তু এগুলোর গুরুত্ব না দিয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া কতটুকু যৌক্তিক ছিল? যদিও সরকার ব্যর্থ হয় এবং গত ২৪ সেপ্টেম্বর অন্তর্র্বর্তী সরকার, শ্রমিক ও মালিকদের নিয়ে একটি বৈঠকের মাধ্যমে শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়; কিন্তু কাজের কাজ কিছু না হওয়ায় তিন মাস থেকে বেতন না পাওয়া নিরুপায় শ্রমিকরা আবারো বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তখন সরকার আবারও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে জোরপূর্বক আন্দোলন বন্ধ করার চেষ্টা করে। ফলে পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন নিহত হয় এবং অনেকে আহত হয়ে পরিবারের বোঝায় পরিণত হয়, যদিও দায়িত্ব নেওয়ার কথা তাদেরই ছিল।
ঠিক একইভাবে কোন ধরনের পুনর্বাসন ছাড়াই কারওয়ানবাজার, ফার্মগেট, গুলিস্তান থেকে হকার উচ্ছেদ করা হয়েছে। যৌথ বাহিনীর অভিযানে কোন বাজারের দুই পাশ ও ফুটপাত থেকে এবং ১২ নভেম্বর গুলিস্তান ও ফার্মগেটের ফুটপাত থেকে শত শত হকারকে উচ্ছেদ করা হয়। এখানে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে- প্রয়োজনের তাগিদেই তারা রাস্তায় দোকান দিয়েছিল। অর্থনীতির এমন বৈষম্যমূলক হালচালের জন্যই ক্ষতবিক্ষত গ্রামীণ কৃষি থেকে উচ্ছেদ হয়ে বা নদীভাঙনের কিংবা শহুরে জীবনের চাকচিক্য দেখে মানুষ শহরে এসে আর কোন কর্মসংস্থান না পেয়ে হকারি করে। তাও যেন তাদের জীবনে শান্তি নেই। তাদের চাঁদা দিতে হয়, পুলিশের হয়রানির শিকার হতে হয়, সংগ্রাম করে জীবনে টিকে থাকতে হয়। অথচ এখানেও গল্পটা ভিন্ন হতে পারতো।
ঠিক ইন্দোনেশিয়ায় যেমন হকারদের স্থানীয়ভাবে পেডাগাং ক্যাকি লিমা সরকার নির্ধারিত এলাকায় ব্যবসা করার অনুমতি দেয়। কিছু শহরে তাদের কর দিতে হয়। হকারদের সামাজিক সুরক্ষা এবং প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ রয়েছে। পাইকারিভাবে হকারদের উচ্ছেদ না করে অন্তর্র্বর্তী সরকার হকারদের নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষা দেয়ার জন্য এরকম একটি উদ্যোগ নিতে পারত।
বিগত সরকারের সময় ব্যাপক প্রবৃদ্ধির কথা বলা হলেও বাস্তবে অনেক খাতে মানসম্মত কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায় দেশের কর্মজীবীদের ৮৫% অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। এদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হলো ফুটপাতের হকার বা রিকশাচালক। দেশে কর্মসংস্থানের সমস্যার সমাধান না করে এদের রাস্তা থেকে উচ্ছেদ করে কিসের বার্তা দিলেন? আবার হকার উচ্ছেদ ছাড়া আরও একটি হলো ব্যাটারিচালিত রিকশা জব্দ করে নিলামে তুলে বেচে দেওয়া।
৭ নভেম্বর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অভিযানে ৭৮টি অটোরিকশা এবং ৩১৫টি ব্যাটারি নিলামের মাধ্যমে ১০ লাখ ৫ হাজার টাকায় এবং ১১ নভেম্বর ১০২টি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ৩৭৬টি ব্যাটারি ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়।
এভাবে যানজট নিয়ন্ত্রণের নামে দরিদ্র রিকশাচালকদের রিকশা জব্দ করে নিলামে বেচে দেওয়াটা কতটা ন্যায্য আচরণ হলো? ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে রিকশা ও ব্যাটারি ক্রয়কারী রিকশাচালকের ঋণ পরিশোধ কিভাবে হবে আর তার সংসারই বা কিভাবে চলবে? ঢাকা শহরে যানজটের জন্য কি শুধু ব্যাটারি রিকশাই দায়ী? আইন ভঙ্গ করার দায়ে ব্যাটারি রিকশা যেভাবে নিলামে তোলা হলো, ঢাকার রাস্তায় যত্রযত্র যাত্রী উঠিয়ে যানজট সৃষ্টিকারী মেয়াদোত্তীর্ণ লক্কড়ঝক্কড় বাস কিংবা কোনো সামর্থ্যবান ব্যক্তির প্রাইভেটকারের বেলায় কি একই আচরণ করা সম্ভব হতো। অথচ মাত্র ৬ শতাংশ যাত্রী বহন করে রাস্তার ৭৬ শতাংশ জায়গা দখল করে থাকে এসব ব্যক্তিগত গাড়ি। তারপরও এলিট শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গিতে যানজট সমস্যার কারণ হিসেবে শুধু রিকশাকেই দায়ী করা হয়। অথচ প্রাইভেটকারের তুলনায় রিকশা কম জায়গা দখল করে এবং সস্তায় বহু মানুষকে পরিবহন করে। সেদিকে সরকারের যেন কোনো খেয়ালই নাই।
গণপরিবহন ব্যবস্থা অপর্যাপ্ততার কারণেই মানুষ সামর্থ্য অনুযায়ী প্রাইভেটকার বা মোটরসাইকেল বা রিকশায় যাতায়াত করেন। গণপরিবহন ব্যবস্থা ঠিকঠাক করে রাস্তায় প্রাইভেটকার চলাচল নিষিদ্ধ করা হলে, রাস্তা থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা তুলে দেওয়াও হবে। সরকারের প্রয়োজন ছিল বৈধ লাইসেন্সের মাধ্যমে এলাকাভেদে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা, আধুনিক যন্ত্রপ্রকৌশলের মাধ্যমে এগুলোর নিরাপত্তা বাড়ানো, যান্ত্রিক কৌশলে এগুলোর গতি বেঁধে দেওয়া, ব্যাটারিচালিত যানবাহনকে লাইসেন্সের আওতায় নিয়ে আসা, চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং অর্থের বিনিময়ে নির্দিষ্ট স্থানে চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা করা। অথচ সরকার এখানেও ব্যর্থ। ফলে নিম্নবিত্তের মুখে হাসি ফোটেনি।
জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্র্বর্তী সরকারের কাছে দেশের সাধারণ মানুষের অন্যতম প্রত্যাশা হলো নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ; কিন্তু অন্তর্র্বর্তী সরকারের তিন মাস পার হলেও নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে তেমন সফলতা দেখা যাচ্ছে না। সরকার বিভিন্ন নিত্যপণ্যের শুল্ক কমিয়ে আমদানি উৎসাহিত করে মূল্য কমানোর চেষ্টা করছে; কিন্তু এই কৌশল কতটা কাজ করছে সেটি নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে সরকার আলু আমদানির শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে এবং ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে। এরপর কিছু পরিমাণ আলু আমদানিও হয়; কিন্তু এর ফলে আলুর দাম কমেনি। গত দুই সপ্তাহে আলুর দাম কেজিতে ১৫ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে কেজিপ্রতি ৭০ থেকে ৭৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আলুর দাম গত বছরও এ রকম বেড়েছিল; তবে সেটি ডিসেম্বরে। অর্থাৎ এ বছর বেশ আগেই আলুর দাম বাড়ল।
শুল্ক কমালেই যে আমদানি বাড়বে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যেমন গত এক বছরে প্রায় ৫০টি প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে ৩৩ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হলেও মাত্র একটি প্রতিষ্ঠান ১০ লাখ মুরগির ডিম আমদানি করেছে। শুল্ক কমানো হলেও নানা ধরনের অশুল্ক বাধার কারণে ব্যবসায়ীরা ডিম আমদানিতে উৎসাহবোধ করেন না।
কাজেই সুদের হার বাড়ানো বা শুল্ক কমানোর মতো পদক্ষেপ বাজার নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন বাজারে অদৃশ্য হাতের কারসাজি বন্ধ করা। চাহিদা ও সরবরাহের সঠিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করা, মজুতদারি প্রতিরোধ এবং কার্যকর রেশন-ব্যবস্থা চালু করা ইত্যাদি।
এসব উদ্যোগ নেওয়া হলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন আরেকটু সহজ হতে পারত; যা তাদের কাছে আশীর্বাদ হতো। অন্তর্র্বর্তী সরকার যা এখনো তাদের উপহার দিতে পারেনি। বাজার খরচ মেটাতে হিমশিম, বাধ্য হয়ে টিসিবির লাইনে চাকরিজীবীÑ এই যদি হয় অবস্থা তাহলে বুঝতে বাকি থাকে না যে, নিম্ন আয়ের মানুষরা ভালো নাই।
[লেখক : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]