alt

উপ-সম্পাদকীয়

বিজয় সংগ্রামের সূচনার সন্ধানে

শেখর ভট্টাচার্য

: সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
image

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হওয়ার জন্য যে কারণটি সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে সেটি হলো মুক্তি আন্দোলন ক্রমান্বয়ে জনআন্দোলন থেকে জনযুদ্ধে রূপান্তরিত হতে পারা

বাঙালির নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধকে যেমন জনযুদ্ধ না বলে উপায় নেই একইভাবে বায়ান্ন থেকে সূচিত মুক্তির আন্দোলনকেও গণআন্দোলন বা জনআন্দোলন বলতেই হয়। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস সমগ্র বাংলাদেশ লড়েছে, যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী একটি নিষ্ঠুর বাহিনীর বিরুদ্ধে। সুস্পষ্ট, সংগঠিত গণআন্দোলন শুরু হয়েছিল পাকিস্তানের জন্মের মাত্র এক বছর পর আটচল্লিশ সাল থেকে কিন্তু বিক্ষিপ্ত আন্দোলনের সূচনা ঘটেছিল মধ্যযুগ থেকে। বাঙালি কবিরা তাদের আত্মাবিষ্কারে ধ্যানস্থ ছিলেন তখন এবং এর প্রকাশ ঘটেছিল বাংলা ভাষা, মানবতাবাদ নিয়ে তাদের অহংকার কিংবা ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়ে। কবিদের বাঙালি হিসেবে যেমন গর্ববোধ ছিল একইভাবে ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে একধরনের ইতিবাচক অহংকার ছিল। মধ্যযুগের কবিদের মধ্যে আবদুল হাকিম এবং চন্ডীদাস ছিলেন অতি গুরুত্বপূর্ণ। কবি আবদুল হাকিম বাংলা ভাষা ছাড়াও আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃত ভাষায় অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। বাঙালি হিসেবে তিনি নিজেকে গর্বিত একজন মানুষ ভাবতে দ্বিধান্বিত ছিলেন না।

সেসময় একশ্রেণির মানুষের বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞার জবাব দিয়েছিলেন আবদুল হাকিম অত্যন্ত আবেগি কবিতা লিখে। বাংলা ভাষার ওপর আক্রমণ নতুন নয়। ভাষার ওপর আক্রমণের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা হাজার বছর পূর্ব থেকে শুরু করে বর্তমানেও চলছে নানা রূপে, নানা পথে। সর্বকালের সর্বযুগের বাংলা ভাষাবিরোধীদের প্রতি, সাড়ে তিনশ বৎসর আগে উচ্চকণ্ঠে অমোঘ বাণী উচ্চারণ করেছিলেন মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম। তিনি তার নূরনামা কাব্যে প্রবল আবেগে বাংলা ভাষাবিরোধীদের উদ্দেশে সুতীক্ষè মনোভাব প্রকাশ করেন, যা ছিল সকল কালের বাঙালির অন্তরের কথা। মনে রাখতে হবে বাঙালি দার্শনিক আবদুল হাকিম বাঙালি ও বাংলা ভাষার যে স্বাতর্ন্ত্য প্রকাশ করেছিলেন তা ছিল প্রচলিত মানসিকতার প্রতি একধরনের দ্রোহ। সাড়ে তিনশ বছর আগের সেই ভাষাবিরোধিতা আমরা লক্ষ্য করি পাকিস্তান নামক এক অদ্ভুত রাষ্ট্রের জন্মের পর।

সাতচল্লিশ সালে পাকিস্তান জন্মের পর পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তি সঠিকভাবে অনুধাবন করেছিল, বাংলা ভাষার প্রতি বাঙালির এই ভালোবাসা একসময় স্বাতর্ন্ত্য পরিচয়বোধ থেকে স্বাধিকার, স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেবে। পাকিস্তানের জন্মের পর তাই ভাষা, সংস্কৃতির ওপর আঘাত এসেছিল সর্বাগ্রে। ভাষাকে রক্ষার জন্য সাড়ে তিনশ বছর আগে উচ্চারিত হয়েছিল দ্রোহের বাণী, সে বাণী বাঙালির স্বাতন্ত্র বোধ সৃষ্টি করে। পরবর্তিতে যা স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ লাভ করে। আবদুল হাকিমের নূরনামা কাব্যের এই পঙক্তিগুলো আমাদের সবার কাছে খুব পরিচিত, কিন্তু মনে রাখতে হবে সাড়ে তিনশ বছর পূর্বে একজন বাঙালি কবির ভাষার অধিকার এবং ভালোবাসা প্রকাশ সহজ বিষয় ছিল না। নূরনাম কাব্যে আবদুল হাকিম সুস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেছিলেন, “যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ/ সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন/ যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি/ দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়ায়/ নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশে না যায়”।

কবি আবদুল হাকিমের এই অসাধারণ দ্রোহের কবিতা বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনা বললে অত্যুক্তি হয় না।

উচ্চ চিন্তার বাঙালি দার্শনিকরা চতুর্দশ শতাব্দীতে মানুষের প্রতি ভালোবাসা জানিয়ে, মনুষ্যত্বের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে যে দর্শন মানবজাতির সামনে তুলে ধরেছিলেন, তা ছিল বিস্ময়কর। বাঙালি মনীষীদের যদিও বিংশ শতাব্দীর অর্ধেক কাল পর্যন্ত কোন জাতীয়বাদী চিন্তা কিংবা স্বাধীন ভূখ- নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন দাবির উত্থাপন করতে দেখা যায়নি তারপরও মানবতার বাণী তাদের জাতীয়তাবাদী চেতনায় শাণিত করে তোলে বলে মনে হয়। মধ্যযুগের অর্থাৎ চতুর্দশ খ্রিস্টাব্দের বৈষ্ণব কবি চন্ডীদাস সে অভূতপূর্ব, অভূতশ্রুত এক বাণী শোনালেন আমাদেরকে, তিনি সহজভাবে উচ্চারণ করলেন “শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।” ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’Ñ এ যেন “বিদ্রোহী চির উন্নত মম শীর”, এর মতো উদ্দীপনাময়, এক তেজস্বী অনুপ্রেরণা! এ ধরনের মানবতাবাদী উচ্চারণ মনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারনার বীজ বপন করা হয়। এভাবে বাঙালি দার্শনিকরা জাতীয়তাবাদ, ভাষা, উচ্চ চিন্তার মাধ্যমে বাঙালির উদারতা বিশ্বজনীনতার প্রকাশ ঘটিয়ে বাঙালি জাতির ভূখ-ের স্বপ্ন দেখতে উদ্বুদ্ধ করে তোলেন।

পাকিস্তানের জন্মের পর আমাদের জাতীয়তাবাদী ও স্বাধিকারের চেতনা ধীরে ধীরে জনগণের রক্তের শিরায় প্রবেশ করে। ভুলে গেলে চলবে না, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ভাষা, সংস্কৃতির অধিকার বোধ থেকেই কিন্তু এর সূচনা ঘটে মধ্যযুগে। ১৯৭১ তাই শুধু এর আগের কয়েকটি দশকের অধিকার আন্দোলনের ফল নয়, এর আরও বৃহৎ পটভূমি রয়েছে বলে আমারা দেখতে পাই। আমাদের মুক্তির আন্দোলনÑ যা চতুর্দশ শতাব্দীতে দৃশ্যমান হয় তা ১৯৪৮ সালের পর ভাষার প্রশ্নে সুসংগঠিত রূপ কিংবা আন্দোলনে রূপ লাভ করে। এ কারণেই ১৯৭১ সালে খুব সহজেই বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছিল। চতুর্দশ শতাব্দী থেকে ভাষা, সংস্কৃতি, মানবতাবোধের স্বাতর্ন্ত্য নিয়ে বাঙালির মুক্তির যে আকাক্সক্ষা সে আকাক্সক্ষার বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই সমগ্র ১৯৭১ সাল জুড়ে। বাঙালির লড়াই সংগ্রামের ইতিহাসে ভাবাবেগ, দেশের প্রতি ভালোবাসার বিমূর্ত আকাক্সক্ষা আমরা দেখেছি ১৯৪৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত কিন্তু ১৯৪৭ সালের পর সেই বিমূর্ত ভালোবাসা মূর্ত রূপ লাভ করে। স্বাধিকারের পথ ধরে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলজুড়ে উত্তাল হতে শুরু করে। যুগপৎ গৌরব ও বেদনার বছর ১৯৭১। সমগ্র বিশ্ব বাঙালির কোমল রূপ দেখে অভ্যস্থ ছিল। ১৯৭১ সালে বিশ্ব সমাজ অনুধাবন করতে সক্ষম হলো সুবর্ণ পলির মতো কোমল বাঙালি আত্মাধিকার অর্জনের জন্য প্রয়োজনে কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। বাঙালির প্রকৃতি যে বাংলার প্রকৃতিরই প্রতিচ্ছবি অর্থাৎ বর্ষাকালে শান্ত, কোমল, গ্রীষ্মের খরতপ্ত দিনে প্রচ- রুক্ষ এবং কঠিন।

বাঙালির আবেগ যখন দুর্দমনীয় হয়ে ওঠে তখন ভয়ংকর মারণাস্ত্র অতি সাধারণ অস্ত্রে পরিণত হয়ে যায়। ১৯৭১ সালজুড়ে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল ভূমিতে মানুষের বীরত্ব কিংবা তেরশ নদীর ঢেউয়ের ধারায় মানুষের চেতনার তীব্রতা দেখে সমগ্র বিশ্ব চমকিত হয়ে উঠেছে। পৃথিবীতে এমন দৃষ্টান্ত বিরল যে শুধু ভাষার জন্য সংগ্রাম করে, স্বাধীনতা অর্জনের বীজটি বপন করে, ২৩ বছর যেতে না যেতেই একটি প্রদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পেরেছে। কেন এরকম অসম্ভব আন্দোলন সম্ভব হলো?

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হওয়ার জন্য যে কারণটি সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে সেটি হলো মুক্তি আন্দোলন ক্রমান্বয়ে জনআন্দোলন থেকে জনযুদ্ধে রূপান্তরিত হতে পারা। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন সমগ্র বাঙালি সমাজকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছিল যে এটি তাদের প্রাণের দাবিতে পরিণত হতে সময় লাগেনি বেশি। এ কারণেই ছয় দফাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ম্যাগনাকার্টা হিসেবে অভিহিত করা হয়। ছয় দফার গ্রহণ যোগ্যতার কারণে আন্দোলন স্বঃস্ফূর্তভাবে জনগণকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। ছয় দফাতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনের জন্য যে দাবি উত্থাপন করা হয়, জনগণ দাবিগুলোকে নিজেদের প্রাণের দাবি হিসেবে বিবেচনা করতে থাকে। মূলত ছয় দফা দাবি উত্থাপনের পর থেকেই আন্দোলন আওয়ামী লীগের আন্দোলন থেকে বাঙালি জাতির আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। ১৯৬৬ সালের ছয় দফার ব্যাপক জন-গ্রহণ-যোগ্যতাই ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানকে ব্যাপক সফলতা প্রদান করে।

মূলত জনগণকেন্দ্রিক, জনগণ দ্বারা পরিচালিত আন্দোলনের কারণেই সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে এক অবিস্মরনীয় জাতীয় সংহতি লাভে বাঙালিরা সমর্থ হয়। ১৯৬৬ সাল থেকে আন্দোলন যেভাবে জনসম্পৃক্ত হয়ে ওঠে এ কারণেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ একটি জনযুদ্ধে পরিণত হতে বেশি সময়ের প্রয়োজন পড়েনি। জনযুদ্ধ সফল হয় কী কারণে? এই যুদ্ধে বাঙালির সব স্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করে। “যুদ্ধে সাধারণ, অতিসাধারণ কৃষক, মজুর, জেলে, কামার, কুমার, শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, শিল্পী, ছাত্র-ছাত্রী, কন্যা, স্ত্রী এমনকি বয়স্ক নারী-পুরুষ ও সশস্ত্রযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন।’ (একাত্তরের চিঠি-প্রথমা প্রকাশন)

জন-আন্দোলন যখন জনযুদ্ধে রূপান্তরিত হয় পৃথিবীর সব মারণাস্ত্র একসঙ্গে সেই জনযুদ্ধকে প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়। আমরা এই উদাহরণ দেখেছি যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীনতা লাভের জন্য বিজয়ের পতাকাকে বাতাসে ওড়ানোর জন্য প্রাণের আবেগ তখন দুর্দমনীয় হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের ষোলো ডিসেম্বরের বিজয় অর্জন তাই বাঙালি জাতির দুর্দমনীয় আবেগের মূর্ত রূপ।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

মানসম্মত কনটেন্ট ও টিআরপির দ্বৈরথ

জিকা ভাইরাস রোধে প্রয়োজন সচেতনতা

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবার গুরুত্ব

ঢাকার বাতাস বিষাক্ত কেন

চরের কৃষি ও কৃষকের জীবন

নিম্ন আয়ের মানুষ ভালো নাই

সবার আগে নিজেকে পরিবর্তন করা দরকার

পুলিশ কবে পুলিশ হবে

জীবন ফিরে আসুক বাংলার নদীগুলোতে

কান্দন সরেন হত্যা ও ভূমি বিরোধ কি এড়ানো যেত না

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র: রাষ্ট্র বিনির্মাণে সমস্যা কোথায়?

মানবাধিকার দিবস : মানুষের অধিকার নিয়ে কেন এত কথা?

আমলাতান্ত্রিক স্বচ্ছতা : সংস্কারের পথে নাকি পুনরাবৃত্তি?

খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কিছু কথা

ছবি

বেগম রোকেয়া : নারী জাগরণের অগ্রদূত

দুর্নীতির সর্বগ্রাসী বিস্তার বন্ধ করতে হবে

মা তোর বদনখানি মলিন হলে

ব্যবসায়ী নেতৃত্বশূন্য ই-ক্যাব

মূল্যস্ফীতির হিসাব নির্ণয়ে নতুন পদ্ধতির প্রাসঙ্গিকতা

মানুষ অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতা চায়

সবার উপরে মানুষ সত্য

এইচএসসিতে ইংরেজিতে ফল বিপর্যয় কেন, করণীয় কী

ছবি

নিরাপদ এবং সুষম পরিবেশের পরিকল্পনা

ফার্মেসি শিক্ষা ও পেশার সংস্কার প্রয়োজন

মশার কয়েলের প্রভাব : জনস্বাস্থ্যের অদৃশ্য হুমকি

“আইনুন কাইনুন সর্বনেশে...”

কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধকতার ঝুঁকি ও করণীয়

এই সর্বনাশের দায় কার?

জ্ঞানই শক্তি

বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস : জোর দিতে হবে প্রতিরোধে

ঋণ ব্যবস্থা : তেলা মাথায় ঢালো তেল, ন্যাড়া মাথায় ভাঙো বেল

বিচারকের ওপর হামলা কেন

বৈশ্বিক নিষ্ক্রিয়তার কবলে রোহিঙ্গা ইস্যু

আন্তর্জাতিক দাসপ্রথা বিলোপ দিবস

বৈষম্য ঘোচাতে চাই একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বিজয় সংগ্রামের সূচনার সন্ধানে

শেখর ভট্টাচার্য

image

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হওয়ার জন্য যে কারণটি সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে সেটি হলো মুক্তি আন্দোলন ক্রমান্বয়ে জনআন্দোলন থেকে জনযুদ্ধে রূপান্তরিত হতে পারা

সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪

বাঙালির নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধকে যেমন জনযুদ্ধ না বলে উপায় নেই একইভাবে বায়ান্ন থেকে সূচিত মুক্তির আন্দোলনকেও গণআন্দোলন বা জনআন্দোলন বলতেই হয়। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস সমগ্র বাংলাদেশ লড়েছে, যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী একটি নিষ্ঠুর বাহিনীর বিরুদ্ধে। সুস্পষ্ট, সংগঠিত গণআন্দোলন শুরু হয়েছিল পাকিস্তানের জন্মের মাত্র এক বছর পর আটচল্লিশ সাল থেকে কিন্তু বিক্ষিপ্ত আন্দোলনের সূচনা ঘটেছিল মধ্যযুগ থেকে। বাঙালি কবিরা তাদের আত্মাবিষ্কারে ধ্যানস্থ ছিলেন তখন এবং এর প্রকাশ ঘটেছিল বাংলা ভাষা, মানবতাবাদ নিয়ে তাদের অহংকার কিংবা ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়ে। কবিদের বাঙালি হিসেবে যেমন গর্ববোধ ছিল একইভাবে ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে একধরনের ইতিবাচক অহংকার ছিল। মধ্যযুগের কবিদের মধ্যে আবদুল হাকিম এবং চন্ডীদাস ছিলেন অতি গুরুত্বপূর্ণ। কবি আবদুল হাকিম বাংলা ভাষা ছাড়াও আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃত ভাষায় অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। বাঙালি হিসেবে তিনি নিজেকে গর্বিত একজন মানুষ ভাবতে দ্বিধান্বিত ছিলেন না।

সেসময় একশ্রেণির মানুষের বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞার জবাব দিয়েছিলেন আবদুল হাকিম অত্যন্ত আবেগি কবিতা লিখে। বাংলা ভাষার ওপর আক্রমণ নতুন নয়। ভাষার ওপর আক্রমণের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা হাজার বছর পূর্ব থেকে শুরু করে বর্তমানেও চলছে নানা রূপে, নানা পথে। সর্বকালের সর্বযুগের বাংলা ভাষাবিরোধীদের প্রতি, সাড়ে তিনশ বৎসর আগে উচ্চকণ্ঠে অমোঘ বাণী উচ্চারণ করেছিলেন মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম। তিনি তার নূরনামা কাব্যে প্রবল আবেগে বাংলা ভাষাবিরোধীদের উদ্দেশে সুতীক্ষè মনোভাব প্রকাশ করেন, যা ছিল সকল কালের বাঙালির অন্তরের কথা। মনে রাখতে হবে বাঙালি দার্শনিক আবদুল হাকিম বাঙালি ও বাংলা ভাষার যে স্বাতর্ন্ত্য প্রকাশ করেছিলেন তা ছিল প্রচলিত মানসিকতার প্রতি একধরনের দ্রোহ। সাড়ে তিনশ বছর আগের সেই ভাষাবিরোধিতা আমরা লক্ষ্য করি পাকিস্তান নামক এক অদ্ভুত রাষ্ট্রের জন্মের পর।

সাতচল্লিশ সালে পাকিস্তান জন্মের পর পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তি সঠিকভাবে অনুধাবন করেছিল, বাংলা ভাষার প্রতি বাঙালির এই ভালোবাসা একসময় স্বাতর্ন্ত্য পরিচয়বোধ থেকে স্বাধিকার, স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেবে। পাকিস্তানের জন্মের পর তাই ভাষা, সংস্কৃতির ওপর আঘাত এসেছিল সর্বাগ্রে। ভাষাকে রক্ষার জন্য সাড়ে তিনশ বছর আগে উচ্চারিত হয়েছিল দ্রোহের বাণী, সে বাণী বাঙালির স্বাতন্ত্র বোধ সৃষ্টি করে। পরবর্তিতে যা স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ লাভ করে। আবদুল হাকিমের নূরনামা কাব্যের এই পঙক্তিগুলো আমাদের সবার কাছে খুব পরিচিত, কিন্তু মনে রাখতে হবে সাড়ে তিনশ বছর পূর্বে একজন বাঙালি কবির ভাষার অধিকার এবং ভালোবাসা প্রকাশ সহজ বিষয় ছিল না। নূরনাম কাব্যে আবদুল হাকিম সুস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেছিলেন, “যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ/ সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন/ যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি/ দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়ায়/ নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশে না যায়”।

কবি আবদুল হাকিমের এই অসাধারণ দ্রোহের কবিতা বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনা বললে অত্যুক্তি হয় না।

উচ্চ চিন্তার বাঙালি দার্শনিকরা চতুর্দশ শতাব্দীতে মানুষের প্রতি ভালোবাসা জানিয়ে, মনুষ্যত্বের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে যে দর্শন মানবজাতির সামনে তুলে ধরেছিলেন, তা ছিল বিস্ময়কর। বাঙালি মনীষীদের যদিও বিংশ শতাব্দীর অর্ধেক কাল পর্যন্ত কোন জাতীয়বাদী চিন্তা কিংবা স্বাধীন ভূখ- নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন দাবির উত্থাপন করতে দেখা যায়নি তারপরও মানবতার বাণী তাদের জাতীয়তাবাদী চেতনায় শাণিত করে তোলে বলে মনে হয়। মধ্যযুগের অর্থাৎ চতুর্দশ খ্রিস্টাব্দের বৈষ্ণব কবি চন্ডীদাস সে অভূতপূর্ব, অভূতশ্রুত এক বাণী শোনালেন আমাদেরকে, তিনি সহজভাবে উচ্চারণ করলেন “শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।” ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’Ñ এ যেন “বিদ্রোহী চির উন্নত মম শীর”, এর মতো উদ্দীপনাময়, এক তেজস্বী অনুপ্রেরণা! এ ধরনের মানবতাবাদী উচ্চারণ মনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারনার বীজ বপন করা হয়। এভাবে বাঙালি দার্শনিকরা জাতীয়তাবাদ, ভাষা, উচ্চ চিন্তার মাধ্যমে বাঙালির উদারতা বিশ্বজনীনতার প্রকাশ ঘটিয়ে বাঙালি জাতির ভূখ-ের স্বপ্ন দেখতে উদ্বুদ্ধ করে তোলেন।

পাকিস্তানের জন্মের পর আমাদের জাতীয়তাবাদী ও স্বাধিকারের চেতনা ধীরে ধীরে জনগণের রক্তের শিরায় প্রবেশ করে। ভুলে গেলে চলবে না, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ভাষা, সংস্কৃতির অধিকার বোধ থেকেই কিন্তু এর সূচনা ঘটে মধ্যযুগে। ১৯৭১ তাই শুধু এর আগের কয়েকটি দশকের অধিকার আন্দোলনের ফল নয়, এর আরও বৃহৎ পটভূমি রয়েছে বলে আমারা দেখতে পাই। আমাদের মুক্তির আন্দোলনÑ যা চতুর্দশ শতাব্দীতে দৃশ্যমান হয় তা ১৯৪৮ সালের পর ভাষার প্রশ্নে সুসংগঠিত রূপ কিংবা আন্দোলনে রূপ লাভ করে। এ কারণেই ১৯৭১ সালে খুব সহজেই বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছিল। চতুর্দশ শতাব্দী থেকে ভাষা, সংস্কৃতি, মানবতাবোধের স্বাতর্ন্ত্য নিয়ে বাঙালির মুক্তির যে আকাক্সক্ষা সে আকাক্সক্ষার বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই সমগ্র ১৯৭১ সাল জুড়ে। বাঙালির লড়াই সংগ্রামের ইতিহাসে ভাবাবেগ, দেশের প্রতি ভালোবাসার বিমূর্ত আকাক্সক্ষা আমরা দেখেছি ১৯৪৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত কিন্তু ১৯৪৭ সালের পর সেই বিমূর্ত ভালোবাসা মূর্ত রূপ লাভ করে। স্বাধিকারের পথ ধরে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলজুড়ে উত্তাল হতে শুরু করে। যুগপৎ গৌরব ও বেদনার বছর ১৯৭১। সমগ্র বিশ্ব বাঙালির কোমল রূপ দেখে অভ্যস্থ ছিল। ১৯৭১ সালে বিশ্ব সমাজ অনুধাবন করতে সক্ষম হলো সুবর্ণ পলির মতো কোমল বাঙালি আত্মাধিকার অর্জনের জন্য প্রয়োজনে কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। বাঙালির প্রকৃতি যে বাংলার প্রকৃতিরই প্রতিচ্ছবি অর্থাৎ বর্ষাকালে শান্ত, কোমল, গ্রীষ্মের খরতপ্ত দিনে প্রচ- রুক্ষ এবং কঠিন।

বাঙালির আবেগ যখন দুর্দমনীয় হয়ে ওঠে তখন ভয়ংকর মারণাস্ত্র অতি সাধারণ অস্ত্রে পরিণত হয়ে যায়। ১৯৭১ সালজুড়ে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল ভূমিতে মানুষের বীরত্ব কিংবা তেরশ নদীর ঢেউয়ের ধারায় মানুষের চেতনার তীব্রতা দেখে সমগ্র বিশ্ব চমকিত হয়ে উঠেছে। পৃথিবীতে এমন দৃষ্টান্ত বিরল যে শুধু ভাষার জন্য সংগ্রাম করে, স্বাধীনতা অর্জনের বীজটি বপন করে, ২৩ বছর যেতে না যেতেই একটি প্রদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পেরেছে। কেন এরকম অসম্ভব আন্দোলন সম্ভব হলো?

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হওয়ার জন্য যে কারণটি সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে সেটি হলো মুক্তি আন্দোলন ক্রমান্বয়ে জনআন্দোলন থেকে জনযুদ্ধে রূপান্তরিত হতে পারা। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন সমগ্র বাঙালি সমাজকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছিল যে এটি তাদের প্রাণের দাবিতে পরিণত হতে সময় লাগেনি বেশি। এ কারণেই ছয় দফাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ম্যাগনাকার্টা হিসেবে অভিহিত করা হয়। ছয় দফার গ্রহণ যোগ্যতার কারণে আন্দোলন স্বঃস্ফূর্তভাবে জনগণকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। ছয় দফাতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনের জন্য যে দাবি উত্থাপন করা হয়, জনগণ দাবিগুলোকে নিজেদের প্রাণের দাবি হিসেবে বিবেচনা করতে থাকে। মূলত ছয় দফা দাবি উত্থাপনের পর থেকেই আন্দোলন আওয়ামী লীগের আন্দোলন থেকে বাঙালি জাতির আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। ১৯৬৬ সালের ছয় দফার ব্যাপক জন-গ্রহণ-যোগ্যতাই ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানকে ব্যাপক সফলতা প্রদান করে।

মূলত জনগণকেন্দ্রিক, জনগণ দ্বারা পরিচালিত আন্দোলনের কারণেই সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে এক অবিস্মরনীয় জাতীয় সংহতি লাভে বাঙালিরা সমর্থ হয়। ১৯৬৬ সাল থেকে আন্দোলন যেভাবে জনসম্পৃক্ত হয়ে ওঠে এ কারণেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ একটি জনযুদ্ধে পরিণত হতে বেশি সময়ের প্রয়োজন পড়েনি। জনযুদ্ধ সফল হয় কী কারণে? এই যুদ্ধে বাঙালির সব স্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করে। “যুদ্ধে সাধারণ, অতিসাধারণ কৃষক, মজুর, জেলে, কামার, কুমার, শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, শিল্পী, ছাত্র-ছাত্রী, কন্যা, স্ত্রী এমনকি বয়স্ক নারী-পুরুষ ও সশস্ত্রযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন।’ (একাত্তরের চিঠি-প্রথমা প্রকাশন)

জন-আন্দোলন যখন জনযুদ্ধে রূপান্তরিত হয় পৃথিবীর সব মারণাস্ত্র একসঙ্গে সেই জনযুদ্ধকে প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়। আমরা এই উদাহরণ দেখেছি যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীনতা লাভের জন্য বিজয়ের পতাকাকে বাতাসে ওড়ানোর জন্য প্রাণের আবেগ তখন দুর্দমনীয় হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের ষোলো ডিসেম্বরের বিজয় অর্জন তাই বাঙালি জাতির দুর্দমনীয় আবেগের মূর্ত রূপ।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

back to top