alt

উপ-সম্পাদকীয়

বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কেন

রেজাউল করিম খোকন

: শনিবার, ০৪ জানুয়ারী ২০২৫

বাজারের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না। সরকার অর্থনৈতিক স্বস্তি দিতে ও আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ঘটাতে না পারলে জনগণ ধৈর্য হারিয়ে ফেলবে। পণ্যের দাম বাড়ার জন্য চাঁদাবাজিকে দায়ী করছেন কেউ কেউ। চাঁদাবাজি বা মজুতদারিÑ যে কারণেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ুক না কেন, এর বিরুদ্ধে সরকারকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বিকল্প কৃষিবাজার চালু করার কথা বলেছেন। কিন্তু তা কীভাবে ও কতদিনে হবে, সেটাও প্রশ্ন বটে। বিকল্প বাজার না হওয়া পর্যন্ত সরকার টিসিবির মাধ্যমে সাশ্রয়ী দামে ভোগ্যপণ্য সরবরাহ বাড়ালে মানুষ কিছুটা স্বস্তি পেতে পারে। সরকার সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, দুদক ইদ্যাদি সংস্কারে যেসব কমিশন গঠন করেছে; তবে তাদের মনে রাখতে হবে, বাজার নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে কোনো সংস্কারই কাজে আসবে না। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা এই সরকারের বড় শক্তি জনগণের সমর্থন। সেটাই যদি নড়বড়ে হয়ে পড়ে, তখন তাদের নৈতিক অবস্থানও দুর্বল হয়ে পড়বে। জুলাই অভ্যুত্থানে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ যেসব কারণে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। নতুন অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরেও মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। কাজেই এ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্র্বর্তী সরকারের কাছে দেশের সাধারণ মানুষের অন্যতম প্রত্যাশা হলো নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু অন্তর্র্বর্তী সরকারের ৫ মাস পার হলেও নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে তেমন সফলতা দেখা যাচ্ছে না। উল্টো চাল, ভোজ্যতেল, ডিম, মুরগি, চিনি ইত্যাদি পণ্যের মূল্য আরও বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি হ্রাসে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হারে নিয়ন্ত্রণ তুলে নিয়ে বাজারে টাকার সরবরাহ কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যক পণ্যের চাহিদা টাকার সরবরাহের ওপর ততটা নির্ভর করে না বলে এভাবে নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এজন্য বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপের প্রয়োজন। এরই মধ্যে বাজার তদারক করতে জেলায় জেলায় বিশেষ টাস্কফোর্স করেছে সরকার। এছাড়া কয়েকটি পণ্যের শুল্ক-কর কমানো হয়েছে। এগুলো দরকারি পদক্ষেপ; কিন্তু যথেষ্ট নয়। নিত্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির কার্যকর ও টেকসই সমাধানের জন্য আরও কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। বাজার অর্থনীতিতে পণ্যের দাম নির্ধারিত হওয়ার কথা চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে বাজারের ‘অদৃশ্য হাতের’ মাধ্যমে। বাংলাদেশে ‘অদৃশ্য হাতের’ নির্দেশে পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হয় ঠিকই; কিন্তু সেই অদৃশ্য হাতটা অনেক ক্ষেত্রে বাজারের নয়, কতিপয় বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর। দেশে উৎপাদিত এবং বিদেশ থেকে আমদানিকৃত উভয় ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রেই তা সত্যি। শুধু দেশে উৎপাদিত নিত্যপণ্যই নয়, বিগত সরকারের আমলে নিত্যপণ্যের আমদানির নিয়ন্ত্রণও চলে গিয়েছিল হাতেগোনা কয়েকটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কাছে। তারা বাজারের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিযোগিতার বদলে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে পণ্য আমদানির প্রতিটি পর্যায়ে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। বেশি পরিমাণে পণ্য আমদানি করা প্রতিষ্ঠানগুলো একজোট হয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যে মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা নিজের ইচ্ছামতো পণ্য কিনতে পারেন না। একজন ব্যবসায়ী যদি কোনো পণ্য ক্রয় করতে চান, তাহলে তাকে বড় ব্যবসায়ীদের কাছে যেতে হবে, তখন সেই বড় ব্যবসায়ীই ঠিক করে দেবেন যে কোন পণ্য কত দামে কার কাছ থেকে কিনতে হবে। এতে রাজি না হয়ে ব্যবসায়ী ব্যক্তিটি যদি মনে করেন তিনি নিজেই পণ্যটি আমদানি করবেন, তাহলে দেখা যাবে ব্যাংক তার এলসি খুলতে রাজি হচ্ছে না, কাস্টমস-ভ্যাটসহ নানা দপ্তর থেকে বাধা আসছে, এমনকি আমদানি করা পণ্য বড় জাহাজ থেকে খালাস করে বন্দরে আনার জন্য লাইটার ভেসেল পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি এই সব বাধা অগ্রাহ্য করে তিনি যদি কোনোভাবে পণ্যটি আমদানি করেও ফেলেন, দেখা যাবে বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী তার আমদানি মূল্যের চেয়ে কম দামে বাজারে পণ্যটি ছেড়ে দিয়ে তাকে লোকসানের মুখে ফেলে দেবে। কতিপয় বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর এভাবে বাজারের ওপর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারার কারণ হলো, তারা একাধারে বড় আমদানিকারক, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মালিকানা বা ব্যবস্থাপনার কর্তৃত্ব ছিল তাদের হাতে, সাগরের বড় জাহাজ থেকে বন্দরে খালাসের জন্য ব্যবহৃত লাইটার জাহাজগুলোও তাদের কিংবা তাদের সহযোগীদের মালিকানাধীন, এমনকি পণ্যের ডিলারশিপেও নিয়ন্ত্রণ এসব ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর আশীর্বাদপুষ্ট লোকজনের হাতে। মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্যসামগ্রীর ওপর কতিপয় বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর এ ধরনের একচেটিয়া আধিপত্য ভাঙতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা আইন-২০১২ এর আওতায় বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনকে শক্তিশালী করে কাজে লাগানো যেতে পারে। প্রতিযোগিতা কমিশনের দায়িত্ব হলো, বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব বিস্তারকারী অনুশীলনগুলোকে নির্মূল করা। এজন্য তাদের বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশ, মনোপলি, ওলিগোপলি, জোটবদ্ধতা অথবা কর্তৃত্বময় অবস্থানের অপব্যবহার প্রতিরোধ করতে হবে। বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রভাবে প্রতিযোগিতা কমিশন কার্যকর ছিল না। এখন সময় এসেছে প্রতিযোগিতা কমিশনকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো। ব্যবসায়ীরা পারস্পরিক যোগসাজশ করে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করছেন কিনা, তো বোঝার জন্য প্রতিযোগিতা কমিশনকে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন ও আমদানির প্রকৃত খরচের সঙ্গে বাজারমূল্য মিলিয়ে দেখতে হবে। ব্যবসায়ীরা কত দামে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অপরিশোধিত ভোজ্যতেল বা চিনি আমদানি করছেন, এগুলো পরিশোধন ও বাজারজাতকরণে কত ব্যয় করছেন, আর কত দরে বাজারে বিক্রয় করছেন, তা খতিয়ে দেখতে হবে। দেশে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য নিয়ে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নানা ধরনের কারসাজি চালিয়ে যেতে পারার একটি কারণ হলো পণ্যের উৎপাদন ও চাহিদা সম্পর্কে সরকারের কাছে সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য না থাকা। যেমনÑ সরকারি হিসাবে আলু, পেঁয়াজ, ডিম ইত্যাদি পণ্য উদ্বৃত্ত থাকলেও বাস্তবে দেখা যায় এগুলোর সংকট রয়েছে, যার সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সময় পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেন। মিলগেটে তদারকি দুর্বলতার কারণে কতিপয় মিলমালিক মিলে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমনের এই ভরা মৌসুমে এভাবে চালের দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। চালের দাম বাড়ছে, এটা ঠিক। কারণ, ধানের দাম অনেক বেড়েছে। ধানের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে আসামি কয়েক দিনে চালের দাম আরও বাড়বে। বাড়তি দামেও ধান পাওয়া যাচ্ছে না। তাই ধানের হাটবাজারে প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানো দরকার। এবার ধানের ফলন কম হয়েছে। তাই ধানের কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। তারপরও চালের দাম যেভাবে বাড়ছে, তা গুটিকয়েক মিলমালিকের কারণে। তারা করপোরেট চাল কোম্পানির সঙ্গে মিল রেখে চালের দাম বাড়াচ্ছেন। বাজার তদারকির বিষয়ে জেলা প্রশাসনকে চালের দাম বাড়ার বিষয়টি নজরদারি করতে হবে। যারা যৌক্তিক কারণ ছাড়া দাম বাড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ অন্য সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে নজরদারি চালাতে হবে। কোথাও কোনো অসঙ্গতি পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

ব্রেন রট: বর্তমান সময়ের এক মারাত্মক ব্যাধি

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলুক দেশের গবেষণা

নির্মোহ ইতিহাস চর্চা ও রাষ্ট্র সংস্কার প্রয়াসে শিক্ষা

জলবায়ুর পরিবর্তন ও দেশের ভবিষ্যৎ

প্রসঙ্গ : থিয়েটার ফর থেরাপির তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক পাঠ

শ্বেতপত্রে নতুন কী আছে?

ছবি

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও জুনো ভাইয়ের স্মৃতি

পরিবেশ সুরক্ষায় সার্কুলার ইকোনমি

ভাড়া ‘নির্ধারণ’ কিংবা ‘নিয়ন্ত্রণ’ করবে কে?

ব্যাংক ও আর্থিক খাতের জন্য কেমন ছিল ২০২৪ সাল?

স্বৈরাচারের শেষ নেই...

ছবি

স্মরণ : বাংলা সাহিত্যের অমর কথাশিল্পী

দোষারোপের রাজনীতি আর কত

জ্ঞান, দক্ষতা ও সৃজনশীলতার বিকাশে চাই বিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা

যৌন নিপীড়ন প্রসঙ্গে

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতটা সফল হবে?

নতুন বছরের প্রত্যাশা

ছবি

মানবিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে জেগে উঠি নতুন বছরে

দোষারোপের রাজনীতি আর কত

প্রশাসনিক সংকট ও ভবিষ্যতের করণীয়

ছবি

বিপ্লবী রাজনীতির কাণ্ডারি : কমরেড মণি সিংহ

স্বাস্ব্য সংস্কার : কী কী বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া জরুরি

জনশিক্ষা, গণশিক্ষা ও পারিবারিক শিক্ষা : রাষ্ট্রসংস্কারের মৌলিক ভিত্তি

জাহাজ ভাঙা শিল্প ও পরিবেশ বিপর্যয়

ছিন্নমূল মানুষের ‘শীত-জীবন’

বিভাজিত তাবলিগ জামাতের দ্বন্দ্ব

কোন পথে দেশ?

অহেতুক মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে কি লাভ হচ্ছে?

রম্যগদ্য : ‘অন্ডুল নাস্তি...’

অনিরাপদ সড়ক, সমাধান কোথায়?

চাই দৃশ্যমান পরিবর্তন

বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং পরিবেশ নিয়ে ভাবনা

সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন

ধনিক শ্রেণীর চলমান সংকট

ছবি

বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য এবং আমাদের প্রান্তিক মানুষ

বায়ু দূষণের কারণে বাড়ছে ওষুধের ব্যবহার

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কেন

রেজাউল করিম খোকন

শনিবার, ০৪ জানুয়ারী ২০২৫

বাজারের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না। সরকার অর্থনৈতিক স্বস্তি দিতে ও আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ঘটাতে না পারলে জনগণ ধৈর্য হারিয়ে ফেলবে। পণ্যের দাম বাড়ার জন্য চাঁদাবাজিকে দায়ী করছেন কেউ কেউ। চাঁদাবাজি বা মজুতদারিÑ যে কারণেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ুক না কেন, এর বিরুদ্ধে সরকারকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বিকল্প কৃষিবাজার চালু করার কথা বলেছেন। কিন্তু তা কীভাবে ও কতদিনে হবে, সেটাও প্রশ্ন বটে। বিকল্প বাজার না হওয়া পর্যন্ত সরকার টিসিবির মাধ্যমে সাশ্রয়ী দামে ভোগ্যপণ্য সরবরাহ বাড়ালে মানুষ কিছুটা স্বস্তি পেতে পারে। সরকার সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, দুদক ইদ্যাদি সংস্কারে যেসব কমিশন গঠন করেছে; তবে তাদের মনে রাখতে হবে, বাজার নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে কোনো সংস্কারই কাজে আসবে না। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা এই সরকারের বড় শক্তি জনগণের সমর্থন। সেটাই যদি নড়বড়ে হয়ে পড়ে, তখন তাদের নৈতিক অবস্থানও দুর্বল হয়ে পড়বে। জুলাই অভ্যুত্থানে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ যেসব কারণে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। নতুন অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরেও মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। কাজেই এ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্র্বর্তী সরকারের কাছে দেশের সাধারণ মানুষের অন্যতম প্রত্যাশা হলো নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু অন্তর্র্বর্তী সরকারের ৫ মাস পার হলেও নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে তেমন সফলতা দেখা যাচ্ছে না। উল্টো চাল, ভোজ্যতেল, ডিম, মুরগি, চিনি ইত্যাদি পণ্যের মূল্য আরও বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি হ্রাসে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হারে নিয়ন্ত্রণ তুলে নিয়ে বাজারে টাকার সরবরাহ কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যক পণ্যের চাহিদা টাকার সরবরাহের ওপর ততটা নির্ভর করে না বলে এভাবে নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এজন্য বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপের প্রয়োজন। এরই মধ্যে বাজার তদারক করতে জেলায় জেলায় বিশেষ টাস্কফোর্স করেছে সরকার। এছাড়া কয়েকটি পণ্যের শুল্ক-কর কমানো হয়েছে। এগুলো দরকারি পদক্ষেপ; কিন্তু যথেষ্ট নয়। নিত্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির কার্যকর ও টেকসই সমাধানের জন্য আরও কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। বাজার অর্থনীতিতে পণ্যের দাম নির্ধারিত হওয়ার কথা চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে বাজারের ‘অদৃশ্য হাতের’ মাধ্যমে। বাংলাদেশে ‘অদৃশ্য হাতের’ নির্দেশে পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হয় ঠিকই; কিন্তু সেই অদৃশ্য হাতটা অনেক ক্ষেত্রে বাজারের নয়, কতিপয় বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর। দেশে উৎপাদিত এবং বিদেশ থেকে আমদানিকৃত উভয় ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রেই তা সত্যি। শুধু দেশে উৎপাদিত নিত্যপণ্যই নয়, বিগত সরকারের আমলে নিত্যপণ্যের আমদানির নিয়ন্ত্রণও চলে গিয়েছিল হাতেগোনা কয়েকটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কাছে। তারা বাজারের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিযোগিতার বদলে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে পণ্য আমদানির প্রতিটি পর্যায়ে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। বেশি পরিমাণে পণ্য আমদানি করা প্রতিষ্ঠানগুলো একজোট হয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যে মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা নিজের ইচ্ছামতো পণ্য কিনতে পারেন না। একজন ব্যবসায়ী যদি কোনো পণ্য ক্রয় করতে চান, তাহলে তাকে বড় ব্যবসায়ীদের কাছে যেতে হবে, তখন সেই বড় ব্যবসায়ীই ঠিক করে দেবেন যে কোন পণ্য কত দামে কার কাছ থেকে কিনতে হবে। এতে রাজি না হয়ে ব্যবসায়ী ব্যক্তিটি যদি মনে করেন তিনি নিজেই পণ্যটি আমদানি করবেন, তাহলে দেখা যাবে ব্যাংক তার এলসি খুলতে রাজি হচ্ছে না, কাস্টমস-ভ্যাটসহ নানা দপ্তর থেকে বাধা আসছে, এমনকি আমদানি করা পণ্য বড় জাহাজ থেকে খালাস করে বন্দরে আনার জন্য লাইটার ভেসেল পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি এই সব বাধা অগ্রাহ্য করে তিনি যদি কোনোভাবে পণ্যটি আমদানি করেও ফেলেন, দেখা যাবে বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী তার আমদানি মূল্যের চেয়ে কম দামে বাজারে পণ্যটি ছেড়ে দিয়ে তাকে লোকসানের মুখে ফেলে দেবে। কতিপয় বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর এভাবে বাজারের ওপর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারার কারণ হলো, তারা একাধারে বড় আমদানিকারক, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মালিকানা বা ব্যবস্থাপনার কর্তৃত্ব ছিল তাদের হাতে, সাগরের বড় জাহাজ থেকে বন্দরে খালাসের জন্য ব্যবহৃত লাইটার জাহাজগুলোও তাদের কিংবা তাদের সহযোগীদের মালিকানাধীন, এমনকি পণ্যের ডিলারশিপেও নিয়ন্ত্রণ এসব ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর আশীর্বাদপুষ্ট লোকজনের হাতে। মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্যসামগ্রীর ওপর কতিপয় বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর এ ধরনের একচেটিয়া আধিপত্য ভাঙতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা আইন-২০১২ এর আওতায় বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনকে শক্তিশালী করে কাজে লাগানো যেতে পারে। প্রতিযোগিতা কমিশনের দায়িত্ব হলো, বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব বিস্তারকারী অনুশীলনগুলোকে নির্মূল করা। এজন্য তাদের বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশ, মনোপলি, ওলিগোপলি, জোটবদ্ধতা অথবা কর্তৃত্বময় অবস্থানের অপব্যবহার প্রতিরোধ করতে হবে। বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রভাবে প্রতিযোগিতা কমিশন কার্যকর ছিল না। এখন সময় এসেছে প্রতিযোগিতা কমিশনকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো। ব্যবসায়ীরা পারস্পরিক যোগসাজশ করে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করছেন কিনা, তো বোঝার জন্য প্রতিযোগিতা কমিশনকে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন ও আমদানির প্রকৃত খরচের সঙ্গে বাজারমূল্য মিলিয়ে দেখতে হবে। ব্যবসায়ীরা কত দামে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অপরিশোধিত ভোজ্যতেল বা চিনি আমদানি করছেন, এগুলো পরিশোধন ও বাজারজাতকরণে কত ব্যয় করছেন, আর কত দরে বাজারে বিক্রয় করছেন, তা খতিয়ে দেখতে হবে। দেশে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য নিয়ে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নানা ধরনের কারসাজি চালিয়ে যেতে পারার একটি কারণ হলো পণ্যের উৎপাদন ও চাহিদা সম্পর্কে সরকারের কাছে সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য না থাকা। যেমনÑ সরকারি হিসাবে আলু, পেঁয়াজ, ডিম ইত্যাদি পণ্য উদ্বৃত্ত থাকলেও বাস্তবে দেখা যায় এগুলোর সংকট রয়েছে, যার সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সময় পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেন। মিলগেটে তদারকি দুর্বলতার কারণে কতিপয় মিলমালিক মিলে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমনের এই ভরা মৌসুমে এভাবে চালের দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। চালের দাম বাড়ছে, এটা ঠিক। কারণ, ধানের দাম অনেক বেড়েছে। ধানের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে আসামি কয়েক দিনে চালের দাম আরও বাড়বে। বাড়তি দামেও ধান পাওয়া যাচ্ছে না। তাই ধানের হাটবাজারে প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানো দরকার। এবার ধানের ফলন কম হয়েছে। তাই ধানের কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। তারপরও চালের দাম যেভাবে বাড়ছে, তা গুটিকয়েক মিলমালিকের কারণে। তারা করপোরেট চাল কোম্পানির সঙ্গে মিল রেখে চালের দাম বাড়াচ্ছেন। বাজার তদারকির বিষয়ে জেলা প্রশাসনকে চালের দাম বাড়ার বিষয়টি নজরদারি করতে হবে। যারা যৌক্তিক কারণ ছাড়া দাম বাড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ অন্য সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে নজরদারি চালাতে হবে। কোথাও কোনো অসঙ্গতি পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

back to top