অমৃত চিছাম
বর্তমান বিশ্বে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি, শিল্পায়ন, এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অতিরিক্ত ব্যবহার পরিবেশকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ১১ জুলাই জাতিসংঘ প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক জনসংখ্যা সম্ভাবনা-২০২৪’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যা ৮২০ কোটি। আসামি ৬০ বছরে এ সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। ২০৮৪ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ১ হাজার ৩০ কোটি। আর শতক শেষ হওয়ার আগেই জনসংখ্যা নেমে আসবে ১ হাজার ২০ কোটিতে। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন চাহিদা মেটাতে পৃথিবীর সব দেশকে নানা ধরনের সমস্যা সম্মুখীন হতে হবে। কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিল্পায়ন ও প্রাকৃতিক সম্পদের অতিরিক্ত ব্যবহার প্রকৃতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে, যা আমাদের জন্য সত্যি উদ্বেগের বিষয়। এই প্রেক্ষাপটে, সার্কুলার ইকোনমি একটি টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক মডেল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এটি প্রথাগত লিনিয়ার ইকোনমির (উৎপাদন-ব্যবহার-নিক্ষেপ) বিকল্প হিসেবে প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় কমিয়ে পরিবেশ সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়। ২০১০ সাল থেকে সার্কুলার ইকোনমি একটি গ্লোবাল মডেল হিসেবে কাজ করছে। এটি পরিবেশ সুরক্ষা, কার্বন নিঃসরণ কমানো, এবং নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের জন্য কার্যকরী হিসেবে স্বীকৃত। সার্কুলার ইকোনমির মূল উদ্দেশ্য হলো উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে বর্জ্য নির্মূল করা। বর্জ্যরে পুনঃব্যবহার এবং পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে এটি ডাম্পিং গ্রাউন্ড এবং ল্যান্ডফিল থেকে বর্জ্যরে চাপ কমায়। প্রথাগত লিনিয়ার ইকোনমি পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার মাত্রাতিরিক্ত। তবে সার্কুলার ইকোনমি সম্পদ পুনর্ব্যবহার করে প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ নিশ্চিত করে। পুনঃব্যবহারযোগ্য পণ্য এবং পুনঃপ্রক্রিয়াজাত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সার্কুলার ইকোনমি গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে সহায়তা করে, যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সার্কুলার ইকোনমি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় টেকসই প্রযুক্তির ব্যবহার এবং ভোক্তাদের মধ্যে পরিবেশবান্ধব আচরণ গড়ে তুলতে সহায়তা করে। বর্জ্য পানিতে নিক্ষেপ করার পরিবর্তে পুনঃব্যবহারের মাধ্যমে সার্কুলার ইকোনমি জলদূষণ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। কাঁচামাল সংগ্রহের সময় প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান ধ্বংস হয়। পুনঃব্যবহার ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাত প্রযুক্তির ব্যবহারে বনভূমি, জলাশয় এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সহজ হয়। পণ্যের দীর্ঘস্থায়িত্ব এবং পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে উৎপাদন খরচ হ্রাস করে সার্কুলার ইকোনমি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনে। এর ফলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, বিশেষত পুনর্ব্যবহার ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাত খাতে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর প্রায় ১০০ বিলিয়ন টন প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে মাত্র ৮.৬% পুনঃব্যবহার করা হয় (সার্কুলারিটি গ্যাপ রিপোর্ট ২০২৩)। লিনিয়ার অর্থনীতি বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণের প্রায় ৪৫% জন্য দায়ী। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সার্কুলার ইকোনমিকে তাদের পরিবেশ নীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছে। ইইউ-এর সার্কুলার ইকোনমি অ্যাকশন প্ল্যান অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ এবং পুনঃব্যবহারের হার দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্লাস্টিক প্যাকেজিংয়ের ৫০% পুনঃব্যবহার নিশ্চিত করা। চীন তাদের জাতীয় সার্কুলার ইকোনমি উন্নয়ন পরিকল্পনার মাধ্যমে পুনঃব্যবহারের হার প্রায় ২৫% বৃদ্ধি করেছে। নেদারল্যান্ডস ২০৫০ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ সার্কুলার ইকোনমিতে রূপান্তরের লক্ষ্য। জাপান ২০১৫ সাল থেকে রিসাইক্লিংয়ের হার প্রায় ২০% বৃদ্ধি করেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে সার্কুলার ইকোনমি বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার প্রায় ২৮% হ্রাস করতে পারে, যা বৈশ্বিক জিডিপিতে প্রায় ৪.৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার সংযোজন করতে পারে। বাংলাদেশে প্রতি বছর উৎপন্ন কঠিন বর্জ্য প্রায় ২৭.৪ মিলিয়ন টন। এর মধ্যে শুধু ৫-১০% পুনঃব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে প্লাস্টিক, ই-বর্জ্য, এবং টেক্সটাইল বর্জ্যরে পুনঃব্যবহার হার অত্যন্ত কম। বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাকশিল্প রপ্তানিকারক দেশ। প্রতি বছর প্রায় ৪ লাখ টন বর্জ্য কাপড় পুনঃব্যবহার না করেই ফেলে দেয়া হয়। সার্কুলার ইকোনমির মাধ্যমে এই বর্জ্য পুনঃব্যবহার করলে বছরে ৮০ কোটি মার্কিন ডলার সাশ্রয় সম্ভব। প্রতি বছর ১০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে মাত্র ৪০% পুনঃব্যবহার করা হয়। ল্যান্ডফিল এবং নদীতে পতিত প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশ এবং প্রাণিকুলের ওপর মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করে। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০২১ অনুযায়ী ইলেক্ট্রনিক বর্জ্যরে পুনঃব্যবহারে জোর দেয়া হয়েছে। প্লাস্টিক পুনঃব্যবহার ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাত বাড়ানোর লক্ষ্যে ১০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। টেক্সটাইল, প্লাস্টিক এবং কৃষি বর্র্জ্য পুনঃব্যবহার করে বছরে প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাশ্রয় করা সম্ভব। নদীদূষণ এবং কার্বন নিঃসরণ প্রায় ২০-২৫% হ্রাস সম্ভব। সার্কুলার ইকোনমি বিশেষভাবে, এসডিজি ৬, ৭, ৮, ৯, ১১, ১২, ১৩, ১৪, এবং ১৫ এর সঙ্গে সম্পর্কিত। কারণ এটি টেকসই উন্নয়নের একটি কেন্দ্রবিন্দু, যা পরিবেশ, অর্থনীতি এবং সমাজের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সার্কুলার ইকোনমির আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তিÑ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঈরৎপঁষধৎ ঊপড়হড়সু অপঃরড়হ চষধহ (২০২০): সার্কুলার ইকোনমি নীতি বাস্তবায়নের একটি ব্যাপক কাঠামো। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি নির্দেশিকা। একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার কমানোর উদ্যোগ।
চীন: ঈরৎপঁষধৎ ঊপড়হড়সু চৎড়সড়ঃরড়হ খধি (২০০৯): টেকসই উন্নয়ন এবং সম্পদ পুনর্ব্যবহারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়।
জাপান: ইধংরপ অপঃ ভড়ৎ ঊংঃধনষরংযরহম ধ ঝড়ঁহফ গধঃবৎরধষ-ঈুপষব ঝড়পরবঃু (২০০০): পুনর্ব্যবহারযোগ্য সম্পদের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা।
ভারত: ঊ-ডধংঃব গধহধমবসবহঃ জঁষবং (২০১৬): ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব। চষধংঃরপ ডধংঃব গধহধমবসবহঃ জঁষবং (২০১৬): প্লাস্টিক বর্জ্য হ্রাস ও পুনঃব্যবহার। বাংলাদেশের আইন ও নীতিমালা: পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আইন। প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা নীতি: একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক হ্রাসে পদক্ষেপ। সার্কুলার ইকোনমি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জসমূহÑ আইন ও নীতিমালার অভাব বা দুর্বলতা, পুনর্ব্যবহারের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা, জনসচেতনতার অভাব, বেসরকারি খাতের সীমিত অংশগ্রহণ। সার্কুলার ইকোনমি পরিবেশ সুরক্ষায় একটি টেকসই ও কার্যকর মডেল, যা আমাদের লিনিয়ার ইকোনমির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করার পথ দেখায়। বর্তমান বিশ্বে প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তন, এবং বর্জ্য সমস্যা এক চরম সংকট সৃষ্টি করেছে। এ অবস্থায়, সার্কুলার ইকোনমি প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধি করে, পুনঃব্যবহারকে উৎসাহিত করে, এবং বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তরিত করার সুযোগ সৃষ্টি করে। এই মডেল শুধু পরিবেশ সুরক্ষায় অবদান রাখে না, বরং অর্থনীতিকেও আরও টেকসই করে তোলে। শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ভোক্তাদের ব্যবহারের পদ্ধতি পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে সচেতনতা ও উদ্ভাবনের সুযোগ তৈরি হয়। এটি নতুন ব্যবসায়িক সুযোগ সৃষ্টি, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং সামাজিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে পারে। সার্কুলার ইকোনমি বাস্তবায়নের জন্য সরকার, শিল্প প্রতিষ্ঠান, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। শিক্ষা ও সচেতনতার মাধ্যমে মানুষকে উৎসাহিত করতে হবে টেকসই পণ্য ব্যবহারে। পাশাপাশি, পরিবেশবান্ধব নীতিমালা, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, এবং পুনর্ব্যবহারের অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে এই মডেল কার্যকর করা সম্ভব। পরিবেশ, অর্থনীতি, এবং সমাজের মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে সার্কুলার ইকোনমি একটি সবুজ, পরিচ্ছন্ন ও টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। এই মডেলের সফল বাস্তবায়ন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর এবং সমৃদ্ধ জীবন নিশ্চিত করবে এটাই সবার প্রত্যাশা।
[লেখক : শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ^বিদ্যালয়]
অমৃত চিছাম
শনিবার, ০৪ জানুয়ারী ২০২৫
বর্তমান বিশ্বে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি, শিল্পায়ন, এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অতিরিক্ত ব্যবহার পরিবেশকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ১১ জুলাই জাতিসংঘ প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক জনসংখ্যা সম্ভাবনা-২০২৪’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যা ৮২০ কোটি। আসামি ৬০ বছরে এ সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। ২০৮৪ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ১ হাজার ৩০ কোটি। আর শতক শেষ হওয়ার আগেই জনসংখ্যা নেমে আসবে ১ হাজার ২০ কোটিতে। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন চাহিদা মেটাতে পৃথিবীর সব দেশকে নানা ধরনের সমস্যা সম্মুখীন হতে হবে। কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিল্পায়ন ও প্রাকৃতিক সম্পদের অতিরিক্ত ব্যবহার প্রকৃতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে, যা আমাদের জন্য সত্যি উদ্বেগের বিষয়। এই প্রেক্ষাপটে, সার্কুলার ইকোনমি একটি টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক মডেল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এটি প্রথাগত লিনিয়ার ইকোনমির (উৎপাদন-ব্যবহার-নিক্ষেপ) বিকল্প হিসেবে প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় কমিয়ে পরিবেশ সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়। ২০১০ সাল থেকে সার্কুলার ইকোনমি একটি গ্লোবাল মডেল হিসেবে কাজ করছে। এটি পরিবেশ সুরক্ষা, কার্বন নিঃসরণ কমানো, এবং নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের জন্য কার্যকরী হিসেবে স্বীকৃত। সার্কুলার ইকোনমির মূল উদ্দেশ্য হলো উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে বর্জ্য নির্মূল করা। বর্জ্যরে পুনঃব্যবহার এবং পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে এটি ডাম্পিং গ্রাউন্ড এবং ল্যান্ডফিল থেকে বর্জ্যরে চাপ কমায়। প্রথাগত লিনিয়ার ইকোনমি পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার মাত্রাতিরিক্ত। তবে সার্কুলার ইকোনমি সম্পদ পুনর্ব্যবহার করে প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ নিশ্চিত করে। পুনঃব্যবহারযোগ্য পণ্য এবং পুনঃপ্রক্রিয়াজাত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সার্কুলার ইকোনমি গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে সহায়তা করে, যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সার্কুলার ইকোনমি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় টেকসই প্রযুক্তির ব্যবহার এবং ভোক্তাদের মধ্যে পরিবেশবান্ধব আচরণ গড়ে তুলতে সহায়তা করে। বর্জ্য পানিতে নিক্ষেপ করার পরিবর্তে পুনঃব্যবহারের মাধ্যমে সার্কুলার ইকোনমি জলদূষণ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। কাঁচামাল সংগ্রহের সময় প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান ধ্বংস হয়। পুনঃব্যবহার ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাত প্রযুক্তির ব্যবহারে বনভূমি, জলাশয় এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সহজ হয়। পণ্যের দীর্ঘস্থায়িত্ব এবং পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে উৎপাদন খরচ হ্রাস করে সার্কুলার ইকোনমি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনে। এর ফলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, বিশেষত পুনর্ব্যবহার ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাত খাতে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর প্রায় ১০০ বিলিয়ন টন প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে মাত্র ৮.৬% পুনঃব্যবহার করা হয় (সার্কুলারিটি গ্যাপ রিপোর্ট ২০২৩)। লিনিয়ার অর্থনীতি বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণের প্রায় ৪৫% জন্য দায়ী। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সার্কুলার ইকোনমিকে তাদের পরিবেশ নীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছে। ইইউ-এর সার্কুলার ইকোনমি অ্যাকশন প্ল্যান অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ এবং পুনঃব্যবহারের হার দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্লাস্টিক প্যাকেজিংয়ের ৫০% পুনঃব্যবহার নিশ্চিত করা। চীন তাদের জাতীয় সার্কুলার ইকোনমি উন্নয়ন পরিকল্পনার মাধ্যমে পুনঃব্যবহারের হার প্রায় ২৫% বৃদ্ধি করেছে। নেদারল্যান্ডস ২০৫০ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ সার্কুলার ইকোনমিতে রূপান্তরের লক্ষ্য। জাপান ২০১৫ সাল থেকে রিসাইক্লিংয়ের হার প্রায় ২০% বৃদ্ধি করেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে সার্কুলার ইকোনমি বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার প্রায় ২৮% হ্রাস করতে পারে, যা বৈশ্বিক জিডিপিতে প্রায় ৪.৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার সংযোজন করতে পারে। বাংলাদেশে প্রতি বছর উৎপন্ন কঠিন বর্জ্য প্রায় ২৭.৪ মিলিয়ন টন। এর মধ্যে শুধু ৫-১০% পুনঃব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে প্লাস্টিক, ই-বর্জ্য, এবং টেক্সটাইল বর্জ্যরে পুনঃব্যবহার হার অত্যন্ত কম। বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাকশিল্প রপ্তানিকারক দেশ। প্রতি বছর প্রায় ৪ লাখ টন বর্জ্য কাপড় পুনঃব্যবহার না করেই ফেলে দেয়া হয়। সার্কুলার ইকোনমির মাধ্যমে এই বর্জ্য পুনঃব্যবহার করলে বছরে ৮০ কোটি মার্কিন ডলার সাশ্রয় সম্ভব। প্রতি বছর ১০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে মাত্র ৪০% পুনঃব্যবহার করা হয়। ল্যান্ডফিল এবং নদীতে পতিত প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশ এবং প্রাণিকুলের ওপর মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করে। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০২১ অনুযায়ী ইলেক্ট্রনিক বর্জ্যরে পুনঃব্যবহারে জোর দেয়া হয়েছে। প্লাস্টিক পুনঃব্যবহার ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাত বাড়ানোর লক্ষ্যে ১০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। টেক্সটাইল, প্লাস্টিক এবং কৃষি বর্র্জ্য পুনঃব্যবহার করে বছরে প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাশ্রয় করা সম্ভব। নদীদূষণ এবং কার্বন নিঃসরণ প্রায় ২০-২৫% হ্রাস সম্ভব। সার্কুলার ইকোনমি বিশেষভাবে, এসডিজি ৬, ৭, ৮, ৯, ১১, ১২, ১৩, ১৪, এবং ১৫ এর সঙ্গে সম্পর্কিত। কারণ এটি টেকসই উন্নয়নের একটি কেন্দ্রবিন্দু, যা পরিবেশ, অর্থনীতি এবং সমাজের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সার্কুলার ইকোনমির আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তিÑ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঈরৎপঁষধৎ ঊপড়হড়সু অপঃরড়হ চষধহ (২০২০): সার্কুলার ইকোনমি নীতি বাস্তবায়নের একটি ব্যাপক কাঠামো। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি নির্দেশিকা। একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার কমানোর উদ্যোগ।
চীন: ঈরৎপঁষধৎ ঊপড়হড়সু চৎড়সড়ঃরড়হ খধি (২০০৯): টেকসই উন্নয়ন এবং সম্পদ পুনর্ব্যবহারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়।
জাপান: ইধংরপ অপঃ ভড়ৎ ঊংঃধনষরংযরহম ধ ঝড়ঁহফ গধঃবৎরধষ-ঈুপষব ঝড়পরবঃু (২০০০): পুনর্ব্যবহারযোগ্য সম্পদের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা।
ভারত: ঊ-ডধংঃব গধহধমবসবহঃ জঁষবং (২০১৬): ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব। চষধংঃরপ ডধংঃব গধহধমবসবহঃ জঁষবং (২০১৬): প্লাস্টিক বর্জ্য হ্রাস ও পুনঃব্যবহার। বাংলাদেশের আইন ও নীতিমালা: পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আইন। প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা নীতি: একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক হ্রাসে পদক্ষেপ। সার্কুলার ইকোনমি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জসমূহÑ আইন ও নীতিমালার অভাব বা দুর্বলতা, পুনর্ব্যবহারের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা, জনসচেতনতার অভাব, বেসরকারি খাতের সীমিত অংশগ্রহণ। সার্কুলার ইকোনমি পরিবেশ সুরক্ষায় একটি টেকসই ও কার্যকর মডেল, যা আমাদের লিনিয়ার ইকোনমির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করার পথ দেখায়। বর্তমান বিশ্বে প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তন, এবং বর্জ্য সমস্যা এক চরম সংকট সৃষ্টি করেছে। এ অবস্থায়, সার্কুলার ইকোনমি প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধি করে, পুনঃব্যবহারকে উৎসাহিত করে, এবং বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তরিত করার সুযোগ সৃষ্টি করে। এই মডেল শুধু পরিবেশ সুরক্ষায় অবদান রাখে না, বরং অর্থনীতিকেও আরও টেকসই করে তোলে। শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ভোক্তাদের ব্যবহারের পদ্ধতি পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে সচেতনতা ও উদ্ভাবনের সুযোগ তৈরি হয়। এটি নতুন ব্যবসায়িক সুযোগ সৃষ্টি, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং সামাজিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে পারে। সার্কুলার ইকোনমি বাস্তবায়নের জন্য সরকার, শিল্প প্রতিষ্ঠান, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। শিক্ষা ও সচেতনতার মাধ্যমে মানুষকে উৎসাহিত করতে হবে টেকসই পণ্য ব্যবহারে। পাশাপাশি, পরিবেশবান্ধব নীতিমালা, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, এবং পুনর্ব্যবহারের অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে এই মডেল কার্যকর করা সম্ভব। পরিবেশ, অর্থনীতি, এবং সমাজের মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে সার্কুলার ইকোনমি একটি সবুজ, পরিচ্ছন্ন ও টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। এই মডেলের সফল বাস্তবায়ন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর এবং সমৃদ্ধ জীবন নিশ্চিত করবে এটাই সবার প্রত্যাশা।
[লেখক : শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ^বিদ্যালয়]