alt

উপ-সম্পাদকীয়

প্রকৃতির প্রতি সদয় হতে হবে

কামরুজ্জামান

: সোমবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২৫

মানব সভ্যতার ইতিহাসে মানুষ আজ আধুনিকতার চরম শিখরে আরোহন করছে। মানুষ সমুদ্রের তলদেশ থেকে শুরু করে মহাকাশ পর্যন্ত বিচরণ করছে। আবিষ্কার করছে নতুন নতুন সব বিষয়বস্তু। উন্মোচিত হচ্ছে জ্ঞানের নতুন নতুন দ্বার। মানুষ তার বিভিন্ন কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে নিজেদের পরিবর্তন করছে। উপার্জন করছে অর্থ ও বস্তুগত সম্পদ। জীবনযাপনে আনছে নতুনত্ব ও বিলাসিতার ছাপ।

মানুষ কৃষিকাজে যেমন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে তেমনি শিল্প উৎপাদনে মানুষ বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে। সবই করছে মানুষ নিজেদের খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য, অতি মুনাফার জন্য, ভোগবিলাসের জন্য।

মানুষের ভোগবিলাসী কর্মকা-ের ফলে প্রকৃতি আজ অনেকটাই বিপন্ন। মানুষের অতি আগ্রাসী কর্মকা-ে প্রকৃতি আজ বিপর্যস্ত। মানুষ শুধু প্রকৃতি থেকে নিয়েই যাচ্ছে। প্রকৃতি দিন দিন রিক্ত ধূসর হচ্ছে। প্রকৃতি তার স্বাভাবিক অবস্থা হারিয়ে হয়ে উঠছে বিধ্বংসী ও ধ্বংসাত্মক।

বন্যা-খরা-জলোচ্ছ্বাস এখন ভয়ংকর হচ্ছে। তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। গরম বেশি পড়ছে। বৃষ্টি বেশি হচ্ছে। দাবানলে পুড়ছে পৃথিবীর অনেক অঞ্চল। সামগ্রিকভাবে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে জীবম-লের ওপর। হুমকির মুখে পড়ছে পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য। এসব হচ্ছে প্রকৃতির প্রতি নির্বিচারে অবিচার করার কারণে।

মানুষ প্রকৃতির সব উপদানেরই ক্ষতি করছে। মাটি-পানি-বায়ু-আকাশ-সমুদ্রÑ সব জায়গারই ক্ষত সৃষ্টি করছে। বিনিময়ে খুব কমই পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য ভূমিকা রাখতে পারছে। মানুষের বহুবিধ অর্থনৈতিক কর্মকা-ের ফলেই মূলত এসব হচ্ছে।

বায়ুদূষণের নগরী হিসেবে ঢাকা শহর একাধিকবার নাম এসেছে। বিশ্বের অনেক দেশের প্রধান শহর ও রাজধানী বায়ুদূষণের নগরী হিসেবে পরিচিত। কারণ হচ্ছে কলকারখানার কালো ধোঁয়া বাতাসে মিশে যাওয়া। বিভিন্ন রকমের পরিবহনের কালো ধোঁয়া নির্গত হওয়া, ধুলাবালি বাতাসে মিশে যাওয়া, বিভিন্ন উৎস হতে কার্বন নিঃসরিত হওয়া ইত্যাদি। বায়ুদূষণের এই প্রভাবকগুলো প্রতিনিয়ত কাজ করছে। আর এ প্রতিক্রিয়া দেখা যায় বায়ুম-লেও। বজ্র ঝড় বা বজ্রপাত এ কারণে আগের চেয়ে অনেকগুণ বেড়েছে। সব মিলিয়ে বায়ুদূষণ এখন চরম আকার ধারণ করেছে। পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ন এবং কম বৃক্ষ আচ্ছাদিত অঞ্চল বায়ুদূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি।

শিল্পকারখানার কঠিন ও তরল বর্জ্য এবং আবাসিক বর্জ্য যত্রতত্র ফেলে রাখার কারণে প্রতিনিয়ত মাটি দূষিত হচ্ছে। পলিথিনের অবাধ ব্যবহার মৃত্তিকার ক্ষতি করছে। কৃষি জমি, বাসাবাড়ি আশপাশের পতিত জমি, বনভূমি সবই আজ ময়লা-আবর্জনায় দূষিত হচ্ছে। এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে কৃষি ফসল উৎপাদনে, বনভূমিতে। নষ্ট হচ্ছে মাটির গুণাগুণ ক্ষমতা। মানুষের অসচেতনতা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে মূলত এমনটি হচ্ছে।

মাটিদূষণ যে কারণে হয় পানিদূষণও একই কারণে হয়। তবে পানিদূষণ বেশি হয় তরল বর্জ্যরে কারণে। বিশেষ করে কেমিক্যাল মিশ্রিত তরল বর্জ্য পানিতে মিশে গিয়ে পানি দূষিত হয়। শিল্পের তরল বর্জ্য, বাসাবাড়ির আবাসিক বর্জ্য, জমে থাকা ময়লা-আবর্জনা থেকে সৃষ্ট তরল বর্জ্য, দীর্ঘ জলাবদ্ধতা ইত্যাদি প্রাকৃতিক জলাশয়ের পানিকে দূষিত করে। আমাদের দেশে নদীনালা, খালবিল ও প্রাকৃতিক জলাশয় আজ মারাত্মক দূষণের কবলে রয়েছে। মানুষের খামখেয়ালিপনা ও অসচেতনতাই পানিদূষণের অন্যতম কারণ। পানিদূষণের কারণে প্রকৃতির অন্যান্য উপাদান প্রাণী ও উদ্ভিদ হুমকির সম্মুখীন।

বাংলাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ২৩০টি প্রবাহমান নদনদী রয়েছে। এসব নদনদীগুলোর অধিকাংশের পানি যেমন দূষণের কবলে রয়েছে তেমন নদী দখলের কারণে নাব্য সংকটে পতিত হয়েছে। মানুষের আগ্রাসী কর্মকা-ের ফলেই এমনটি হচ্ছে।

সমুদ্রের দূষণ ঘটছে মানুষের দ্বারা ব্যবহৃত পদার্থ যেমনÑ শিল্প , কৃষি ও আবাসিক বর্জ্য, কণা, শব্দ, অতিরিক্ত কার্বন-ডাই অক্সাইড বা আক্রমণকারী জীবগুলো সমুদ্রে প্রবেশের কারণে। এই বর্জ্যরে সিংহভাগ ৮০% ভূমিভিত্তিক কার্যকলাপ থেকে আসে। যদিও সামুদ্রিক পরিবহন সমুদ্রদূষণে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখে। এটি রাসায়নিক এবং আবর্জনার সংমিশ্রণ, যার বেশির ভাগই আসে স্থল উৎস থেকে এবং ধুয়ে ফেলা হয় বা সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়া হয়। এই দূষণের ফলে পরিবেশ, সমস্ত জীবের স্বাস্থ্য এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কাঠামোর ক্ষতি হয়। বেশির ভাগ ইনপুট ভূমি, নদী, পয়ঃনিষ্কাশন বা বায়ুম-লের মাধ্যমে আসে। লোহা, কার্বনিক অ্যাসিড, নাইট্রোজেন, সিলিকন, সালফার, কীটনাশক বা ধূলিকণা সমুদ্রে গিয়ে মিশে। বায়ুদূষণও একটি অবদানকারী কারণ। দূষণ প্রায়শই অ-পয়েন্ট উৎস যেমনÑ কৃষিপ্রবাহ , বায়ু-প্রবাহিত ধ্বংসাবশেষ এবং ধুলো থেকে আসে। নন-পয়েন্ট উৎসগুলো মূলত নদীর মাধ্যমে সমুদ্রে প্রবেশ করার কারণে হয়। তবে বায়ু দ্বারা প্রবাহিত ধ্বংসাবশেষ এবং ধূলিকণাও একটি ভূমিকা পালন করতে পারে। এর সবই হচ্ছে মূলত মানুষের দ্বারা।

প্লাস্টিক বর্জ্য প্রাকৃতিক পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ। মানুষের অতিরিক্ত প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার ও পলিথিনের কারণে আশপাশের পরিবেশ যেমন নষ্ট হচ্ছে তেমনি করে মৃত্তিকা, প্রাকৃতিক জলাশয়, নদীনালা, খালবিল, সমুদ্র বনজঙ্গল সবই দূষিত হচ্ছে। বিশেষ করে প্লাস্টিক সামগ্রী সমুদ্রদূষণে কার্যকর ভূমিকা রাখছে।

প্রকৃতির প্রতি কেন মানুষের এত শত্রুতা? মানুষ পাহাড় কেটে ফেলছে, বনে আগুন দিচ্ছে, বনের গাছ কেটে ফেলছে, প্রাকৃতিক জলাশয় দূষণ করছে, বায়ুম-ল দূষণ করছে, কার্বন নিঃসরণ বাড়াচ্ছে। মানুষ এসব করছে মূলত নিজেদের স্বার্থের জন্য। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে পৃথিবীকে সুন্দর ও বাসযোগ্য রাখতে হলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা প্রয়োজন।

প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য ভূ-রাজনৈতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রয়োজন ধনী-গরিব বৈষম্য কমিয়ে আনা। বনে আগুন দেয়া ও পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে। সবুজ শিল্পায়ন গড়ে তুলতে হবে। আধুনিক ও নিরাপদ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনতে হবে। বেশি করে গাছ লাগাতে হবে। প্রাকৃতিক বনায়ন বৃদ্ধি করতে হবে। মোটকথা প্রকৃতির প্রতি আমাদের সদয় হতে হবে। বসবাসযোগ্য পৃথিবীর জন্য প্রকৃতিকে আমাদেরই নিরাপদ রাখতে হবে।

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, গাজীপুর]

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

কুষ্ঠ ও বৈষম্য : মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি অবহেলিত অধ্যায়

ছবি

প্রান্তজনের বাংলাদেশ

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

সাইবার নিরাপত্তা : অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে আমাদের প্রস্তুতি

ছবি

বাহান্নর গর্ভে জন্ম নেয়া এক ঝড়ের পাখি

প্রবাসী শ্রমিক : অর্থের যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের সহযোদ্ধা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

ভোগবাদের বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিসের জলবায়ু বার্তা

রম্যগদ্য : হাসি নিষেধ...

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : দাবি ও সমাধানের পথ

সিরিয়ার পতন কিভাবে আমেরিকার স্বার্থকে হুমকিতে ফেলছে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধানে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

প্রকৃতির প্রতি সদয় হতে হবে

কামরুজ্জামান

সোমবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২৫

মানব সভ্যতার ইতিহাসে মানুষ আজ আধুনিকতার চরম শিখরে আরোহন করছে। মানুষ সমুদ্রের তলদেশ থেকে শুরু করে মহাকাশ পর্যন্ত বিচরণ করছে। আবিষ্কার করছে নতুন নতুন সব বিষয়বস্তু। উন্মোচিত হচ্ছে জ্ঞানের নতুন নতুন দ্বার। মানুষ তার বিভিন্ন কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে নিজেদের পরিবর্তন করছে। উপার্জন করছে অর্থ ও বস্তুগত সম্পদ। জীবনযাপনে আনছে নতুনত্ব ও বিলাসিতার ছাপ।

মানুষ কৃষিকাজে যেমন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে তেমনি শিল্প উৎপাদনে মানুষ বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে। সবই করছে মানুষ নিজেদের খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য, অতি মুনাফার জন্য, ভোগবিলাসের জন্য।

মানুষের ভোগবিলাসী কর্মকা-ের ফলে প্রকৃতি আজ অনেকটাই বিপন্ন। মানুষের অতি আগ্রাসী কর্মকা-ে প্রকৃতি আজ বিপর্যস্ত। মানুষ শুধু প্রকৃতি থেকে নিয়েই যাচ্ছে। প্রকৃতি দিন দিন রিক্ত ধূসর হচ্ছে। প্রকৃতি তার স্বাভাবিক অবস্থা হারিয়ে হয়ে উঠছে বিধ্বংসী ও ধ্বংসাত্মক।

বন্যা-খরা-জলোচ্ছ্বাস এখন ভয়ংকর হচ্ছে। তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। গরম বেশি পড়ছে। বৃষ্টি বেশি হচ্ছে। দাবানলে পুড়ছে পৃথিবীর অনেক অঞ্চল। সামগ্রিকভাবে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে জীবম-লের ওপর। হুমকির মুখে পড়ছে পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য। এসব হচ্ছে প্রকৃতির প্রতি নির্বিচারে অবিচার করার কারণে।

মানুষ প্রকৃতির সব উপদানেরই ক্ষতি করছে। মাটি-পানি-বায়ু-আকাশ-সমুদ্রÑ সব জায়গারই ক্ষত সৃষ্টি করছে। বিনিময়ে খুব কমই পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য ভূমিকা রাখতে পারছে। মানুষের বহুবিধ অর্থনৈতিক কর্মকা-ের ফলেই মূলত এসব হচ্ছে।

বায়ুদূষণের নগরী হিসেবে ঢাকা শহর একাধিকবার নাম এসেছে। বিশ্বের অনেক দেশের প্রধান শহর ও রাজধানী বায়ুদূষণের নগরী হিসেবে পরিচিত। কারণ হচ্ছে কলকারখানার কালো ধোঁয়া বাতাসে মিশে যাওয়া। বিভিন্ন রকমের পরিবহনের কালো ধোঁয়া নির্গত হওয়া, ধুলাবালি বাতাসে মিশে যাওয়া, বিভিন্ন উৎস হতে কার্বন নিঃসরিত হওয়া ইত্যাদি। বায়ুদূষণের এই প্রভাবকগুলো প্রতিনিয়ত কাজ করছে। আর এ প্রতিক্রিয়া দেখা যায় বায়ুম-লেও। বজ্র ঝড় বা বজ্রপাত এ কারণে আগের চেয়ে অনেকগুণ বেড়েছে। সব মিলিয়ে বায়ুদূষণ এখন চরম আকার ধারণ করেছে। পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ন এবং কম বৃক্ষ আচ্ছাদিত অঞ্চল বায়ুদূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি।

শিল্পকারখানার কঠিন ও তরল বর্জ্য এবং আবাসিক বর্জ্য যত্রতত্র ফেলে রাখার কারণে প্রতিনিয়ত মাটি দূষিত হচ্ছে। পলিথিনের অবাধ ব্যবহার মৃত্তিকার ক্ষতি করছে। কৃষি জমি, বাসাবাড়ি আশপাশের পতিত জমি, বনভূমি সবই আজ ময়লা-আবর্জনায় দূষিত হচ্ছে। এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে কৃষি ফসল উৎপাদনে, বনভূমিতে। নষ্ট হচ্ছে মাটির গুণাগুণ ক্ষমতা। মানুষের অসচেতনতা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে মূলত এমনটি হচ্ছে।

মাটিদূষণ যে কারণে হয় পানিদূষণও একই কারণে হয়। তবে পানিদূষণ বেশি হয় তরল বর্জ্যরে কারণে। বিশেষ করে কেমিক্যাল মিশ্রিত তরল বর্জ্য পানিতে মিশে গিয়ে পানি দূষিত হয়। শিল্পের তরল বর্জ্য, বাসাবাড়ির আবাসিক বর্জ্য, জমে থাকা ময়লা-আবর্জনা থেকে সৃষ্ট তরল বর্জ্য, দীর্ঘ জলাবদ্ধতা ইত্যাদি প্রাকৃতিক জলাশয়ের পানিকে দূষিত করে। আমাদের দেশে নদীনালা, খালবিল ও প্রাকৃতিক জলাশয় আজ মারাত্মক দূষণের কবলে রয়েছে। মানুষের খামখেয়ালিপনা ও অসচেতনতাই পানিদূষণের অন্যতম কারণ। পানিদূষণের কারণে প্রকৃতির অন্যান্য উপাদান প্রাণী ও উদ্ভিদ হুমকির সম্মুখীন।

বাংলাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ২৩০টি প্রবাহমান নদনদী রয়েছে। এসব নদনদীগুলোর অধিকাংশের পানি যেমন দূষণের কবলে রয়েছে তেমন নদী দখলের কারণে নাব্য সংকটে পতিত হয়েছে। মানুষের আগ্রাসী কর্মকা-ের ফলেই এমনটি হচ্ছে।

সমুদ্রের দূষণ ঘটছে মানুষের দ্বারা ব্যবহৃত পদার্থ যেমনÑ শিল্প , কৃষি ও আবাসিক বর্জ্য, কণা, শব্দ, অতিরিক্ত কার্বন-ডাই অক্সাইড বা আক্রমণকারী জীবগুলো সমুদ্রে প্রবেশের কারণে। এই বর্জ্যরে সিংহভাগ ৮০% ভূমিভিত্তিক কার্যকলাপ থেকে আসে। যদিও সামুদ্রিক পরিবহন সমুদ্রদূষণে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখে। এটি রাসায়নিক এবং আবর্জনার সংমিশ্রণ, যার বেশির ভাগই আসে স্থল উৎস থেকে এবং ধুয়ে ফেলা হয় বা সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়া হয়। এই দূষণের ফলে পরিবেশ, সমস্ত জীবের স্বাস্থ্য এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কাঠামোর ক্ষতি হয়। বেশির ভাগ ইনপুট ভূমি, নদী, পয়ঃনিষ্কাশন বা বায়ুম-লের মাধ্যমে আসে। লোহা, কার্বনিক অ্যাসিড, নাইট্রোজেন, সিলিকন, সালফার, কীটনাশক বা ধূলিকণা সমুদ্রে গিয়ে মিশে। বায়ুদূষণও একটি অবদানকারী কারণ। দূষণ প্রায়শই অ-পয়েন্ট উৎস যেমনÑ কৃষিপ্রবাহ , বায়ু-প্রবাহিত ধ্বংসাবশেষ এবং ধুলো থেকে আসে। নন-পয়েন্ট উৎসগুলো মূলত নদীর মাধ্যমে সমুদ্রে প্রবেশ করার কারণে হয়। তবে বায়ু দ্বারা প্রবাহিত ধ্বংসাবশেষ এবং ধূলিকণাও একটি ভূমিকা পালন করতে পারে। এর সবই হচ্ছে মূলত মানুষের দ্বারা।

প্লাস্টিক বর্জ্য প্রাকৃতিক পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ। মানুষের অতিরিক্ত প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার ও পলিথিনের কারণে আশপাশের পরিবেশ যেমন নষ্ট হচ্ছে তেমনি করে মৃত্তিকা, প্রাকৃতিক জলাশয়, নদীনালা, খালবিল, সমুদ্র বনজঙ্গল সবই দূষিত হচ্ছে। বিশেষ করে প্লাস্টিক সামগ্রী সমুদ্রদূষণে কার্যকর ভূমিকা রাখছে।

প্রকৃতির প্রতি কেন মানুষের এত শত্রুতা? মানুষ পাহাড় কেটে ফেলছে, বনে আগুন দিচ্ছে, বনের গাছ কেটে ফেলছে, প্রাকৃতিক জলাশয় দূষণ করছে, বায়ুম-ল দূষণ করছে, কার্বন নিঃসরণ বাড়াচ্ছে। মানুষ এসব করছে মূলত নিজেদের স্বার্থের জন্য। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে পৃথিবীকে সুন্দর ও বাসযোগ্য রাখতে হলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা প্রয়োজন।

প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য ভূ-রাজনৈতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রয়োজন ধনী-গরিব বৈষম্য কমিয়ে আনা। বনে আগুন দেয়া ও পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে। সবুজ শিল্পায়ন গড়ে তুলতে হবে। আধুনিক ও নিরাপদ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনতে হবে। বেশি করে গাছ লাগাতে হবে। প্রাকৃতিক বনায়ন বৃদ্ধি করতে হবে। মোটকথা প্রকৃতির প্রতি আমাদের সদয় হতে হবে। বসবাসযোগ্য পৃথিবীর জন্য প্রকৃতিকে আমাদেরই নিরাপদ রাখতে হবে।

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, গাজীপুর]

back to top