ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
বাংলাদেশে জেন জেড একটি বৈচিত্র্যময় প্রজন্ম, যা বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে সংজ্ঞায়িত। তারাই প্রথম প্রজন্ম যারা ইন্টারনেটকে জীবনের অপরিহার্য অংশ হিসেবে গ্রহণ করে বেড়ে উঠেছে, যা তাদের প্রযুক্তি-সচেতন এবং বৈশ্বিকভাবে সংযুক্ত করেছে। একই সঙ্গে সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক ঐতিহ্যের সঙ্গে তাদের গভীরভাবে সংযুক্তি আধুনিকতা এবং ঐতিহ্যের একটি অনন্য মিশ্রণ সৃষ্টি করেছে। এই দ্বৈত পরিচয় তাদের বাংলাদেশি সমাজের প্রথাগত প্রত্যাশা এবং বর্তমান বৈশ্বিক ও ডিজিটাল বিশ্বের সঙ্গে সমন্বয় হতে সক্ষম করে।
বাংলাদেশে জেন জেড একটি শক্তিশালী লক্ষ্যবোধ এবং অর্থবহ পরিবর্তন দেখার আকাক্সক্ষা দ্বারা চিহ্নিত। তারা বর্তমান অবস্থায় সন্তুষ্ট নয়, বরং বাংলাদেশকে কোন অবস্থানে উন্নীত করা যেতে পারে তার একটি ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা চালিত। এই প্রজন্ম সত্যনিষ্ঠ এবং স্বচ্ছতাকে মূল্য দেয় এবং তারা দ্রুতই কপটতা ও অবিচারকে চ্যালেঞ্জ করে। বাংলাদেশে জেন জেড-এর আকাক্সক্ষার কেন্দ্রে রয়েছে একটি ন্যায়সঙ্গত সমাজ প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা। তারা একটি সরকার চায়, যা জবাবদিহিতামূলক, স্বচ্ছ এবং জনগণের চাহিদার প্রতি ক্রিয়াশীল। বহুদিন ধরে দেশের বিপদ হিসেবে পরিচিত দুর্নীতি তারা নির্মূল করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তারা এমন নেতাদের চায় যারা কেবল ব্যক্তিগত লাভের জন্য ক্ষমতায় নয়, বরং সত্যিকারের জনগণের জীবন উন্নত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শিক্ষা জেন জেড-এর আরেকটি মূল অগ্রাধিকার। তারা জ্ঞানের শক্তি বোঝে এবং একটি আধুনিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক তথা সবার জন্য সমান অধিকার বাস্তবায়নমূলক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়। তারা চায় শিক্ষা শুধু চাকরির জন্য নয়, বরং জীবনের জন্য উপযোগীÑ যা তাদেরকে পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে মানিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় সক্ষমতা প্রদান করবে। অর্থনৈতিক সুযোগও তাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় উপরের দিকে রয়েছে। বাংলাদেশের জেন জেড এমন একটি দেশ চায় যেখানে সবাই সফল হওয়ার সুযোগ পাবে, যেখানে উদ্যোক্তা কার্যক্রম উৎসাহিত হবে এবং কঠোর পরিশ্রম ও উদ্ভাবন পুরস্কৃত হবে। তারা স্বজনপ্রীতি এবং পক্ষপাতিত্বের অবসান চায়, যা অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও উদ্ভাবনকে প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত করে চলেছে। এর বিপরীতে তারা একটি মেধাভিত্তিক সিস্টেমের জন্য আহ্বান জানায়। এছাড়া এই প্রজন্ম পরিবেশ নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
বাংলাদেশে জেন জেড তাদের ধারণাগুলোকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হওয়ার জন্য পরিচিত। তারা যখন কিছু অর্জন করতে চায়, তখন তারা পদ্ধতিগত ও কৌশলগত হয়। তাদের কার্যনির্বাহী পরিকল্পনাগুলো প্রায়ই ডিজিটাল টুল ও সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারকে অন্তর্ভুক্ত করেÑ যা তাদের বার্তা বাড়াতে এবং বৃহত্তর শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, যখন তারা একটি প্রতিবাদ সংগঠিত করে বা কোনোকিছুতে সমর্থন জানায়, তখন জেন জেড সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে। তারা ডিজিটাল ক্যাম্পেইন তৈরি করে, হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে বার্তা ছড়িয়ে দেয়Ñ এমনকি প্রভাবশালীদের সঙ্গেও যুক্ত হয় গুরুত্ব বাড়াতে। এই পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে; যেখানে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে তারা প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। তারা সহযোগিতাকে মূল্য দেয়। জেন জেড দলবদ্ধভাবে কাজ করতে বা সমমনা ব্যক্তি ও সংগঠনের সঙ্গে জোট গঠনে আগ্রহী। তারা যৌথ প্রচেষ্টার শক্তি বোঝে এবং প্রায়ই তাদের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সম্পদ সংগ্রহ, ধারণা ভাগাভাগি এবং একে অপরের উদ্যোগকে সমর্থন করে। তাদের কার্যনির্বাহী শৈলীর আরেকটি দিক হলো ঝুঁকি নেয়ার ইচ্ছা। জেন জেড নতুন কিছু চেষ্টা করতে বা প্রচলিত নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করতে ভয় পায় না। এই উদ্ভাবনী মনোভাব এবং ডিজিটাল দক্ষতার সমন্বয় তাদের লক্ষ্য অর্জনে অত্যন্ত কার্যকরী করে তুলেছে। বাংলাদেশে জেন জেড এর অন্যতম বড় শক্তি হলো দ্রুত সংগঠিত ও সক্রিয় করার ক্ষমতা। তারা সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্যান্য ডিজিটাল টুলের ব্যবহার করে নেটওয়ার্ক তৈরি, তথ্য ভাগাভাগি এবং এমন স্কেলে কার্যক্রম সমন্বয় করে যা আগে কল্পনাতীত ছিল। এই ক্ষমতা তাদের শক্তিশালী গ্রাসরুট আন্দোলন তৈরি করতে সক্ষম করেছে, যা পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাদের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি আরেকটি শক্তি। বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত থাকায় তারা অন্যান্য দেশের সাফল্য ও ব্যর্থতা থেকে শিখতে পারছে এবং সেই শিক্ষা নিজস্ব প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ করছে। এই বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি তাদেরকে আরও সহানুভূতিশীল এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের আন্তঃসংযোগ সম্পর্কে সচেতন করে তুলছে। জেন জেড উদ্ভাবকদের প্রজন্ম। তারা প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে এবং নতুন উপায়ে চিন্তা করতে ভয় পায় না। সমস্যার সমাধানে তাদের উদ্ভাবনী মনোভাব স্পষ্ট; যেখানে তারা সর্বদা নতুন ও উন্নততর পদ্ধতি খোঁজে। তবে যে কোনো প্রজন্মের মতো, বাংলাদেশের জেন জেড-এরও কিছু দুর্বলতা রয়েছে। তাদের একটি চ্যালেঞ্জ হলো হতাশ হওয়ার আশঙ্কা। তাদের উচ্চ-প্রত্যাশা ও পরিবর্তনের প্রতি অস্থিরতা কখনো কখনো হতাশায় পরিণত হতে পারেÑ যখন অগ্রগতি তাদের প্রত্যাশার চেয়ে ধীর হয়। এই হতাশা যদি সঠিকভাবে পরিচালিত না হয়, তবে তা তাদের প্রচেষ্টাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো মেরুকরণের
ঝুঁকি। তাদের সক্রিয়তা একটি শক্তি হলেও, এটি সমাজের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে যখন তাদের মতামত আরও রক্ষণশীল উপাদানের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া আশঙ্কা থাকে। এই বিভাজনগুলো নেভিগেট করে একটি সংহত আন্দোলন বজায় রাখা এই প্রজন্মের জন্য একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে।
যদিও জেন জেড অত্যন্ত শিক্ষিত ও তথ্যসমৃদ্ধ, তারা যেসব বিষয় সমাধান করতে চায় সেগুলোর জটিলতা তারা সহজেই অবমূল্যায়নও করতে পারে। আদর্শবাদ ও বাস্তবতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; কারণ তারা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গঠনে বড় ভূমিকা নেবে আগামীতে। তাদের উদ্যম ও চালনা প্রশংসনীয়, তবে নিঃসন্দেহে পরিবর্তনের জন্য ধৈর্য ও বাস্তববাদ বজায় রাখা প্রয়োজন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলো কেবল শুরু হয়েছে। জেন জেড দেখিয়েছে যে তারা বাস্তব পরিবর্তন আনার সক্ষমতা রাখে এবং ভবিষ্যতে তারা আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার ক্ষেত্রে আশাবাদী। এই প্রজন্মের ক্ষমতা রয়েছে এমন একটি বাংলাদেশ তৈরি করারÑ যেখানে ন্যায়, সমতা এবং অগ্রগতি নিশ্চিত হবে। তবে, তাদের সাফল্য নির্ভর করবে তাদের ঐক্যবদ্ধ থাকার ক্ষমতা, গতিবেগ বজায় রাখা এবং তাদের সাফল্য ও ব্যর্থতা থেকে নিরন্তর শিখে-চলার ওপর। মনে করা হচ্ছে তারা সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হবে তা মোকাবিলায় তারা শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসবে; বিশ্ব তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে এবং তাদের কর্মসূচি আগামী প্রজন্মের জন্য বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। বাংলাদেশে জেন জেড কেবল একটি প্রজন্ম নয়; তারা একটি আন্দোলন, একটি পরিবর্তনের শক্তিÑ যা ইতোমধ্যে এই জাতিকে পুনর্গঠন করতে শুরু করেছে। তাদের গল্প এখনো লেখা হচ্ছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি আকর্ষণীয় অধ্যায় সৃষ্টি হওয়ার অভিপ্রায়কে ব্যক্ত করবে। আগের জেনারেশনগুলোতে সামাজিকতা এবং অর্থ-সম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্ব পেত নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর পরিম-ল। এমনকি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা বেড়াজালে আবদ্ধ
থাকত মিশ্র সংস্কৃতি বা সংস্কৃতির সহযোগ।
সেন্টিনিয়ালরা সেখানে প্রতিটি পর্যায়কে দেখে স্কুলের ক্লাস ঘরের মতো। প্রাথমিক পাঠদানের সহশিক্ষার সাধারণ পরিবেশে শ্রেণী, ধর্ম, পেশানির্বিশেষে সবার সন্তান পাশাপাশি বসে ক্লাস করতে পারে। এখানে আসে না কোনও সার্বভৌমত্ব বা পারস্পরিক চুক্তির বিষয়। উন্নত শিক্ষা, অর্থনীতি, এবং শিল্প ক্ষেত্রে জেড প্রজন্মের চিন্তাধারাও ঠিক একই রকম। অবশ্য সময়ের সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতিতে যথেষ্ট পরিবর্তন এবং নানা স্থানে যুদ্ধের ফলে ব্যবসায়িক অবনতির এখানে প্রভাব রেখেছে। ওয়াই জেনারেশন যেখানে স্বর্ণ সঞ্চয় ও বাড়ি কেনাতে অর্থ বিনিয়োগে ব্যস্ত, সেখানে জেন জি অভ্যস্ত হয়েছে ক্রিপ্টো-কারেন্সিতে। এখানে কখনও মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়নি ভিন্ন দেশীয় প্রযুক্তি উপেক্ষা করার ব্যাপারটি। উচ্চশিক্ষা লাভে ঘন ঘন অভিবাসনের কারণে বেড়েছে দুই ততোধিক সংস্কৃতির প্রতিনিধিদের একই ছাদের নিচে বসবাসের সুযোগ।
জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে দেশের ভেতরেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কো-লিভিং এবং কো-ওয়ার্কিং স্পেস। দেশে ও বিদেশে এই পরিবর্তনগুলোর মধ্য দিয়ে আই প্রজন্মরা নতুন অর্থ নির্ধারণ করেছে সামাজিকতার। এই বিবর্তন একটি কর্মদক্ষ ও বাজেটবান্ধব ব্যবস্থা তৈরি করলেও বিলুপ্তির মুখে পড়েছে সমাজের ঐতিহ্যবাহী রীতি-নীতিগুলো।
[লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]
ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২৫
বাংলাদেশে জেন জেড একটি বৈচিত্র্যময় প্রজন্ম, যা বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে সংজ্ঞায়িত। তারাই প্রথম প্রজন্ম যারা ইন্টারনেটকে জীবনের অপরিহার্য অংশ হিসেবে গ্রহণ করে বেড়ে উঠেছে, যা তাদের প্রযুক্তি-সচেতন এবং বৈশ্বিকভাবে সংযুক্ত করেছে। একই সঙ্গে সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক ঐতিহ্যের সঙ্গে তাদের গভীরভাবে সংযুক্তি আধুনিকতা এবং ঐতিহ্যের একটি অনন্য মিশ্রণ সৃষ্টি করেছে। এই দ্বৈত পরিচয় তাদের বাংলাদেশি সমাজের প্রথাগত প্রত্যাশা এবং বর্তমান বৈশ্বিক ও ডিজিটাল বিশ্বের সঙ্গে সমন্বয় হতে সক্ষম করে।
বাংলাদেশে জেন জেড একটি শক্তিশালী লক্ষ্যবোধ এবং অর্থবহ পরিবর্তন দেখার আকাক্সক্ষা দ্বারা চিহ্নিত। তারা বর্তমান অবস্থায় সন্তুষ্ট নয়, বরং বাংলাদেশকে কোন অবস্থানে উন্নীত করা যেতে পারে তার একটি ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা চালিত। এই প্রজন্ম সত্যনিষ্ঠ এবং স্বচ্ছতাকে মূল্য দেয় এবং তারা দ্রুতই কপটতা ও অবিচারকে চ্যালেঞ্জ করে। বাংলাদেশে জেন জেড-এর আকাক্সক্ষার কেন্দ্রে রয়েছে একটি ন্যায়সঙ্গত সমাজ প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা। তারা একটি সরকার চায়, যা জবাবদিহিতামূলক, স্বচ্ছ এবং জনগণের চাহিদার প্রতি ক্রিয়াশীল। বহুদিন ধরে দেশের বিপদ হিসেবে পরিচিত দুর্নীতি তারা নির্মূল করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তারা এমন নেতাদের চায় যারা কেবল ব্যক্তিগত লাভের জন্য ক্ষমতায় নয়, বরং সত্যিকারের জনগণের জীবন উন্নত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শিক্ষা জেন জেড-এর আরেকটি মূল অগ্রাধিকার। তারা জ্ঞানের শক্তি বোঝে এবং একটি আধুনিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক তথা সবার জন্য সমান অধিকার বাস্তবায়নমূলক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়। তারা চায় শিক্ষা শুধু চাকরির জন্য নয়, বরং জীবনের জন্য উপযোগীÑ যা তাদেরকে পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে মানিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় সক্ষমতা প্রদান করবে। অর্থনৈতিক সুযোগও তাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় উপরের দিকে রয়েছে। বাংলাদেশের জেন জেড এমন একটি দেশ চায় যেখানে সবাই সফল হওয়ার সুযোগ পাবে, যেখানে উদ্যোক্তা কার্যক্রম উৎসাহিত হবে এবং কঠোর পরিশ্রম ও উদ্ভাবন পুরস্কৃত হবে। তারা স্বজনপ্রীতি এবং পক্ষপাতিত্বের অবসান চায়, যা অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও উদ্ভাবনকে প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত করে চলেছে। এর বিপরীতে তারা একটি মেধাভিত্তিক সিস্টেমের জন্য আহ্বান জানায়। এছাড়া এই প্রজন্ম পরিবেশ নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
বাংলাদেশে জেন জেড তাদের ধারণাগুলোকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হওয়ার জন্য পরিচিত। তারা যখন কিছু অর্জন করতে চায়, তখন তারা পদ্ধতিগত ও কৌশলগত হয়। তাদের কার্যনির্বাহী পরিকল্পনাগুলো প্রায়ই ডিজিটাল টুল ও সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারকে অন্তর্ভুক্ত করেÑ যা তাদের বার্তা বাড়াতে এবং বৃহত্তর শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, যখন তারা একটি প্রতিবাদ সংগঠিত করে বা কোনোকিছুতে সমর্থন জানায়, তখন জেন জেড সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে। তারা ডিজিটাল ক্যাম্পেইন তৈরি করে, হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে বার্তা ছড়িয়ে দেয়Ñ এমনকি প্রভাবশালীদের সঙ্গেও যুক্ত হয় গুরুত্ব বাড়াতে। এই পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে; যেখানে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে তারা প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। তারা সহযোগিতাকে মূল্য দেয়। জেন জেড দলবদ্ধভাবে কাজ করতে বা সমমনা ব্যক্তি ও সংগঠনের সঙ্গে জোট গঠনে আগ্রহী। তারা যৌথ প্রচেষ্টার শক্তি বোঝে এবং প্রায়ই তাদের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সম্পদ সংগ্রহ, ধারণা ভাগাভাগি এবং একে অপরের উদ্যোগকে সমর্থন করে। তাদের কার্যনির্বাহী শৈলীর আরেকটি দিক হলো ঝুঁকি নেয়ার ইচ্ছা। জেন জেড নতুন কিছু চেষ্টা করতে বা প্রচলিত নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করতে ভয় পায় না। এই উদ্ভাবনী মনোভাব এবং ডিজিটাল দক্ষতার সমন্বয় তাদের লক্ষ্য অর্জনে অত্যন্ত কার্যকরী করে তুলেছে। বাংলাদেশে জেন জেড এর অন্যতম বড় শক্তি হলো দ্রুত সংগঠিত ও সক্রিয় করার ক্ষমতা। তারা সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্যান্য ডিজিটাল টুলের ব্যবহার করে নেটওয়ার্ক তৈরি, তথ্য ভাগাভাগি এবং এমন স্কেলে কার্যক্রম সমন্বয় করে যা আগে কল্পনাতীত ছিল। এই ক্ষমতা তাদের শক্তিশালী গ্রাসরুট আন্দোলন তৈরি করতে সক্ষম করেছে, যা পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাদের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি আরেকটি শক্তি। বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত থাকায় তারা অন্যান্য দেশের সাফল্য ও ব্যর্থতা থেকে শিখতে পারছে এবং সেই শিক্ষা নিজস্ব প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ করছে। এই বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি তাদেরকে আরও সহানুভূতিশীল এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের আন্তঃসংযোগ সম্পর্কে সচেতন করে তুলছে। জেন জেড উদ্ভাবকদের প্রজন্ম। তারা প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে এবং নতুন উপায়ে চিন্তা করতে ভয় পায় না। সমস্যার সমাধানে তাদের উদ্ভাবনী মনোভাব স্পষ্ট; যেখানে তারা সর্বদা নতুন ও উন্নততর পদ্ধতি খোঁজে। তবে যে কোনো প্রজন্মের মতো, বাংলাদেশের জেন জেড-এরও কিছু দুর্বলতা রয়েছে। তাদের একটি চ্যালেঞ্জ হলো হতাশ হওয়ার আশঙ্কা। তাদের উচ্চ-প্রত্যাশা ও পরিবর্তনের প্রতি অস্থিরতা কখনো কখনো হতাশায় পরিণত হতে পারেÑ যখন অগ্রগতি তাদের প্রত্যাশার চেয়ে ধীর হয়। এই হতাশা যদি সঠিকভাবে পরিচালিত না হয়, তবে তা তাদের প্রচেষ্টাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো মেরুকরণের
ঝুঁকি। তাদের সক্রিয়তা একটি শক্তি হলেও, এটি সমাজের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে যখন তাদের মতামত আরও রক্ষণশীল উপাদানের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া আশঙ্কা থাকে। এই বিভাজনগুলো নেভিগেট করে একটি সংহত আন্দোলন বজায় রাখা এই প্রজন্মের জন্য একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে।
যদিও জেন জেড অত্যন্ত শিক্ষিত ও তথ্যসমৃদ্ধ, তারা যেসব বিষয় সমাধান করতে চায় সেগুলোর জটিলতা তারা সহজেই অবমূল্যায়নও করতে পারে। আদর্শবাদ ও বাস্তবতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; কারণ তারা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গঠনে বড় ভূমিকা নেবে আগামীতে। তাদের উদ্যম ও চালনা প্রশংসনীয়, তবে নিঃসন্দেহে পরিবর্তনের জন্য ধৈর্য ও বাস্তববাদ বজায় রাখা প্রয়োজন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলো কেবল শুরু হয়েছে। জেন জেড দেখিয়েছে যে তারা বাস্তব পরিবর্তন আনার সক্ষমতা রাখে এবং ভবিষ্যতে তারা আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার ক্ষেত্রে আশাবাদী। এই প্রজন্মের ক্ষমতা রয়েছে এমন একটি বাংলাদেশ তৈরি করারÑ যেখানে ন্যায়, সমতা এবং অগ্রগতি নিশ্চিত হবে। তবে, তাদের সাফল্য নির্ভর করবে তাদের ঐক্যবদ্ধ থাকার ক্ষমতা, গতিবেগ বজায় রাখা এবং তাদের সাফল্য ও ব্যর্থতা থেকে নিরন্তর শিখে-চলার ওপর। মনে করা হচ্ছে তারা সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হবে তা মোকাবিলায় তারা শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসবে; বিশ্ব তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে এবং তাদের কর্মসূচি আগামী প্রজন্মের জন্য বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। বাংলাদেশে জেন জেড কেবল একটি প্রজন্ম নয়; তারা একটি আন্দোলন, একটি পরিবর্তনের শক্তিÑ যা ইতোমধ্যে এই জাতিকে পুনর্গঠন করতে শুরু করেছে। তাদের গল্প এখনো লেখা হচ্ছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি আকর্ষণীয় অধ্যায় সৃষ্টি হওয়ার অভিপ্রায়কে ব্যক্ত করবে। আগের জেনারেশনগুলোতে সামাজিকতা এবং অর্থ-সম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্ব পেত নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর পরিম-ল। এমনকি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা বেড়াজালে আবদ্ধ
থাকত মিশ্র সংস্কৃতি বা সংস্কৃতির সহযোগ।
সেন্টিনিয়ালরা সেখানে প্রতিটি পর্যায়কে দেখে স্কুলের ক্লাস ঘরের মতো। প্রাথমিক পাঠদানের সহশিক্ষার সাধারণ পরিবেশে শ্রেণী, ধর্ম, পেশানির্বিশেষে সবার সন্তান পাশাপাশি বসে ক্লাস করতে পারে। এখানে আসে না কোনও সার্বভৌমত্ব বা পারস্পরিক চুক্তির বিষয়। উন্নত শিক্ষা, অর্থনীতি, এবং শিল্প ক্ষেত্রে জেড প্রজন্মের চিন্তাধারাও ঠিক একই রকম। অবশ্য সময়ের সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতিতে যথেষ্ট পরিবর্তন এবং নানা স্থানে যুদ্ধের ফলে ব্যবসায়িক অবনতির এখানে প্রভাব রেখেছে। ওয়াই জেনারেশন যেখানে স্বর্ণ সঞ্চয় ও বাড়ি কেনাতে অর্থ বিনিয়োগে ব্যস্ত, সেখানে জেন জি অভ্যস্ত হয়েছে ক্রিপ্টো-কারেন্সিতে। এখানে কখনও মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়নি ভিন্ন দেশীয় প্রযুক্তি উপেক্ষা করার ব্যাপারটি। উচ্চশিক্ষা লাভে ঘন ঘন অভিবাসনের কারণে বেড়েছে দুই ততোধিক সংস্কৃতির প্রতিনিধিদের একই ছাদের নিচে বসবাসের সুযোগ।
জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে দেশের ভেতরেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কো-লিভিং এবং কো-ওয়ার্কিং স্পেস। দেশে ও বিদেশে এই পরিবর্তনগুলোর মধ্য দিয়ে আই প্রজন্মরা নতুন অর্থ নির্ধারণ করেছে সামাজিকতার। এই বিবর্তন একটি কর্মদক্ষ ও বাজেটবান্ধব ব্যবস্থা তৈরি করলেও বিলুপ্তির মুখে পড়েছে সমাজের ঐতিহ্যবাহী রীতি-নীতিগুলো।
[লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]