alt

উপ-সম্পাদকীয়

একটি দেয়ালচিত্র ও কিছু কথা

মাহরুফ চৌধুরী

: বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৫

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান-উত্তর একটি দেয়ালচিত্র জন্ম দিয়েছে বিতর্ক, দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের। সত্যিই এটি একটি দুঃখজনক ঘটনা। এই দেয়ালচিত্রটি একটি গাছের রূপক চিত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় আদর্শ ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ ধারণাটিকে তুলে ধরা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। গাছের শাখায় মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এ চারটি ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীর পরিচয়ের চারটি পাতার পাশাপাশি ‘আদিবাসী’ পরিচয়কে পঞ্চম পাতা হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। প্রথমে এটি জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে প্রশংসিত হলেও, এই দেয়ালচিত্রের প্রতিচ্ছবি পাঠ্যপুস্তকের পেছনের প্রচ্ছদে ব্যবহৃত হওয়ার পর বিষয়টি বিতর্কের জন্ম দেয়। প্রতিবাদের মুখে তা পাঠ্যবইয়ের ডিজিটাল কপি থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি জাতিগুলোর পক্ষে ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা’ (অ্যাগ্রিভড ইন্ডিজেনাস স্টুডেন্ট-মাসেস)-র ব্যানারে সেই প্রতিচ্ছবি পাঠ্যপুস্তকের ডিজিটাল কপিতে পুনর্বহালের দাবিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের অফিস ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করলে, এর বিরোধী পক্ষ ‘সার্বভৌমত্বের পক্ষে শিক্ষার্থীরা’ (স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি) নামক একটি সংগঠন প্রতিরোধে মাঠে নামে। ফলে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ পরিস্থিতি সংঘর্ষে রূপ নেয়।

প্রথমত, দেয়ালচিত্রটিতে ব্যবহৃত শব্দগুলোর প্রতি যদি আমরা লক্ষ্য করি ‘আদিবাসী’ শব্দটির ব্যবহার উদ্দেশ্যপ্রেণোদিত মনে হতে পারে। কারণ ‘আদিবাসী’ শব্দটি চিত্রে ব্যবহৃত আর চারটি শব্দের ধর্মভিত্তিক পরিচয়ের সমগোত্রীয় নয়। তাই যে কারো মনে ‘আদিবাসী’ পরিচয়কে ধর্মভিত্তিক পরিচয়ের সমগোত্রীয় হিসেবে দেখানোর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন জাগতে পারে। এটা সহজবোধ্য যে ‘আদিবাসী’ পরিচয়টি কোন ধর্মের পরিচয় বহন করে না। বরং এটি সুস্পষ্টভাবে স্থানিক এবং ঐতিহাসিক বাস্তবতায় আবাসিক অধিকারে পরিচয় বহন করে, যা মূলত একটি নির্দিষ্ট স্থানে ঐতিহাসিক পরম্পরায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর প্রথাগত ভূমি অধিকার, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও প্রকৃতি-ঘনিষ্ঠ জীবনধারার সঙ্গে সংযুক্ত। সাধারণত ‘মুসলিম’, ‘হিন্দু’, ‘বৌদ্ধ’, ‘খ্রিস্টান’ শব্দগুলো অনুসারীদের ধর্মীয় পরিচয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বাস, উপাসনা পদ্ধতি এবং আধ্যাত্মিক আদর্শের পরিচয় তুলে ধরে। কিন্তু ‘আদিবাসী’ শব্দটি ধর্মীয় পরিচয় বহন করে না, এটি একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বসবাসকারীদের স্থানিক, ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক অবস্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা তাদের স্বাতর্ন্ত্য বজায় রাখার লড়াই ও রাজনৈতিক দাবিকে প্রতিফলিত করে। তাই বিশ্বব্যাপী এই পরিচয় প্রথাগত ভূমির ওপর অধিকার, সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব রক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে বিশেষ স্বীকৃতির জন্য একটি সুনির্দিষ্ট দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দ্বিতীয়ত, ইউরোপীয় জাতিগুলোর ঔপনিবেশিক বসতি স্থাপনের মাধ্যমে বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় সেখানকার আদিবাসীদের উচ্ছেদ ও বিতাড়িত করার মাধ্যমে তাদের ভূ-সম্পত্তি জবর দখলের প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষণে নানা নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। নৃবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পরিচয় গড়ে ওঠে ভূমিপুত্র হিসেবে তাদের ভূমি অধিকার, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি এবং স্থানীয় জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে। এংলো-আইরিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন (১৯৩৬-২০১৫) তার ‘কল্পিত সম্প্রদায়’ (ইমাজিনড কমিউনিটিস) তত্ত্বে জাতীয়তাবাদ এবং জাতিগত পরিচয় নির্মাণে একই লক্ষ্য ও ঐক্যের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই ধারণার আলোকে দেখা যায়, বাংলাদেশে বসবাসকারী নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলোর একত্রে ‘আদিবাসী’ পরিচয়কে ধর্মীয় পরিচয়ের মতো একক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত করা অসম্ভব, বরং এটি নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলোর বহুস্তরীয় এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাইরে থেকে নিজেদের আবাসিক অবস্থানকে সংজ্ঞায়িত করার একটি প্রয়াস। ফলে প্রশ্ন থেকে যায়, আদিবাসী পরিচয়কে গাছের পঞ্চম পাতার অংশ হিসেবে দেখানো কি সত্যিই তাদের ধর্মীয় অবস্থানকে স্বীকৃতি দেয়? নাকি সেটা আমাদের পাহাড়ি ভাই বোনদের পরিচয়কে বিশেষায়িত করার মাধ্যমে বিশেষ কোন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা?

তৃতীয়ত, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে উল্লেখিত ধর্মাবলম্বী মানুষ থাকা সত্ত্বেও তারা কেন নিজেদের সেই সব ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচিত না হয়ে পৃথক ‘আদিবাসী’ পরিচয়কে গুরুত্ব দিচ্ছেন এবং সেটা প্রতিষ্ঠা করার জন্য আন্দোলনে যাচ্ছেন, এমনকি সংঘাতে জড়াচ্ছেন সেটাও বোঝা জরুরি। তাত্ত্বিকভাবে সেটা বোঝার জন্য ইতালিয়ান দার্শনিক, ভাষাতাত্ত্বিক এবং সমাজবিজ্ঞানী অ্যান্তোনিও গ্রামশির (১৮৯১-১৯৩৭) ‘সাংস্কৃতিক আধিপত্য’ (কালচারাল হেজিমনি) তত্ত্বের আশ্রয় নেয়া যেতে পারে। এই তত্ত্বে বলা হয়েছে, শাসকগোষ্ঠী কখনও কখনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রভাবশালী ধারণাকে প্রচার ও সংরক্ষণ করতে গিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বরকে দমন করে। বঞ্চনা, অন্যায় ও অবিচারের শিকার এ দেশে বসবাসকারী ছোট ছোট নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলোর ‘আদিবাসী’ পরিচয় সেই কাঠামোগত দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধী অবস্থান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই ‘আদিবাসী’ শব্দের ছত্রছায়ায় তারা শুধু তাদের ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ নয়, বরং তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ খুঁজে পেতে চাচ্ছেন। তাই আমাদের ছোট ছোট নৃতাত্ত্বিক জাতির ভাইবোনদের এই স্বীকৃতি লাভের লড়াইয়ের মূলে রয়েছে পরিচিতির সূত্রে আন্তর্জাতিক সমর্থন ও আইনি বৈধতা আদায়ের প্রচেষ্টা। এখন প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রীয় পরিম-লে আমাদের যে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক জাতিসত্তার পরিচয় ‘বাংলাদেশি’, সে রাষ্ট্রীয় জাতীয়তায় ছোট ছোট নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলোর ভাইবোনেরা তাদের নৃতাত্ত্বিক বা ধর্মীয় পরিচয়কে গুরুত্ব না দিয়ে কেন ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের জন্য এমন মরিয়া ও মারমুখী হয়ে উঠেছেন? আমরা যে বহুত্ববাদী সমাজের অঙ্গীকার করছি রাষ্ট্রীয় পরিম-লে সে বাস্তবতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ছোট ছোট নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলোকে অবশ্যই আমাদের সমমর্যাদায় গ্রহণ করতে হবে। তাদের আলাদা পরিচয়ের দাবিকে উপেক্ষা করলে, সেটা হবে অন্যায় এবং সেই একই ঐতিহাসিক নিপীড়নের পুনরাবৃত্তি ঘটবে যেটা পাকিস্তানিরা আমাদের সঙ্গে করেছিল। তাই পাহাড়ি অঞ্চলে বা সমতলে বসবাসকারী ছোট জনগোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব পরিচয়কে যথাযথভাবে মর্যাদার সঙ্গে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় অন্যদের সঙ্গে তারা শুধু সাংস্কৃতিক স্বাতর্ন্ত্যই নয়, বরং নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থানকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগও পেতে হবে। নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলোর সঙ্গে সংকর বাঙালির জাতিগত বিরোধের মূল কারণ আমাদের মূলধারার রাষ্ট্রীয় জাতিসত্তায় তাদের স্বাতর্ন্ত্রের স্বীকৃতির ও সৌহার্দপূর্ণ আচরণের অভাব এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে তাদের প্রান্তিককরণের প্রভাব। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রবিনির্মাণের প্রক্রিয়ায় আমাদের কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। রাষ্ট্র কি এই জাতিগোষ্ঠীগুলোর ‘অভ্যন্তরীণ অন্যতা’ (ইন্টারনাল আদারনেস) মেনে নিতে প্রস্তুত? নাকি তাদের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক অবস্থানকে অগ্রাহ্য করে তাদের পরিচয়কে একীভূতকরণের মাধ্যমে অবলুপ্ত করতে চায়? কিংবা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে নানাভাবে তাদের নিষ্পেষিত করতে চায়? আদিবাসী পরিচয়ের দাবির পেছনে মূল কারণগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে এ পরিচয়কে একটি আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। ‘আদিবাসী’ শব্দটি ইংরেজি ‘ইন্ডিজেনাস’ শব্দের অনুবাদ, যা মূলত উপনিবেশ-উত্তর প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয় জাতিগুলোর ঔপনিবেশিক ধ্যানধারণা ও নীতিমালার বিপরীতে অধিকৃত ভূমির প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার এবং স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের সনদ এবং আদিবাসীদের অধিকারের ঘোষণা (ইউএন ডিক্লারেশন অন দ্য রাইটস অব ইন্ডিজেনাস পিপলস) বা সংক্ষেপে উনড্রিপ (ইউএনডিআইপি) বলা হয়। এ ঘোষণা অনুযায়ী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দাবির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তাদের ঐতিহ্য, ভূমি অধিকার, সংস্কৃতির সংরক্ষণ এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। সে যা-ই হোক, এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ‘আদিবাসী’ পরিচয় আদায় করতে চেষ্টা করার উদ্দেশ্য কেবল একটি সাংস্কৃতিক স্বীকৃতির প্রশ্ন নয়; এটি তাদের ভূমিগত, আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সঙ্গেও জড়িত। ‘আদিবাসী’ হিসেবে তারা স্বীকৃতি পেলে অতি সহজেই তাদের ঐতিহাসিক নিপীড়ন এবং প্রান্তিককরণের বিষয়গুলো সামনে চলে আসবে। তাই এই দাবি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার ক্ষেত্রেও নানা দিক থেকে স্পর্শকাতর।

‘আদিবাসী’ দাবিকে ঘিরে অভিযোগ রয়েছে যে এটি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে উৎসাহিত করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের লড়াই মূলত একটি ‘বহিরাগত’ শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিরোধ। গ্রামশির ‘আধিপত্য’ (হেজিমনি) তত্ত্ব মতে, রাষ্ট্রশক্তি সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চেতনাকে দমিয়ে রাখতে চায়। বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে, যেখানে একটি একক জাতি ধারণাকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে, ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীগুলোর পরিচয়ের দাবি এই একক কাঠামোর বিরুদ্ধে একটি বহুত্ববাদী চ্যালেঞ্জ। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী আদিবাসী জনগণের স্বীকৃতি শুধু তাদের ঐতিহ্যকে রক্ষা নয়, বরং তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার একটি কাঠামো প্রদান করে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, রাষ্ট্র এবং সমাজ কি ‘আদিবাসী’ দাবীদার এ ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর প্রাপ্য অধিকারগুলোকে শুধু সাংস্কৃতিক স্তরে সীমাবদ্ধ রাখবে, নাকি তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বাড়ানোর ক্ষেত্রে বাস্তব পদক্ষেপ নেবে? তবে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে যারা নিজেদের ‘আদিবাসী’ বলে দাবি করেন, তাদের অনেকেই এই অঞ্চলের আদি অধিবাসী নন, তারা বিভিন্ন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ অন্যান্য অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করেছেন। ঐতিহাসিক নথিপত্র ও নানা ঐতিহাসিক বিবরণ রয়েছে যেগুলো অনেকের কাছে দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। ফলে স্থানিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে একটি বিতর্কের জন্ম হয়েছে যে, এই অঞ্চলে অভিবাসিত নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলো কীভাবে নিজেদের এদেশের ‘আদিবাসী’ তথা ভূমিপুত্র বলে দাবি করতে পারেন। বিভিন্ন গবেষক যেমন আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও নৃতাত্ত্বিক জেমস স্কট (১৯৩৬-২০২৪) তার ‘শাসিত না হওয়ার শিল্প’ (আর্ট অফ নট বিয়িং গভর্নড, ২০০৯) গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, অনেক জনগোষ্ঠী পাহাড়ি অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছেন রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ এড়িয়ে নিজেদের সংস্কৃতি ও স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য। এছাড়া ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহ এবং প্রাপ্ত নথিপত্র ও বিবরণকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় অভিবাসন, স্থানান্তর এবং ভূমি অধিকারের প্রশ্নে কোনো নিরবচ্ছিন্ন ঐতিহ্য নেই। বহু জনগোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে অভ্যন্তরীণ বা বাইরের চাপের কারণে স্থানান্তরিত হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান প্রজন্মের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর জন্য আদিবাসী পরিচয় তাদের আর্থ- সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থান রক্ষার একটি উপায় মাত্র। তাই এই দাবিকে ‘অযৌক্তিক’ বা ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলা যায় অতিসহজেই। কিন্তু সেটা বলার আগে, এই দাবির পেছনের কারণগুলো কী এবং সেগুলো কীভাবে সমাধান করা যায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। নতুবা নানা চক্রান্তের কারণে এটি একটি বৃহত্তর বিভাজন ও বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রক্রিয়ার অংশ হবে যেখানে আমাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাইবোনেরা তাদের অধিকার ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সহজেই নানা চক্রান্তের ফাঁদে পা দেবেন এবং আন্তর্জাতিক আইনের শরণাপন্ন হবেন। প্রশ্ন হতে পারে, এই দাবিকে ঐতিহাসিক বিতর্কের চেয়ে বহুত্ববাদী নতুন চেতনায় সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অস্তিত্বের প্রেক্ষাপটে কীভাবে মূল্যায়ন করা উচিত?

(চলবে)

[লেখক: ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]

বায়ুদূষণ মনিটরিংয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার

ছবি

যোগেন ম-লের ‘বহুজনবাদী’ রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা

আলো, অন্ধকার ও চরিত্রবান জীবন

শিক্ষকরা কেন বারবার মার খাবে?

মনোবিশ্লেষক নাট্যক্রিয়া অনুশীলনের ক্ষেত্র হোক সহজতর

প্রসঙ্গ জেনারেশন জেড

বাড়ছে বেকারত্ব : প্রতিকারে জরুরি পদক্ষেপ নিন

প্রকৃতির প্রতি সদয় হতে হবে

ছবি

আভিজাত্যের বাঁধ এবং প্রান্তিক মানুষ

বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস

অর্থনীতি কোনদিকে যাচ্ছে?

বৈষম্যবিরোধী সংস্কার দরকার

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পোস্টমর্টেম প্রসঙ্গে

রাজনীতির লালসালু ও ময়না দ্বীপ : জনগণের আস্থার সংকট

প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব কি বাস্তবসম্মত

‘ভিলেজ পলিটিক্স’ ও সাধারণ গ্রামবাসী

রম্যগদ্য : ‘ধেয়ে আসছে বুলেট’

রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য পেনশন ও গ্র্যাচুইটি সময়ের দাবি

ফসলের দাম ও কৃষক

রূপাইয়া, ডন, অনন্ত কিংবা রেংদের মনের ক্ষত কে সারাবে?

পরিবেশ বিপর্যয় : শিক্ষার্থীদের করণীয়

বায়ুদূষণ রোধে প্রয়োজন জনসচেতনতা

কিশোর অপরাধ ও কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন

চাই জীবনমুখী যুগোপযোগী উচ্চশিক্ষা

খেজুর গুড়ের বাণিজ্যিক গুরুত্ব

হামাস-ইসরাইলের অস্ত্র বিরতি

ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি

আদিবাসীদের প্রাণের স্পন্দন

ছবি

ট্রাম্পের বিস্ফোরক মন্তব্য ও যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা সম্পর্ক

কৃতিত্ব অস্বীকারের অপসংস্কৃতি

পশ্চিমবঙ্গ : স্যালাইনে ফাঙ্গাস, অসহায় মানুষ

ছবি

আত্মপরিচয় ও জাতিসত্তার অঙ্গীকার : বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য

এইচএমপিভি ভাইরাস : প্রয়োজন জনসচেতনতা

সিভিল সার্ভিস ক্যাডারে কেন সংস্কার জরুরি

কেন দ্যাখাও মিথ্যে স্বপ্ন

অনিয়ন্ত্রিত অটোরিকশা ও সড়ক দুর্ঘটনা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

একটি দেয়ালচিত্র ও কিছু কথা

মাহরুফ চৌধুরী

বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৫

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান-উত্তর একটি দেয়ালচিত্র জন্ম দিয়েছে বিতর্ক, দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের। সত্যিই এটি একটি দুঃখজনক ঘটনা। এই দেয়ালচিত্রটি একটি গাছের রূপক চিত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় আদর্শ ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ ধারণাটিকে তুলে ধরা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। গাছের শাখায় মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এ চারটি ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীর পরিচয়ের চারটি পাতার পাশাপাশি ‘আদিবাসী’ পরিচয়কে পঞ্চম পাতা হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। প্রথমে এটি জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে প্রশংসিত হলেও, এই দেয়ালচিত্রের প্রতিচ্ছবি পাঠ্যপুস্তকের পেছনের প্রচ্ছদে ব্যবহৃত হওয়ার পর বিষয়টি বিতর্কের জন্ম দেয়। প্রতিবাদের মুখে তা পাঠ্যবইয়ের ডিজিটাল কপি থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি জাতিগুলোর পক্ষে ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা’ (অ্যাগ্রিভড ইন্ডিজেনাস স্টুডেন্ট-মাসেস)-র ব্যানারে সেই প্রতিচ্ছবি পাঠ্যপুস্তকের ডিজিটাল কপিতে পুনর্বহালের দাবিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের অফিস ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করলে, এর বিরোধী পক্ষ ‘সার্বভৌমত্বের পক্ষে শিক্ষার্থীরা’ (স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি) নামক একটি সংগঠন প্রতিরোধে মাঠে নামে। ফলে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ পরিস্থিতি সংঘর্ষে রূপ নেয়।

প্রথমত, দেয়ালচিত্রটিতে ব্যবহৃত শব্দগুলোর প্রতি যদি আমরা লক্ষ্য করি ‘আদিবাসী’ শব্দটির ব্যবহার উদ্দেশ্যপ্রেণোদিত মনে হতে পারে। কারণ ‘আদিবাসী’ শব্দটি চিত্রে ব্যবহৃত আর চারটি শব্দের ধর্মভিত্তিক পরিচয়ের সমগোত্রীয় নয়। তাই যে কারো মনে ‘আদিবাসী’ পরিচয়কে ধর্মভিত্তিক পরিচয়ের সমগোত্রীয় হিসেবে দেখানোর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন জাগতে পারে। এটা সহজবোধ্য যে ‘আদিবাসী’ পরিচয়টি কোন ধর্মের পরিচয় বহন করে না। বরং এটি সুস্পষ্টভাবে স্থানিক এবং ঐতিহাসিক বাস্তবতায় আবাসিক অধিকারে পরিচয় বহন করে, যা মূলত একটি নির্দিষ্ট স্থানে ঐতিহাসিক পরম্পরায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর প্রথাগত ভূমি অধিকার, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও প্রকৃতি-ঘনিষ্ঠ জীবনধারার সঙ্গে সংযুক্ত। সাধারণত ‘মুসলিম’, ‘হিন্দু’, ‘বৌদ্ধ’, ‘খ্রিস্টান’ শব্দগুলো অনুসারীদের ধর্মীয় পরিচয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বাস, উপাসনা পদ্ধতি এবং আধ্যাত্মিক আদর্শের পরিচয় তুলে ধরে। কিন্তু ‘আদিবাসী’ শব্দটি ধর্মীয় পরিচয় বহন করে না, এটি একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বসবাসকারীদের স্থানিক, ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক অবস্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা তাদের স্বাতর্ন্ত্য বজায় রাখার লড়াই ও রাজনৈতিক দাবিকে প্রতিফলিত করে। তাই বিশ্বব্যাপী এই পরিচয় প্রথাগত ভূমির ওপর অধিকার, সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব রক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে বিশেষ স্বীকৃতির জন্য একটি সুনির্দিষ্ট দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দ্বিতীয়ত, ইউরোপীয় জাতিগুলোর ঔপনিবেশিক বসতি স্থাপনের মাধ্যমে বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় সেখানকার আদিবাসীদের উচ্ছেদ ও বিতাড়িত করার মাধ্যমে তাদের ভূ-সম্পত্তি জবর দখলের প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষণে নানা নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। নৃবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পরিচয় গড়ে ওঠে ভূমিপুত্র হিসেবে তাদের ভূমি অধিকার, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি এবং স্থানীয় জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে। এংলো-আইরিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন (১৯৩৬-২০১৫) তার ‘কল্পিত সম্প্রদায়’ (ইমাজিনড কমিউনিটিস) তত্ত্বে জাতীয়তাবাদ এবং জাতিগত পরিচয় নির্মাণে একই লক্ষ্য ও ঐক্যের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই ধারণার আলোকে দেখা যায়, বাংলাদেশে বসবাসকারী নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলোর একত্রে ‘আদিবাসী’ পরিচয়কে ধর্মীয় পরিচয়ের মতো একক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত করা অসম্ভব, বরং এটি নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলোর বহুস্তরীয় এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাইরে থেকে নিজেদের আবাসিক অবস্থানকে সংজ্ঞায়িত করার একটি প্রয়াস। ফলে প্রশ্ন থেকে যায়, আদিবাসী পরিচয়কে গাছের পঞ্চম পাতার অংশ হিসেবে দেখানো কি সত্যিই তাদের ধর্মীয় অবস্থানকে স্বীকৃতি দেয়? নাকি সেটা আমাদের পাহাড়ি ভাই বোনদের পরিচয়কে বিশেষায়িত করার মাধ্যমে বিশেষ কোন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা?

তৃতীয়ত, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে উল্লেখিত ধর্মাবলম্বী মানুষ থাকা সত্ত্বেও তারা কেন নিজেদের সেই সব ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচিত না হয়ে পৃথক ‘আদিবাসী’ পরিচয়কে গুরুত্ব দিচ্ছেন এবং সেটা প্রতিষ্ঠা করার জন্য আন্দোলনে যাচ্ছেন, এমনকি সংঘাতে জড়াচ্ছেন সেটাও বোঝা জরুরি। তাত্ত্বিকভাবে সেটা বোঝার জন্য ইতালিয়ান দার্শনিক, ভাষাতাত্ত্বিক এবং সমাজবিজ্ঞানী অ্যান্তোনিও গ্রামশির (১৮৯১-১৯৩৭) ‘সাংস্কৃতিক আধিপত্য’ (কালচারাল হেজিমনি) তত্ত্বের আশ্রয় নেয়া যেতে পারে। এই তত্ত্বে বলা হয়েছে, শাসকগোষ্ঠী কখনও কখনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রভাবশালী ধারণাকে প্রচার ও সংরক্ষণ করতে গিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বরকে দমন করে। বঞ্চনা, অন্যায় ও অবিচারের শিকার এ দেশে বসবাসকারী ছোট ছোট নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলোর ‘আদিবাসী’ পরিচয় সেই কাঠামোগত দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধী অবস্থান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই ‘আদিবাসী’ শব্দের ছত্রছায়ায় তারা শুধু তাদের ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ নয়, বরং তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ খুঁজে পেতে চাচ্ছেন। তাই আমাদের ছোট ছোট নৃতাত্ত্বিক জাতির ভাইবোনদের এই স্বীকৃতি লাভের লড়াইয়ের মূলে রয়েছে পরিচিতির সূত্রে আন্তর্জাতিক সমর্থন ও আইনি বৈধতা আদায়ের প্রচেষ্টা। এখন প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রীয় পরিম-লে আমাদের যে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক জাতিসত্তার পরিচয় ‘বাংলাদেশি’, সে রাষ্ট্রীয় জাতীয়তায় ছোট ছোট নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলোর ভাইবোনেরা তাদের নৃতাত্ত্বিক বা ধর্মীয় পরিচয়কে গুরুত্ব না দিয়ে কেন ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের জন্য এমন মরিয়া ও মারমুখী হয়ে উঠেছেন? আমরা যে বহুত্ববাদী সমাজের অঙ্গীকার করছি রাষ্ট্রীয় পরিম-লে সে বাস্তবতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ছোট ছোট নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলোকে অবশ্যই আমাদের সমমর্যাদায় গ্রহণ করতে হবে। তাদের আলাদা পরিচয়ের দাবিকে উপেক্ষা করলে, সেটা হবে অন্যায় এবং সেই একই ঐতিহাসিক নিপীড়নের পুনরাবৃত্তি ঘটবে যেটা পাকিস্তানিরা আমাদের সঙ্গে করেছিল। তাই পাহাড়ি অঞ্চলে বা সমতলে বসবাসকারী ছোট জনগোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব পরিচয়কে যথাযথভাবে মর্যাদার সঙ্গে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় অন্যদের সঙ্গে তারা শুধু সাংস্কৃতিক স্বাতর্ন্ত্যই নয়, বরং নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থানকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগও পেতে হবে। নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলোর সঙ্গে সংকর বাঙালির জাতিগত বিরোধের মূল কারণ আমাদের মূলধারার রাষ্ট্রীয় জাতিসত্তায় তাদের স্বাতর্ন্ত্রের স্বীকৃতির ও সৌহার্দপূর্ণ আচরণের অভাব এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে তাদের প্রান্তিককরণের প্রভাব। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রবিনির্মাণের প্রক্রিয়ায় আমাদের কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। রাষ্ট্র কি এই জাতিগোষ্ঠীগুলোর ‘অভ্যন্তরীণ অন্যতা’ (ইন্টারনাল আদারনেস) মেনে নিতে প্রস্তুত? নাকি তাদের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক অবস্থানকে অগ্রাহ্য করে তাদের পরিচয়কে একীভূতকরণের মাধ্যমে অবলুপ্ত করতে চায়? কিংবা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে নানাভাবে তাদের নিষ্পেষিত করতে চায়? আদিবাসী পরিচয়ের দাবির পেছনে মূল কারণগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে এ পরিচয়কে একটি আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। ‘আদিবাসী’ শব্দটি ইংরেজি ‘ইন্ডিজেনাস’ শব্দের অনুবাদ, যা মূলত উপনিবেশ-উত্তর প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয় জাতিগুলোর ঔপনিবেশিক ধ্যানধারণা ও নীতিমালার বিপরীতে অধিকৃত ভূমির প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার এবং স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের সনদ এবং আদিবাসীদের অধিকারের ঘোষণা (ইউএন ডিক্লারেশন অন দ্য রাইটস অব ইন্ডিজেনাস পিপলস) বা সংক্ষেপে উনড্রিপ (ইউএনডিআইপি) বলা হয়। এ ঘোষণা অনুযায়ী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দাবির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তাদের ঐতিহ্য, ভূমি অধিকার, সংস্কৃতির সংরক্ষণ এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। সে যা-ই হোক, এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ‘আদিবাসী’ পরিচয় আদায় করতে চেষ্টা করার উদ্দেশ্য কেবল একটি সাংস্কৃতিক স্বীকৃতির প্রশ্ন নয়; এটি তাদের ভূমিগত, আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সঙ্গেও জড়িত। ‘আদিবাসী’ হিসেবে তারা স্বীকৃতি পেলে অতি সহজেই তাদের ঐতিহাসিক নিপীড়ন এবং প্রান্তিককরণের বিষয়গুলো সামনে চলে আসবে। তাই এই দাবি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার ক্ষেত্রেও নানা দিক থেকে স্পর্শকাতর।

‘আদিবাসী’ দাবিকে ঘিরে অভিযোগ রয়েছে যে এটি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে উৎসাহিত করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের লড়াই মূলত একটি ‘বহিরাগত’ শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিরোধ। গ্রামশির ‘আধিপত্য’ (হেজিমনি) তত্ত্ব মতে, রাষ্ট্রশক্তি সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চেতনাকে দমিয়ে রাখতে চায়। বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে, যেখানে একটি একক জাতি ধারণাকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে, ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীগুলোর পরিচয়ের দাবি এই একক কাঠামোর বিরুদ্ধে একটি বহুত্ববাদী চ্যালেঞ্জ। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী আদিবাসী জনগণের স্বীকৃতি শুধু তাদের ঐতিহ্যকে রক্ষা নয়, বরং তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার একটি কাঠামো প্রদান করে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, রাষ্ট্র এবং সমাজ কি ‘আদিবাসী’ দাবীদার এ ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর প্রাপ্য অধিকারগুলোকে শুধু সাংস্কৃতিক স্তরে সীমাবদ্ধ রাখবে, নাকি তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বাড়ানোর ক্ষেত্রে বাস্তব পদক্ষেপ নেবে? তবে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে যারা নিজেদের ‘আদিবাসী’ বলে দাবি করেন, তাদের অনেকেই এই অঞ্চলের আদি অধিবাসী নন, তারা বিভিন্ন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ অন্যান্য অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করেছেন। ঐতিহাসিক নথিপত্র ও নানা ঐতিহাসিক বিবরণ রয়েছে যেগুলো অনেকের কাছে দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। ফলে স্থানিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে একটি বিতর্কের জন্ম হয়েছে যে, এই অঞ্চলে অভিবাসিত নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলো কীভাবে নিজেদের এদেশের ‘আদিবাসী’ তথা ভূমিপুত্র বলে দাবি করতে পারেন। বিভিন্ন গবেষক যেমন আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও নৃতাত্ত্বিক জেমস স্কট (১৯৩৬-২০২৪) তার ‘শাসিত না হওয়ার শিল্প’ (আর্ট অফ নট বিয়িং গভর্নড, ২০০৯) গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, অনেক জনগোষ্ঠী পাহাড়ি অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছেন রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ এড়িয়ে নিজেদের সংস্কৃতি ও স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য। এছাড়া ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহ এবং প্রাপ্ত নথিপত্র ও বিবরণকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় অভিবাসন, স্থানান্তর এবং ভূমি অধিকারের প্রশ্নে কোনো নিরবচ্ছিন্ন ঐতিহ্য নেই। বহু জনগোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে অভ্যন্তরীণ বা বাইরের চাপের কারণে স্থানান্তরিত হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান প্রজন্মের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর জন্য আদিবাসী পরিচয় তাদের আর্থ- সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থান রক্ষার একটি উপায় মাত্র। তাই এই দাবিকে ‘অযৌক্তিক’ বা ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলা যায় অতিসহজেই। কিন্তু সেটা বলার আগে, এই দাবির পেছনের কারণগুলো কী এবং সেগুলো কীভাবে সমাধান করা যায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। নতুবা নানা চক্রান্তের কারণে এটি একটি বৃহত্তর বিভাজন ও বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রক্রিয়ার অংশ হবে যেখানে আমাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাইবোনেরা তাদের অধিকার ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সহজেই নানা চক্রান্তের ফাঁদে পা দেবেন এবং আন্তর্জাতিক আইনের শরণাপন্ন হবেন। প্রশ্ন হতে পারে, এই দাবিকে ঐতিহাসিক বিতর্কের চেয়ে বহুত্ববাদী নতুন চেতনায় সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অস্তিত্বের প্রেক্ষাপটে কীভাবে মূল্যায়ন করা উচিত?

(চলবে)

[লেখক: ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]

back to top