alt

উপ-সম্পাদকীয়

শুল্ক বনাম উদ্ভাবন যুদ্ধ

এম এ হোসাইন

: শনিবার, ০১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

শুল্ক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে বৈশ্বিক আধিপত্য বজায় রাখার হাতিয়ার হিসেবে দেখা হলেও এখন একটি নতুন শক্তি এ ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে। বর্তমান শতাব্দীতে কোন জাতির উদ্ভাবনী শক্তির ওপর নির্ভর করে বিশ্ব মঞ্চে সেই জাতির আধিপত্য। ডিপসিক একটি অপেক্ষাকৃত অখ্যাত চীনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) স্টার্টআপ, বৈশ্বিক প্রযুক্তি বাজারে সুনাম কেড়ে নিয়ে আমেরিকার অর্থনৈতিক কৌশলের ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়েছে। কম উন্নত চিপে চলা এই স্টার্টআপের উদ্ভাবনী ও সাশ্রয়ী এআই মডেল কেবল প্রযুক্তিগত সাফল্য নয়; এটি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যে বড় রকমের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়; যা বৈশ্বিক বাণিজ্য ও প্রযুক্তি নেতৃত্বের জন্য গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।

ডিপসিকের এ সাফল্য একটি স্পষ্ট নিদর্শন যে শুল্ক, চিপ নিষেধাজ্ঞা বা অন্যান্য অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার নয়। দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষত চীনের মতো প্রতিযোগীদের উত্থান রোধে এবং সেমিকন্ডাক্টর ও এআইয়ের মতো উচ্চপ্রযুক্তি খাতে আধিপত্য বজায় রাখতে শুল্ককে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে; কিন্তু ডিপসিকের এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট; যা এখন বিশ্বের সর্বাধিক ডাউনলোডেড অ্যাপগুলোর একটিÑ এই কৌশলের একটি বড় দুর্বলতা উন্মোচন করেছে তা হলো প্রতিপক্ষের অর্থনৈতিক বাধা অতিক্রম করে উদ্ভাবন করার সক্ষমতা।

ডিপসিকের সাফল্যের ধাক্কা বৈশ্বিক বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে। এর প্রভাবে এনভিডিয়ার শেয়ার ৯% ও উচ্চপ্রযুক্তির চিপ তৈরির ডাচ প্রতিষ্ঠান এএসএমএলের শেয়ার ১১% নেমে যায়। চীনের এমন অভাবনীয় প্রযুক্তি অগ্রগতির মুখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিপ-নির্ভর কৌশলের টেকসই এর বাস্তবতা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ এই এই শেয়ার পতনের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে। এই ডিপসিকের মডেল কম উন্নত চিপেও চলতে পারে। ফলে চীনা মডেলটি এআইতে আমেরিকার প্রতিযোগিতামূলক সুবিধার মূলভিত্তি যা এতদিন ছিলÑ উচ্চ ব্যয় ও উচ্চ প্রযুক্তির পদ্ধতিকে চ্যালেঞ্জ করছে।

এ ঘটনা এআই প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের চীনের উপর ‘অজেয় শ্রেষ্ঠত্ব’ সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। অদূর অতীত পর্যন্ত ওপেনএআই, গুগল ও মেটার মতো মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্টদের এআইতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা হতো; কিন্তু ডিপসিকের সাফল্য চীনের এআইয়ের ক্রমবর্ধমান উন্নত প্রযুক্তির প্রতি সক্ষমতা কেবল এ প্রশ্নই উত্থাপন করেÑ যুক্তরাষ্ট্র কি এখনও এগিয়ে, নাকি চীন তার বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে?

সাম্প্রতিক সময়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চীনা পণ্যে ৬০% শুল্ক আরোপের হুমকি দুই পরাশক্তির মধ্যে উত্তেজনা আরও বাড়িয়েছে। এই হুমকি বৈশ্বিক প্রযুক্তি অঙ্গনে মার্কিন আধিপত্য বজায় রাখতে ওয়াশিংটনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার প্রতি নির্ভরতার প্রতিফলন। বছরের পর বছর ধরে শুল্ক চীনের উত্থান রোধ ও কৌশলগত শিল্পে আধিপত্য ধরে রাখার মার্কিন নীতির মূল স্তম্ভ ছিল; কিন্তু ডিপসিকের সাফল্য ইঙ্গিত দেয় যে এসব পদক্ষেপ এখন আর কার্যকর নয়।

বস্তুত ডিপসিকের দ্রুত সাফল্য একটি বড় প্রবণতার প্রতীকÑ যুক্তরাষ্ট্র ঐতিহ্যগতভাবে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে নেতৃত্ব দিলেও চীনের এআই ও সেমিকন্ডাক্টরে দ্রুত অগ্রগতি ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দিচ্ছে। উন্নত চিপে চীনের প্রবেশাধিকার সীমিত করে যুক্তরাষ্ট্র অজান্তেই চীনের স্বনির্ভরতার প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করেছে। ফলাফল হলো- একটি প্রযুক্তিগত বিপ্লব যা আমেরিকার বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে।

এই পরিবর্তন আধুনিক যুগে শুল্কের কার্যকারিতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর জন্য ব্যয় বাড়ানো, ঘরোয়া শিল্প রক্ষা ও বাণিজ্য অগ্রাধিকার জোরদার করতে শুল্ককে দীর্ঘদিন হাতিয়ার হিসেবে দেখা হয়েছে। কিন্তু ডিপসিকের সাফল্য দেখিয়েছে যে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বৈশ্বিক প্রতিযোগীদের অগ্রগতি রোধে আর যথেষ্ট নয়। বরং এসব পদক্ষেপ উল্টো প্রভাব ফেলতে পারেÑ যে উদ্ভাবন তারা দমাতে চায়, তা আরও উৎসাহিত করতে পারে।

এই নতুন বাস্তবতার প্রভাব ইতিমধ্যে স্পষ্ট। যদি আরও কোম্পানি ডিপসিকের পথ অনুসরণ করে, তবে উন্নত মার্কিন চিপের চাহিদা হ্রাস পেতে পারে; যা বৈশ্বিক প্রযুক্তি বাজারে আমেরিকার প্রভাব আরও দুর্বল করবে। সিলিকন ভ্যালির আধিপত্য নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে ন্যাসড্যাক ১০০-এর তীব্র পতন ও ইউরোপীয় প্রযুক্তি শেয়ারের ধস ইতিমধ্যে এর প্রভাব নির্দেশ করে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ ইঙ্গিত দেয় যে বৈশ্বিক প্রযুক্তি বাস্তুতন্ত্র একটি বড় পরিবর্তনের মুখে; যা আমেরিকার প্রযুক্তিগত নেতৃত্বকে হ্রাস করার হুমকি তৈরি করেছে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ৬০% শুল্ক সম্ভবত মার্কিন উদ্ভাবনের গতি নিয়ে ওয়াশিংটনের হতাশার প্রতিফলন, কিন্তু এমন পদক্ষেপ দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন করার ঝুঁকি বাড়ায়। শুল্ক হয়তো শক্তি প্রদর্শন করে, কিন্তু এটি মার্কিন কৌশলের একটি মৌলিক ত্রুটিও প্রকাশ করেÑ সক্রিয় উদ্ভাবনের বদলে নিষেধাজ্ঞার ওপর নির্ভরতা। প্রযুক্তিগত নমনীয়তার এই বিশ্বে চীনের মতো প্রতিযোগীরা এসব বাধা অতিক্রমে দক্ষতা দেখাচ্ছে; যা ওয়াশিংটনের নীতিকে ক্রমশ অকার্যকর করে তুলছে।

ডিপসিকের উত্থান মার্কিন নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি সতর্কবার্তা। যদি যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক প্রযুক্তি চ্যালেঞ্জের সমাধান হিসেবে শুল্ক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার উপর নির্ভরতা অব্যাহত রাখে, তবে যে শিল্পগুলোতে এক সময় তার আধিপত্য ছিল, সেখানেই পিছিয়ে পড়বে। প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণে নয়, বরং উদ্ভাবন ও সহযোগিতাকে উৎসাহিত করার মধ্যেই নিহিত। যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিপক্ষকে শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে ঘরোয়া শিল্পের বিকাশ ও আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এখন ক্ষমতা, সম্পদ ও প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি। এই নতুন বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে সাফল্যের চাবিকাঠি হলো উদ্ভাবন। যুক্তরাষ্ট্রকে গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করতে হবে, স্থানীয় প্রতিভা বিকাশের পরিবেশ তৈরি করতে হবে ও উদীয়মান প্রযুক্তির অগ্রভাগে থাকতে কাজ করতে হবে। শুধু তখনই বৈশ্বিক প্রযুক্তি শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতায় তার সুবিধা ধরে রাখা সম্ভব।

ডিপসিকের সাফল্য শুধু চীনের জয় নয়; এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি হুঁশিয়ারি। যদি ওয়াশিংটন বৈশ্বিক বাজারে তার অবস্থান ধরে রাখতে শুল্কের মতো পুরনো কৌশলের ওপর নির্ভরতা বজায় রাখে, তবে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন নয়, অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতাÑ যে বিশ্বে সাফল্য নির্ধারণ করে, সেখানে পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। মার্কিন অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্মূল্যায়নের সময় এখনই, পাছে খুব দেরি না হয় যায়।

ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার দৃষ্টিভঙ্গির পুনর্বিবেচনা করতে হবেÑ এটা স্বীকার করে যে, অর্থনৈতিক শক্তির ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে উদ্ভাবন, অভিযোজন ও সহযোগিতার ক্ষমতা দ্বারা, কেবল শাস্তিমূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে নয়। এখন প্রশ্ন হলোÑ যুক্তরাষ্ট্র কি অভিযোজিত হবে, নাকি বৈশ্বিক নেতৃত্ব হারাতে দেবে?

[লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক]

সব ক্ষেত্রে বাংলাকে প্রাধান্য দিন

গুজব : মানবসৃষ্ট দুর্যোগ

অন্তর্বর্তী সরকার: নাগরিকদের প্রত্যাশা কি পূরণ হবে?

পাঠ্যবই সংকটে থমকে গেছে শিক্ষার চাকা

আরজি কর : শাসক রোষে ভিকটিমের পরিবার

চাই কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়ন

একটি দেয়ালচিত্র ও কিছু কথা

রম্যগদ্য : “ডক্টর.জ্বী-ভাগো...”

বায়ুদূষণ মনিটরিংয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার

ছবি

যোগেন ম-লের ‘বহুজনবাদী’ রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা

একটি দেয়ালচিত্র ও কিছু কথা

আলো, অন্ধকার ও চরিত্রবান জীবন

শিক্ষকরা কেন বারবার মার খাবে?

মনোবিশ্লেষক নাট্যক্রিয়া অনুশীলনের ক্ষেত্র হোক সহজতর

প্রসঙ্গ জেনারেশন জেড

বাড়ছে বেকারত্ব : প্রতিকারে জরুরি পদক্ষেপ নিন

প্রকৃতির প্রতি সদয় হতে হবে

ছবি

আভিজাত্যের বাঁধ এবং প্রান্তিক মানুষ

বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস

অর্থনীতি কোনদিকে যাচ্ছে?

বৈষম্যবিরোধী সংস্কার দরকার

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পোস্টমর্টেম প্রসঙ্গে

রাজনীতির লালসালু ও ময়না দ্বীপ : জনগণের আস্থার সংকট

প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব কি বাস্তবসম্মত

‘ভিলেজ পলিটিক্স’ ও সাধারণ গ্রামবাসী

রম্যগদ্য : ‘ধেয়ে আসছে বুলেট’

রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য পেনশন ও গ্র্যাচুইটি সময়ের দাবি

ফসলের দাম ও কৃষক

রূপাইয়া, ডন, অনন্ত কিংবা রেংদের মনের ক্ষত কে সারাবে?

পরিবেশ বিপর্যয় : শিক্ষার্থীদের করণীয়

বায়ুদূষণ রোধে প্রয়োজন জনসচেতনতা

কিশোর অপরাধ ও কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন

চাই জীবনমুখী যুগোপযোগী উচ্চশিক্ষা

খেজুর গুড়ের বাণিজ্যিক গুরুত্ব

হামাস-ইসরাইলের অস্ত্র বিরতি

ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

শুল্ক বনাম উদ্ভাবন যুদ্ধ

এম এ হোসাইন

শনিবার, ০১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

শুল্ক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে বৈশ্বিক আধিপত্য বজায় রাখার হাতিয়ার হিসেবে দেখা হলেও এখন একটি নতুন শক্তি এ ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে। বর্তমান শতাব্দীতে কোন জাতির উদ্ভাবনী শক্তির ওপর নির্ভর করে বিশ্ব মঞ্চে সেই জাতির আধিপত্য। ডিপসিক একটি অপেক্ষাকৃত অখ্যাত চীনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) স্টার্টআপ, বৈশ্বিক প্রযুক্তি বাজারে সুনাম কেড়ে নিয়ে আমেরিকার অর্থনৈতিক কৌশলের ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়েছে। কম উন্নত চিপে চলা এই স্টার্টআপের উদ্ভাবনী ও সাশ্রয়ী এআই মডেল কেবল প্রযুক্তিগত সাফল্য নয়; এটি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যে বড় রকমের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়; যা বৈশ্বিক বাণিজ্য ও প্রযুক্তি নেতৃত্বের জন্য গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।

ডিপসিকের এ সাফল্য একটি স্পষ্ট নিদর্শন যে শুল্ক, চিপ নিষেধাজ্ঞা বা অন্যান্য অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার নয়। দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষত চীনের মতো প্রতিযোগীদের উত্থান রোধে এবং সেমিকন্ডাক্টর ও এআইয়ের মতো উচ্চপ্রযুক্তি খাতে আধিপত্য বজায় রাখতে শুল্ককে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে; কিন্তু ডিপসিকের এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট; যা এখন বিশ্বের সর্বাধিক ডাউনলোডেড অ্যাপগুলোর একটিÑ এই কৌশলের একটি বড় দুর্বলতা উন্মোচন করেছে তা হলো প্রতিপক্ষের অর্থনৈতিক বাধা অতিক্রম করে উদ্ভাবন করার সক্ষমতা।

ডিপসিকের সাফল্যের ধাক্কা বৈশ্বিক বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে। এর প্রভাবে এনভিডিয়ার শেয়ার ৯% ও উচ্চপ্রযুক্তির চিপ তৈরির ডাচ প্রতিষ্ঠান এএসএমএলের শেয়ার ১১% নেমে যায়। চীনের এমন অভাবনীয় প্রযুক্তি অগ্রগতির মুখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিপ-নির্ভর কৌশলের টেকসই এর বাস্তবতা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ এই এই শেয়ার পতনের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে। এই ডিপসিকের মডেল কম উন্নত চিপেও চলতে পারে। ফলে চীনা মডেলটি এআইতে আমেরিকার প্রতিযোগিতামূলক সুবিধার মূলভিত্তি যা এতদিন ছিলÑ উচ্চ ব্যয় ও উচ্চ প্রযুক্তির পদ্ধতিকে চ্যালেঞ্জ করছে।

এ ঘটনা এআই প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের চীনের উপর ‘অজেয় শ্রেষ্ঠত্ব’ সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। অদূর অতীত পর্যন্ত ওপেনএআই, গুগল ও মেটার মতো মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্টদের এআইতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা হতো; কিন্তু ডিপসিকের সাফল্য চীনের এআইয়ের ক্রমবর্ধমান উন্নত প্রযুক্তির প্রতি সক্ষমতা কেবল এ প্রশ্নই উত্থাপন করেÑ যুক্তরাষ্ট্র কি এখনও এগিয়ে, নাকি চীন তার বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে?

সাম্প্রতিক সময়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চীনা পণ্যে ৬০% শুল্ক আরোপের হুমকি দুই পরাশক্তির মধ্যে উত্তেজনা আরও বাড়িয়েছে। এই হুমকি বৈশ্বিক প্রযুক্তি অঙ্গনে মার্কিন আধিপত্য বজায় রাখতে ওয়াশিংটনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার প্রতি নির্ভরতার প্রতিফলন। বছরের পর বছর ধরে শুল্ক চীনের উত্থান রোধ ও কৌশলগত শিল্পে আধিপত্য ধরে রাখার মার্কিন নীতির মূল স্তম্ভ ছিল; কিন্তু ডিপসিকের সাফল্য ইঙ্গিত দেয় যে এসব পদক্ষেপ এখন আর কার্যকর নয়।

বস্তুত ডিপসিকের দ্রুত সাফল্য একটি বড় প্রবণতার প্রতীকÑ যুক্তরাষ্ট্র ঐতিহ্যগতভাবে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে নেতৃত্ব দিলেও চীনের এআই ও সেমিকন্ডাক্টরে দ্রুত অগ্রগতি ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দিচ্ছে। উন্নত চিপে চীনের প্রবেশাধিকার সীমিত করে যুক্তরাষ্ট্র অজান্তেই চীনের স্বনির্ভরতার প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করেছে। ফলাফল হলো- একটি প্রযুক্তিগত বিপ্লব যা আমেরিকার বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে।

এই পরিবর্তন আধুনিক যুগে শুল্কের কার্যকারিতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর জন্য ব্যয় বাড়ানো, ঘরোয়া শিল্প রক্ষা ও বাণিজ্য অগ্রাধিকার জোরদার করতে শুল্ককে দীর্ঘদিন হাতিয়ার হিসেবে দেখা হয়েছে। কিন্তু ডিপসিকের সাফল্য দেখিয়েছে যে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বৈশ্বিক প্রতিযোগীদের অগ্রগতি রোধে আর যথেষ্ট নয়। বরং এসব পদক্ষেপ উল্টো প্রভাব ফেলতে পারেÑ যে উদ্ভাবন তারা দমাতে চায়, তা আরও উৎসাহিত করতে পারে।

এই নতুন বাস্তবতার প্রভাব ইতিমধ্যে স্পষ্ট। যদি আরও কোম্পানি ডিপসিকের পথ অনুসরণ করে, তবে উন্নত মার্কিন চিপের চাহিদা হ্রাস পেতে পারে; যা বৈশ্বিক প্রযুক্তি বাজারে আমেরিকার প্রভাব আরও দুর্বল করবে। সিলিকন ভ্যালির আধিপত্য নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে ন্যাসড্যাক ১০০-এর তীব্র পতন ও ইউরোপীয় প্রযুক্তি শেয়ারের ধস ইতিমধ্যে এর প্রভাব নির্দেশ করে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ ইঙ্গিত দেয় যে বৈশ্বিক প্রযুক্তি বাস্তুতন্ত্র একটি বড় পরিবর্তনের মুখে; যা আমেরিকার প্রযুক্তিগত নেতৃত্বকে হ্রাস করার হুমকি তৈরি করেছে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ৬০% শুল্ক সম্ভবত মার্কিন উদ্ভাবনের গতি নিয়ে ওয়াশিংটনের হতাশার প্রতিফলন, কিন্তু এমন পদক্ষেপ দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন করার ঝুঁকি বাড়ায়। শুল্ক হয়তো শক্তি প্রদর্শন করে, কিন্তু এটি মার্কিন কৌশলের একটি মৌলিক ত্রুটিও প্রকাশ করেÑ সক্রিয় উদ্ভাবনের বদলে নিষেধাজ্ঞার ওপর নির্ভরতা। প্রযুক্তিগত নমনীয়তার এই বিশ্বে চীনের মতো প্রতিযোগীরা এসব বাধা অতিক্রমে দক্ষতা দেখাচ্ছে; যা ওয়াশিংটনের নীতিকে ক্রমশ অকার্যকর করে তুলছে।

ডিপসিকের উত্থান মার্কিন নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি সতর্কবার্তা। যদি যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক প্রযুক্তি চ্যালেঞ্জের সমাধান হিসেবে শুল্ক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার উপর নির্ভরতা অব্যাহত রাখে, তবে যে শিল্পগুলোতে এক সময় তার আধিপত্য ছিল, সেখানেই পিছিয়ে পড়বে। প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণে নয়, বরং উদ্ভাবন ও সহযোগিতাকে উৎসাহিত করার মধ্যেই নিহিত। যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিপক্ষকে শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে ঘরোয়া শিল্পের বিকাশ ও আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এখন ক্ষমতা, সম্পদ ও প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি। এই নতুন বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে সাফল্যের চাবিকাঠি হলো উদ্ভাবন। যুক্তরাষ্ট্রকে গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করতে হবে, স্থানীয় প্রতিভা বিকাশের পরিবেশ তৈরি করতে হবে ও উদীয়মান প্রযুক্তির অগ্রভাগে থাকতে কাজ করতে হবে। শুধু তখনই বৈশ্বিক প্রযুক্তি শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতায় তার সুবিধা ধরে রাখা সম্ভব।

ডিপসিকের সাফল্য শুধু চীনের জয় নয়; এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি হুঁশিয়ারি। যদি ওয়াশিংটন বৈশ্বিক বাজারে তার অবস্থান ধরে রাখতে শুল্কের মতো পুরনো কৌশলের ওপর নির্ভরতা বজায় রাখে, তবে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন নয়, অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতাÑ যে বিশ্বে সাফল্য নির্ধারণ করে, সেখানে পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। মার্কিন অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্মূল্যায়নের সময় এখনই, পাছে খুব দেরি না হয় যায়।

ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার দৃষ্টিভঙ্গির পুনর্বিবেচনা করতে হবেÑ এটা স্বীকার করে যে, অর্থনৈতিক শক্তির ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে উদ্ভাবন, অভিযোজন ও সহযোগিতার ক্ষমতা দ্বারা, কেবল শাস্তিমূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে নয়। এখন প্রশ্ন হলোÑ যুক্তরাষ্ট্র কি অভিযোজিত হবে, নাকি বৈশ্বিক নেতৃত্ব হারাতে দেবে?

[লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক]

back to top