মাহরুফ চৌধুরী
(শেষাংশ)
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আদিবাসী পরিচয়ের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা অত্যন্ত জটিল এবং বহুমাত্রিক। বাংলাদেশের পাহাড়ি এবং সমতলভূমির বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী নিজেদেও ‘আদিবাসী’ বলে পরিচয় দিয়ে যে বার্তা দিচ্ছে, তা কেবল আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দাবি নয়, এটি একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দাবিও বটে। এটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের প্রতীক এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে অধিকার আদায়ে তাঁদের নিজস্ব অবস্থান তুলে ধরার প্রয়াস।
জাতিসংঘের উপরে উল্লেখিত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্রে ‘আদিবাসী’ পরিচয়কে একটি বৈশ্বিক কাঠামোতে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যেখানে জাতিগত বৈচিত্র্য এবং প্রথাগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কাঠামোর আওতায় নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ‘আদিবাসী’ দাবিদার জনগোষ্ঠীগুলো এই দাবিকে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। তাই ভূ-রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এই পরিচয় বাংলাদেশের জন্য একটি বিতর্কিত ও সংবেদনশীল ইস্যু। রাষ্ট্রীয় পরিসীমা এবং সার্বভৌমত্বের প্রেক্ষাপটে অনেকেই মনে করেন, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর ‘আদিবাসী’ পরিচয় বিভাজনমূলক এবং জাতীয় ঐক্যের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সমালোচকদের মতে আমাদের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসকারী জাতিগুলোকে ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদকে উসকে দিতে পারে। বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। এর প্রমাণ হিসেবে তারা ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন সময়ে পাহাড়ি অঞ্চলে সংঘাত এবং সশস্ত্র আন্দোলনের উদাহরণগুলো তুলে ধরেন। বর্তমানে এই বিরোধিতা শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নয়। এ দাবির পক্ষে ও বিপক্ষে নানা যুক্তি তর্ক, প্রচার-প্রচারণ অব্যাহত রয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সেসবের ধারাবাহিকতারই ইঙ্গিতবহ।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের প্রশ্নে অনেক রাষ্ট্রই দ্বিধাগ্রস্ত। কারণ এই স্বীকৃতি প্রদান করলে তা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব এবং আভ্যন্তরীণ নীতিমালা তৈরিতে বাইরের প্রভাব, এমনকি হস্তক্ষেপেরও সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। অপরদিকে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের দাবি রাষ্ট্রীয় আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে এবং বহুত্ববাদী কাঠামো প্রতিষ্ঠার দাবি তোলে। ফলে প্রশ্নটি কেবল জাতীয় ঐক্যেও জন্য হুমকি নাকি বৈচির্ত্যের স্বীকৃতির লড়াই, তা নির্ভর করে এই ইস্যুটিকে রাষ্ট্র কীভাবে দেখছে এবং মোকাবিলা করছে তার ওপর। ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের রাজনৈতিক বাস্তবতা শুধু স্থানিক নয়; এটি একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলনের অংশ, যা শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরুদ্ধেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হিসেবে দেখা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, জাতীয় ঐক্যের প্রেক্ষাপটে আদিবাসী পরিচয় কেন বাধার সৃষ্টি করছে? বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়ে ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ ধারণাটি একটি আদর্শ, যা ভাষাতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় বৈচির্ত্যকে একসঙ্গে ধারণ করার প্রত্যয়কে বোঝায়। রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে ‘বাংলাদেশি’ পরিচয়কে মূল পরিচয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও, এ দেশের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব পরিচয়ের প্রতি উপেক্ষা বা সে পরিচয়ের ভুল ব্যাখ্যাও জাতীয় ঐক্যের ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
বাঙালি ভাষাতাত্ত্বিক জাতি হলেও নৃতাত্ত্বিক বিচারে একটি সংকর জাতি। তাই বাঙালিত্বে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য স্বাভাবিক এবং ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে দেয়াল চিত্রটিতে ‘আদিবাসী’ পরিচয়কে ধর্মীয় পরিচয়ের সমগোত্রীয় হিসেবে বিবেচনা করা এবং সেই দেয়াল চিত্রের অপসারণ নিয়ে আন্দোলন, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও সংঘাত স্পষ্টতই একটি তাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিক ভুল। আলোচনায় এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, আদিবাসী পরিচয় একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর স্থানিক, ঐতিহাসিক এবং আর্থ-সামাজিক বাস্তবতাকে প্রতিনিধিত্ব করে, যা তাদের সাংস্কৃতিক ও ভূমি অধিকারের জন্য একটি রাজনৈতিক দাবির ভিত্তি। ফলে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভূমির উপর একই দেশের সেই অঞ্চলে বসবাসকারি অন্য জনগোষ্ঠীর স্থানিক ও ঐতিহাসিক অধিকারকে সরাসরি নাকচ করে দেয়। একই দেশের জনগণের মধ্যে ভূমি অধিকারে বৈষম্য তৈরি করে। ফলে ভূমির উপর অধিকারের প্রশ্নে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সৃষ্টি করে এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে তাদের দাবিকে আলাদা করে দেখায় ও বৈষম্য তৈরি করে। সঙ্গত কারণে রাষ্ট্রীয় নীতি এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এই দাবিকে প্রায়শই বিভাজনমূলক এবং জাতীয় ঐক্যের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হয়। জাতিগত দ্বন্দ্ব এবং সংঘর্ষের প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে বোঝা যায় এই বিভাজনমূলক ধারণার জন্ম ও তা প্রতিষ্ঠা করার লড়াই মূলত রাষ্ট্রীয় শক্তির অপব্যবহার, ভূমি অধিকারের প্রশ্নে ন্যায্যতার অনুপস্থিতি এবং সাংস্কৃতিক সমতার অভাবের বিরুদ্ধে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ এবং সমতলভূমির জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্কের ইতিহাসে দেখা যায়, স্থানিক অধিকার এবং সম্পদের ব্যবস্থাপনা নিয়ে যে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে, তা ক্রমাগত দ্বন্দ্ব সংঘাতের রূপ নিচ্ছে এবং একটি জাতি-রাষ্ট্রের ঐক্যবদ্ধ কাঠামোর জন্য দীর্ঘস্থায়ী চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। বাংলাদেশে বসবাসকারী নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব পরিচয়ের স্বীকৃতি ও তাদের মূলধারার বাঙালি জাতির সমমর্যাদায় সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন কেবল জাতীয় ঐক্যকে সুসংহতই করবে না; বরং এটি একটি বহুত্ববাদী রাষ্ট্র কাঠামো তৈরির সুযোগও সৃষ্টি করবে। তবে এ সুযোগ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি, যা বৈচিত্র্যকে শুধু আলিঙ্গনই করবে না, বরং তাকে জাতীয় ঐক্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গণ্য করবে ও জাতীয় সমৃদ্ধির উৎস হিসেবে মূল্যায়ন করবে। বৈচিত্র্যের প্রতি যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান না করলে তা শুধু জাতিগত সংঘাত বাড়ায় না, বরং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিশ্বাসের সংকটও সৃষ্টি করে।
এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্য ও ভৌগোলিক সার্বভৌমত্ব অক্ষুণœ রাখতে সমাধানের পথ কী? আদিবাসী পরিচয়ের ইস্যুটি একটি জটিল সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা, যা চূড়ান্ত সমাধানের জন্য সুচিন্তিত সমন্বিত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পদক্ষেপ দাবি করে। ‘আদিবাসী’ শব্দটি আমাদের পাহাড়ি ভাইবোনদেও যদি নৃতাত্ত্বিক, ভাষাতাত্ত্বিক বা সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সাধারণ (কমন) বহিঃপ্রকাশ না হয় এবং দেশের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এই শব্দটির ব্যবহারে আপত্তি জানায়, তবে এর ব্যবহারের যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে গঠনমূলক আলাপ, আলোচনা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে ঐক্যমতে পৌঁছানো অপরিহার্য। তবে এই আলাপ, আলোচনা ও পর্যালোচনায় উত্তেজনা, হটকারিতা কিংবা বিশৃঙ্খলা নয়, বরং শান্তি ও সমঝোতার মনোভাব নিয়ে মূল সমস্যাগুলো তথা বিরোধের কারণ ও দাবিগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর দ্রুত সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো আন্তর্জাতিক মানদ-ের আলোকে একটি ন্যায়সঙ্গত নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা, যা ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করবে। এর পাশাপাশি তাদের ভূমি অধিকার, আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তাসহ শিক্ষার সুযোগ এবং উন্নয়ন সংক্রান্ত চাহিদাগুলোকে গুরুত্ব সহকারে মূল্যায়ন করে সেগুলো পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যদিকে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীসহ সকল নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোকেও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি আস্থা ও আনুগত্য রেখে তাদের দাবিগুলোকে যুক্তিসংগত ও সমন্বিতভাবে তুলে ধরতে হবে, যাতে আলোচনার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হয়। বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ প্রতিষ্ঠা করা, জাতীয় ঐক্য ও সংহতির জন্য কাজ করা। যেমন একটি দেয়াল চিত্রে বিভিন্ন রঙ একত্রে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে, তেমনি একটি রাষ্ট্রের বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীগুলো তাদের নিজস্ব পরিচিতি ও অধিকার বজায় রেখে ঐক্যের ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী জাতি গঠন করতে পারে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে বৈচির্ত্যকে আলিঙ্গন যেন আমাদের বিভাজনের কারণ না হয়, বরং তা যেন ঐক্যের ভিতকে আরও শক্তিশালী ও সুসংহত করে, সেটি নিশ্চিত করা বাংলাদেশী হিসেবে আমাদের সবারই দায়িত্ব ও কর্তব্য। কেবল সরকার, দেশের সাধারণ জনগণ এবং পাহাড়ি জনগণের আন্তরিকতা এবং সহযোগিতার মাধ্যমেই বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব।
জাতীয় ঐক্য ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আলোচনার পথ খোলা রাখতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে আলোচনার পথে ও পৌঁছাতে হবে সমঝোতায়। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বাংলাদেশে বসবাসকারী প্রতিটি জনগোষ্ঠীর অধিকার, মর্যাদা এবং অবস্থানকে সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কাঠামো তৈরি ও তা বাস্তবায় করতে হবে।
[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]
মাহরুফ চৌধুরী
শনিবার, ০১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
(শেষাংশ)
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আদিবাসী পরিচয়ের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা অত্যন্ত জটিল এবং বহুমাত্রিক। বাংলাদেশের পাহাড়ি এবং সমতলভূমির বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী নিজেদেও ‘আদিবাসী’ বলে পরিচয় দিয়ে যে বার্তা দিচ্ছে, তা কেবল আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দাবি নয়, এটি একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দাবিও বটে। এটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের প্রতীক এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে অধিকার আদায়ে তাঁদের নিজস্ব অবস্থান তুলে ধরার প্রয়াস।
জাতিসংঘের উপরে উল্লেখিত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্রে ‘আদিবাসী’ পরিচয়কে একটি বৈশ্বিক কাঠামোতে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যেখানে জাতিগত বৈচিত্র্য এবং প্রথাগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কাঠামোর আওতায় নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ‘আদিবাসী’ দাবিদার জনগোষ্ঠীগুলো এই দাবিকে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। তাই ভূ-রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এই পরিচয় বাংলাদেশের জন্য একটি বিতর্কিত ও সংবেদনশীল ইস্যু। রাষ্ট্রীয় পরিসীমা এবং সার্বভৌমত্বের প্রেক্ষাপটে অনেকেই মনে করেন, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর ‘আদিবাসী’ পরিচয় বিভাজনমূলক এবং জাতীয় ঐক্যের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সমালোচকদের মতে আমাদের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসকারী জাতিগুলোকে ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদকে উসকে দিতে পারে। বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। এর প্রমাণ হিসেবে তারা ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন সময়ে পাহাড়ি অঞ্চলে সংঘাত এবং সশস্ত্র আন্দোলনের উদাহরণগুলো তুলে ধরেন। বর্তমানে এই বিরোধিতা শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নয়। এ দাবির পক্ষে ও বিপক্ষে নানা যুক্তি তর্ক, প্রচার-প্রচারণ অব্যাহত রয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সেসবের ধারাবাহিকতারই ইঙ্গিতবহ।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের প্রশ্নে অনেক রাষ্ট্রই দ্বিধাগ্রস্ত। কারণ এই স্বীকৃতি প্রদান করলে তা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব এবং আভ্যন্তরীণ নীতিমালা তৈরিতে বাইরের প্রভাব, এমনকি হস্তক্ষেপেরও সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। অপরদিকে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের দাবি রাষ্ট্রীয় আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে এবং বহুত্ববাদী কাঠামো প্রতিষ্ঠার দাবি তোলে। ফলে প্রশ্নটি কেবল জাতীয় ঐক্যেও জন্য হুমকি নাকি বৈচির্ত্যের স্বীকৃতির লড়াই, তা নির্ভর করে এই ইস্যুটিকে রাষ্ট্র কীভাবে দেখছে এবং মোকাবিলা করছে তার ওপর। ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের রাজনৈতিক বাস্তবতা শুধু স্থানিক নয়; এটি একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলনের অংশ, যা শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরুদ্ধেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হিসেবে দেখা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, জাতীয় ঐক্যের প্রেক্ষাপটে আদিবাসী পরিচয় কেন বাধার সৃষ্টি করছে? বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়ে ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ ধারণাটি একটি আদর্শ, যা ভাষাতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় বৈচির্ত্যকে একসঙ্গে ধারণ করার প্রত্যয়কে বোঝায়। রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে ‘বাংলাদেশি’ পরিচয়কে মূল পরিচয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও, এ দেশের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব পরিচয়ের প্রতি উপেক্ষা বা সে পরিচয়ের ভুল ব্যাখ্যাও জাতীয় ঐক্যের ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
বাঙালি ভাষাতাত্ত্বিক জাতি হলেও নৃতাত্ত্বিক বিচারে একটি সংকর জাতি। তাই বাঙালিত্বে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য স্বাভাবিক এবং ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে দেয়াল চিত্রটিতে ‘আদিবাসী’ পরিচয়কে ধর্মীয় পরিচয়ের সমগোত্রীয় হিসেবে বিবেচনা করা এবং সেই দেয়াল চিত্রের অপসারণ নিয়ে আন্দোলন, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও সংঘাত স্পষ্টতই একটি তাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিক ভুল। আলোচনায় এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, আদিবাসী পরিচয় একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর স্থানিক, ঐতিহাসিক এবং আর্থ-সামাজিক বাস্তবতাকে প্রতিনিধিত্ব করে, যা তাদের সাংস্কৃতিক ও ভূমি অধিকারের জন্য একটি রাজনৈতিক দাবির ভিত্তি। ফলে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভূমির উপর একই দেশের সেই অঞ্চলে বসবাসকারি অন্য জনগোষ্ঠীর স্থানিক ও ঐতিহাসিক অধিকারকে সরাসরি নাকচ করে দেয়। একই দেশের জনগণের মধ্যে ভূমি অধিকারে বৈষম্য তৈরি করে। ফলে ভূমির উপর অধিকারের প্রশ্নে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সৃষ্টি করে এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে তাদের দাবিকে আলাদা করে দেখায় ও বৈষম্য তৈরি করে। সঙ্গত কারণে রাষ্ট্রীয় নীতি এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এই দাবিকে প্রায়শই বিভাজনমূলক এবং জাতীয় ঐক্যের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হয়। জাতিগত দ্বন্দ্ব এবং সংঘর্ষের প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে বোঝা যায় এই বিভাজনমূলক ধারণার জন্ম ও তা প্রতিষ্ঠা করার লড়াই মূলত রাষ্ট্রীয় শক্তির অপব্যবহার, ভূমি অধিকারের প্রশ্নে ন্যায্যতার অনুপস্থিতি এবং সাংস্কৃতিক সমতার অভাবের বিরুদ্ধে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ এবং সমতলভূমির জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্কের ইতিহাসে দেখা যায়, স্থানিক অধিকার এবং সম্পদের ব্যবস্থাপনা নিয়ে যে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে, তা ক্রমাগত দ্বন্দ্ব সংঘাতের রূপ নিচ্ছে এবং একটি জাতি-রাষ্ট্রের ঐক্যবদ্ধ কাঠামোর জন্য দীর্ঘস্থায়ী চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। বাংলাদেশে বসবাসকারী নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব পরিচয়ের স্বীকৃতি ও তাদের মূলধারার বাঙালি জাতির সমমর্যাদায় সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন কেবল জাতীয় ঐক্যকে সুসংহতই করবে না; বরং এটি একটি বহুত্ববাদী রাষ্ট্র কাঠামো তৈরির সুযোগও সৃষ্টি করবে। তবে এ সুযোগ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি, যা বৈচিত্র্যকে শুধু আলিঙ্গনই করবে না, বরং তাকে জাতীয় ঐক্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গণ্য করবে ও জাতীয় সমৃদ্ধির উৎস হিসেবে মূল্যায়ন করবে। বৈচিত্র্যের প্রতি যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান না করলে তা শুধু জাতিগত সংঘাত বাড়ায় না, বরং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিশ্বাসের সংকটও সৃষ্টি করে।
এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্য ও ভৌগোলিক সার্বভৌমত্ব অক্ষুণœ রাখতে সমাধানের পথ কী? আদিবাসী পরিচয়ের ইস্যুটি একটি জটিল সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা, যা চূড়ান্ত সমাধানের জন্য সুচিন্তিত সমন্বিত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পদক্ষেপ দাবি করে। ‘আদিবাসী’ শব্দটি আমাদের পাহাড়ি ভাইবোনদেও যদি নৃতাত্ত্বিক, ভাষাতাত্ত্বিক বা সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সাধারণ (কমন) বহিঃপ্রকাশ না হয় এবং দেশের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এই শব্দটির ব্যবহারে আপত্তি জানায়, তবে এর ব্যবহারের যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে গঠনমূলক আলাপ, আলোচনা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে ঐক্যমতে পৌঁছানো অপরিহার্য। তবে এই আলাপ, আলোচনা ও পর্যালোচনায় উত্তেজনা, হটকারিতা কিংবা বিশৃঙ্খলা নয়, বরং শান্তি ও সমঝোতার মনোভাব নিয়ে মূল সমস্যাগুলো তথা বিরোধের কারণ ও দাবিগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর দ্রুত সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো আন্তর্জাতিক মানদ-ের আলোকে একটি ন্যায়সঙ্গত নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা, যা ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করবে। এর পাশাপাশি তাদের ভূমি অধিকার, আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তাসহ শিক্ষার সুযোগ এবং উন্নয়ন সংক্রান্ত চাহিদাগুলোকে গুরুত্ব সহকারে মূল্যায়ন করে সেগুলো পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যদিকে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীসহ সকল নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোকেও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি আস্থা ও আনুগত্য রেখে তাদের দাবিগুলোকে যুক্তিসংগত ও সমন্বিতভাবে তুলে ধরতে হবে, যাতে আলোচনার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হয়। বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ প্রতিষ্ঠা করা, জাতীয় ঐক্য ও সংহতির জন্য কাজ করা। যেমন একটি দেয়াল চিত্রে বিভিন্ন রঙ একত্রে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে, তেমনি একটি রাষ্ট্রের বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীগুলো তাদের নিজস্ব পরিচিতি ও অধিকার বজায় রেখে ঐক্যের ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী জাতি গঠন করতে পারে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে বৈচির্ত্যকে আলিঙ্গন যেন আমাদের বিভাজনের কারণ না হয়, বরং তা যেন ঐক্যের ভিতকে আরও শক্তিশালী ও সুসংহত করে, সেটি নিশ্চিত করা বাংলাদেশী হিসেবে আমাদের সবারই দায়িত্ব ও কর্তব্য। কেবল সরকার, দেশের সাধারণ জনগণ এবং পাহাড়ি জনগণের আন্তরিকতা এবং সহযোগিতার মাধ্যমেই বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব।
জাতীয় ঐক্য ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আলোচনার পথ খোলা রাখতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে আলোচনার পথে ও পৌঁছাতে হবে সমঝোতায়। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বাংলাদেশে বসবাসকারী প্রতিটি জনগোষ্ঠীর অধিকার, মর্যাদা এবং অবস্থানকে সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কাঠামো তৈরি ও তা বাস্তবায় করতে হবে।
[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]