alt

উপ-সম্পাদকীয়

চাই কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়ন

মিহির কুমার রায়

: শনিবার, ০১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

গ্রামীণ অর্থনীতি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও সাম্প্রতিক সময়ের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে এ খাতের স্থবিরতার চিত্র উঠে এসেছে। জিডিপিতে গ্রামীণ অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি কৃষি খাতের অবদান উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে। প্রায় ৩০ শতাংশ অবদান রাখা গ্রামীণ উদ্যোগগুলো টিকে থাকার লড়াই করছে। সব মিলিয়ে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির স্থবিরতা অর্থনীতিবিদদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে।

গ্রামীণ অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি কৃষি খাত। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) কৃষি খাতের অবদান প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে এসেছে। প্রথম প্রান্তিকে কৃষি খাতের অবদান ছিল জিডিপির মাত্র ০.১৬ শতাংশ, যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে এটি ছিল ০.৩৫ শতাংশ। এবারের বন্যা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কৃষির অবদান কমেছে। একইসঙ্গে দেশের সামগ্রিক জিডিপি প্রবৃদ্ধিও প্রায় ২ শতাংশে নেমে এসেছে।

গ্রামীণ ঋণপ্রবাহে সংকট

গ্রামীণ অঞ্চলে ঋণপ্রবাহ কমছে, যা এ খাতের স্থবিরতাকে আরও গভীর করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ পঞ্জিকাবর্ষের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) গ্রামীণ এলাকায় বিতরণকৃত ঋণ স্থিতি কমেছে প্রায় ১.১২ শতাংশ। ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিক শেষে এ ঋণ স্থিতি ছিল ১ লাখ ২৪ হাজার ৭৩৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, যেখানে আগের প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) এটি ছিল ১ লাখ ২৬ হাজার ১৫০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।

দেশের ব্যাংক খাতের মাধ্যমে বিতরণকৃত মোট ঋণ স্থিতিতে গ্রামীণ ঋণের অবদানও কমেছে। ২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে এ হার ছিল ৭.৯ শতাংশ, যা ২০২৪ সালের একই সময়ে কমে ৭.৭ শতাংশে নেমে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কৃষি খাতে ৩৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। তবে ব্যাংকগুলো অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মাত্র ৬ হাজার ৪৫৮ কোটি ১৮ লাখ টাকা বিতরণ করেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬.৮২ শতাংশ কম।

কৃষি ঋণের উপখাতভিত্তিক বিশ্লেষণ

কৃষি ঋণ বিতরণের উপখাত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শস্য উৎপাদনে ঋণের অংশ ৪৪ শতাংশ থেকে কমে ৪৩ শতাংশে নেমে এসেছে। দারিদ্র্য দূরীকরণে ঋণের অংশও ৮ শতাংশ থেকে কমে ৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবে মৎস্য, পশুপালন ও পোল্ট্রি খাতে ঋণের প্রবাহ কিছুটা বেড়েছে।

চলতি অর্থবছরে কৃষি ঋণের ৩৮ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ১২ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা বিতরণের দায়িত্ব রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর, আর ২৫ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা বিতরণ করবে বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলো। তবে বিদেশি ব্যাংকগুলো থেকে কৃষি ঋণের প্রবাহ ৭১ শতাংশ এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ৩১ শতাংশ কমেছে। সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর কৃষি ঋণ বিতরণও ১৬ শতাংশের বেশি হ্রাস পেয়েছে।

ঋণ আদায়ে কৃষি খাতের শীর্ষ অবস্থান

ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কৃষি ঋণ বিতরণ কমেছে। তবে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে কৃষি খাত বরাবরই দেশের সবচেয়ে ভালো পারফরমার। ২০২৪ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে কৃষি খাতে ঋণ আদায় হয়েছে ৯ হাজার ২০৯ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮ হাজার ১৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা। অর্থাৎ, কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ কমলেও ঋণ আদায়ের হার ১৫ শতাংশ বেড়েছে।

অন্যদিকে, দেশের গ্রামীণ ব্যাংক ও শীর্ষ ১০টি এনজিও প্রতিষ্ঠান ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে কৃষি খাতে ১৫ হাজার ৭১০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করেছে, যা গত বছরের তুলনায় ০.৬২ শতাংশ বেশি। এনজিওগুলো ঋণ বিতরণের ধারা বজায় রাখতে পারলেও তফসিলি ব্যাংকগুলো পিছিয়ে পড়ছে।

উর্বরতা হ্রাস ও উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এক গবেষণা অনুযায়ী, ১৯৯১-২০০০ সালে দেশের জমির উর্বরতা ছিল ২.৭৫ শতাংশ, যা ২০০১-২০১০ সালে বেড়ে ৩.৩০ শতাংশে উন্নীত হয়। কিন্তু ২০১১-২০২০ সালে এটি নেমে এসে মাত্র ০.৪৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সার, কীটনাশক ও ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ধানের উৎপাদন খরচ ক্রমাগত বাড়ছে। ২০১২ সালে প্রতি কেজি চাল উৎপাদন খরচ ছিল ১০.৫১ টাকা, যা ২০১৫ সালে ১১.৬৭ টাকা এবং ২০১৮ সালে ১২.৮৮ টাকায় উন্নীত হয়েছে। অন্যদিকে, প্রতি কেজি চাল বিক্রি করে ২০১২ সালে কৃষক ১৬.১৭ টাকা লাভ করলেও, ২০১৮ সালে এটি ১৭.৪৮ টাকায় পৌঁছেছে। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির ফলে কৃষকের লাভের পরিমাণ কমছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে কৃষকরা ধান চাষে আগ্রহ হারাতে পারেন।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও কৃষি খাতের ক্ষতি

সাম্প্রতিক বন্যায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লেগেছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ৩৭ লাখ ২ হাজার ৭৩৩ হেক্টর জমি বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে, যার ফলে অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। এই বিপুল ক্ষতি গ্রামীণ জনপদের জীবনযাত্রায় মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

উন্নয়নের জন্য জরুরি পদক্ষেপ

কৃষি খাতের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো, কৃষকবান্ধব নীতি গ্রহণ এবং সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করতে হবে। ফসল উৎপাদনের মৌলিক উপাদান মাটি ও পানির দূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার কারণে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, যা দ্রুত সমাধান করা দরকার।

গ্রামীণ অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি। কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। ফসল উৎপাদনের নতুন জাত উদ্ভাবন করতে হবে। কৃষিপণ্য সংরক্ষণ ও বিপণন ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ করা দরকার। উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।

কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়নে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। বিশেষ করে বন্যা, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় কার্যকর নীতি গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় গ্রামীণ অর্থনীতির সংকট আরও গভীর হতে পারে।

[লেখক: সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি]

ইমাম রইস উদ্দিন হত্যাকাণ্ড : সুবিচার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব

কারাগার, সংশোধনাগার ও ভবঘুরে কেন্দ্রগুলোর সংস্কার কি হবে

জ্বালানির বদল, জীবিকার ঝুঁকি

প্রসঙ্গ : রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও চট্টগ্রামে এস্কর্ট ডিউটি

দেশটা কারো বাপের নয়!

বুদ্ধের বাণীতে বিশ্বশান্তির প্রার্থনা

আর কত ধর্ষণের খবর শুনতে হবে?

সংস্কারের স্বপ্ন বনাম বাস্তবতার রাজনীতি

মধুমাসের স্মৃতি ও দেশীয় ফলের রসাল সমারোহ

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

লিঙ্গের রাজনীতি বা বিবাদ নয়, চাই মানবিকতার নিবিড় বন্ধন

বাজেট : বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পারমাণবিক আলোচনার স্থবিরতা

রম্যগদ্য: “বাঙালি আমরা, নহি তো মেষ...”

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

চাই কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়ন

মিহির কুমার রায়

শনিবার, ০১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

গ্রামীণ অর্থনীতি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও সাম্প্রতিক সময়ের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে এ খাতের স্থবিরতার চিত্র উঠে এসেছে। জিডিপিতে গ্রামীণ অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি কৃষি খাতের অবদান উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে। প্রায় ৩০ শতাংশ অবদান রাখা গ্রামীণ উদ্যোগগুলো টিকে থাকার লড়াই করছে। সব মিলিয়ে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির স্থবিরতা অর্থনীতিবিদদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে।

গ্রামীণ অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি কৃষি খাত। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) কৃষি খাতের অবদান প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে এসেছে। প্রথম প্রান্তিকে কৃষি খাতের অবদান ছিল জিডিপির মাত্র ০.১৬ শতাংশ, যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে এটি ছিল ০.৩৫ শতাংশ। এবারের বন্যা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কৃষির অবদান কমেছে। একইসঙ্গে দেশের সামগ্রিক জিডিপি প্রবৃদ্ধিও প্রায় ২ শতাংশে নেমে এসেছে।

গ্রামীণ ঋণপ্রবাহে সংকট

গ্রামীণ অঞ্চলে ঋণপ্রবাহ কমছে, যা এ খাতের স্থবিরতাকে আরও গভীর করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ পঞ্জিকাবর্ষের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) গ্রামীণ এলাকায় বিতরণকৃত ঋণ স্থিতি কমেছে প্রায় ১.১২ শতাংশ। ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিক শেষে এ ঋণ স্থিতি ছিল ১ লাখ ২৪ হাজার ৭৩৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, যেখানে আগের প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) এটি ছিল ১ লাখ ২৬ হাজার ১৫০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।

দেশের ব্যাংক খাতের মাধ্যমে বিতরণকৃত মোট ঋণ স্থিতিতে গ্রামীণ ঋণের অবদানও কমেছে। ২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে এ হার ছিল ৭.৯ শতাংশ, যা ২০২৪ সালের একই সময়ে কমে ৭.৭ শতাংশে নেমে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কৃষি খাতে ৩৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। তবে ব্যাংকগুলো অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মাত্র ৬ হাজার ৪৫৮ কোটি ১৮ লাখ টাকা বিতরণ করেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬.৮২ শতাংশ কম।

কৃষি ঋণের উপখাতভিত্তিক বিশ্লেষণ

কৃষি ঋণ বিতরণের উপখাত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শস্য উৎপাদনে ঋণের অংশ ৪৪ শতাংশ থেকে কমে ৪৩ শতাংশে নেমে এসেছে। দারিদ্র্য দূরীকরণে ঋণের অংশও ৮ শতাংশ থেকে কমে ৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবে মৎস্য, পশুপালন ও পোল্ট্রি খাতে ঋণের প্রবাহ কিছুটা বেড়েছে।

চলতি অর্থবছরে কৃষি ঋণের ৩৮ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ১২ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা বিতরণের দায়িত্ব রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর, আর ২৫ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা বিতরণ করবে বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলো। তবে বিদেশি ব্যাংকগুলো থেকে কৃষি ঋণের প্রবাহ ৭১ শতাংশ এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ৩১ শতাংশ কমেছে। সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর কৃষি ঋণ বিতরণও ১৬ শতাংশের বেশি হ্রাস পেয়েছে।

ঋণ আদায়ে কৃষি খাতের শীর্ষ অবস্থান

ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কৃষি ঋণ বিতরণ কমেছে। তবে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে কৃষি খাত বরাবরই দেশের সবচেয়ে ভালো পারফরমার। ২০২৪ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে কৃষি খাতে ঋণ আদায় হয়েছে ৯ হাজার ২০৯ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮ হাজার ১৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা। অর্থাৎ, কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ কমলেও ঋণ আদায়ের হার ১৫ শতাংশ বেড়েছে।

অন্যদিকে, দেশের গ্রামীণ ব্যাংক ও শীর্ষ ১০টি এনজিও প্রতিষ্ঠান ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে কৃষি খাতে ১৫ হাজার ৭১০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করেছে, যা গত বছরের তুলনায় ০.৬২ শতাংশ বেশি। এনজিওগুলো ঋণ বিতরণের ধারা বজায় রাখতে পারলেও তফসিলি ব্যাংকগুলো পিছিয়ে পড়ছে।

উর্বরতা হ্রাস ও উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এক গবেষণা অনুযায়ী, ১৯৯১-২০০০ সালে দেশের জমির উর্বরতা ছিল ২.৭৫ শতাংশ, যা ২০০১-২০১০ সালে বেড়ে ৩.৩০ শতাংশে উন্নীত হয়। কিন্তু ২০১১-২০২০ সালে এটি নেমে এসে মাত্র ০.৪৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সার, কীটনাশক ও ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ধানের উৎপাদন খরচ ক্রমাগত বাড়ছে। ২০১২ সালে প্রতি কেজি চাল উৎপাদন খরচ ছিল ১০.৫১ টাকা, যা ২০১৫ সালে ১১.৬৭ টাকা এবং ২০১৮ সালে ১২.৮৮ টাকায় উন্নীত হয়েছে। অন্যদিকে, প্রতি কেজি চাল বিক্রি করে ২০১২ সালে কৃষক ১৬.১৭ টাকা লাভ করলেও, ২০১৮ সালে এটি ১৭.৪৮ টাকায় পৌঁছেছে। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির ফলে কৃষকের লাভের পরিমাণ কমছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে কৃষকরা ধান চাষে আগ্রহ হারাতে পারেন।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও কৃষি খাতের ক্ষতি

সাম্প্রতিক বন্যায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লেগেছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ৩৭ লাখ ২ হাজার ৭৩৩ হেক্টর জমি বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে, যার ফলে অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। এই বিপুল ক্ষতি গ্রামীণ জনপদের জীবনযাত্রায় মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

উন্নয়নের জন্য জরুরি পদক্ষেপ

কৃষি খাতের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো, কৃষকবান্ধব নীতি গ্রহণ এবং সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করতে হবে। ফসল উৎপাদনের মৌলিক উপাদান মাটি ও পানির দূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার কারণে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, যা দ্রুত সমাধান করা দরকার।

গ্রামীণ অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি। কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। ফসল উৎপাদনের নতুন জাত উদ্ভাবন করতে হবে। কৃষিপণ্য সংরক্ষণ ও বিপণন ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ করা দরকার। উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।

কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়নে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। বিশেষ করে বন্যা, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় কার্যকর নীতি গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় গ্রামীণ অর্থনীতির সংকট আরও গভীর হতে পারে।

[লেখক: সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি]

back to top