alt

opinion » post-editorial

আরজি কর : শাসক রোষে ভিকটিমের পরিবার

গৌতম রায়

: শনিবার, ০১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

আরজি করকা-ে ধর্ষিতা, মৃতা, তিলোত্তমার বাবা-মাকে শিয়ালদা কোর্টের রায় প্রকাশিত হবার পর যে ভাষায় পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা আক্রমণ করছেন, তার উত্তরে একটা কথাই বলতে পারা যায় যে, ধরণী দ্বিধা হও। তিলোত্তমা কা- ঘিরে যে প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের অঙ্গীকার গত কয়েক মাস ধরে কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গে নয়, বা কেবলমাত্র ভারতেই নয়। গোটা বিশ্বের ধীশক্তিসম্পন্ন মানুষদের মধ্যে উচ্চারিত হচ্ছে। তার সঙ্গে সম্পৃক্ত গতিতে যদি নিজের কন্যার খুন এবং ধর্ষণের বিচার ঘিরে নির্যাতিতার বাবা-মা প্রতিবাদ করেন, প্রতিরোধের সংকল্পের কথা বলেন, তবে কি সেটা অপরাধ?

তারা যদি রাজ্যের প্রচলিত প্রশাসনের উপর আস্থা রাখতে না পারেন, সেটা কি তাদের অপরাধ? আর তার জন্য তাদের টাকা-পয়সা দিয়ে কোনও বিরোধী রাজনৈতিক দলের হয়ে ওকালতি করবার অপবাদ শুনতে হবে? তাদের প্রতিবাদের জন্যে, মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি অনাস্থার জন্যে এই অপবাদ দেবেন শাসকদলের তাবড় তাবড় নেতারা?

আরজি কর কা-ের সঙ্গে যদি শাসকদলের কোনোরকম সম্পর্ক নাই থাকে, তাহলে তিলোত্তমার বাবা-মার প্রতিবাদ ঘিরে কেন এত রাগ? উচ্চারণ করতেও দ্বিধা হয়, এমন সব শব্দ, রাজ্যের শাসকদলের বড় বড় নেতারা ব্যবহার করছেন নির্যাতিতার পরিবার ঘিরে? যদি শাসকদলের কোন ভূমিকাই না থাকে তিলোত্তমা ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায়, তাহলে তার বাবা, মা আদালতের রায় ঘিরে যা মন্তব্যই করে থাকুনই না কেন, তা কেন গায়ে ফোসকা পড়াচ্ছে শাসকদলের বড় বড় নেতাদের?

একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু। তারপর তার বাবা-মাকে টাকা পয়সা দিয়ে মুখ বন্ধ করবার চেষ্টা খোদ শাসক দলের পক্ষ থেকে। এই টাকা দেওয়ার প্রস্তাব উচ্চারিত হয়েছে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর মুখ থেকে। শাসক দলের দাবার ঘুঁটির দান হতে না চাওয়া নির্যাতিতার বাবা-মা। কন্যার ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে তাদের মুখর ভূমিকা পালন করা। কোনও রাজনৈতিক দলের ছত্র ছায়ায় তা পালন না করা। সমস্ত ধরনের প্রতিবাদী প্রতিরোধী মানুষের সংকল্পে তাদের একাত্ম হয়ে থাকা। প্রতিবাদের লক্ষ্য টা খোদ সদর দপ্তরের দিকে হানা। সে যেন সদর দপ্তরে কামান দাগার মতো করে তাদের প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হওয়া।

এটাই কি তাদের অপরাধ? এ জন্যই কি শাসক দলের নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত নেতারা, জেল খাটা নেতারা, তারা সরাসরি নির্যাতিতার বাবা-মার মুখ বন্ধ করবার জন্য লেখার অযোগ্য ভাষায়, টাকা পয়সা থেকে শুরু করে নানা ধরনের কথাবার্তা বলতে শুরু করেছেন?

পশ্চিমবঙ্গে বিগত এক যুগের বেশি সময় ধরে কোন মানুষের প্রতিবাদ করবার এতোটুকু অধিকার নেই। শাসক পশ্চিমবঙ্গে গত একযুগের বেশি সময় ধরে এমন একটা ফ্যাসিবাদী মানসিকতা বলবৎ করেছে, যার দরুন কোন মানুষ প্রতিবাদের কথা উচ্চারিত করতে পারে না। যদি কোন মানুষ শাসকের কোনো বিষয় ঘিরে প্রতিবাদ করে, শাসক দলের কোনো বিষয়ে ঘিরে প্রতিবাদ করে, তাহলে তাদের ধোপা নাপিত পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়।

শাসক দলের পক্ষ থেকে নির্যাতিতার পরিবারের ওপর, বিশেষ করে তার বাবা, মায়ের উপরে এমন ভাষায় আক্রমণ শুরু হয়েছে যে, শব্দগুলো লিখতেও দ্বিধা বোধ হয়। এই আক্রমণ প্রথম শুরু করলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব যার নাম কাগজে-কলমে লিখতে ঘৃণাবোধ হয়। তৃণমূল কংগ্রেসকে ক্ষমতায় আনবার জন্য যে ব্যাপক অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি পশ্চিমবঙ্গের বুকে, বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীনই ঘটতে শুরু করেছিল তা হলো সারদা নামক চিটফান্ড কেলেঙ্কারি। যেটি ঘটতে শুরু করেছিল পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসক দলের পক্ষপাতিত্বে আর তারাই সেই সময় বামফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করবার জন্য সব রকমভাবে যতœবান ছিল, তাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতাতেও কার্যকরী ছিল। সেই সারদা নামক চিটফান্ডের অন্যতম প্রধান মুখপাত্র হিসেবে যে লোকটি বহু বিতর্কিত, যার শিক্ষাগত যোগ্যতা থেকে শুরু করে সমস্ত ধরনের বিষয় ঘিরে বহু ধরনের বিতর্ক রয়েছে। সেই ব্যক্তিটিই আরজিকর কান্ডে নির্যাতিতার পরিবারকে ঘিরে যে ভাষায় আক্রমণ করেছে, তা কোনো সভ্য ভদ্রলোকের মুখের ভাষা হতে পারে না, রাজনৈতিক লোক তো কোন দূরের কথা।

এই ব্যক্তিটির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, টাকার লোভে নাকি আরজিকর কা-ে নির্যাতিতার পরিবার, রাজ্যের প্রধান বিরোধীদল সিপিআইয়ের (এম) উস্কানিতে এ ধরনের অভিযোগ করে চলেছে।

আরজি কর কা- ঘটবার অব্যাহিত পরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্য সভায় নির্যাতিতার পরিবারকে টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করবার চেষ্টা করেছিলেন। সেদিনই নির্যাতিতার পরিবার ঘৃণাভরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তারপরেও পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ছলেবলে কৌশলে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের পক্ষ থেকে নির্যাতিতার পরিবারকে টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করবার চেষ্টা করা হয়। চাপ দেওয়া হয়। ভয় দেখানো হয়। নানা ধরনের হুমকি পর্যন্ত দেখান দেওয়া হয়।

এসব সত্ত্বেও নির্যাতিতার পরিবার কোনো অবস্থাতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল বা তার স্থানীয় স্তরের নানা ধরনের দুষ্কৃতদের চাপের কাছে এতোটুকু আত্মসমর্পণ করেনি। তারা বারবার বলেছিলেন, আমরা বিচার চাই। নির্যাতিতার খুনি কারা? বা এই খুনকে ঘিরে যে গভীরতার ষড়যন্ত্র, তার বিচার চাই। গোটা ষড়যন্ত্রের উন্মোচন চাই। তাদের এই দাবির স্বপক্ষে গোটা পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক দল-মত নির্বিশেষে সমবেত হয়েছেন। রাত জেগেছেন। জুনিয়র ডাক্তার বাবুরা নানা দাবিকে সম্পৃক্ত করে নির্যাতিতার বিচারের দাবিকে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন। দীর্ঘদিন অনশন করেছেন। তা সত্ত্বেও কিন্তু নির্যাতিতার বিচার ঘিরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বা পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল কখনো কোনোরকম ইতিবাচক কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বরঞ্চ গোটা বিচারের দাবিটিকেই তারা অনভিপ্রেত বলে মনে করেছেন এবং বিচারের দাবিতে যাতে সাধারণ মানুষের চিন্তা চেতনার বাইরে উপস্থাপিত হয়, তার জন্য নানা ধরনের প্রগলভ কথাবার্তা, বিষান্তর কথাবার্তা তারা প্রকাশ্যে বলেছেন। তাদের পেটোয়া সংবাদমাধ্যমের দ্বারা নানাভাবে চেষ্টা করেছেন কী করে আর জি করের নির্যাতিতার বিচারের বিষয়টিকে জোলো করে দিতে পারা যায়।

পশ্চিমবঙ্গের নানা ধরনের শাসকের তল্পিবাহী মিডিয়াকে বিজ্ঞাপনের নামে উপঢৌকন দিয়েছে শাসক। তা সত্ত্বেও কিন্তু সাধারণ মানুষ, নির্যাতিতার বিচারের দাবিতে মুখর থেকেছেন। কোনো অবস্থাতেই তারা তাদের দাবি থেকে সরে আসেননি। এই দাবি যারা করেছেন তাদের মধ্যে যেমন বিরোধী দলের মানুষ আছেন, আবার এমন মানুষ আছেন, যারা বিরোধী দলের সমর্থক নয়। আবার শাসক দলের সমর্থকও নন। বিবেকবোধসম্পন্ন যে সমস্ত মানুষ আছেন, যারাই অন্যায়-অবিচার, অসৎ আচরণ মেনে নিতে অপারক, তারা প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন। প্রতিরোধের সংকল্পে মুখর হয়েছেন; কিন্তু এ সমস্ত কিছুকে অস্বীকার করে শাসক দল, শিয়ালদা কোর্টের রায় প্রকাশিত হবার পর এমনভাবে নির্যাতিতার পরিবারের প্রতি ব্যক্তিগত আক্রমণ উন্মুখ হয়েছে; যা ভাবলে আমাদের সত্যিই মানবিক বোধগুলো কেমন যেন শিউরে ওঠে।

কোন মা-বাবা নিজের মেয়ের ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পরে খুন ঘিরে টাকা নিয়ে দরকষাকষি করবার স্বার্থে বিরোধী দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফেলতে পারেন, আরজি কর কা-ে নির্যাতিতার পরিবার ঘিরে শাসক দলের বিভিন্ন ধরনের নেতা, যাদের নাম লিখতে পর্যন্ত ঘৃণা হয়, তারা অভিযোগ করছে। বিশ্ব মানবতা একদিন না একদিন পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের এ অভিযোগের বিচার করবে এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। যে মা তার সন্তান হারিয়েছেন, যে বাবা তার সন্তান হারিয়েছেন, সেই মা, সেই বাবা, তার সন্তানের ধর্ষণ এবং খুনের বিনিময় টাকা ঘিরে দরকষাকষি করবার জন্য হাতে হাত মিলিয়েছেনÑ এ অভিযোগ করছেন রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের এমন ধরনের লোকজনেরা, যারা দুর্নীতির অভিযোগে, আর্থিক তছরূপের অভিযোগে জেল বাস করেছে। কেন্দ্রীয় শাসক দলের সঙ্গে রাজ্যের শাসক দলের বন্দোবস্তের ভিত্তিতে তারা এই মুহূর্তে জামিনে আছে। তাদের মামলা এখনো পর্যন্ত শেষ হয়নি। তাদের এক কথায় নির্দোষ কোন অবস্থাতেই কখনো বলতে পারা যায় না এই মুহূর্তে।

আসলে পশ্চিমবঙ্গে এখন একটা এমন ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে যেখানে কখনো কোনো অবস্থাতেই কোনোরকম অভিযোগ করতে পারা সম্ভব নয় শাসক দলের বিরুদ্ধে। শাসক দলের বিরুদ্ধে যদি কেউ কোনরকম অভিযোগ তোলেন, তাহলে তিনি শাসকের এতটাই অসুয়ার সম্মুখীন হন, যার দ্বারা তার জীবন এবং জীবিকা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

শারদীয় পূজার দিনলিপি

ঋণের জন্য আত্মহত্যা, ঋণ নিয়েই চল্লিশা

জাকসু নির্বাচন ও হট্টগোল: আমাদের জন্য শিক্ষণীয় কী?

নরসুন্দর পেশার গুরুত্ব ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন

বিভাগভিত্তিক এমপিআর নির্বাচন পদ্ধতি

প্ল্যাটফর্ম সমাজে বাংলাদেশ: জ্ঞানের ভবিষ্যৎ কার হাতে?

আনন্দবেদনার হাসপাতাল: সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ছবি

ভিন্ন ধরনের নির্বাচন, ভিন্ন ধরনের ফল

বেসরকারি খাতে সিআইবি’র যাত্রা: ঋণ ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত

স্বাস্থ্যসেবায় মানবিকতা প্রতিষ্ঠা হোক

ছবি

নেপালে সরকার পতন ও বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ

ডাকসু নির্বাচন ও সংস্কারপ্রয়াস: রাজনৈতিক চিন্তার নতুন দিগন্ত

নির্বাচন কি সব সমস্যার সমাধান

জিতিয়া উৎসব

ছবি

অলির পর নেপাল কোন পথে?

রম্যগদ্য: “মরেও বাঁচবি নারে পাগলা...”

অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শ্রীপুর পৌরসভা

ভূরিভোজ, উচ্ছেদ এবং আদিবাসী পাহাড়িয়া

অনলাইন সংস্কৃতিতে হাস্যরসের সমাজবিজ্ঞান

মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার

বাস্তব মস্কো বনাম বিভ্রান্ত ইউরোপ

ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতির গতিপ্রকৃতি

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

ছবি

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

একজন নাগরিকের অভিমানী বিদায় ও রাষ্ট্রের নৈতিক সংকট

tab

opinion » post-editorial

আরজি কর : শাসক রোষে ভিকটিমের পরিবার

গৌতম রায়

শনিবার, ০১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

আরজি করকা-ে ধর্ষিতা, মৃতা, তিলোত্তমার বাবা-মাকে শিয়ালদা কোর্টের রায় প্রকাশিত হবার পর যে ভাষায় পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা আক্রমণ করছেন, তার উত্তরে একটা কথাই বলতে পারা যায় যে, ধরণী দ্বিধা হও। তিলোত্তমা কা- ঘিরে যে প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের অঙ্গীকার গত কয়েক মাস ধরে কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গে নয়, বা কেবলমাত্র ভারতেই নয়। গোটা বিশ্বের ধীশক্তিসম্পন্ন মানুষদের মধ্যে উচ্চারিত হচ্ছে। তার সঙ্গে সম্পৃক্ত গতিতে যদি নিজের কন্যার খুন এবং ধর্ষণের বিচার ঘিরে নির্যাতিতার বাবা-মা প্রতিবাদ করেন, প্রতিরোধের সংকল্পের কথা বলেন, তবে কি সেটা অপরাধ?

তারা যদি রাজ্যের প্রচলিত প্রশাসনের উপর আস্থা রাখতে না পারেন, সেটা কি তাদের অপরাধ? আর তার জন্য তাদের টাকা-পয়সা দিয়ে কোনও বিরোধী রাজনৈতিক দলের হয়ে ওকালতি করবার অপবাদ শুনতে হবে? তাদের প্রতিবাদের জন্যে, মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি অনাস্থার জন্যে এই অপবাদ দেবেন শাসকদলের তাবড় তাবড় নেতারা?

আরজি কর কা-ের সঙ্গে যদি শাসকদলের কোনোরকম সম্পর্ক নাই থাকে, তাহলে তিলোত্তমার বাবা-মার প্রতিবাদ ঘিরে কেন এত রাগ? উচ্চারণ করতেও দ্বিধা হয়, এমন সব শব্দ, রাজ্যের শাসকদলের বড় বড় নেতারা ব্যবহার করছেন নির্যাতিতার পরিবার ঘিরে? যদি শাসকদলের কোন ভূমিকাই না থাকে তিলোত্তমা ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায়, তাহলে তার বাবা, মা আদালতের রায় ঘিরে যা মন্তব্যই করে থাকুনই না কেন, তা কেন গায়ে ফোসকা পড়াচ্ছে শাসকদলের বড় বড় নেতাদের?

একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু। তারপর তার বাবা-মাকে টাকা পয়সা দিয়ে মুখ বন্ধ করবার চেষ্টা খোদ শাসক দলের পক্ষ থেকে। এই টাকা দেওয়ার প্রস্তাব উচ্চারিত হয়েছে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর মুখ থেকে। শাসক দলের দাবার ঘুঁটির দান হতে না চাওয়া নির্যাতিতার বাবা-মা। কন্যার ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে তাদের মুখর ভূমিকা পালন করা। কোনও রাজনৈতিক দলের ছত্র ছায়ায় তা পালন না করা। সমস্ত ধরনের প্রতিবাদী প্রতিরোধী মানুষের সংকল্পে তাদের একাত্ম হয়ে থাকা। প্রতিবাদের লক্ষ্য টা খোদ সদর দপ্তরের দিকে হানা। সে যেন সদর দপ্তরে কামান দাগার মতো করে তাদের প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হওয়া।

এটাই কি তাদের অপরাধ? এ জন্যই কি শাসক দলের নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত নেতারা, জেল খাটা নেতারা, তারা সরাসরি নির্যাতিতার বাবা-মার মুখ বন্ধ করবার জন্য লেখার অযোগ্য ভাষায়, টাকা পয়সা থেকে শুরু করে নানা ধরনের কথাবার্তা বলতে শুরু করেছেন?

পশ্চিমবঙ্গে বিগত এক যুগের বেশি সময় ধরে কোন মানুষের প্রতিবাদ করবার এতোটুকু অধিকার নেই। শাসক পশ্চিমবঙ্গে গত একযুগের বেশি সময় ধরে এমন একটা ফ্যাসিবাদী মানসিকতা বলবৎ করেছে, যার দরুন কোন মানুষ প্রতিবাদের কথা উচ্চারিত করতে পারে না। যদি কোন মানুষ শাসকের কোনো বিষয় ঘিরে প্রতিবাদ করে, শাসক দলের কোনো বিষয়ে ঘিরে প্রতিবাদ করে, তাহলে তাদের ধোপা নাপিত পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়।

শাসক দলের পক্ষ থেকে নির্যাতিতার পরিবারের ওপর, বিশেষ করে তার বাবা, মায়ের উপরে এমন ভাষায় আক্রমণ শুরু হয়েছে যে, শব্দগুলো লিখতেও দ্বিধা বোধ হয়। এই আক্রমণ প্রথম শুরু করলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব যার নাম কাগজে-কলমে লিখতে ঘৃণাবোধ হয়। তৃণমূল কংগ্রেসকে ক্ষমতায় আনবার জন্য যে ব্যাপক অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি পশ্চিমবঙ্গের বুকে, বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীনই ঘটতে শুরু করেছিল তা হলো সারদা নামক চিটফান্ড কেলেঙ্কারি। যেটি ঘটতে শুরু করেছিল পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসক দলের পক্ষপাতিত্বে আর তারাই সেই সময় বামফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করবার জন্য সব রকমভাবে যতœবান ছিল, তাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতাতেও কার্যকরী ছিল। সেই সারদা নামক চিটফান্ডের অন্যতম প্রধান মুখপাত্র হিসেবে যে লোকটি বহু বিতর্কিত, যার শিক্ষাগত যোগ্যতা থেকে শুরু করে সমস্ত ধরনের বিষয় ঘিরে বহু ধরনের বিতর্ক রয়েছে। সেই ব্যক্তিটিই আরজিকর কান্ডে নির্যাতিতার পরিবারকে ঘিরে যে ভাষায় আক্রমণ করেছে, তা কোনো সভ্য ভদ্রলোকের মুখের ভাষা হতে পারে না, রাজনৈতিক লোক তো কোন দূরের কথা।

এই ব্যক্তিটির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, টাকার লোভে নাকি আরজিকর কা-ে নির্যাতিতার পরিবার, রাজ্যের প্রধান বিরোধীদল সিপিআইয়ের (এম) উস্কানিতে এ ধরনের অভিযোগ করে চলেছে।

আরজি কর কা- ঘটবার অব্যাহিত পরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্য সভায় নির্যাতিতার পরিবারকে টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করবার চেষ্টা করেছিলেন। সেদিনই নির্যাতিতার পরিবার ঘৃণাভরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তারপরেও পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ছলেবলে কৌশলে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের পক্ষ থেকে নির্যাতিতার পরিবারকে টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করবার চেষ্টা করা হয়। চাপ দেওয়া হয়। ভয় দেখানো হয়। নানা ধরনের হুমকি পর্যন্ত দেখান দেওয়া হয়।

এসব সত্ত্বেও নির্যাতিতার পরিবার কোনো অবস্থাতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল বা তার স্থানীয় স্তরের নানা ধরনের দুষ্কৃতদের চাপের কাছে এতোটুকু আত্মসমর্পণ করেনি। তারা বারবার বলেছিলেন, আমরা বিচার চাই। নির্যাতিতার খুনি কারা? বা এই খুনকে ঘিরে যে গভীরতার ষড়যন্ত্র, তার বিচার চাই। গোটা ষড়যন্ত্রের উন্মোচন চাই। তাদের এই দাবির স্বপক্ষে গোটা পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক দল-মত নির্বিশেষে সমবেত হয়েছেন। রাত জেগেছেন। জুনিয়র ডাক্তার বাবুরা নানা দাবিকে সম্পৃক্ত করে নির্যাতিতার বিচারের দাবিকে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন। দীর্ঘদিন অনশন করেছেন। তা সত্ত্বেও কিন্তু নির্যাতিতার বিচার ঘিরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বা পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল কখনো কোনোরকম ইতিবাচক কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বরঞ্চ গোটা বিচারের দাবিটিকেই তারা অনভিপ্রেত বলে মনে করেছেন এবং বিচারের দাবিতে যাতে সাধারণ মানুষের চিন্তা চেতনার বাইরে উপস্থাপিত হয়, তার জন্য নানা ধরনের প্রগলভ কথাবার্তা, বিষান্তর কথাবার্তা তারা প্রকাশ্যে বলেছেন। তাদের পেটোয়া সংবাদমাধ্যমের দ্বারা নানাভাবে চেষ্টা করেছেন কী করে আর জি করের নির্যাতিতার বিচারের বিষয়টিকে জোলো করে দিতে পারা যায়।

পশ্চিমবঙ্গের নানা ধরনের শাসকের তল্পিবাহী মিডিয়াকে বিজ্ঞাপনের নামে উপঢৌকন দিয়েছে শাসক। তা সত্ত্বেও কিন্তু সাধারণ মানুষ, নির্যাতিতার বিচারের দাবিতে মুখর থেকেছেন। কোনো অবস্থাতেই তারা তাদের দাবি থেকে সরে আসেননি। এই দাবি যারা করেছেন তাদের মধ্যে যেমন বিরোধী দলের মানুষ আছেন, আবার এমন মানুষ আছেন, যারা বিরোধী দলের সমর্থক নয়। আবার শাসক দলের সমর্থকও নন। বিবেকবোধসম্পন্ন যে সমস্ত মানুষ আছেন, যারাই অন্যায়-অবিচার, অসৎ আচরণ মেনে নিতে অপারক, তারা প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন। প্রতিরোধের সংকল্পে মুখর হয়েছেন; কিন্তু এ সমস্ত কিছুকে অস্বীকার করে শাসক দল, শিয়ালদা কোর্টের রায় প্রকাশিত হবার পর এমনভাবে নির্যাতিতার পরিবারের প্রতি ব্যক্তিগত আক্রমণ উন্মুখ হয়েছে; যা ভাবলে আমাদের সত্যিই মানবিক বোধগুলো কেমন যেন শিউরে ওঠে।

কোন মা-বাবা নিজের মেয়ের ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পরে খুন ঘিরে টাকা নিয়ে দরকষাকষি করবার স্বার্থে বিরোধী দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফেলতে পারেন, আরজি কর কা-ে নির্যাতিতার পরিবার ঘিরে শাসক দলের বিভিন্ন ধরনের নেতা, যাদের নাম লিখতে পর্যন্ত ঘৃণা হয়, তারা অভিযোগ করছে। বিশ্ব মানবতা একদিন না একদিন পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের এ অভিযোগের বিচার করবে এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। যে মা তার সন্তান হারিয়েছেন, যে বাবা তার সন্তান হারিয়েছেন, সেই মা, সেই বাবা, তার সন্তানের ধর্ষণ এবং খুনের বিনিময় টাকা ঘিরে দরকষাকষি করবার জন্য হাতে হাত মিলিয়েছেনÑ এ অভিযোগ করছেন রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের এমন ধরনের লোকজনেরা, যারা দুর্নীতির অভিযোগে, আর্থিক তছরূপের অভিযোগে জেল বাস করেছে। কেন্দ্রীয় শাসক দলের সঙ্গে রাজ্যের শাসক দলের বন্দোবস্তের ভিত্তিতে তারা এই মুহূর্তে জামিনে আছে। তাদের মামলা এখনো পর্যন্ত শেষ হয়নি। তাদের এক কথায় নির্দোষ কোন অবস্থাতেই কখনো বলতে পারা যায় না এই মুহূর্তে।

আসলে পশ্চিমবঙ্গে এখন একটা এমন ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে যেখানে কখনো কোনো অবস্থাতেই কোনোরকম অভিযোগ করতে পারা সম্ভব নয় শাসক দলের বিরুদ্ধে। শাসক দলের বিরুদ্ধে যদি কেউ কোনরকম অভিযোগ তোলেন, তাহলে তিনি শাসকের এতটাই অসুয়ার সম্মুখীন হন, যার দ্বারা তার জীবন এবং জীবিকা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

back to top