সংগীত কুমার
শিক্ষা একটি জাতির অগ্রগতির মূল হাতিয়ার। একটি সুসংগঠিত শিক্ষাব্যবস্থা একটি জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথকে সহজ করে দেয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার চরম অব্যবস্থাপনা ও নীতিগত দুর্বলতা শিক্ষার্থীদের জন্য মারাত্মক সংকট তৈরি করেছে। বিশেষ করে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের নামে অব্যবস্থাপনা, ভুলত্রুটি সংশোধনে দীর্ঘসূত্রিতা এবং পাঠ্যবই সরবরাহে গাফিলতির কারণে শিক্ষাব্যবস্থা আজ বড় চ্যালেঞ্জের মুখে।
জুলাই অভ’্যত্থানের পর মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে, অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত তাদের পড়ার ধারায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে। কিন্তু আদতে হচ্ছে তার উল্টো। নতুন শিক্ষাবর্ষের এক মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন পাঠ্যবই তুলে দিতে পারেনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ঠিক কবে নাগাদ সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাবে এ নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। কারণ পাঠ্যপুস্তকে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সংযোজন-বিয়োজন শেষে অনেক বই এখনও ছাপাখানা থেকে বিতরণের উপর্যুক্ত হয়ে ওঠেনি। এদিকে বই না পাওয়ায় পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠদান কার্যক্রম! বই সংকটে ঠিকমতো ক্লাস না হওয়ায়, শিক্ষার্থীরা স্কুলবিমুখী হচ্ছে। এই সংকট শুধু শিক্ষার গতিকে থামিয়ে দিচ্ছে না বরং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিতার মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
শিক্ষকরা বলছেন, বই না পাওয়ায় শিক্ষার্থীরা স্কুলবিমুখ হচ্ছে। ফলে অন্য সময়ের তুলনায় শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার এখন অনেক বেশি। বই না থাকায় শিক্ষার্থীদের ক্লাসে মনোযোগ হচ্ছে ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কারণ বই ছাড়া ক্লাস করতে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কম। এই অজুহাতে শিক্ষকরাও ক্লাস নিতে চাচ্ছেন না। ফলে পড়াশোনা থেকে শিক্ষার্থীরা দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছে। পড়াশোনার বদলে খেলাধুলা আর আড্ডা দিয়ে তাদের সময় কাটছে, যা তাদের পড়াশোনায় অপূরণীয় ক্ষতির সৃষ্টি করছে। মূলত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এর আসল ভুক্তভোগী, যা তাদের মৌলিক শিক্ষার ভিত্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। অর্থাৎ, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শুধু শিক্ষাগতভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে না, বরং তাদের সৃজনশীলতা, বিশ্লেষণী দক্ষতা ও বাস্তবজ্ঞান অর্জনের ক্ষমতাও ব্যাহত হচ্ছে, যা সামগ্রিকভাবে জাতির অগ্রগতি ও উন্নয়নের পথে বড় বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
এনসিটিবির তথ্যমতে, এবার প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪ কোটি ৩৪ লাখ ৩ হাজার ২৮৩ জন। তাদের জন্য ছাপা হচ্ছে ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২ কপি বই। প্রাথমিকে ২ কোটি ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৪৭৯ জন শিক্ষার্থীর জন্য ছাপানো হচ্ছে ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫৫ বই। আর মাধ্যমিক পর্যায়ের ২ কোটি ২৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮০৪ জন শিক্ষার্থীর জন্য ছাপানো হচ্ছে ৩০ কোটি ৯৬ লাখ ১২ হাজার ৮৪৭ কপি বই। এছাড়াও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য জন্য সাড়ে আট হাজার বই পাশাপাশি শিক্ষকের জন্য প্রায় ৪১ লাখ সহায়িকা বই ছাপানো হচ্ছে। এই ৪০ কোটি বই ছাপতে প্রয়োজন ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার টন কাগজ।
কিন্তু দেশে এই বিপুল পরিমাণ কাগজের মজুত আছে কিনা তা বিবেচনা করে দেখেনি এনসিটিবি। ফলে ছাপাখানাগুলো একযোগে কাজ শুরু করলে দেখা দেয় কাগজের সংকট। উদ্বুদ্ধ এই পরিস্থিতিরই সুযোগ নেয় কাগজ মিল মালিকরা। দফায় দফায় তারা কাগজের মূল্য বাড়ানোয় গত এক মাসের ব্যবধানে প্রতি টন কাগজের দাম বেড়েছে ৩০ হাজার টাকা। এই সুযোগে তারা হাতিয়ে নিয়েছে ৩৪৫ কোটি টাকারও বেশি। এখন বেশি দাম দিয়েও চাহিদা অনুযায়ী কাগজ পাচ্ছে না পাঠ্যবই ছাপানোর দায়িত্বে থাকা ১১৬ ছাপাখানা। ফলে অধিকাংশ ছাপাখানা কাগজ সংকটে প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা বই ছাপানো বন্ধ রাখছে। যার ফলে বই ছাপানোর কাজ নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অনেক পিছিয়ে যাচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং তাদের একাডেমিক কার্যক্রমকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা জানিয়েছেন, ‘বছরের প্রথম দিন যে ৬ কোটি বই দেয়ার কথা দাবি করা হয়েছে, তা আসলে সঠিক নয়। বই মূলত গেছে ২ কোটি ৮৫ লাখ কপি।’ সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, শিক্ষার্থীদের হাতে এখনো ৭০ শতাংশ বই পৌঁছায়নি, যার ফলে শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই সংকটে পড়েছে। এ অবস্থায় সঠিক সময়ে বই বিতরণ না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক পড়াশোনা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এদিকে, এনসিটিবির সম্পাদনা কমিটি পাঠ্যবই সম্পাদনার কাজে দীর্ঘ সময় নিলেও আগের পাঠ্যবই ও এ বছরের পাঠ্যবই বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নতুন কারিকুলামে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আনা হয়নি। বরং, বইয়ের কিছু ভুল-ভ্রান্তি ও অসঙ্গতি শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করছে। বিশিষ্টজনদের মতে, পাঠ্যবই সম্পাদনার জন্য এত দীর্ঘ সময় নেয়া মোটেও যৌক্তিক হয়নি, বরং সময়মতো ও মানসম্মত বই প্রকাশ করাই ছিল মূল লক্ষ্য।
শিক্ষার্থীদের হাতে যথাসময়ে সঠিক ও নির্ভুল পাঠ্যবই পৌঁছে দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত ভুল সংশোধন, যথাযথ সম্পাদনা এবং বই বিতরণের কার্যক্রমকে স্বচ্ছ ও সময়োপযোগী করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা বজায় থাকে।
এখন যে কয়েকটি প্রেস ছাপার কাজ করছে, তারা যদি কাগজ ও কালিসহ আনুষঙ্গিক সব উপকরণ ঠিকমতো পায়, তাহলে দৈনিক বই ছাপতে পারবে ৫০ লাখ কপি। কিন্তু প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাবে বর্তমানে গড়ে প্রতিদিন ছাপা হচ্ছে মাত্র ১৫-২৫ লাখ কপি, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তদুপরি, মূলত ছোট বইগুলো ছাপানো হলেও বড় বইগুলোর ছাপার কাজ এখনো বাকি রয়েছে।
সরকারি হিসাবে, এ বছর শিক্ষার্থীদের জন্য ৪০ কোটি বই ছাপানোর কথা থাকলেও এখনো অর্ধেক বইও ছাপা হয়নি। বর্তমানে প্রায় ২০ কোটি বই ছাপানো বাকি। যদি গড়ে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ২৫ লাখ কপি বইও ছাপা হয়, তবে সব বই ছাপতে সময় লাগবে ৮০ দিন। অর্থাৎ, এই ধীরগতিতে চলতে থাকলে এপ্রিল মাসেও বই ছাপার কাজ শেষ হবে না! ফলে প্রশ্ন থেকেই যায়Ñ শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছাবে কবে?
এ ধরনের পরিস্থিতি শিক্ষার ধারাবাহিকতা ও মানের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বছরের শুরুতে পাঠ্যবই না পাওয়ার ফলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় বিঘœ ঘটছে, যা তাদের শেখার আগ্রহ কমিয়ে দিতে পারে। এছাড়া, দেরিতে বই হাতে পাওয়ায় শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাঠ্যসূচি শেষ করতে পারবে কিনা, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে।
অপরদিকে, পাঠ্যবই ছাপানোর ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা ও অব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ববোধ ও সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে। সময়মতো কাগজ, কালি ও অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করা হলে বই ছাপার গতি বাড়ানো সম্ভব হতো। তাই দ্রুত এই সংকট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। শিক্ষাব্যবস্থা কোনো পরীক্ষামূলক ব্যবস্থা নয়, যেখানে বছরের পর বছর অব্যবস্থাপনা চলতে থাকবে। শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সবার আগে বিবেচনায় রেখে বই ছাপানো ও বিতরণের প্রক্রিয়াকে আরও দক্ষ, স্বচ্ছ ও সময়োপযোগী করা দরকার। অন্যথায়, বছরের পর বছর একই সমস্যার পুনরাবৃত্তি ঘটবে এবং শিক্ষার্থীরা তাদের মৌলিক শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
গত ২৪ জানুয়ারি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এক সংবাদ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেÑ বাংলাবাজার ও শেরপুর থেকে ২৪ হাজার সরকারি বিনামূল্যের পাঠ্যবই উদ্ধার করেছে পুলিশ। যখন সারা দেশে শিক্ষার্থীরা বই সংকটে ভুগছে, তখন এসব বই খোলা বাজারে অবাধে বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। যে বই ছাপাতে সরকারের ব্যয় হয় মাত্র ৩০ থেকে ৫০ টাকা, সেই বই ২০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক ও অনৈতিক।
এ ঘটনা শুধু অমানবিক নয়, বরং জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি ভয়াবহ অবিচার। সরকারি নীতিমালা অনুসারে, শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবই বিনামূল্যে সরবরাহ করার কথা, অথচ কিছু অসাধু ব্যক্তি ও ছাপাখানার মালিক এসব বই অবৈধভাবে গুদামজাত করে কিংবা বিক্রি করে দিচ্ছেন। এটি স্পষ্টতই শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি চরম অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার প্রতিফলন। শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, পাঠ্যবই বিতরণ ব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরেই জটিলতা ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। প্রশ্ন উঠছেÑ এত বড় অনিয়ম কীভাবে ঘটল? সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি কতটা কার্যকর? দায়ীদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে?
[লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়]
সংগীত কুমার
শনিবার, ০১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
শিক্ষা একটি জাতির অগ্রগতির মূল হাতিয়ার। একটি সুসংগঠিত শিক্ষাব্যবস্থা একটি জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথকে সহজ করে দেয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার চরম অব্যবস্থাপনা ও নীতিগত দুর্বলতা শিক্ষার্থীদের জন্য মারাত্মক সংকট তৈরি করেছে। বিশেষ করে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের নামে অব্যবস্থাপনা, ভুলত্রুটি সংশোধনে দীর্ঘসূত্রিতা এবং পাঠ্যবই সরবরাহে গাফিলতির কারণে শিক্ষাব্যবস্থা আজ বড় চ্যালেঞ্জের মুখে।
জুলাই অভ’্যত্থানের পর মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে, অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত তাদের পড়ার ধারায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে। কিন্তু আদতে হচ্ছে তার উল্টো। নতুন শিক্ষাবর্ষের এক মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন পাঠ্যবই তুলে দিতে পারেনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ঠিক কবে নাগাদ সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাবে এ নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। কারণ পাঠ্যপুস্তকে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সংযোজন-বিয়োজন শেষে অনেক বই এখনও ছাপাখানা থেকে বিতরণের উপর্যুক্ত হয়ে ওঠেনি। এদিকে বই না পাওয়ায় পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠদান কার্যক্রম! বই সংকটে ঠিকমতো ক্লাস না হওয়ায়, শিক্ষার্থীরা স্কুলবিমুখী হচ্ছে। এই সংকট শুধু শিক্ষার গতিকে থামিয়ে দিচ্ছে না বরং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিতার মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
শিক্ষকরা বলছেন, বই না পাওয়ায় শিক্ষার্থীরা স্কুলবিমুখ হচ্ছে। ফলে অন্য সময়ের তুলনায় শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার এখন অনেক বেশি। বই না থাকায় শিক্ষার্থীদের ক্লাসে মনোযোগ হচ্ছে ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কারণ বই ছাড়া ক্লাস করতে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কম। এই অজুহাতে শিক্ষকরাও ক্লাস নিতে চাচ্ছেন না। ফলে পড়াশোনা থেকে শিক্ষার্থীরা দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছে। পড়াশোনার বদলে খেলাধুলা আর আড্ডা দিয়ে তাদের সময় কাটছে, যা তাদের পড়াশোনায় অপূরণীয় ক্ষতির সৃষ্টি করছে। মূলত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এর আসল ভুক্তভোগী, যা তাদের মৌলিক শিক্ষার ভিত্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। অর্থাৎ, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শুধু শিক্ষাগতভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে না, বরং তাদের সৃজনশীলতা, বিশ্লেষণী দক্ষতা ও বাস্তবজ্ঞান অর্জনের ক্ষমতাও ব্যাহত হচ্ছে, যা সামগ্রিকভাবে জাতির অগ্রগতি ও উন্নয়নের পথে বড় বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
এনসিটিবির তথ্যমতে, এবার প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪ কোটি ৩৪ লাখ ৩ হাজার ২৮৩ জন। তাদের জন্য ছাপা হচ্ছে ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২ কপি বই। প্রাথমিকে ২ কোটি ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৪৭৯ জন শিক্ষার্থীর জন্য ছাপানো হচ্ছে ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫৫ বই। আর মাধ্যমিক পর্যায়ের ২ কোটি ২৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮০৪ জন শিক্ষার্থীর জন্য ছাপানো হচ্ছে ৩০ কোটি ৯৬ লাখ ১২ হাজার ৮৪৭ কপি বই। এছাড়াও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য জন্য সাড়ে আট হাজার বই পাশাপাশি শিক্ষকের জন্য প্রায় ৪১ লাখ সহায়িকা বই ছাপানো হচ্ছে। এই ৪০ কোটি বই ছাপতে প্রয়োজন ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার টন কাগজ।
কিন্তু দেশে এই বিপুল পরিমাণ কাগজের মজুত আছে কিনা তা বিবেচনা করে দেখেনি এনসিটিবি। ফলে ছাপাখানাগুলো একযোগে কাজ শুরু করলে দেখা দেয় কাগজের সংকট। উদ্বুদ্ধ এই পরিস্থিতিরই সুযোগ নেয় কাগজ মিল মালিকরা। দফায় দফায় তারা কাগজের মূল্য বাড়ানোয় গত এক মাসের ব্যবধানে প্রতি টন কাগজের দাম বেড়েছে ৩০ হাজার টাকা। এই সুযোগে তারা হাতিয়ে নিয়েছে ৩৪৫ কোটি টাকারও বেশি। এখন বেশি দাম দিয়েও চাহিদা অনুযায়ী কাগজ পাচ্ছে না পাঠ্যবই ছাপানোর দায়িত্বে থাকা ১১৬ ছাপাখানা। ফলে অধিকাংশ ছাপাখানা কাগজ সংকটে প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা বই ছাপানো বন্ধ রাখছে। যার ফলে বই ছাপানোর কাজ নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অনেক পিছিয়ে যাচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং তাদের একাডেমিক কার্যক্রমকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা জানিয়েছেন, ‘বছরের প্রথম দিন যে ৬ কোটি বই দেয়ার কথা দাবি করা হয়েছে, তা আসলে সঠিক নয়। বই মূলত গেছে ২ কোটি ৮৫ লাখ কপি।’ সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, শিক্ষার্থীদের হাতে এখনো ৭০ শতাংশ বই পৌঁছায়নি, যার ফলে শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই সংকটে পড়েছে। এ অবস্থায় সঠিক সময়ে বই বিতরণ না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক পড়াশোনা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এদিকে, এনসিটিবির সম্পাদনা কমিটি পাঠ্যবই সম্পাদনার কাজে দীর্ঘ সময় নিলেও আগের পাঠ্যবই ও এ বছরের পাঠ্যবই বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নতুন কারিকুলামে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আনা হয়নি। বরং, বইয়ের কিছু ভুল-ভ্রান্তি ও অসঙ্গতি শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করছে। বিশিষ্টজনদের মতে, পাঠ্যবই সম্পাদনার জন্য এত দীর্ঘ সময় নেয়া মোটেও যৌক্তিক হয়নি, বরং সময়মতো ও মানসম্মত বই প্রকাশ করাই ছিল মূল লক্ষ্য।
শিক্ষার্থীদের হাতে যথাসময়ে সঠিক ও নির্ভুল পাঠ্যবই পৌঁছে দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত ভুল সংশোধন, যথাযথ সম্পাদনা এবং বই বিতরণের কার্যক্রমকে স্বচ্ছ ও সময়োপযোগী করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা বজায় থাকে।
এখন যে কয়েকটি প্রেস ছাপার কাজ করছে, তারা যদি কাগজ ও কালিসহ আনুষঙ্গিক সব উপকরণ ঠিকমতো পায়, তাহলে দৈনিক বই ছাপতে পারবে ৫০ লাখ কপি। কিন্তু প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাবে বর্তমানে গড়ে প্রতিদিন ছাপা হচ্ছে মাত্র ১৫-২৫ লাখ কপি, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তদুপরি, মূলত ছোট বইগুলো ছাপানো হলেও বড় বইগুলোর ছাপার কাজ এখনো বাকি রয়েছে।
সরকারি হিসাবে, এ বছর শিক্ষার্থীদের জন্য ৪০ কোটি বই ছাপানোর কথা থাকলেও এখনো অর্ধেক বইও ছাপা হয়নি। বর্তমানে প্রায় ২০ কোটি বই ছাপানো বাকি। যদি গড়ে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ২৫ লাখ কপি বইও ছাপা হয়, তবে সব বই ছাপতে সময় লাগবে ৮০ দিন। অর্থাৎ, এই ধীরগতিতে চলতে থাকলে এপ্রিল মাসেও বই ছাপার কাজ শেষ হবে না! ফলে প্রশ্ন থেকেই যায়Ñ শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছাবে কবে?
এ ধরনের পরিস্থিতি শিক্ষার ধারাবাহিকতা ও মানের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বছরের শুরুতে পাঠ্যবই না পাওয়ার ফলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় বিঘœ ঘটছে, যা তাদের শেখার আগ্রহ কমিয়ে দিতে পারে। এছাড়া, দেরিতে বই হাতে পাওয়ায় শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাঠ্যসূচি শেষ করতে পারবে কিনা, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে।
অপরদিকে, পাঠ্যবই ছাপানোর ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা ও অব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ববোধ ও সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে। সময়মতো কাগজ, কালি ও অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করা হলে বই ছাপার গতি বাড়ানো সম্ভব হতো। তাই দ্রুত এই সংকট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। শিক্ষাব্যবস্থা কোনো পরীক্ষামূলক ব্যবস্থা নয়, যেখানে বছরের পর বছর অব্যবস্থাপনা চলতে থাকবে। শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সবার আগে বিবেচনায় রেখে বই ছাপানো ও বিতরণের প্রক্রিয়াকে আরও দক্ষ, স্বচ্ছ ও সময়োপযোগী করা দরকার। অন্যথায়, বছরের পর বছর একই সমস্যার পুনরাবৃত্তি ঘটবে এবং শিক্ষার্থীরা তাদের মৌলিক শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
গত ২৪ জানুয়ারি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এক সংবাদ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেÑ বাংলাবাজার ও শেরপুর থেকে ২৪ হাজার সরকারি বিনামূল্যের পাঠ্যবই উদ্ধার করেছে পুলিশ। যখন সারা দেশে শিক্ষার্থীরা বই সংকটে ভুগছে, তখন এসব বই খোলা বাজারে অবাধে বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। যে বই ছাপাতে সরকারের ব্যয় হয় মাত্র ৩০ থেকে ৫০ টাকা, সেই বই ২০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক ও অনৈতিক।
এ ঘটনা শুধু অমানবিক নয়, বরং জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি ভয়াবহ অবিচার। সরকারি নীতিমালা অনুসারে, শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবই বিনামূল্যে সরবরাহ করার কথা, অথচ কিছু অসাধু ব্যক্তি ও ছাপাখানার মালিক এসব বই অবৈধভাবে গুদামজাত করে কিংবা বিক্রি করে দিচ্ছেন। এটি স্পষ্টতই শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি চরম অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার প্রতিফলন। শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, পাঠ্যবই বিতরণ ব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরেই জটিলতা ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। প্রশ্ন উঠছেÑ এত বড় অনিয়ম কীভাবে ঘটল? সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি কতটা কার্যকর? দায়ীদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে?
[লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়]