alt

উপ-সম্পাদকীয়

অন্তর্বর্তী সরকার: নাগরিকদের প্রত্যাশা কি পূরণ হবে?

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: রোববার, ০২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

বিভিন্ন কমিশনের সুপারিশ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মোহাম্মদ ইউনূসের বাসনা অনেক বড়, তিনি মনে করেন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থানের চার্টার তৈরি হবে এবং তা হবে নতুন বাংলাদেশের নতুন চার্টার। আওয়ামী লীগ ব্যতীত বাকি রাজনৈতিক দলগুলোর মতৈক্যর ভিত্তিতে যে চার্টার তৈরি হবে তা থাকবে অক্ষয় ও অমর, কোন রাজনৈতিক দল চার্টার থেকে সরতে পারবে না। ড. ইউনূস জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি হলেও রাজনীতিতে খুব বেশি পরিপক্ক বলে মনে হয় না। রাজনীতির ঘোরপ্যাচের অভিজ্ঞতা না থাকায় তিনি শুধু স্বপ্ন বুনতে ভালোবাসেন। স্বপ্নের বাস্তবায়নও তার আরাধ্য বাসনা। এই বাসনা থেকেই তিনি জাতির জন্য কতগুলো দিকনির্দেশনা রেখে যেতে চান। তবে ঐকমত্যের স্বাক্ষরিত চার্টারের স্থায়িত্ব নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন।

দেশ গড়ার চার্টারের পরিবর্তে বর্তমানে অনুসৃত নীতি মোতাবেক শুধু আওয়ামী লীগ ঠেকানোর পরিকল্পনা দিয়ে দেশের মানুষকে তুষ্ট রাখা কঠিন হবে। সবাই এখন শুধু আওয়ামী লীগ বিরোধী ঐক্যের কথা বলছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ পনের বছর চেষ্টা করেও বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও নিপীড়ন দিয়ে কোন রাজনৈতিক দলকে নিশ্চিহ্ন করা সহজ নয়, যদি না জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করে। এর চেয়ে আরও কঠিন দুর্যোগেও আওয়ামী লীগ মরেনি। বিএনপির মতো আওয়ামী লীগেও দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, সন্ত্রাসী, অর্থপাচারকারী ছাড়াও অগণিত নিরীহ সমর্থকও রয়েছে। শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল বিচার করলেই এর সত্যতা মিলবে। ১৯৯১ সনে কাস্টিং ভোটের ৩০.০৮ শতাংশ পায় বিএনপি এবং ৩০. ০১ শতাংশ পায় আওয়ামী লীগ; ১৯৯৬ সনে আওয়ামী লীগ পায় ৩৭.৪ শতাংশ ভোট এবং বিএনপি পায় ৩৩.৬ শতাংশ; ২০০১ সনে বিএনপি পায় ৪০. ৯৭ শতাংশ এবং আওয়ামী লীগ পায় ৪০.১৩ শতাংশ; ২০০৮ সনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পায় ৪৯.০ শতাংশ এবং বিএনপি পায় ৩৩. ২০ শতাংশ। তারপরও আওয়ামী এখন নিষ্কৃয়।

আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি করা হচ্ছে, কেউ কেউ কমপক্ষে তিন বছরের জন্য হলেও তাদের রাজনীতি বন্ধ করার পক্ষে। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হলেও নিশ্চিন্তে নির্বাচন করতে দেয়া হবে বলে মনে হয় না। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সরব উপস্থিতি বিএনপি যেমন চায় না, তেমনি নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগকে বিযুক্ত করার পক্ষেও তারা নয়। কারণ বিএনপির নিশ্চিত বিজয়ে ৩০-৪০ শতাংশ ভোটারের অনুপস্থিতি আওয়ামী লীগ আমলের মতো নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। তাই বিএনপির শাসনকালকে নিরাপদ ও নিরূপদ্রব রাখার জন্য নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ বিএনপির জন্য অপরিহার্য। বিশ্বের কাছে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হলেও আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ বিএনপির জন্য জরুরি।

আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনার পক্ষে বিএনপির আরও একটি ভাবনা কাজ করতে পারে এবং তা হচ্ছে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশে রাজনৈতিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সবাইকে দায়বদ্ধ করা। স্বাভাবিক রাজনীতির সুযোগ না থাকলে আওয়ামী লীগ অস্বাভাবিক রাস্তায় হাঁটতে পারে, যা বিএনপির জন্য সুখকর হবে না। সরকারের নিষ্কৃয়তায় দেশে বিগত প্রায় ছয় মাস ধরে একটি অস্বাভাবিক পরিবেশ বিরাজ করছে। ছাত্রদের প্রেসার গ্রুপ থেকে একটু চাপ দিলেই সরকার তড়িঘড়ি করে দাবি মেনে নিচ্ছে। পুলিশের প্রতি ছাত্রদের অবজ্ঞা ও অবহেলা দেখে অন্যরাও সাহসী হয়ে উঠছে এবং তাদের দাবি নিয়ে মাঠে নামছে, মিছিল আর গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা দখল করে ঢাকা শহরে অচলাবস্থা তৈরি করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আগের মতো পেটাতে পারছে না। পুলিশ যদি আগের মতো লাঠিচার্জ করে, রবার বুলেট ছোড়ে, গরম পানি নিক্ষেপ করে বা চরম মুহূর্তে গুলি করে তাহলে অন্তর্বর্তী সরকারও ‘স্বৈরাচারী’ শাসক হিসেবে আখ্যায়িত হবে। নির্বাচিত পরবর্তী সরকারকেও একই অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে। বিএনপি এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনার পক্ষে থাকতে পারে। নির্বাচনে আনার বিবেচনা থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের প্রতি বিএনপি চাণক্যনীতি অবলম্বন করছেÑ শীর্ষ নেতারা আওয়ামী লীগের প্রতি কিছুটা নমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করছে, অন্যদিকে মাঠকর্মীদের দিয়ে দেশের সর্বত্র আওয়ামী লীগকে প্রতিরোধ করা হচ্ছে।

অলিখিত ঐক্যবদ্ধ জোটের শরিকদের মধ্যে ইদানীং বিভিন্ন ইস্যুতে মতভেদ ও বাকবিত-া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের পুনর্জাগরণের ভয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও সরকারের অংশীজনরা উৎকণ্ঠিত; তাই বিএনপি ছাড়া বাকিরা নির্বাচনের আগেই বিচার সম্পন্ন করে আওয়ামী লীগকে খোঁয়াড়ে ঢোকানোর পক্ষে। কিন্তু বিএনপি চায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য ন্যূনতম যে সংস্কার প্রয়োজন সেগুলো সম্পন্ন করে যত শীঘ্রই সম্ভব নির্বাচনের আয়োজন করা। অন্যদিকে ছাত্র ও সমন্বয়করা মনে করে, শুধু বিএনপির সমর্থন না থাকায় সংবিধান পুনর্লিখনের মাধ্যমে ‘মুজিববাদী সংবিধানের’ কবর রচনা করা সম্ভব হয়নি, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া স্থগিত রাখতে হয়েছে, প্রেসিডেন্টকে সরানো যায়নি, জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব বাতিল হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং ভারতের একই সুরে কথা বলাও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা সহ্য করতে পারছে না।

অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অনেক বেনিফিট পাওয়া সত্ত্বেও বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে। কারণ বিএনপির কর্মীদের সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিএনপির ধারণা ছিল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা তাদের পক্ষে থাকবে; কিন্তু ঘটনা সম্পূর্ণ বিপরীত, যতই দিন যাচ্ছে ততই ছাত্ররা ইসলামপন্থী দলগুলোর দিকে সরে যাচ্ছে। ছাত্র ও সমন্বয়কদের নিয়ে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় বিএনপির হতাশা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা যাতে নতুন দল করতে না পারে সেজন্য বিএনপির ছাত্রদল সমন্বয়কদের ঢাকার বাইরের সমাবেশে বাধা দিচ্ছেÑ এই অভিযোগ সমন্বয়কদের।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের দল গঠনের আভাস পেয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচন পরিচালনার জন্য নিরপেক্ষ মনে করছেন না। কিন্তু উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, বর্তমান সরকারে সব পক্ষের অংশীদারত্ব রয়েছে এবং সব পক্ষ নানা সুবিধা ভোগ করছে। কথাটা মিথ্যা নয়, বিএনপি ও জামায়াতের লোকজন মামলা থেকে দেদার খালাস পাচ্ছে, দেশের প্রতিটি সেক্টরে তাদের লোকদের বসানো হয়েছে এবং হচ্ছে।

বিএনপি এবং জামায়াত চায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সব মামলা অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে রুজু হোক এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই নির্যাতন ও হেনস্তার শিকার হোক। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে মামলা হলে পরবর্তী সরকারের আর কোন দায় থাকবে না। এদের আচরণ দেখে মনে হবে, রাজনীতির মাঠে শত্রু আর মিত্রের ফারাক করা কঠিন, শত্রু এক সেকেন্ডে মিত্র হয়ে যায়। দীর্ঘদিনের জোটবদ্ধ বিএনপি-জামায়াত একে অন্যের কাছ থেকে ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে, অন্যদিকে জামায়াতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের। আদর্শের দ্বন্দ্বে নয়, স্বার্থের দ্বন্দ্বে অন্তর্বর্তী সরকার, বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলাম ইদানীং ভিন্ন সুরে কথা বলছে। ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, আওয়ামী লীগের প্রশ্নে তারা আবার এক মুহূর্তে এক হয়ে যায়। বর্তমানে আওয়ামী লীগই একমাত্র শিকার যা বধ করতে তাদের একতাবদ্ধ রাখছে।

আওয়ামী লীগ ফোবিয়া বা আওয়ামী লীগের পুনরুত্থানের ভয় থেকেই ঐক্যের গরজÑ দুর্নীতি, ঘুষ, অর্থ পাচার ইত্যাদির বিরুদ্ধে ঐক্যের কোন গরজ নেই। আওয়ামী লীগ ফোবিয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার অস্থির বলেই দেশে অরাজকতা ও সন্ত্রাস প্রশ্রয় পাচ্ছে। এই প্রশ্রয় বুমেরাং হয়ে একদিন অন্তর্বর্তী সরকার বা পরবর্তী দলীয় সরকারকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়তে পারে। ঐক্য ঐক্য করে নিজেদের দুর্বলতা উন্মোচন করার চেয়ে কাজের মাধ্যমে জনগণের মন জয় করাই অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত। ড. মোহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে জনগণ মনে মনে বড় বড় প্রত্যাশার বীজ বপন করেছিল, কিন্তু বিগত প্রায় ছয় মাসে তারা প্রত্যাশা পূরণের কোন আভাসও খুঁজে পায়নি। অন্তর্বর্তী সরকার মানুষের মনে শুধু প্রত্যাশা পূরণের আশাবাদ তৈরি করতে পারলেই নির্বাচনের দাবি করে কেউ হালে পানি পেত না। অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা কেউই কামনা করে না; কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার বারবার হোঁচট খেলে রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের বিকল্প ভাবনারও মৃত্যু ঘটবে।

[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]

সব ক্ষেত্রে বাংলাকে প্রাধান্য দিন

গুজব : মানবসৃষ্ট দুর্যোগ

পাঠ্যবই সংকটে থমকে গেছে শিক্ষার চাকা

আরজি কর : শাসক রোষে ভিকটিমের পরিবার

চাই কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়ন

একটি দেয়ালচিত্র ও কিছু কথা

শুল্ক বনাম উদ্ভাবন যুদ্ধ

রম্যগদ্য : “ডক্টর.জ্বী-ভাগো...”

বায়ুদূষণ মনিটরিংয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার

ছবি

যোগেন ম-লের ‘বহুজনবাদী’ রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা

একটি দেয়ালচিত্র ও কিছু কথা

আলো, অন্ধকার ও চরিত্রবান জীবন

শিক্ষকরা কেন বারবার মার খাবে?

মনোবিশ্লেষক নাট্যক্রিয়া অনুশীলনের ক্ষেত্র হোক সহজতর

প্রসঙ্গ জেনারেশন জেড

বাড়ছে বেকারত্ব : প্রতিকারে জরুরি পদক্ষেপ নিন

প্রকৃতির প্রতি সদয় হতে হবে

ছবি

আভিজাত্যের বাঁধ এবং প্রান্তিক মানুষ

বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস

অর্থনীতি কোনদিকে যাচ্ছে?

বৈষম্যবিরোধী সংস্কার দরকার

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পোস্টমর্টেম প্রসঙ্গে

রাজনীতির লালসালু ও ময়না দ্বীপ : জনগণের আস্থার সংকট

প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব কি বাস্তবসম্মত

‘ভিলেজ পলিটিক্স’ ও সাধারণ গ্রামবাসী

রম্যগদ্য : ‘ধেয়ে আসছে বুলেট’

রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য পেনশন ও গ্র্যাচুইটি সময়ের দাবি

ফসলের দাম ও কৃষক

রূপাইয়া, ডন, অনন্ত কিংবা রেংদের মনের ক্ষত কে সারাবে?

পরিবেশ বিপর্যয় : শিক্ষার্থীদের করণীয়

বায়ুদূষণ রোধে প্রয়োজন জনসচেতনতা

কিশোর অপরাধ ও কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন

চাই জীবনমুখী যুগোপযোগী উচ্চশিক্ষা

খেজুর গুড়ের বাণিজ্যিক গুরুত্ব

হামাস-ইসরাইলের অস্ত্র বিরতি

ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

অন্তর্বর্তী সরকার: নাগরিকদের প্রত্যাশা কি পূরণ হবে?

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

রোববার, ০২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

বিভিন্ন কমিশনের সুপারিশ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মোহাম্মদ ইউনূসের বাসনা অনেক বড়, তিনি মনে করেন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থানের চার্টার তৈরি হবে এবং তা হবে নতুন বাংলাদেশের নতুন চার্টার। আওয়ামী লীগ ব্যতীত বাকি রাজনৈতিক দলগুলোর মতৈক্যর ভিত্তিতে যে চার্টার তৈরি হবে তা থাকবে অক্ষয় ও অমর, কোন রাজনৈতিক দল চার্টার থেকে সরতে পারবে না। ড. ইউনূস জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি হলেও রাজনীতিতে খুব বেশি পরিপক্ক বলে মনে হয় না। রাজনীতির ঘোরপ্যাচের অভিজ্ঞতা না থাকায় তিনি শুধু স্বপ্ন বুনতে ভালোবাসেন। স্বপ্নের বাস্তবায়নও তার আরাধ্য বাসনা। এই বাসনা থেকেই তিনি জাতির জন্য কতগুলো দিকনির্দেশনা রেখে যেতে চান। তবে ঐকমত্যের স্বাক্ষরিত চার্টারের স্থায়িত্ব নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন।

দেশ গড়ার চার্টারের পরিবর্তে বর্তমানে অনুসৃত নীতি মোতাবেক শুধু আওয়ামী লীগ ঠেকানোর পরিকল্পনা দিয়ে দেশের মানুষকে তুষ্ট রাখা কঠিন হবে। সবাই এখন শুধু আওয়ামী লীগ বিরোধী ঐক্যের কথা বলছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ পনের বছর চেষ্টা করেও বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও নিপীড়ন দিয়ে কোন রাজনৈতিক দলকে নিশ্চিহ্ন করা সহজ নয়, যদি না জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করে। এর চেয়ে আরও কঠিন দুর্যোগেও আওয়ামী লীগ মরেনি। বিএনপির মতো আওয়ামী লীগেও দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, সন্ত্রাসী, অর্থপাচারকারী ছাড়াও অগণিত নিরীহ সমর্থকও রয়েছে। শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল বিচার করলেই এর সত্যতা মিলবে। ১৯৯১ সনে কাস্টিং ভোটের ৩০.০৮ শতাংশ পায় বিএনপি এবং ৩০. ০১ শতাংশ পায় আওয়ামী লীগ; ১৯৯৬ সনে আওয়ামী লীগ পায় ৩৭.৪ শতাংশ ভোট এবং বিএনপি পায় ৩৩.৬ শতাংশ; ২০০১ সনে বিএনপি পায় ৪০. ৯৭ শতাংশ এবং আওয়ামী লীগ পায় ৪০.১৩ শতাংশ; ২০০৮ সনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পায় ৪৯.০ শতাংশ এবং বিএনপি পায় ৩৩. ২০ শতাংশ। তারপরও আওয়ামী এখন নিষ্কৃয়।

আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি করা হচ্ছে, কেউ কেউ কমপক্ষে তিন বছরের জন্য হলেও তাদের রাজনীতি বন্ধ করার পক্ষে। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হলেও নিশ্চিন্তে নির্বাচন করতে দেয়া হবে বলে মনে হয় না। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সরব উপস্থিতি বিএনপি যেমন চায় না, তেমনি নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগকে বিযুক্ত করার পক্ষেও তারা নয়। কারণ বিএনপির নিশ্চিত বিজয়ে ৩০-৪০ শতাংশ ভোটারের অনুপস্থিতি আওয়ামী লীগ আমলের মতো নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। তাই বিএনপির শাসনকালকে নিরাপদ ও নিরূপদ্রব রাখার জন্য নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ বিএনপির জন্য অপরিহার্য। বিশ্বের কাছে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হলেও আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ বিএনপির জন্য জরুরি।

আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনার পক্ষে বিএনপির আরও একটি ভাবনা কাজ করতে পারে এবং তা হচ্ছে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশে রাজনৈতিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সবাইকে দায়বদ্ধ করা। স্বাভাবিক রাজনীতির সুযোগ না থাকলে আওয়ামী লীগ অস্বাভাবিক রাস্তায় হাঁটতে পারে, যা বিএনপির জন্য সুখকর হবে না। সরকারের নিষ্কৃয়তায় দেশে বিগত প্রায় ছয় মাস ধরে একটি অস্বাভাবিক পরিবেশ বিরাজ করছে। ছাত্রদের প্রেসার গ্রুপ থেকে একটু চাপ দিলেই সরকার তড়িঘড়ি করে দাবি মেনে নিচ্ছে। পুলিশের প্রতি ছাত্রদের অবজ্ঞা ও অবহেলা দেখে অন্যরাও সাহসী হয়ে উঠছে এবং তাদের দাবি নিয়ে মাঠে নামছে, মিছিল আর গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা দখল করে ঢাকা শহরে অচলাবস্থা তৈরি করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আগের মতো পেটাতে পারছে না। পুলিশ যদি আগের মতো লাঠিচার্জ করে, রবার বুলেট ছোড়ে, গরম পানি নিক্ষেপ করে বা চরম মুহূর্তে গুলি করে তাহলে অন্তর্বর্তী সরকারও ‘স্বৈরাচারী’ শাসক হিসেবে আখ্যায়িত হবে। নির্বাচিত পরবর্তী সরকারকেও একই অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে। বিএনপি এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনার পক্ষে থাকতে পারে। নির্বাচনে আনার বিবেচনা থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের প্রতি বিএনপি চাণক্যনীতি অবলম্বন করছেÑ শীর্ষ নেতারা আওয়ামী লীগের প্রতি কিছুটা নমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করছে, অন্যদিকে মাঠকর্মীদের দিয়ে দেশের সর্বত্র আওয়ামী লীগকে প্রতিরোধ করা হচ্ছে।

অলিখিত ঐক্যবদ্ধ জোটের শরিকদের মধ্যে ইদানীং বিভিন্ন ইস্যুতে মতভেদ ও বাকবিত-া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের পুনর্জাগরণের ভয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও সরকারের অংশীজনরা উৎকণ্ঠিত; তাই বিএনপি ছাড়া বাকিরা নির্বাচনের আগেই বিচার সম্পন্ন করে আওয়ামী লীগকে খোঁয়াড়ে ঢোকানোর পক্ষে। কিন্তু বিএনপি চায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য ন্যূনতম যে সংস্কার প্রয়োজন সেগুলো সম্পন্ন করে যত শীঘ্রই সম্ভব নির্বাচনের আয়োজন করা। অন্যদিকে ছাত্র ও সমন্বয়করা মনে করে, শুধু বিএনপির সমর্থন না থাকায় সংবিধান পুনর্লিখনের মাধ্যমে ‘মুজিববাদী সংবিধানের’ কবর রচনা করা সম্ভব হয়নি, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া স্থগিত রাখতে হয়েছে, প্রেসিডেন্টকে সরানো যায়নি, জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব বাতিল হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং ভারতের একই সুরে কথা বলাও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা সহ্য করতে পারছে না।

অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অনেক বেনিফিট পাওয়া সত্ত্বেও বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে। কারণ বিএনপির কর্মীদের সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিএনপির ধারণা ছিল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা তাদের পক্ষে থাকবে; কিন্তু ঘটনা সম্পূর্ণ বিপরীত, যতই দিন যাচ্ছে ততই ছাত্ররা ইসলামপন্থী দলগুলোর দিকে সরে যাচ্ছে। ছাত্র ও সমন্বয়কদের নিয়ে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় বিএনপির হতাশা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা যাতে নতুন দল করতে না পারে সেজন্য বিএনপির ছাত্রদল সমন্বয়কদের ঢাকার বাইরের সমাবেশে বাধা দিচ্ছেÑ এই অভিযোগ সমন্বয়কদের।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের দল গঠনের আভাস পেয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচন পরিচালনার জন্য নিরপেক্ষ মনে করছেন না। কিন্তু উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, বর্তমান সরকারে সব পক্ষের অংশীদারত্ব রয়েছে এবং সব পক্ষ নানা সুবিধা ভোগ করছে। কথাটা মিথ্যা নয়, বিএনপি ও জামায়াতের লোকজন মামলা থেকে দেদার খালাস পাচ্ছে, দেশের প্রতিটি সেক্টরে তাদের লোকদের বসানো হয়েছে এবং হচ্ছে।

বিএনপি এবং জামায়াত চায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সব মামলা অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে রুজু হোক এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই নির্যাতন ও হেনস্তার শিকার হোক। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে মামলা হলে পরবর্তী সরকারের আর কোন দায় থাকবে না। এদের আচরণ দেখে মনে হবে, রাজনীতির মাঠে শত্রু আর মিত্রের ফারাক করা কঠিন, শত্রু এক সেকেন্ডে মিত্র হয়ে যায়। দীর্ঘদিনের জোটবদ্ধ বিএনপি-জামায়াত একে অন্যের কাছ থেকে ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে, অন্যদিকে জামায়াতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের। আদর্শের দ্বন্দ্বে নয়, স্বার্থের দ্বন্দ্বে অন্তর্বর্তী সরকার, বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলাম ইদানীং ভিন্ন সুরে কথা বলছে। ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, আওয়ামী লীগের প্রশ্নে তারা আবার এক মুহূর্তে এক হয়ে যায়। বর্তমানে আওয়ামী লীগই একমাত্র শিকার যা বধ করতে তাদের একতাবদ্ধ রাখছে।

আওয়ামী লীগ ফোবিয়া বা আওয়ামী লীগের পুনরুত্থানের ভয় থেকেই ঐক্যের গরজÑ দুর্নীতি, ঘুষ, অর্থ পাচার ইত্যাদির বিরুদ্ধে ঐক্যের কোন গরজ নেই। আওয়ামী লীগ ফোবিয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার অস্থির বলেই দেশে অরাজকতা ও সন্ত্রাস প্রশ্রয় পাচ্ছে। এই প্রশ্রয় বুমেরাং হয়ে একদিন অন্তর্বর্তী সরকার বা পরবর্তী দলীয় সরকারকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়তে পারে। ঐক্য ঐক্য করে নিজেদের দুর্বলতা উন্মোচন করার চেয়ে কাজের মাধ্যমে জনগণের মন জয় করাই অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত। ড. মোহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে জনগণ মনে মনে বড় বড় প্রত্যাশার বীজ বপন করেছিল, কিন্তু বিগত প্রায় ছয় মাসে তারা প্রত্যাশা পূরণের কোন আভাসও খুঁজে পায়নি। অন্তর্বর্তী সরকার মানুষের মনে শুধু প্রত্যাশা পূরণের আশাবাদ তৈরি করতে পারলেই নির্বাচনের দাবি করে কেউ হালে পানি পেত না। অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা কেউই কামনা করে না; কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার বারবার হোঁচট খেলে রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের বিকল্প ভাবনারও মৃত্যু ঘটবে।

[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]

back to top