alt

opinion » post-editorial

গুজব : মানবসৃষ্ট দুর্যোগ

গাজী তারেক আজিজ

: রোববার, ০২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

সারাদেশে চলছে গুজব। পাল্টা গুজব আর পাল্টাপাল্টি গুজব। এসব গুজবের বিস্তার কখনও নিছক হেয়ালিপনা থেকে। আবার কখনও প্রতিপক্ষকে ঘায়েলে গোয়েবলসীয় এই নীতি যখন মানুষের ঘুম হারাম করে ছাড়ে। তখন পরিত্রাণ পেতে গেলে প্রথম কাজ হচ্ছে গুজবের অংশ না হওয়া। অর্থাৎ গুজব নিজে রটনা না করে অন্যকেও নিরুৎসাহিত করা। আর কোন খবর যখন বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে একটু সচেতনতায় অবশ্যই চেক করে নিতে কেউ বাধা দেবে না। তাছাড়া অথেনটিক সোর্স অর্থাৎ ভেরিফায়েড পেজ যেমন নিউজ চ্যানেলগুলো উক্ত বিষয়ে কী তথ্য প্রচার করছে সেদিকে নজর রাখা। যতটুকুই নিশ্চিত হোন না কেন নিজে থেকে সংযোজন বিয়োজন করে বুঝিয়ে বলার চেষ্টায়ও শ্রোতার অপরিপক্ক কিংবা বিশ্লেষণী ক্ষমতা বুঝে কোন কথার জবাব দেয়া। পারতপক্ষে কোন রটনা সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হলেও স্পর্শকাতর বিষয়গুলো এড়িয়ে চলাই সঙ্গত হবে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি নেতা ও হিটলারের প্রচারমন্ত্রী ড. পল যোসেফ গোয়েবলস অপপ্রচারকে যখন হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়ে টার্গেটেড পিপলের কাছে বিনামূল্যে রেডিও কিংবা ট্রাঞ্জেস্টার বিতরণ করে কোন রকম দ্বিধা ছাড়াই মিথ্যা ও অবাস্তব তথ্য প্রচার করতেন বলে এই নীতিকে সবাই তারই নাম অনুসারে গোয়েবলসীয় নীতি বলে থাকেন। কারণ গোয়েবলস বিশ্বাস করতেন একটা মিথ্যাকে ১০০ বার প্রচার করলে সেটা মানুষ সত্য বলে ধরে নেয়। আর এক্ষেত্রে গোয়েবলস অনেকাংশে সফলও হয়েছেন বলে ধরে নেয়া হয়ে থাকে। তার কাজের কারণেই মানুষের কাছে আজও সমালোচিত হয়ে রয়েছেন। গোয়েবলসের আলোচিত উক্তি ছিল, ‘আপনি যদি একটি মিথ্যা বলেন এবং সেটা বারবার সবার সামনে বলতে থাকেন তাহলে লোকজন একসময় সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করবে।’ পরে অবশ্য তিনি সস্ত্রীক আত্মহত্যা করেন। সেই থেকে অদ্যাবধি গুজব নিয়ে যত কায়কারবার, উঠে আসে তার নাম। সব মানুষের মধ্যেই যে কোন কিছুকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আবার ঘটে যাওয়া সত্যকে আড়াল করতেও শাসকগোষ্ঠী এমনটা করার নজিরও বেশ লক্ষণীয় ছিল। আবার যুগে যুগে শাসকদের ঘুম হারাম করতেও এই একই হাতিয়ার ছিল ‘গুজব’Ñ যা কখনও কখনও মারাত্মক আকার ধারণ করে দাঙ্গা বাঁধিয়ে দিতে দেখা গেছে। সব ক্ষেত্রেই উৎসুক জনতার হেয়ালিপনাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দায়ী। তার আগে যা ঘটার ঘটে যায়Ñ যা হওয়ার হয়ে যায়। যাতে প্রশাসনের কার্যত কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না বললেই চলে। নিয়ন্ত্রণ করাও দুষ্কর। সম্প্রতি বাংলাদেশে সরকার পতনের পর যে যেমন করে পারছে গুজব রটিয়ে যাচ্ছে। এই গুজবের ফলে প্রাণ বিসর্জনের মতো ঘটনা ঘটছে অহরহ। এতে করে মব জাস্টিস, মব লিঞ্চিং, ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডারের মতো ঘটনা সামাল দেয়াও যেন জটিল পরিস্থিতি তৈরি করে। ধারাবাহিকভাবে গুজব রটিয়ে যাচ্ছে তথাকথিত মিডিয়াও। যাদের প্রচুর ‘ভিউজ’ দরকার। কে কার আগে এসব হটকেক সামনে এনে আমজনতার রসের খোরাক জুগিয়ে টাকা কামাইয়ের ধান্ধাবাজিতে ব্যস্ত। উপরন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার মতো সস্তা মাধ্যম দিয়ে প্রতিনিয়ত তৈরি হওয়া সেলিব্রিটি তো রয়েছেই। আবার কখনও দেখা যাচ্ছে পূর্বের ন্যায় কলরেকর্ড ফাঁস। তার ওপর রয়েছে চ্যাটিং সাইটের স্ক্রিনশট ফাঁস। সেই ফাঁস হওয়া নিয়েও চলে তুঘলকি কা-। এতে শিকার হয়েছেন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের আমলা থেকে শুরু করে হাল আমলের সমন্বয়ক। তবে গুজব নিয়ে বেশ ট্রল আর রোস্টিংয়ের শিকার হচ্ছেন কেউ। আবার নিজেও অন্যদের বিরুদ্ধে গুজব রটিয়ে ফায়দা তুলতেও ব্যস্ত রয়েছেন অনেকে। এতে যে আর যাই হোক ভালো কিছু হয় না সেটা সহজেই অনুমেয়। গুজব থেকে পরিত্রাণের উপায় হচ্ছে, যা-ই কিছু ঘটুক না কেন যদি জানতে হয় অথেনটিক সোর্স থেকে জানা। অথবা যে সোর্স থেকেই জানবেন সেইসব সোর্সকে ফ্যাক্টচেকের মাধ্যমে যাচাই করা। আজকাল অনেক ফ্যাক্টচেক প্রতিষ্ঠান নিজে থেকেই জানিয়ে দেয় কোনটা আসল আর কোনটা নকল মানে ভুয়া। তাই ভেরিফায়েড সোর্স থেকে জানা তথ্য অনেকাংশে নিশ্চিত হওয়া যায়। তবে সেক্ষেত্রেও জটিলতা দেখা যায় প্রথমেই একটা নিউজ করে পরে ডিলিট করে দিতেও দেখা গেছে। আবার যারা গুজব রটনায় লিপ্ত তারা বিভিন্ন নিউজ চ্যানেলের স্টিকার বানিয়েও প্রচার করে থাকে। এতে সাধারণ জনগণ বিভ্রান্ত হয়ে থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন টিভি মিডিয়ার নিউজ চ্যানেলের আদলে অনেকেই অনলাইন নিউজ চ্যানেল গড়ে তুলে বা আইপি টিভিতে নিউজ প্রচার করে। কোনরূপ সত্যতা যাচাই না করেই। এখন অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগ। যে যে যার যার অবস্থান থেকে নিজস্ব বিশ্লেষণী ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমেও মনগড়া তথ্য প্রচার করায় কিছুটা হলেও মানুষের জীবন অনাকাক্সিক্ষত হুমকিতে পতিত হচ্ছে। কেউই ভাবে না তার একটা অহেতুক তথ্য ছড়ানোতে তার নিজের যদি না-ও হয় কোন নিকটাত্মীয় ঠিকই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে। গুজব এখন সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। আমরা সেই ব্যাধিতে ভুগছি। যদি এর মহামারি আকার ধারণ করে তবেই কি ঘুম ভাঙবে নীতিনির্ধারকদের? মিথ্যা, ভুল তথ্য, বানোয়াট তথ্য দিয়ে গুজব রটানো হয়ে থাকে। এতে মানুষে মানুষে বিদ্বেষ বাড়ে। সমাজে হিংসাত্মক মনোভাব তৈরি হয়ে হানাহানি বাড়ে। এসব হয় সামাজিক রীতিনীতি, প্রথা, রাজনীতিক বিশ্বাস, ধর্মীয় কুসংস্কার, বিদেশি অপসংস্কৃতি, সংবেদনশীল তথ্য, অজ্ঞানতা, গোঁড়ামি, কুসংস্কার থেকে। এতে মানুষের কল্যাণ তো নেই-ই রয়েছে অকল্যাণ। গুজব থেকে মানুষের পরিত্রাণ পেতে সচেতনতার বিকল্প নেই। সমাজবিজ্ঞানের ভাষায়, গুজব হলো এমন কোনো বিবৃতি যার সত্যতা অল্প সময়ে কিংবা কখনোই নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। তবে গুজবের ভেতর এমন কিছু চটকদারিত্ব থাকে, যা সহজে মানুষকে প্রলুব্ধ বা আকৃষ্ট করে। যেহেতু সহজে সত্য-মিথ্যা নির্ণয় করা যায় না তাই এটি মানুষকে দ্বিধাগ্রস্ত করে। এতে করে সমাজের গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে দ্বন্দ্ব হয়। রাজনৈতিক দল আর দলে দ্বন্দ্ব হয়। ধর্মীয় মতাবলম্বীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়। বিভ্রান্তি কর তথ্যের ঢালাও বা একচেটিয়া প্রচারের ফলেও গ্রামে গ্রামে দ্বন্দ্ব হয়। অনিশ্চিত পরিস্থিতি, উদ্বেগ, তথ্যের গুরুত্ব, অস্পষ্টতা, নিজের ভাবমূর্তি রক্ষা, নিছক ভালো লাগা, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে, নিজের সামাজিক অবস্থানের কারণে এর প্রবাহ বাড়েÑ যা কোনভাবেই কাম্য নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেইসবুক ইউটিউব কিংবা যে কোন পত্রিকা শেয়ার না করা। কমেন্ট না করা। লাইক না দেয়া। আর নিজে থেকে কোন বক্তব্য নিশ্চিত না হয়ে দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। দেশের রাজনীতিবিদদের মতো লাগামহীন কথা বলা থেকেও বিরত থাকতে হবে। কারণ রাজনীতিকরা মঞ্চে ওঠে যা ইচ্ছে তা-ই বলে বেড়ানোর ফলে সীমিত চিন্তার অধিকারী এসবে বিশ্বাস করেন। আর এতেই যত সমস্যার সূত্রপাত। সেইসব ব্যক্তি নিজে যতটুকু ধারণ করতে পারে তার বেশি প্রচার করে। প্রচারের কোন নিয়ম নীতি তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় মনে করে এসব করে। শেষে, দরকার আত্মোপলব্ধি। নিছক একটা কথায় চলে যেতে পারে প্রাণ। ঘটে যেতে পারে ভয়াবহ দাঙ্গা। আমরা সামাজিক জীব। প্রতিনিয়ত প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়তে হচ্ছে আমাদের। তার ওপর গুজবনির্ভরতার সঙ্গে লড়ে যেতে হচ্ছে। একদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। অন্যদিকে অর্থনৈতিক মূল্যস্ফীতি। তারপর অর্থ পাচার। তারপর বেকারত্ব। সবমিলিয়ে একটা জাতি যখনই উঠে দাঁড়াতে চায় তখনই কোন না কোন দুর্যোগ। প্রাকৃতিক হলেও সেটা সৃষ্টিকর্তা রক্ষা করেন। ভিন্নভাবে পুষিয়ে দিয়ে। কিন্তু মানবসৃষ্ট দুর্যোগ গুজব কাটিয়ে ওঠার কার্যকর উপায় কি? আদৌ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব?

[লেখক: অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]

শারদীয় পূজার দিনলিপি

ঋণের জন্য আত্মহত্যা, ঋণ নিয়েই চল্লিশা

জাকসু নির্বাচন ও হট্টগোল: আমাদের জন্য শিক্ষণীয় কী?

নরসুন্দর পেশার গুরুত্ব ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন

বিভাগভিত্তিক এমপিআর নির্বাচন পদ্ধতি

প্ল্যাটফর্ম সমাজে বাংলাদেশ: জ্ঞানের ভবিষ্যৎ কার হাতে?

আনন্দবেদনার হাসপাতাল: সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ছবি

ভিন্ন ধরনের নির্বাচন, ভিন্ন ধরনের ফল

বেসরকারি খাতে সিআইবি’র যাত্রা: ঋণ ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত

স্বাস্থ্যসেবায় মানবিকতা প্রতিষ্ঠা হোক

ছবি

নেপালে সরকার পতন ও বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ

ডাকসু নির্বাচন ও সংস্কারপ্রয়াস: রাজনৈতিক চিন্তার নতুন দিগন্ত

নির্বাচন কি সব সমস্যার সমাধান

জিতিয়া উৎসব

ছবি

অলির পর নেপাল কোন পথে?

রম্যগদ্য: “মরেও বাঁচবি নারে পাগলা...”

অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শ্রীপুর পৌরসভা

ভূরিভোজ, উচ্ছেদ এবং আদিবাসী পাহাড়িয়া

অনলাইন সংস্কৃতিতে হাস্যরসের সমাজবিজ্ঞান

মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার

বাস্তব মস্কো বনাম বিভ্রান্ত ইউরোপ

ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতির গতিপ্রকৃতি

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

ছবি

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

একজন নাগরিকের অভিমানী বিদায় ও রাষ্ট্রের নৈতিক সংকট

tab

opinion » post-editorial

গুজব : মানবসৃষ্ট দুর্যোগ

গাজী তারেক আজিজ

রোববার, ০২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

সারাদেশে চলছে গুজব। পাল্টা গুজব আর পাল্টাপাল্টি গুজব। এসব গুজবের বিস্তার কখনও নিছক হেয়ালিপনা থেকে। আবার কখনও প্রতিপক্ষকে ঘায়েলে গোয়েবলসীয় এই নীতি যখন মানুষের ঘুম হারাম করে ছাড়ে। তখন পরিত্রাণ পেতে গেলে প্রথম কাজ হচ্ছে গুজবের অংশ না হওয়া। অর্থাৎ গুজব নিজে রটনা না করে অন্যকেও নিরুৎসাহিত করা। আর কোন খবর যখন বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে একটু সচেতনতায় অবশ্যই চেক করে নিতে কেউ বাধা দেবে না। তাছাড়া অথেনটিক সোর্স অর্থাৎ ভেরিফায়েড পেজ যেমন নিউজ চ্যানেলগুলো উক্ত বিষয়ে কী তথ্য প্রচার করছে সেদিকে নজর রাখা। যতটুকুই নিশ্চিত হোন না কেন নিজে থেকে সংযোজন বিয়োজন করে বুঝিয়ে বলার চেষ্টায়ও শ্রোতার অপরিপক্ক কিংবা বিশ্লেষণী ক্ষমতা বুঝে কোন কথার জবাব দেয়া। পারতপক্ষে কোন রটনা সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হলেও স্পর্শকাতর বিষয়গুলো এড়িয়ে চলাই সঙ্গত হবে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি নেতা ও হিটলারের প্রচারমন্ত্রী ড. পল যোসেফ গোয়েবলস অপপ্রচারকে যখন হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়ে টার্গেটেড পিপলের কাছে বিনামূল্যে রেডিও কিংবা ট্রাঞ্জেস্টার বিতরণ করে কোন রকম দ্বিধা ছাড়াই মিথ্যা ও অবাস্তব তথ্য প্রচার করতেন বলে এই নীতিকে সবাই তারই নাম অনুসারে গোয়েবলসীয় নীতি বলে থাকেন। কারণ গোয়েবলস বিশ্বাস করতেন একটা মিথ্যাকে ১০০ বার প্রচার করলে সেটা মানুষ সত্য বলে ধরে নেয়। আর এক্ষেত্রে গোয়েবলস অনেকাংশে সফলও হয়েছেন বলে ধরে নেয়া হয়ে থাকে। তার কাজের কারণেই মানুষের কাছে আজও সমালোচিত হয়ে রয়েছেন। গোয়েবলসের আলোচিত উক্তি ছিল, ‘আপনি যদি একটি মিথ্যা বলেন এবং সেটা বারবার সবার সামনে বলতে থাকেন তাহলে লোকজন একসময় সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করবে।’ পরে অবশ্য তিনি সস্ত্রীক আত্মহত্যা করেন। সেই থেকে অদ্যাবধি গুজব নিয়ে যত কায়কারবার, উঠে আসে তার নাম। সব মানুষের মধ্যেই যে কোন কিছুকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আবার ঘটে যাওয়া সত্যকে আড়াল করতেও শাসকগোষ্ঠী এমনটা করার নজিরও বেশ লক্ষণীয় ছিল। আবার যুগে যুগে শাসকদের ঘুম হারাম করতেও এই একই হাতিয়ার ছিল ‘গুজব’Ñ যা কখনও কখনও মারাত্মক আকার ধারণ করে দাঙ্গা বাঁধিয়ে দিতে দেখা গেছে। সব ক্ষেত্রেই উৎসুক জনতার হেয়ালিপনাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দায়ী। তার আগে যা ঘটার ঘটে যায়Ñ যা হওয়ার হয়ে যায়। যাতে প্রশাসনের কার্যত কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না বললেই চলে। নিয়ন্ত্রণ করাও দুষ্কর। সম্প্রতি বাংলাদেশে সরকার পতনের পর যে যেমন করে পারছে গুজব রটিয়ে যাচ্ছে। এই গুজবের ফলে প্রাণ বিসর্জনের মতো ঘটনা ঘটছে অহরহ। এতে করে মব জাস্টিস, মব লিঞ্চিং, ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডারের মতো ঘটনা সামাল দেয়াও যেন জটিল পরিস্থিতি তৈরি করে। ধারাবাহিকভাবে গুজব রটিয়ে যাচ্ছে তথাকথিত মিডিয়াও। যাদের প্রচুর ‘ভিউজ’ দরকার। কে কার আগে এসব হটকেক সামনে এনে আমজনতার রসের খোরাক জুগিয়ে টাকা কামাইয়ের ধান্ধাবাজিতে ব্যস্ত। উপরন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার মতো সস্তা মাধ্যম দিয়ে প্রতিনিয়ত তৈরি হওয়া সেলিব্রিটি তো রয়েছেই। আবার কখনও দেখা যাচ্ছে পূর্বের ন্যায় কলরেকর্ড ফাঁস। তার ওপর রয়েছে চ্যাটিং সাইটের স্ক্রিনশট ফাঁস। সেই ফাঁস হওয়া নিয়েও চলে তুঘলকি কা-। এতে শিকার হয়েছেন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের আমলা থেকে শুরু করে হাল আমলের সমন্বয়ক। তবে গুজব নিয়ে বেশ ট্রল আর রোস্টিংয়ের শিকার হচ্ছেন কেউ। আবার নিজেও অন্যদের বিরুদ্ধে গুজব রটিয়ে ফায়দা তুলতেও ব্যস্ত রয়েছেন অনেকে। এতে যে আর যাই হোক ভালো কিছু হয় না সেটা সহজেই অনুমেয়। গুজব থেকে পরিত্রাণের উপায় হচ্ছে, যা-ই কিছু ঘটুক না কেন যদি জানতে হয় অথেনটিক সোর্স থেকে জানা। অথবা যে সোর্স থেকেই জানবেন সেইসব সোর্সকে ফ্যাক্টচেকের মাধ্যমে যাচাই করা। আজকাল অনেক ফ্যাক্টচেক প্রতিষ্ঠান নিজে থেকেই জানিয়ে দেয় কোনটা আসল আর কোনটা নকল মানে ভুয়া। তাই ভেরিফায়েড সোর্স থেকে জানা তথ্য অনেকাংশে নিশ্চিত হওয়া যায়। তবে সেক্ষেত্রেও জটিলতা দেখা যায় প্রথমেই একটা নিউজ করে পরে ডিলিট করে দিতেও দেখা গেছে। আবার যারা গুজব রটনায় লিপ্ত তারা বিভিন্ন নিউজ চ্যানেলের স্টিকার বানিয়েও প্রচার করে থাকে। এতে সাধারণ জনগণ বিভ্রান্ত হয়ে থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন টিভি মিডিয়ার নিউজ চ্যানেলের আদলে অনেকেই অনলাইন নিউজ চ্যানেল গড়ে তুলে বা আইপি টিভিতে নিউজ প্রচার করে। কোনরূপ সত্যতা যাচাই না করেই। এখন অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগ। যে যে যার যার অবস্থান থেকে নিজস্ব বিশ্লেষণী ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমেও মনগড়া তথ্য প্রচার করায় কিছুটা হলেও মানুষের জীবন অনাকাক্সিক্ষত হুমকিতে পতিত হচ্ছে। কেউই ভাবে না তার একটা অহেতুক তথ্য ছড়ানোতে তার নিজের যদি না-ও হয় কোন নিকটাত্মীয় ঠিকই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে। গুজব এখন সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। আমরা সেই ব্যাধিতে ভুগছি। যদি এর মহামারি আকার ধারণ করে তবেই কি ঘুম ভাঙবে নীতিনির্ধারকদের? মিথ্যা, ভুল তথ্য, বানোয়াট তথ্য দিয়ে গুজব রটানো হয়ে থাকে। এতে মানুষে মানুষে বিদ্বেষ বাড়ে। সমাজে হিংসাত্মক মনোভাব তৈরি হয়ে হানাহানি বাড়ে। এসব হয় সামাজিক রীতিনীতি, প্রথা, রাজনীতিক বিশ্বাস, ধর্মীয় কুসংস্কার, বিদেশি অপসংস্কৃতি, সংবেদনশীল তথ্য, অজ্ঞানতা, গোঁড়ামি, কুসংস্কার থেকে। এতে মানুষের কল্যাণ তো নেই-ই রয়েছে অকল্যাণ। গুজব থেকে মানুষের পরিত্রাণ পেতে সচেতনতার বিকল্প নেই। সমাজবিজ্ঞানের ভাষায়, গুজব হলো এমন কোনো বিবৃতি যার সত্যতা অল্প সময়ে কিংবা কখনোই নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। তবে গুজবের ভেতর এমন কিছু চটকদারিত্ব থাকে, যা সহজে মানুষকে প্রলুব্ধ বা আকৃষ্ট করে। যেহেতু সহজে সত্য-মিথ্যা নির্ণয় করা যায় না তাই এটি মানুষকে দ্বিধাগ্রস্ত করে। এতে করে সমাজের গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে দ্বন্দ্ব হয়। রাজনৈতিক দল আর দলে দ্বন্দ্ব হয়। ধর্মীয় মতাবলম্বীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়। বিভ্রান্তি কর তথ্যের ঢালাও বা একচেটিয়া প্রচারের ফলেও গ্রামে গ্রামে দ্বন্দ্ব হয়। অনিশ্চিত পরিস্থিতি, উদ্বেগ, তথ্যের গুরুত্ব, অস্পষ্টতা, নিজের ভাবমূর্তি রক্ষা, নিছক ভালো লাগা, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে, নিজের সামাজিক অবস্থানের কারণে এর প্রবাহ বাড়েÑ যা কোনভাবেই কাম্য নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেইসবুক ইউটিউব কিংবা যে কোন পত্রিকা শেয়ার না করা। কমেন্ট না করা। লাইক না দেয়া। আর নিজে থেকে কোন বক্তব্য নিশ্চিত না হয়ে দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। দেশের রাজনীতিবিদদের মতো লাগামহীন কথা বলা থেকেও বিরত থাকতে হবে। কারণ রাজনীতিকরা মঞ্চে ওঠে যা ইচ্ছে তা-ই বলে বেড়ানোর ফলে সীমিত চিন্তার অধিকারী এসবে বিশ্বাস করেন। আর এতেই যত সমস্যার সূত্রপাত। সেইসব ব্যক্তি নিজে যতটুকু ধারণ করতে পারে তার বেশি প্রচার করে। প্রচারের কোন নিয়ম নীতি তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় মনে করে এসব করে। শেষে, দরকার আত্মোপলব্ধি। নিছক একটা কথায় চলে যেতে পারে প্রাণ। ঘটে যেতে পারে ভয়াবহ দাঙ্গা। আমরা সামাজিক জীব। প্রতিনিয়ত প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়তে হচ্ছে আমাদের। তার ওপর গুজবনির্ভরতার সঙ্গে লড়ে যেতে হচ্ছে। একদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। অন্যদিকে অর্থনৈতিক মূল্যস্ফীতি। তারপর অর্থ পাচার। তারপর বেকারত্ব। সবমিলিয়ে একটা জাতি যখনই উঠে দাঁড়াতে চায় তখনই কোন না কোন দুর্যোগ। প্রাকৃতিক হলেও সেটা সৃষ্টিকর্তা রক্ষা করেন। ভিন্নভাবে পুষিয়ে দিয়ে। কিন্তু মানবসৃষ্ট দুর্যোগ গুজব কাটিয়ে ওঠার কার্যকর উপায় কি? আদৌ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব?

[লেখক: অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]

back to top