বাবুল চন্দ্র সূত্রধর
প্রান্তিক বা প্রান্তিকতা প্রত্যয়টি উন্নয়ন ও অনুন্নয়নের আলোচনায় এক বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে। প্রত্যয়টির সুনির্দিষ্ট কোন মানদ- বা নির্ধারক না থাকলেও সাধারণত সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও জীবন ধারণের অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদান থেকে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অভিগম্যতার অনুপস্থিতি বা দূরত্বকে বুঝায়। সাধারণভাবে এই দূরত্বের জন্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অসচেতনতা ও উদাসীনতা এবং সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থায় স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও স্বার্থপরতা প্রভৃতি কতিপয় মুখস্থ পদের ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এসবের পেছনেও কাজ করে শক্তিশালী এক সামাজিক অনুঘটক। সমাজের সামগ্রিক অগ্রগতিতে মানুষের অধিকারের সঙ্গে উন্নয়ন, উন্নয়নের সাথে অর্থনীতি আর অর্থনীতির সাথে মনস্তত্ত্বÑ এই প্রপঞ্চগুলোর কার্যকর সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে যে দৃঢ় মানবিক বন্ধন সৃষ্টি হওয়া একান্ত আবশ্যক, তার অনুপস্থিতিই এক্ষেত্রে আসল ভূমিকা পালন করে, এটি আজ সর্বমহলে স্বীকৃত।
তাই সমাজতাত্ত্বিক প্রত্যয় হিসেবে উন্নয়ন বা অনুন্নয়নের অর্থ আরো ব্যাপকতর। আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে উন্নয়নের সংজ্ঞা অনুসন্ধান করলে বিষয়টি পরিচ্ছন্ন হতে পারে। ব্রিটিশ চিন্তাবিদ ওয়েন বারডারের মতে, জনগণের অর্থনৈতিক কল্যাণের সমষ্টিকে কিংবা বহু মানুষের জন্য অর্থনৈতিক কল্যাণ নিশ্চিত করাকেই উন্নয়ন বলা যায় না বরং উন্নয়ন হলো সেই সুশৃঙ্খল ও সামগ্রিক ব্যবস্থা, যেখানে ব্যক্তি বা জনগণ, উৎপাদন প্রতিষ্ঠান, প্রযুক্তি ও বিভিন্ন সংস্থা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ায় ব্যাপৃত হয়; যাতে করে যার যার নিজস্ব সক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে।
নোবেল বিজয়ী বাঙালি সমাজ-দার্শনিক অমর্ত্য সেন উন্নয়ন বলতে বুঝিয়েছেন আত্মনির্ভরতা বা স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে নানা ধরনের অন্তরায়কে অপসারণ করার ব্যবস্থাকে। উভয়ের চিন্তা থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বা স্ব^াধীনতা অর্জনের পূর্ণ নিশ্চয়তা বিধানের মধ্যেই উন্নয়নের সারকথা নিহিত; মানুষের মৌলিক প্রয়োজন তথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বিনোদনের সংস্থান হওয়ার মধ্যে এটি সীমিত নয়। ধরুন, একজন ব্যক্তির উল্লিখিত প্রয়োজন যথাযথভাবে পরিপূর্ণ করে তার হাত, পা চোখ ও মুখ বেঁধে দেয়া হলো, তাহলে কি তার প্রয়োজন মেটানো হলো? উন্নয়ন প্রত্যয়টিকে অবশ্যই একটি অখ- বা সর্বাত্মক প্রত্যয় হিসেবে বিচার করতে হবে এবং এ কারণেই কথাটি সবিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখতে হবে। সমাজদেহকে যদি মানবদেহের প্রতিরূপ হিসেবে অনুধাবন করা যায়, তবে বিষয়টি বেশ সহজতর হয়ে উঠতে পারে।
নির্ধারকের সুস্পষ্টতা না থাকায় বাংলাদেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা নিয়ে বিস্তর বিভ্রান্তি রয়েছে; তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রায় অর্ধকোটি লোককে প্রান্তিক বলে অভিহিত করা যায়। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর গবেষণায় এসব লোকজনের সামাজিক পরিচিতি উঠে এসেছে, যার মধ্যে রয়েছেÑ বাণিজ্যিক যৌনকর্মী ও তাদের সন্তান, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী, কারিগর শ্রেণী, এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত মানুষজন, স্থায়ীভাবে অসুস্থ গরিব মানুষজন, ভূমিহীন চাষি ও গ্রামীণ গরিব মানুষজন বিশেষত নারী, শহুরে বস্তিবাসী, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জনগোষ্ঠী, গৃহহীন ও কর্মহীন ব্যক্তিবর্গ ও তাদের পরিবার এবং পরিবেশগত কারণে বাস্তুহারা মানুষজন।
আলোচনায় ব্যবহৃত পদমালার বিষয়টি এখানে পরিচ্ছন্ন করা আবশ্যক বলে মনে করছি। প্রথমত, আদিবাসীদের প্রধানত বলা হচ্ছে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, উপজাতি, নৃগোষ্ঠী প্রভৃতি। উল্লিখিত পদগুলোর ব্যবহারে ব্যক্তিগতভাবে আমার অনীহা রয়েছে। ক্ষুদ্র মানে হলো ছোট, যা কারো জনগোষ্ঠীভিত্তিক পরিচয়ে ব্যবহার করা একধরনের অপমানজনক বটে। কাউকে উপজাতি বলতে হলে সে কোন জাতির উপজাতি তার সপ্রমাণিত ব্যাখ্যা থাকা জরুরি। আর, মানুষ হিসেবে যাদের জন্ম, তাদের পরিচয়ে নৃ পদটির ব্যবহার হাস্যকর; কেননা নৃ বলতে শুধু মানুষকেই বোঝানো হয়ে থাকে। জাতিসংঘের ব্যাখ্যাটি মাথায় রেখে আদিবাসী পদের ব্যবহার অধিকতর যুক্তিযুক্ত বলে মনে করি; জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলেছেÑ ‘আদিবাসী তারাই যাদের নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দেশের অন্য জনগোষ্ঠী থেকে পৃথক এবং তাদের অবস্থা পুরোপুরি বা আংশিকভাবে তাদের নিজস্ব আচার- আচরণ/ রীতি-নীতি, ঐতিহ্য বা বিশেষ আইন ও নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কোন রাষ্ট্রে তাদের আইনগত অবস্থা যাই হোক না কেন, তারা তাদের নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ সংরক্ষণ করছেন...।’
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে দলিত জনগোষ্ঠীর খোদ অস্তিত্ব নিয়েই মহলবিশেষে প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে কি দলিতদের বসবাস নেই? আমাদের নগর-বন্দর পরিচ্ছন্ন রাখে, পাদুকা মেরামত ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, আমিষের জোগান দেয়, বাদ্য বাজিয়ে আনন্দ প্রদান করে (ইত্যাকার বহুবিধ পরিচয় বহনকারী) এরা তাহলে কারা? প্রসঙ্গত বলা আবশ্যক যে, দলিত জনগোষ্ঠীসমূহের অনেকের উত্তরাধিকার-সূত্রীয় পেশা আজকাল সমাজে প্রচলিত নেই, কিন্তু তাদের আর্থিক ও সামাজিক পরিচিতি বদলায়নি। আবার, অনেকের পেশা মূল ¯্রােতধারার লোকজন দখল করে ফেলেছে।
আদিবাসী ও দলিতÑ উভয়কেই বলা হয় সংখ্যালঘুর মধ্যকার সংখ্যালঘু। সংখ্যালঘু পদটির ব্যবহারেও আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। কারণ, এই পদটিকে আপাদমস্তক গিলে ফেলেছে ধর্মীয় পরিচিতি। এজন্য আমি ‘সংখ্যাস্বল্প জনগোষ্ঠী’ পদটির ব্যবহার করতে আগ্রহী। আমি মনে করি, আলোচ্য সব জনগোষ্ঠীর পরিচয় প্রদানে এই পদটি যথার্থ অর্থবহ, অধিকতর যুক্তিযুক্তও বটে। একইভাবে আভিধানিক অর্থে আদিবাসী বা দলিত বলা যাবে না কিন্তু নানা ধরনে ও রূপে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করে, এমন লোকসমষ্ঠির জন্যও একই অভিধা প্রযোজ্য হতে পারে। প্রান্তিকতার বিচারেও এসব জনগোষ্ঠীর অবস্থান সর্বাগ্রে বিবেচিত হওয়ার মতো, এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়। মোদ্দা কথা, এরা একাধারে সংখ্যাস্বল্প ও প্রান্তিক।
উৎসগত ও সামাজিক পরিচয় যা-ই হোক, এই সংখ্যাস্বল্প প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসমূহের একটি অভিন্ন মিলনক্ষেত্র রয়েছে; তা হলো দারিদ্র্য। তাই এদের বিবেচনা করতে হবে অভিন্নভাবেই এবং এদের জন্য উন্নয়ন পরিকল্পনাও হতে হবে অভিন্ন; তবে জনগোষ্ঠীর মানুষের অনগ্রসরতার কারণ, প্রকৃতি, ধরন, প্রকোপ প্রভৃতি আলাদাভাবে অনুসন্ধান করতে হবে এবং যার যার চাহিদা ও উপযোগিতা বিবেচনা করে উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আর, সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত বিশেষণ। উপযুক্ত বিশেষণ স্থির করতে পারলে উদ্দিষ্ঠ জনগোষ্ঠীসমূহের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সহজতর হয়ে উঠবে বলে আমাদের বিশ্বাস। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোর সফল বাস্তবায়নে এসব জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনে করি। যেহেতু উন্নয়ন একটি সামগ্রিক বিষয় এবং কোনভাবেই নিছক সম্পদ অর্জন বা সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাব-নিকাশের বিষয় নয়Ñ সমন্বিত উদ্যোগ এ ধারণাটিকেও প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
[লেখক: মানবাধিকারকর্মী]
,
মানবাধিকারকর্মী ও গবেষক
মোবাইল: ০১৭১২৬৪৯৬৪১
ঊ-সধরষ: নপথংঁঃৎধফযধৎ@ুধযড়ড়.পড়স
বাবুল চন্দ্র সূত্রধর
সোমবার, ০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
প্রান্তিক বা প্রান্তিকতা প্রত্যয়টি উন্নয়ন ও অনুন্নয়নের আলোচনায় এক বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে। প্রত্যয়টির সুনির্দিষ্ট কোন মানদ- বা নির্ধারক না থাকলেও সাধারণত সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও জীবন ধারণের অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদান থেকে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অভিগম্যতার অনুপস্থিতি বা দূরত্বকে বুঝায়। সাধারণভাবে এই দূরত্বের জন্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অসচেতনতা ও উদাসীনতা এবং সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থায় স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও স্বার্থপরতা প্রভৃতি কতিপয় মুখস্থ পদের ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এসবের পেছনেও কাজ করে শক্তিশালী এক সামাজিক অনুঘটক। সমাজের সামগ্রিক অগ্রগতিতে মানুষের অধিকারের সঙ্গে উন্নয়ন, উন্নয়নের সাথে অর্থনীতি আর অর্থনীতির সাথে মনস্তত্ত্বÑ এই প্রপঞ্চগুলোর কার্যকর সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে যে দৃঢ় মানবিক বন্ধন সৃষ্টি হওয়া একান্ত আবশ্যক, তার অনুপস্থিতিই এক্ষেত্রে আসল ভূমিকা পালন করে, এটি আজ সর্বমহলে স্বীকৃত।
তাই সমাজতাত্ত্বিক প্রত্যয় হিসেবে উন্নয়ন বা অনুন্নয়নের অর্থ আরো ব্যাপকতর। আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে উন্নয়নের সংজ্ঞা অনুসন্ধান করলে বিষয়টি পরিচ্ছন্ন হতে পারে। ব্রিটিশ চিন্তাবিদ ওয়েন বারডারের মতে, জনগণের অর্থনৈতিক কল্যাণের সমষ্টিকে কিংবা বহু মানুষের জন্য অর্থনৈতিক কল্যাণ নিশ্চিত করাকেই উন্নয়ন বলা যায় না বরং উন্নয়ন হলো সেই সুশৃঙ্খল ও সামগ্রিক ব্যবস্থা, যেখানে ব্যক্তি বা জনগণ, উৎপাদন প্রতিষ্ঠান, প্রযুক্তি ও বিভিন্ন সংস্থা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ায় ব্যাপৃত হয়; যাতে করে যার যার নিজস্ব সক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে।
নোবেল বিজয়ী বাঙালি সমাজ-দার্শনিক অমর্ত্য সেন উন্নয়ন বলতে বুঝিয়েছেন আত্মনির্ভরতা বা স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে নানা ধরনের অন্তরায়কে অপসারণ করার ব্যবস্থাকে। উভয়ের চিন্তা থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বা স্ব^াধীনতা অর্জনের পূর্ণ নিশ্চয়তা বিধানের মধ্যেই উন্নয়নের সারকথা নিহিত; মানুষের মৌলিক প্রয়োজন তথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বিনোদনের সংস্থান হওয়ার মধ্যে এটি সীমিত নয়। ধরুন, একজন ব্যক্তির উল্লিখিত প্রয়োজন যথাযথভাবে পরিপূর্ণ করে তার হাত, পা চোখ ও মুখ বেঁধে দেয়া হলো, তাহলে কি তার প্রয়োজন মেটানো হলো? উন্নয়ন প্রত্যয়টিকে অবশ্যই একটি অখ- বা সর্বাত্মক প্রত্যয় হিসেবে বিচার করতে হবে এবং এ কারণেই কথাটি সবিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখতে হবে। সমাজদেহকে যদি মানবদেহের প্রতিরূপ হিসেবে অনুধাবন করা যায়, তবে বিষয়টি বেশ সহজতর হয়ে উঠতে পারে।
নির্ধারকের সুস্পষ্টতা না থাকায় বাংলাদেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা নিয়ে বিস্তর বিভ্রান্তি রয়েছে; তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রায় অর্ধকোটি লোককে প্রান্তিক বলে অভিহিত করা যায়। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর গবেষণায় এসব লোকজনের সামাজিক পরিচিতি উঠে এসেছে, যার মধ্যে রয়েছেÑ বাণিজ্যিক যৌনকর্মী ও তাদের সন্তান, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী, কারিগর শ্রেণী, এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত মানুষজন, স্থায়ীভাবে অসুস্থ গরিব মানুষজন, ভূমিহীন চাষি ও গ্রামীণ গরিব মানুষজন বিশেষত নারী, শহুরে বস্তিবাসী, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জনগোষ্ঠী, গৃহহীন ও কর্মহীন ব্যক্তিবর্গ ও তাদের পরিবার এবং পরিবেশগত কারণে বাস্তুহারা মানুষজন।
আলোচনায় ব্যবহৃত পদমালার বিষয়টি এখানে পরিচ্ছন্ন করা আবশ্যক বলে মনে করছি। প্রথমত, আদিবাসীদের প্রধানত বলা হচ্ছে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, উপজাতি, নৃগোষ্ঠী প্রভৃতি। উল্লিখিত পদগুলোর ব্যবহারে ব্যক্তিগতভাবে আমার অনীহা রয়েছে। ক্ষুদ্র মানে হলো ছোট, যা কারো জনগোষ্ঠীভিত্তিক পরিচয়ে ব্যবহার করা একধরনের অপমানজনক বটে। কাউকে উপজাতি বলতে হলে সে কোন জাতির উপজাতি তার সপ্রমাণিত ব্যাখ্যা থাকা জরুরি। আর, মানুষ হিসেবে যাদের জন্ম, তাদের পরিচয়ে নৃ পদটির ব্যবহার হাস্যকর; কেননা নৃ বলতে শুধু মানুষকেই বোঝানো হয়ে থাকে। জাতিসংঘের ব্যাখ্যাটি মাথায় রেখে আদিবাসী পদের ব্যবহার অধিকতর যুক্তিযুক্ত বলে মনে করি; জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলেছেÑ ‘আদিবাসী তারাই যাদের নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দেশের অন্য জনগোষ্ঠী থেকে পৃথক এবং তাদের অবস্থা পুরোপুরি বা আংশিকভাবে তাদের নিজস্ব আচার- আচরণ/ রীতি-নীতি, ঐতিহ্য বা বিশেষ আইন ও নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কোন রাষ্ট্রে তাদের আইনগত অবস্থা যাই হোক না কেন, তারা তাদের নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ সংরক্ষণ করছেন...।’
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে দলিত জনগোষ্ঠীর খোদ অস্তিত্ব নিয়েই মহলবিশেষে প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে কি দলিতদের বসবাস নেই? আমাদের নগর-বন্দর পরিচ্ছন্ন রাখে, পাদুকা মেরামত ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, আমিষের জোগান দেয়, বাদ্য বাজিয়ে আনন্দ প্রদান করে (ইত্যাকার বহুবিধ পরিচয় বহনকারী) এরা তাহলে কারা? প্রসঙ্গত বলা আবশ্যক যে, দলিত জনগোষ্ঠীসমূহের অনেকের উত্তরাধিকার-সূত্রীয় পেশা আজকাল সমাজে প্রচলিত নেই, কিন্তু তাদের আর্থিক ও সামাজিক পরিচিতি বদলায়নি। আবার, অনেকের পেশা মূল ¯্রােতধারার লোকজন দখল করে ফেলেছে।
আদিবাসী ও দলিতÑ উভয়কেই বলা হয় সংখ্যালঘুর মধ্যকার সংখ্যালঘু। সংখ্যালঘু পদটির ব্যবহারেও আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। কারণ, এই পদটিকে আপাদমস্তক গিলে ফেলেছে ধর্মীয় পরিচিতি। এজন্য আমি ‘সংখ্যাস্বল্প জনগোষ্ঠী’ পদটির ব্যবহার করতে আগ্রহী। আমি মনে করি, আলোচ্য সব জনগোষ্ঠীর পরিচয় প্রদানে এই পদটি যথার্থ অর্থবহ, অধিকতর যুক্তিযুক্তও বটে। একইভাবে আভিধানিক অর্থে আদিবাসী বা দলিত বলা যাবে না কিন্তু নানা ধরনে ও রূপে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করে, এমন লোকসমষ্ঠির জন্যও একই অভিধা প্রযোজ্য হতে পারে। প্রান্তিকতার বিচারেও এসব জনগোষ্ঠীর অবস্থান সর্বাগ্রে বিবেচিত হওয়ার মতো, এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়। মোদ্দা কথা, এরা একাধারে সংখ্যাস্বল্প ও প্রান্তিক।
উৎসগত ও সামাজিক পরিচয় যা-ই হোক, এই সংখ্যাস্বল্প প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসমূহের একটি অভিন্ন মিলনক্ষেত্র রয়েছে; তা হলো দারিদ্র্য। তাই এদের বিবেচনা করতে হবে অভিন্নভাবেই এবং এদের জন্য উন্নয়ন পরিকল্পনাও হতে হবে অভিন্ন; তবে জনগোষ্ঠীর মানুষের অনগ্রসরতার কারণ, প্রকৃতি, ধরন, প্রকোপ প্রভৃতি আলাদাভাবে অনুসন্ধান করতে হবে এবং যার যার চাহিদা ও উপযোগিতা বিবেচনা করে উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আর, সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত বিশেষণ। উপযুক্ত বিশেষণ স্থির করতে পারলে উদ্দিষ্ঠ জনগোষ্ঠীসমূহের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সহজতর হয়ে উঠবে বলে আমাদের বিশ্বাস। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোর সফল বাস্তবায়নে এসব জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনে করি। যেহেতু উন্নয়ন একটি সামগ্রিক বিষয় এবং কোনভাবেই নিছক সম্পদ অর্জন বা সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাব-নিকাশের বিষয় নয়Ñ সমন্বিত উদ্যোগ এ ধারণাটিকেও প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
[লেখক: মানবাধিকারকর্মী]
,
মানবাধিকারকর্মী ও গবেষক
মোবাইল: ০১৭১২৬৪৯৬৪১
ঊ-সধরষ: নপথংঁঃৎধফযধৎ@ুধযড়ড়.পড়স