অরূপরতন চৌধুরী
সরস্বতী পূজা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি বিশেষ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব। এই পূজা বিদ্যার দেবী সরস্বতীকে আরাধনা করার জন্য উদযাপিত হয়। তিনি জ্ঞান, সংগীত, শিল্পকলা এবং বুদ্ধির দেবী হিসেবে পূজিত। সরস্বতী পূজা সাধারণত মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়, যা বাসন্তী পঞ্চমী নামেও পরিচিত।
দেবী সরস্বতী : সরস্বতী দেবীকে শুভ্র বসনে সজ্জিত, হাতে বীণা, বেদ ও মালা ধারণ করা অবস্থায় কল্পনা করা হয়। তার বাহন হংস, যা জ্ঞানের প্রতীক। দেবী সরস্বতী মানবজাতির মধ্যে জ্ঞান ও সৃজনশীলতার বীজ বপন করেন।
পূজার আয়োজন : সরস্বতী পূজা বিদ্যালয়, কলেজ এবং বাসাবাড়িতে উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয়। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা দেবীর কাছে জ্ঞান ও সাফল্যের প্রার্থনা করে। পূজার জন্য একটি মঞ্চ বা বেদি তৈরি করা হয় এবং সেখানে দেবীর মূর্তি স্থাপন করা হয়।
পূজা অনুষ্ঠানে দর্পণ, পুস্তক এবং দেবীর প্রিয় উপকরণ যেমন হলুদ ফুল, যবের শীষ, এবং মিষ্টি নিবেদন করা হয়। পূজার প্রধান আচারগুলোর মধ্যে অঞ্জলি প্রদান ও হোম যজ্ঞ রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ দিন : সরস্বতী পূজা শিক্ষার্থীদের জন্য এক অনন্য দিন। এই দিনে তারা লেখাপড়ার সামগ্রী যেমন খাতা-কলম এবং বই দেবীর সামনে অর্পণ করে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। অনেক স্কুল-কলেজে এ দিনটিকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদযাপন করা হয়।
সাংস্কৃতিক তাৎপর্য : সরস্বতী পূজা শুধু ধর্মীয় নয়, এটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও অংশ। এটি মানুষের মনে সৃষ্টিশীলতা ও জ্ঞানার্জনের প্রতি উৎসাহ জাগায়। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ এই দিনে একত্রিত হয়ে আনন্দ ও উৎসবের মাধ্যমে বন্ধনকে দৃঢ় করে।
সরস্বতী শব্দের দুই অর্থÑ একটি ত্রিলোক্য ব্যাপিনী সূর্যাগ্নি, অন্যটি নদী। সরস+বতী=সরস্বতী, অর্থ জ্যোতির্ময়ী। ঋগবেদে আছে ‘অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী’, সম্ভবত সরস্বতী নদীর তীরেই বৈদিক এবং ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উদ্ভব। সরস্বতী মূলত বৈদিক দেবী। বেদে সরস্বতী প্রধানত নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সরস শব্দের অর্থ জল। অতএব সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হলো জলবতী, অর্থাৎ নদী। তিনি বিদ্যার দেবী, জ্ঞানদায়িনী, বীণাপাণি, কুলপ্রিয়া, পলাশপ্রিয়া প্রভৃতি নামে অভিহিত। তার এক হাতে বীণা, অন্য হাতে পুস্তক। সরস্বতী ‘সতত রসে সমৃদ্ধা’। তিনি শুক্ল বর্ণা, শুভ্র হংসবাহনা, ‘বীণা-রঞ্জিত পুস্তক হস্তে’ অর্থাৎ এক হাতে বীণা ও অন্য হাতে পুস্তক। মাঘ মাসের শুক্লাপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে জ্ঞান, বিদ্যা ও ললিতকলার দেবী সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি বাড়িতে সরস্বতী পূজার উৎসবের আয়োজন করা হয়।
প্রাচীন হিন্দু সাহিত্যে সরস্বতী নানা নামে পরিচিত। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় ব্রহ্মাণী (ব্রহ্মার শক্তি), ব্রাহ্মী (বিজ্ঞানের দেবী), ভারতী (ইতিহাসের দেবী), বর্ণেশ্বরী (অক্ষরের দেবী), কবিজিহ্বাগ্রবাসিনী (যিনি কবিগণের জিহ্বাগ্রে বাস করেন) ইত্যাদি নাম। আবার সরস্বতী বিদ্যাদাত্রী (যিনি বিদ্যা দান করেন), বীণাবাদিনী (যিনি বীণা বাজান), পুস্তকধারিণী (যিনি হস্তে পুস্তক ধারণ করেন), বীণাপাণি (যার হাতে বীণা শোভা পায়), হংসবাহিনী (যে দেবীর বাহন রাজহংস) ও বাºেবী (বাক্যের দেবী) নামেও পরিচিত।
প্রতিমাকল্প
সরস্বতীর মূর্তিবিদ্যা : দেবী তার বীণা, রাজহাঁস, ময়ূর, স্ফটিক জপমালা এবং পদ্মের সাথে চিত্রিত। (দুটি ছবি- উপরে কেরালার একটি টাইলস ম্যুরাল। নিচে কর্ণাটকে একটি সাংস্কৃতিক মার্বেল ভাস্কর্য)।
দেবী সরস্বতীকে প্রায়শই বিশুদ্ধ শ্বেতবস্ত্র পরিহিতা একজন সুন্দরী নারী হিসেবে চিত্রিত করা হয়, যিনি প্রায়শই আলো, জ্ঞান এবং সত্যের প্রতীক একটি সাদা পদ্মোপরি উপবিষ্টা। তিনি শুধু জ্ঞানই নয়, সর্বোচ্চ বাস্তবতার অভিজ্ঞতাও মূর্ত করেন। সাধারণত তার শ্বেত মূর্তিকল্পের বস্ত্র, ফুল থেকে রাজহাঁস পর্যন্ত- শ্বেত বর্ণ সত্ত্ব গুণ বা বিশুদ্ধতা, সত্য জ্ঞান, অর্ন্তদৃষ্টি এবং প্রজ্ঞার প্রতীক।
তার ধ্যান মন্ত্রে তাকে চন্দ্রের মতো শুভ্র, শুভ্র বস্ত্র পরিহিতা, শুভ্র অলঙ্কারে সজ্জিতা, সৌন্দর্যে দ্যুতিমতী, কলম এবং পুস্তকধারিণী (জ্ঞানের প্রতীক) হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
তিনি সাধারণত চতুর্ভুজা, কখনও বা দ্বিভুজা। চতুর্ভুজারূপে, চার হাত তার স্বামী ব্রহ্মার চারটি মস্তককে প্রতীকীভাবে প্রতিফলিত করে, যা মানস (মন, ইন্দ্রিয়), বুদ্ধি (ধীশক্তি, যু্ক্িত বা ন্যায়), চিত্ত (কল্পনা, সৃজনশীলতা) এবং অহঙ্কার (আত্ম চেতনা, অহং) এর প্রতীক। ব্রহ্মা বিমূর্তের প্রতিনিধিত্ব করেন, অন্যদিকে তিনি কর্ম এবং বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করেন।
দেবীর চার হাতে প্রতীকী অর্থে- পুস্তক (বই বা লিপি), মালা (জপমালা), কমগুলু এবং বাদ্যযন্ত্র (বীণা) দেখা যায়। তার ধারণ করা বইটি বেদের প্রতীক যা বিশ্বজনীন, ঐশ্বরিক, শাশ্বত এবং সত্য জ্ঞানসহ সমস্ত ধরনের শিক্ষার প্রতীক। স্ফটিকমালা ধ্যানশক্তি, অভ্যন্তরীন প্রতিফলন এবং আধ্যাত্মিকতার প্রতীক। কমন্ডলুটি ভুল থেকে সঠিক, অশুচি থেকে শুচি এবং অপ্রয়োজনীয় থেকে সারাংশকে পৃথককরণের দ্বারা বিশুদ্ধকারীশক্তির প্রতীক। কিছু গ্রন্থে, কমগুলু সোমের প্রতীক- সোম একপ্রকার পানীয় যা মুক্ত করে এবং জ্ঞানের দিকে নিয়ে যায়। সরস্বতীর সবচেয়ে বিখ্যাত বৈশিষ্ট্য হলো তার বাদ্যযন্ত্র বীণা, যা সমস্ত সৃজনশীল শিল্প ও বিজ্ঞানের প্রতীক এবং তা ধারণ করা হলো জ্ঞান প্রকাশের প্রতীক যা সাদৃশ্য তৈরি করে। সরস্বতী অনুরাগের সঙ্গেও যুক্ত, যা সঙ্গীতের প্রতি ভালবাসা এবং বাক্যে বা ছন্দময় সঙ্গীতে প্রকাশিত সমস্ত আবেগ এবং অনুভূতির প্রতীক।
একটি হংস বা রাজহাঁস প্রায়শই তার পায়ের কাছে থাকে। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীতে হংস একটি পবিত্র পাখি। বলা হয়, হংসকে যদি দুধ এবং জলের মিশ্রন দেওয়া হয়, জল ত্যাগ করে শুধু দুধ পান করার অনন্য ক্ষমতা হংসের রয়েছে। পাখির এই বৈশিষ্ট্যটি জীবনের জটিলতার মধ্যে জ্ঞানান্বেষণ, ভাল এবং মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা, অসত্য থেকে সত্য, বাহ্যিক প্রদর্শন থেকে সারাংশ এবং অদৃশ্য থেকে চিরন্তন এর রূপক হিসেবে কাজ করে। রাজহাঁসের সঙ্গে তার যোগসূত্রের কারণে সরস্বতীকে হংসবাহিনী (যার বাহন হংস) বলা হয়। রাজহাঁস আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতা, উৎকর্ষ এবং মোক্ষের প্রতীক।
কখনও কখনও দেবীর পাশে একটি চিত্রমেখলা (ময়ূর) দেখানো হয়। ময়ূর রঙিন জৌলুস, নৃত্য-সর্পগ্রাসকারী তথা অপস্মাররূপ সর্পের বিষকে আলোকিত দীপ্তিতে রূপান্তরিত করার অপরাসায়নিক শক্তির প্রতীক।
বলা হয়, দেবী সরস্বতীর একমাত্র ঐশ্বর্য হল জ্ঞান। দেবী সরস্বতীর সর্বাঙ্গ দুধের মতো ধবধবে সাদা তবে চোখের মণি, মাথার চুল ও ভ্রু-দুটি কালো। গলায় মুক্তোর মালা, অন্যান্য সমস্ত অলঙ্কারই দেবীর সাদা। প্রসন্ন দিব্য বিগ্রহের বাঁ-হাতে বীণা। শুদ্ধসত্ত্ব দেবীর পরিহিত বস্ত্রাদিও শ্বেতবর্ণের। ডানহাতে শ্বেতপদ্ম। বাহন হাঁসটিও শ্বেতপদ্মের মতো সাদা।
ধ্যানমন্ত্রে বর্ণিত প্রতিমাকল্পটিতে দেবী সরস্বতী দেবীকে শ্বেতবর্ণা, শ্বেতপদ্মে আসীনা, মুক্তার হারে ভূষিতা, পদ্মলোচনা ও বীণাপুস্তকধারিণী এক দিব্য নারীমূর্তিরূপে কল্পনা করা হয়েছে।
[লেখক : সম্মানিক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা, ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারি, বারডেম ও অধ্যাপক ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ]
অরূপরতন চৌধুরী
সোমবার, ০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
সরস্বতী পূজা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি বিশেষ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব। এই পূজা বিদ্যার দেবী সরস্বতীকে আরাধনা করার জন্য উদযাপিত হয়। তিনি জ্ঞান, সংগীত, শিল্পকলা এবং বুদ্ধির দেবী হিসেবে পূজিত। সরস্বতী পূজা সাধারণত মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়, যা বাসন্তী পঞ্চমী নামেও পরিচিত।
দেবী সরস্বতী : সরস্বতী দেবীকে শুভ্র বসনে সজ্জিত, হাতে বীণা, বেদ ও মালা ধারণ করা অবস্থায় কল্পনা করা হয়। তার বাহন হংস, যা জ্ঞানের প্রতীক। দেবী সরস্বতী মানবজাতির মধ্যে জ্ঞান ও সৃজনশীলতার বীজ বপন করেন।
পূজার আয়োজন : সরস্বতী পূজা বিদ্যালয়, কলেজ এবং বাসাবাড়িতে উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয়। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা দেবীর কাছে জ্ঞান ও সাফল্যের প্রার্থনা করে। পূজার জন্য একটি মঞ্চ বা বেদি তৈরি করা হয় এবং সেখানে দেবীর মূর্তি স্থাপন করা হয়।
পূজা অনুষ্ঠানে দর্পণ, পুস্তক এবং দেবীর প্রিয় উপকরণ যেমন হলুদ ফুল, যবের শীষ, এবং মিষ্টি নিবেদন করা হয়। পূজার প্রধান আচারগুলোর মধ্যে অঞ্জলি প্রদান ও হোম যজ্ঞ রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ দিন : সরস্বতী পূজা শিক্ষার্থীদের জন্য এক অনন্য দিন। এই দিনে তারা লেখাপড়ার সামগ্রী যেমন খাতা-কলম এবং বই দেবীর সামনে অর্পণ করে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। অনেক স্কুল-কলেজে এ দিনটিকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদযাপন করা হয়।
সাংস্কৃতিক তাৎপর্য : সরস্বতী পূজা শুধু ধর্মীয় নয়, এটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও অংশ। এটি মানুষের মনে সৃষ্টিশীলতা ও জ্ঞানার্জনের প্রতি উৎসাহ জাগায়। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ এই দিনে একত্রিত হয়ে আনন্দ ও উৎসবের মাধ্যমে বন্ধনকে দৃঢ় করে।
সরস্বতী শব্দের দুই অর্থÑ একটি ত্রিলোক্য ব্যাপিনী সূর্যাগ্নি, অন্যটি নদী। সরস+বতী=সরস্বতী, অর্থ জ্যোতির্ময়ী। ঋগবেদে আছে ‘অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী’, সম্ভবত সরস্বতী নদীর তীরেই বৈদিক এবং ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উদ্ভব। সরস্বতী মূলত বৈদিক দেবী। বেদে সরস্বতী প্রধানত নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সরস শব্দের অর্থ জল। অতএব সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হলো জলবতী, অর্থাৎ নদী। তিনি বিদ্যার দেবী, জ্ঞানদায়িনী, বীণাপাণি, কুলপ্রিয়া, পলাশপ্রিয়া প্রভৃতি নামে অভিহিত। তার এক হাতে বীণা, অন্য হাতে পুস্তক। সরস্বতী ‘সতত রসে সমৃদ্ধা’। তিনি শুক্ল বর্ণা, শুভ্র হংসবাহনা, ‘বীণা-রঞ্জিত পুস্তক হস্তে’ অর্থাৎ এক হাতে বীণা ও অন্য হাতে পুস্তক। মাঘ মাসের শুক্লাপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে জ্ঞান, বিদ্যা ও ললিতকলার দেবী সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি বাড়িতে সরস্বতী পূজার উৎসবের আয়োজন করা হয়।
প্রাচীন হিন্দু সাহিত্যে সরস্বতী নানা নামে পরিচিত। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় ব্রহ্মাণী (ব্রহ্মার শক্তি), ব্রাহ্মী (বিজ্ঞানের দেবী), ভারতী (ইতিহাসের দেবী), বর্ণেশ্বরী (অক্ষরের দেবী), কবিজিহ্বাগ্রবাসিনী (যিনি কবিগণের জিহ্বাগ্রে বাস করেন) ইত্যাদি নাম। আবার সরস্বতী বিদ্যাদাত্রী (যিনি বিদ্যা দান করেন), বীণাবাদিনী (যিনি বীণা বাজান), পুস্তকধারিণী (যিনি হস্তে পুস্তক ধারণ করেন), বীণাপাণি (যার হাতে বীণা শোভা পায়), হংসবাহিনী (যে দেবীর বাহন রাজহংস) ও বাºেবী (বাক্যের দেবী) নামেও পরিচিত।
প্রতিমাকল্প
সরস্বতীর মূর্তিবিদ্যা : দেবী তার বীণা, রাজহাঁস, ময়ূর, স্ফটিক জপমালা এবং পদ্মের সাথে চিত্রিত। (দুটি ছবি- উপরে কেরালার একটি টাইলস ম্যুরাল। নিচে কর্ণাটকে একটি সাংস্কৃতিক মার্বেল ভাস্কর্য)।
দেবী সরস্বতীকে প্রায়শই বিশুদ্ধ শ্বেতবস্ত্র পরিহিতা একজন সুন্দরী নারী হিসেবে চিত্রিত করা হয়, যিনি প্রায়শই আলো, জ্ঞান এবং সত্যের প্রতীক একটি সাদা পদ্মোপরি উপবিষ্টা। তিনি শুধু জ্ঞানই নয়, সর্বোচ্চ বাস্তবতার অভিজ্ঞতাও মূর্ত করেন। সাধারণত তার শ্বেত মূর্তিকল্পের বস্ত্র, ফুল থেকে রাজহাঁস পর্যন্ত- শ্বেত বর্ণ সত্ত্ব গুণ বা বিশুদ্ধতা, সত্য জ্ঞান, অর্ন্তদৃষ্টি এবং প্রজ্ঞার প্রতীক।
তার ধ্যান মন্ত্রে তাকে চন্দ্রের মতো শুভ্র, শুভ্র বস্ত্র পরিহিতা, শুভ্র অলঙ্কারে সজ্জিতা, সৌন্দর্যে দ্যুতিমতী, কলম এবং পুস্তকধারিণী (জ্ঞানের প্রতীক) হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
তিনি সাধারণত চতুর্ভুজা, কখনও বা দ্বিভুজা। চতুর্ভুজারূপে, চার হাত তার স্বামী ব্রহ্মার চারটি মস্তককে প্রতীকীভাবে প্রতিফলিত করে, যা মানস (মন, ইন্দ্রিয়), বুদ্ধি (ধীশক্তি, যু্ক্িত বা ন্যায়), চিত্ত (কল্পনা, সৃজনশীলতা) এবং অহঙ্কার (আত্ম চেতনা, অহং) এর প্রতীক। ব্রহ্মা বিমূর্তের প্রতিনিধিত্ব করেন, অন্যদিকে তিনি কর্ম এবং বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করেন।
দেবীর চার হাতে প্রতীকী অর্থে- পুস্তক (বই বা লিপি), মালা (জপমালা), কমগুলু এবং বাদ্যযন্ত্র (বীণা) দেখা যায়। তার ধারণ করা বইটি বেদের প্রতীক যা বিশ্বজনীন, ঐশ্বরিক, শাশ্বত এবং সত্য জ্ঞানসহ সমস্ত ধরনের শিক্ষার প্রতীক। স্ফটিকমালা ধ্যানশক্তি, অভ্যন্তরীন প্রতিফলন এবং আধ্যাত্মিকতার প্রতীক। কমন্ডলুটি ভুল থেকে সঠিক, অশুচি থেকে শুচি এবং অপ্রয়োজনীয় থেকে সারাংশকে পৃথককরণের দ্বারা বিশুদ্ধকারীশক্তির প্রতীক। কিছু গ্রন্থে, কমগুলু সোমের প্রতীক- সোম একপ্রকার পানীয় যা মুক্ত করে এবং জ্ঞানের দিকে নিয়ে যায়। সরস্বতীর সবচেয়ে বিখ্যাত বৈশিষ্ট্য হলো তার বাদ্যযন্ত্র বীণা, যা সমস্ত সৃজনশীল শিল্প ও বিজ্ঞানের প্রতীক এবং তা ধারণ করা হলো জ্ঞান প্রকাশের প্রতীক যা সাদৃশ্য তৈরি করে। সরস্বতী অনুরাগের সঙ্গেও যুক্ত, যা সঙ্গীতের প্রতি ভালবাসা এবং বাক্যে বা ছন্দময় সঙ্গীতে প্রকাশিত সমস্ত আবেগ এবং অনুভূতির প্রতীক।
একটি হংস বা রাজহাঁস প্রায়শই তার পায়ের কাছে থাকে। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীতে হংস একটি পবিত্র পাখি। বলা হয়, হংসকে যদি দুধ এবং জলের মিশ্রন দেওয়া হয়, জল ত্যাগ করে শুধু দুধ পান করার অনন্য ক্ষমতা হংসের রয়েছে। পাখির এই বৈশিষ্ট্যটি জীবনের জটিলতার মধ্যে জ্ঞানান্বেষণ, ভাল এবং মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা, অসত্য থেকে সত্য, বাহ্যিক প্রদর্শন থেকে সারাংশ এবং অদৃশ্য থেকে চিরন্তন এর রূপক হিসেবে কাজ করে। রাজহাঁসের সঙ্গে তার যোগসূত্রের কারণে সরস্বতীকে হংসবাহিনী (যার বাহন হংস) বলা হয়। রাজহাঁস আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতা, উৎকর্ষ এবং মোক্ষের প্রতীক।
কখনও কখনও দেবীর পাশে একটি চিত্রমেখলা (ময়ূর) দেখানো হয়। ময়ূর রঙিন জৌলুস, নৃত্য-সর্পগ্রাসকারী তথা অপস্মাররূপ সর্পের বিষকে আলোকিত দীপ্তিতে রূপান্তরিত করার অপরাসায়নিক শক্তির প্রতীক।
বলা হয়, দেবী সরস্বতীর একমাত্র ঐশ্বর্য হল জ্ঞান। দেবী সরস্বতীর সর্বাঙ্গ দুধের মতো ধবধবে সাদা তবে চোখের মণি, মাথার চুল ও ভ্রু-দুটি কালো। গলায় মুক্তোর মালা, অন্যান্য সমস্ত অলঙ্কারই দেবীর সাদা। প্রসন্ন দিব্য বিগ্রহের বাঁ-হাতে বীণা। শুদ্ধসত্ত্ব দেবীর পরিহিত বস্ত্রাদিও শ্বেতবর্ণের। ডানহাতে শ্বেতপদ্ম। বাহন হাঁসটিও শ্বেতপদ্মের মতো সাদা।
ধ্যানমন্ত্রে বর্ণিত প্রতিমাকল্পটিতে দেবী সরস্বতী দেবীকে শ্বেতবর্ণা, শ্বেতপদ্মে আসীনা, মুক্তার হারে ভূষিতা, পদ্মলোচনা ও বীণাপুস্তকধারিণী এক দিব্য নারীমূর্তিরূপে কল্পনা করা হয়েছে।
[লেখক : সম্মানিক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা, ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারি, বারডেম ও অধ্যাপক ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ]