alt

উপ-সম্পাদকীয়

ভোজবাজি ও ভানুমতির খেলা

বাবুল রবিদাস

: বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

মানুষের চিত্তবিনোদনের মাধ্যম হিসেবে সংগীত, আবৃত্তি, নাটক, যাত্রা, নৃত্যের মতো শিল্পকলার জনপ্রিয়তা সুপ্রাচীনকাল থেকে থাকলেও জাদুবিদ্যা বা ম্যাজিকও মানুষের মনে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ‘ইন্দ্রজাল’, ‘মায়াজাল’, ‘ভানুমতির খেলা’ ও ‘ভোজবাজি’ এই বিদ্যার পরিচিত কিছু রূপ। প্রাচীন প্রবাদে বলা হয়- ‘লোকোত্তর চমৎকার প্রাণ’Ñঅর্থাৎ অলৌকিক চমৎকারই রসের প্রাণস্বরূপ।

‘মায়াজাল’ শব্দের অর্থ বিভ্রান্তিকর দৃশ্য বা রূপান্তরের খেলা। ‘ইন্দ্রজাল’ বলতে বোঝানো হয় মন্ত্র, দ্রব্য বা কৌশলের মাধ্যমে অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখানো। আধুনিক যুগের দৃষ্টিকোণ থেকে, মানুষের শ্রেষ্ঠ ইন্দ্রিয় হচ্ছে চোখ, আর চোখের ওপর যে বিভ্রম সৃষ্টি করা হয়, সেটাই ‘ইন্দ্রজাল’।

ভোজবাজি ও ভানুমতির খেলার উৎস

‘ম্যাজিক’ শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘সধমড়ং’ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ বুদ্ধিমান বা দক্ষ ব্যক্তি। ধারণা করা হয়, ভারতীয় রাজা ভোজ এবং তার কন্যা ভানুমতি ছিলেন জাদুবিদ্যায় অত্যন্ত দক্ষ। তাদের নাম থেকেই ‘ভানুমতির খেলা’ এবং ‘ভোজবাজি’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে।

২০২৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ‘ভোজবিহার’ নামক স্থান পরিদর্শন করি, যেখানে ভোজরাজার রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। সেই স্থান থেকে সংগৃহীত প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষিত আছে ময়নামতি প্রতœতাত্ত্বিক জাদুঘরে।

ভোজবিহারে পাওয়া নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘বজ্রস্বত্ব’, যা ব্রোঞ্জের তৈরি একটি প্রতিমূর্তি। প্রতœতাত্ত্বিক গবেষণা অনুযায়ী, ভোজরাজা ও ভানুমতি ছিলেন বৌদ্ধধর্মাবলম্বী, যদিও কিছু মতানুসারে তাদের হিন্দুধর্মীয় প্রভাবের কথাও বলা হয়।

ভোজরাজা ও ভানুমতির কিংবদন্তি

প্রাচীন ভারতে ভোজরাজা ও তার কন্যা ভানুমতি জাদুবিদ্যায় এতটাই পারদর্শী ছিলেন যে তাদের কৌশল দেখে মানুষ হতবাক হয়ে যেত। এ বিষয়ে প্রচলিত একটি গল্প হলোÑ

একবার ভোজরাজা তার কন্যার জন্য উজ্জয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্যের কাছে বিবাহের প্রস্তাব পাঠান। দূত ছদ্মবেশে বিক্রমাদিত্যের দরবারে গিয়ে নিজেকে ‘বিদ্যাধর’ বলে পরিচয় দেন এবং এক মহিলাকে তার স্ত্রী হিসেবে উপস্থাপন করেন। তিনি জানান, দেবরাজ ইন্দ্রের অভিশাপে তিনি মর্ত্যে অবস্থান করছেন এবং স্বর্গে যুদ্ধে অংশ নিতে চান। তিনি অনুরোধ করেন, রাজা যেন তার স্ত্রীকে কিছু সময়ের জন্য আশ্রয় দেন।

রাজা বিক্রমাদিত্য সম্মতি দিলে, দূত একটি দড়ি আকাশের দিকে ছুড়ে দেন, যা সেখানে আটকে যায়। এরপর তিনি সেই দড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকেন এবং অদৃশ্য হয়ে যান। কিছুক্ষণ পর ওপর থেকে রক্তাক্ত দেহাংশ পড়ে আসতে থাকে, যা দেখে সবাই শোকাহত হয় এবং সেই ‘বিদ্যাধরের স্ত্রী’কে সতীদাহের নিয়মে দাহ করা হয়।

পরদিন সকালে সেই বিদ্যাধর সুস্থ-সবল অবস্থায় ফিরে আসেন এবং স্ত্রীকে ফেরত চান। রাজা হতবুদ্ধি হয়ে জানান, গতকাল তার স্ত্রীর দাহ সম্পন্ন হয়েছে। বিদ্যাধর উত্তরে বলেন, ‘যেহেতু আমি জীবিত, তাহলে কালকের ঘটনা ছিল বিভ্রমমাত্র। প্রকৃতপক্ষে আমার স্ত্রী রাজসিংহাসনের নিচে লুকিয়ে ছিল।’ এরপর তিনি স্বীকার করেন যে এটি ছিল একধরনের জাদুকৌশল।

ইন্দ্রজাল ও জাদুবিদ্যার পরিচিতি

ভোজরাজা ও ভানুমতির খেলা থেকে পরবর্তী সময়ে ‘ভোজবাজি’ ও ‘ভানুমতির খেলা’ শব্দের প্রচলন হয়। কেউ কেউ বলেন, দেবরাজ ইন্দ্রের সভায় এসব খেলা প্রদর্শিত হতো, তাই একে ‘ইন্দ্রজাল’ বলা হয়। আবার অনেকে বলেন, মানুষের চোখের ওপর যে বিভ্রম সৃষ্টি করা হয়, সেটাই ইন্দ্রজাল।

যে নামেই ডাকা হোক, জাদুবিদ্যার মূল আকর্ষণই হলো মোহজাল সৃষ্টি করা। ইংরেজি ‘সধমরপ’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ‘ভোজবাজি’, ‘ভানুমতির খেলা’, ‘জাদুবিদ্যা’, ‘ইন্দ্রজাল’, ‘মোহজাল’ ও ‘মায়াজাল’ ব্যবহার করা হয়, তবে ‘জাদুবিদ্যা’ ও ‘ইন্দ্রজাল’ শব্দ দুটি সবচেয়ে বেশি পরিচিত।

[লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

কুষ্ঠ ও বৈষম্য : মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি অবহেলিত অধ্যায়

ছবি

প্রান্তজনের বাংলাদেশ

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

সাইবার নিরাপত্তা : অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে আমাদের প্রস্তুতি

ছবি

বাহান্নর গর্ভে জন্ম নেয়া এক ঝড়ের পাখি

প্রবাসী শ্রমিক : অর্থের যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের সহযোদ্ধা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

ভোগবাদের বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিসের জলবায়ু বার্তা

রম্যগদ্য : হাসি নিষেধ...

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : দাবি ও সমাধানের পথ

সিরিয়ার পতন কিভাবে আমেরিকার স্বার্থকে হুমকিতে ফেলছে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধানে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ভোজবাজি ও ভানুমতির খেলা

বাবুল রবিদাস

বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

মানুষের চিত্তবিনোদনের মাধ্যম হিসেবে সংগীত, আবৃত্তি, নাটক, যাত্রা, নৃত্যের মতো শিল্পকলার জনপ্রিয়তা সুপ্রাচীনকাল থেকে থাকলেও জাদুবিদ্যা বা ম্যাজিকও মানুষের মনে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ‘ইন্দ্রজাল’, ‘মায়াজাল’, ‘ভানুমতির খেলা’ ও ‘ভোজবাজি’ এই বিদ্যার পরিচিত কিছু রূপ। প্রাচীন প্রবাদে বলা হয়- ‘লোকোত্তর চমৎকার প্রাণ’Ñঅর্থাৎ অলৌকিক চমৎকারই রসের প্রাণস্বরূপ।

‘মায়াজাল’ শব্দের অর্থ বিভ্রান্তিকর দৃশ্য বা রূপান্তরের খেলা। ‘ইন্দ্রজাল’ বলতে বোঝানো হয় মন্ত্র, দ্রব্য বা কৌশলের মাধ্যমে অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখানো। আধুনিক যুগের দৃষ্টিকোণ থেকে, মানুষের শ্রেষ্ঠ ইন্দ্রিয় হচ্ছে চোখ, আর চোখের ওপর যে বিভ্রম সৃষ্টি করা হয়, সেটাই ‘ইন্দ্রজাল’।

ভোজবাজি ও ভানুমতির খেলার উৎস

‘ম্যাজিক’ শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘সধমড়ং’ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ বুদ্ধিমান বা দক্ষ ব্যক্তি। ধারণা করা হয়, ভারতীয় রাজা ভোজ এবং তার কন্যা ভানুমতি ছিলেন জাদুবিদ্যায় অত্যন্ত দক্ষ। তাদের নাম থেকেই ‘ভানুমতির খেলা’ এবং ‘ভোজবাজি’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে।

২০২৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ‘ভোজবিহার’ নামক স্থান পরিদর্শন করি, যেখানে ভোজরাজার রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। সেই স্থান থেকে সংগৃহীত প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষিত আছে ময়নামতি প্রতœতাত্ত্বিক জাদুঘরে।

ভোজবিহারে পাওয়া নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘বজ্রস্বত্ব’, যা ব্রোঞ্জের তৈরি একটি প্রতিমূর্তি। প্রতœতাত্ত্বিক গবেষণা অনুযায়ী, ভোজরাজা ও ভানুমতি ছিলেন বৌদ্ধধর্মাবলম্বী, যদিও কিছু মতানুসারে তাদের হিন্দুধর্মীয় প্রভাবের কথাও বলা হয়।

ভোজরাজা ও ভানুমতির কিংবদন্তি

প্রাচীন ভারতে ভোজরাজা ও তার কন্যা ভানুমতি জাদুবিদ্যায় এতটাই পারদর্শী ছিলেন যে তাদের কৌশল দেখে মানুষ হতবাক হয়ে যেত। এ বিষয়ে প্রচলিত একটি গল্প হলোÑ

একবার ভোজরাজা তার কন্যার জন্য উজ্জয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্যের কাছে বিবাহের প্রস্তাব পাঠান। দূত ছদ্মবেশে বিক্রমাদিত্যের দরবারে গিয়ে নিজেকে ‘বিদ্যাধর’ বলে পরিচয় দেন এবং এক মহিলাকে তার স্ত্রী হিসেবে উপস্থাপন করেন। তিনি জানান, দেবরাজ ইন্দ্রের অভিশাপে তিনি মর্ত্যে অবস্থান করছেন এবং স্বর্গে যুদ্ধে অংশ নিতে চান। তিনি অনুরোধ করেন, রাজা যেন তার স্ত্রীকে কিছু সময়ের জন্য আশ্রয় দেন।

রাজা বিক্রমাদিত্য সম্মতি দিলে, দূত একটি দড়ি আকাশের দিকে ছুড়ে দেন, যা সেখানে আটকে যায়। এরপর তিনি সেই দড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকেন এবং অদৃশ্য হয়ে যান। কিছুক্ষণ পর ওপর থেকে রক্তাক্ত দেহাংশ পড়ে আসতে থাকে, যা দেখে সবাই শোকাহত হয় এবং সেই ‘বিদ্যাধরের স্ত্রী’কে সতীদাহের নিয়মে দাহ করা হয়।

পরদিন সকালে সেই বিদ্যাধর সুস্থ-সবল অবস্থায় ফিরে আসেন এবং স্ত্রীকে ফেরত চান। রাজা হতবুদ্ধি হয়ে জানান, গতকাল তার স্ত্রীর দাহ সম্পন্ন হয়েছে। বিদ্যাধর উত্তরে বলেন, ‘যেহেতু আমি জীবিত, তাহলে কালকের ঘটনা ছিল বিভ্রমমাত্র। প্রকৃতপক্ষে আমার স্ত্রী রাজসিংহাসনের নিচে লুকিয়ে ছিল।’ এরপর তিনি স্বীকার করেন যে এটি ছিল একধরনের জাদুকৌশল।

ইন্দ্রজাল ও জাদুবিদ্যার পরিচিতি

ভোজরাজা ও ভানুমতির খেলা থেকে পরবর্তী সময়ে ‘ভোজবাজি’ ও ‘ভানুমতির খেলা’ শব্দের প্রচলন হয়। কেউ কেউ বলেন, দেবরাজ ইন্দ্রের সভায় এসব খেলা প্রদর্শিত হতো, তাই একে ‘ইন্দ্রজাল’ বলা হয়। আবার অনেকে বলেন, মানুষের চোখের ওপর যে বিভ্রম সৃষ্টি করা হয়, সেটাই ইন্দ্রজাল।

যে নামেই ডাকা হোক, জাদুবিদ্যার মূল আকর্ষণই হলো মোহজাল সৃষ্টি করা। ইংরেজি ‘সধমরপ’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ‘ভোজবাজি’, ‘ভানুমতির খেলা’, ‘জাদুবিদ্যা’, ‘ইন্দ্রজাল’, ‘মোহজাল’ ও ‘মায়াজাল’ ব্যবহার করা হয়, তবে ‘জাদুবিদ্যা’ ও ‘ইন্দ্রজাল’ শব্দ দুটি সবচেয়ে বেশি পরিচিত।

[লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]

back to top