alt

উপ-সম্পাদকীয়

পশ্চিমবঙ্গ : রাজনৈতিক হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

গৌতম রায়

: শনিবার, ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

মুসলমানদের নিয়ে রাজনীতির পাশা খেলা চলে। কেউ বা বলেন তাদের ‘দুধেল গাই’। অন্যে আক্রমণ শানায় আরও বুদ্ধি খরচ করে। কিন্তু মুসলমান কেমন আছেন এই বাংলায়, মুর্শিদাবাদের লালগোলার ফরজেম শেখ, হাসিবুর রহমান আর উত্তর চব্বিশ পরগনার ন্যাজাটের সুমন সর্দার নিজের জীবন দিয়ে তা দেখিয়ে গেলেন।

বিতর্ক চলবে, কে বা কারা সুপ্রিম কোর্টের রায় অগ্রাহ্য করে সাফাইয়ের কাজে শ্রমিক ব্যবহার করেÑ তা ঘিরে। শাসক আর বিরোধীদের তর্জা চলবেই।

কিন্তু কী ভয়াবহ আর্থিক সংকটে আজ বাংলার মুসলমান সমাজের রয়েছেÑ যার জেরে অমন প্রাণ হাতে করে ফরজেম, হাসিবুর সুমনদের কাজ করতে হচ্ছেÑ তা নিয়ে কোনও আলোচনা হবে।

এক শাসক বলবে, আমরা মুসলমানদের কত কিছু করে দিয়েছি। জিজ্ঞাসা করুন ধর্মাচারণে উৎসাহ দেয়ার বাইরে, তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিশেষ করে মেয়েদের, প্রসূতির স্বাস্থ্যÑ অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন-উত্তর পেলেও বাস্তবে তা মিলবে না।

আর এক শাসক, অন্য শাসকের মুসলমান তোষণের বাইরে কিছু দেখতেই পাবে না। মুসলমান বিদ্বেষের নক্ষত্রেই যে তাদের জন্ম।

বিচারপতি সাচারÑ তাকে ঘিরে, তার প্রতিবেদন ঘিরে শোরগোলÑ এত মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কল্যাণের জন্য? না, ভোটের জন্য? প্রশ্ন তুললেই বলা হবে, বাংলাদেশে চলে যান।

প্রদীপ জ্বলতে পিলসুজের উপরেই। আলো পাবেন বর্ণ হিন্দুরা। ফরজেম, হাসিবুরদের গায়ের উপর দিয়ে প্রদীপের তেল গড়িয়ে পড়বে না। ‘সভ্যতার পিলসুজ’ কে ঘিরে, আজ বেঁচে থাকলে রবীন্দ্রনাথ, তেল গড়িয়ে পড়ার বদলে হয়তো লিখতেন, প্রদীপের আগুনেই ওরা পুড়ে মরবেÑ পশ্চিমবঙ্গে সহনাগরিক মুসলমান সমাজের আর্থ- সামাজিক প্রেক্ষিত যদি আমরা ছয়ের দশক থেকে আজকের দিন পর্যন্ত পরিচালনা করি, তাহলে দেখতে পাব, ১৯৭২ সালে একটি বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের নেতৃত্বে এই রাজ্য সরকার গঠন করে। সিদ্ধার্থ শংকরের একটি পারিবারিক রাজনৈতিক উত্তরাধিকার ছিল। তিনি সম্পর্কে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের দৌহিত্র হতেন। সেই বিষয়টিকেই তিনি তার রাজনৈতিক মাইলেজ নেয়ার ক্ষেত্রে মারাত্মক রকম ভাবে ব্যবহার করেছিলেন মুসলমানদের ভোটব্যাংক হিসেবে সাব্যস্ত করে তাদের প্রতি কিছু নিছক সহানুভূতিশীল কথা বলবার মধ্য দিয়ে।

সিদ্ধার্থ শংকর নিজে যেহেতু অত্যন্ত দক্ষ আইনজীবী ছিলেন তাই কিছু কিছু ক্ষেত্রে মুসলমানদের আইনি হেনস্তার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তিনি ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নিতেন। এই উদ্যোগটা পরবর্তীকালে তিনি যখন আর মুখ্যমন্ত্রী নন পশ্চিমবঙ্গের, তখনো নিতেন। ফলে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের তার প্রতি একটা সহানুভূতির মানসিকতা ছিল। কিন্তু মুসলমান সমাজের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য যে ধরনের প্রশাসনিক উদ্যোগ নেয়া দরকার ছিল, তা সিদ্ধার্থ শংকরের আমলে আদৌ হয়নি।

এরপরই দীর্ঘদিন বামফ্রন্ট সরকার পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাশীল ছিল। বামফ্রন্ট সরকার একদম প্রাথমিক পর্যায়েই ভূমি সংস্কার, অপারেশন বার্গার মধ্য দিয়ে এমন একটি ইতিবাচক সামাজিক পরিস্থিতি তৈরি করতে পেরেছিলেন যেখানে গ্রামীণ বাংলার সর্বস্তরের পিছিয়ে পড়া মানুষ, আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকবার একটা উৎসাহ পেয়েছিলেন। এই জায়গাতে বাঙালি মুসলমান, তপশিলি জাতি-উপজাতি বা বিভিন্ন পিছিয়ে পড়া মানুষ, গ্রাম বাংলায় বর্ণ হিন্দুদের যে ভয়ংকর অত্যাচার, সামন্ততান্ত্রিক পরিকাঠামো, সেখান থেকে কিছুটা হলেও নিস্তার পেয়েছিলেন।

তবে ভূমি সংস্কারের যে ইতিবাচক দিক তার ধারাবাহিকতা সেভাবে বজায় থাকেনি। তার কারণ একটা সময় দেখতে পাওয়া গেল যে, বর্ণ হিন্দুরা, যে আধা সামন্ততান্ত্রিক প্রভুরা, মুসলমানসহ সমস্ত ধরনের প্রান্তিক মানুষের ওপর শোষণ চালিয়ে নিজেদের শ্রেণী স্বার্থকে বজায় রাখত, তারা পোশাক বদল করে ধীরে ধীরে শাসকদলের আঙিনার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। ফলে বর্ণ হিন্দুদের যে দাপট সেটা অতীতের মতো প্রকট না থাকলেও প্রথম বামফ্রন্ট সরকার বা দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকারের পর থেকে যেভাবে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েতে শুরু করেছিল। সেই ক্ষয়িষ্ণুতার মাত্রাটা আর বজায় রইল না। বরঞ্চ বলতে পারা যায়, বর্ণ হিন্দু এবং সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা সম্পন্ন একটা অংশের হিন্দু, তারা জমিকে কেন্দ্র করে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এমনভাবে নিজেদের বিবর্তিত করে ফেলল যার দাপটে, পশ্চিমবঙ্গের পিছিয়ে পড়া মুসলমান সমাজ, তপশিলি জাতি- উপজাতিভুক্ত সমাজ, তারা যে প্রথম বা দ্বিতীয় বামফ্রন্টের আমলে কিছুটা ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে শুরু করেছিল, সেটা ভীষণ রকম ভাবে বিঘিœত হলো।

এই অবস্থার মধ্যেও বাংলার মুসলমান সমাজ যাতে প্রথাগত শিক্ষার আঙিনায় নিজেদের মেলে ধরতে পারে সেজন্য মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকার বিশেষ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। মাদ্রাসার দুটি স্তরের পরীক্ষাকে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের উচ্চ মাধ্যমিকের সমকুল করা হলো মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকীকরণ এবং বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে। পশ্চিমবঙ্গের সাবেক রাজ্যপাল, তথা বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী এ আর কিদোয়াইয়ের নেতৃত্বে একটি কমিশন বামফ্রন্ট সরকার তৈরি করল। সেই কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক মাদ্রাসা শিক্ষায় আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত অথচ মুসলমান সমাজের ধর্মীয় চেতনার সঙ্গে সঙ্গতি সম্পন্ন একটি পাঠক্রম চালু করা হলো। মাদ্রাসায় যেমন বিজ্ঞান পড়ানো হচ্ছে, তেমনি নানা ধরনের রসায়নাগার স্থাপন করা হলো। ইংরেজি শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, সেই সঙ্গে ‘থিয়োজফি’, অর্থাৎ ধর্মীয় শিক্ষা প্রচলিত রইল।

এই যে ব্যবস্থাটা বামফ্রন্ট সরকার পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের সামাজিক উন্নতির লক্ষ্যে প্রচলন করল, সেটি কেবল ভারতে নয়, ভারতের বাইরে, আরব দেশেও বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছিল। মাদ্রাসা শিক্ষাতে বামফ্রন্ট সরকারের আমলের সেই মডেল ভারতের বাইরের বহু দেশ, তারা মডেল হিসেবে গ্রহণ করেছিল। এই সমস্ত ব্যবস্থাই লাগু ছিল কিন্তু সরকার অনুমোদিত মাদ্রাসাগুলোতে।

মুসলমান সমাজের নতুন প্রজন্মের জন্য সুনির্দিষ্ট ভাবনাচিন্তার প্রয়োগ শিক্ষা ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকার করতে পারলেও, সামগ্রিকভাবে মুসলমান সমাজের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের প্রশ্নে খুব একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারেনি তারা নানা ধরনের রাজনৈতিক প্রেক্ষিতের দরুণ।

বামফ্রন্ট সরকারের ক্ষমতায় থাকবার প্রথম দিকে সার্বিকভাবে রাজ্যের শিল্পায়নের পরিবেশ পরিস্থিতিগত ক্ষেত্রে ভারত সরকারের কিছু নিয়ম নীতির দরুণ অগ্রগতির পরিমাণে একটা শ্লথতা ছিল সেই সময়ের বিভিন্ন ধরনের লাইসেন্স রাজ, মাশুল সমীকরণ নীতি ইত্যাদির ফলে। এজন্যে নতুন শিল্পায়নের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ ইতিবাচক অবস্থা তৈরি হয়নি। তাই গরিব মানুষ, বিশেষ করে সংখ্যালঘু মুসলমান, তপশিলি জাতি-উপজাতি আদিবাসী, ওবিসিসহ সমস্ত ধরনের সামাজিক এবং আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষ, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা অসুবিধের মধ্যে পড়ে।

তাদের এই অসুবিধের মধ্যে পড়ার জন্য সেই সময়ের জাতীয় রাজনীতির নানা ধরনের প্রেক্ষিতের একটা বড় ভূমিকা ছিল। বামপন্থীদের সম্বন্ধে জাতীয় স্তরে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এমন অভিযোগ ওঠানো হয়েছিল যে, তার জেরে বড় বা মাঝারি শিল্প পশ্চিমবঙ্গে আসার ক্ষেত্রে যথেষ্ট চিন্তিত ছিল। বামপন্থীরা ধর্মঘটপ্রবণ। বামপন্থীরা শিল্পপতিদের ওপর আঘাত করে। এই ধরনের কায়েমি স্বার্থান্বেষীদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারের দরুণ শিল্পায়নের প্রশ্নটি সেই সময়ে, কৃষি ক্ষেত্রের অগ্রগতির সঙ্গে সমান সামঞ্জস্য রেখে এগিয়ে যেতে পারেনি। সমস্ত ধরনের পশ্চাদপদ মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি এবং অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের বিষয়টি বিশেষভাবে বাধা প্রাপ্ত হয়েছে।

এই ধরনের রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিবেশের কারণে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়েছে। এই বাঁধার মধ্যেই জাতীয় স্তরে ঐতিহাসিক বাবড়ি মসজিদ ধ্বংসের পরবর্তী যে রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি হয়, তার একটা প্রভাব, দেশের অন্যান্য রাজ্যের মতোই পশ্চিমবঙ্গের ওপরেও পড়তে শুরু করে। ফলে, মুসলমান সমাজের আর্থ-সামাজিক উন্নতির দিকটা বেশ ভালোভাবেই বাধাপ্রাপ্ত হয়। সেই সঙ্গে বাধাপ্রাপ্ত হয় বাংলার মুসলমান সমাজের অধিকারপূর্বক প্রতিনিধিত্বের দিকটিও।

বাঙালি মুসলমানের ওপর একটা বড় অংশের বাঙালি হিন্দুর সামাজিক সন্ত্রাস ধীরে ধীরে ভয়াবহ আকার নিতে শুরু করে। মুসলমান মাত্রই তাকে সন্ত্রাসী বলে দেগে দেয়া। মুসলমান মাত্রই বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলে তাকে দেগে দেয়াÑ এই জায়গাটিকে প্রায় সমস্ত অংশের রাজনীতিকদের একটা বড় গোষ্ঠী, নিজের নিজের মতো করে তোল্লা দিতে থাকে।

একদিকে যেমন পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মাদ্রাসা শিক্ষার সঙ্গে জঙ্গি প্রশিক্ষণের বিষয়টিকে যেভাবে উপস্থাপিত করেন, তার গুনাহগার কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে আজও বামপন্থীদের দিয়ে চলতে হচ্ছে। যে বাঙালি মুসলমান স্বাধীনতার পর বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই একমাত্র সামাজিক সম্মানের একটা জায়গায় নিজেদের উপস্থাপিত করতে শুরু করেছিল ধীরে ধীরে, বুদ্ধদেব বাবুর সেদিনের ওই ধরনের মন্তব্য, সেই বাঙালি মুসলমান সমাজকে, মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে ফেলে। অসম্মানিত করে অপমানিত করে। আর তার সুযোগটা পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

যে বাঙালি মুসলমানদের আস্থার ওপর বামফ্রন্ট সরকারের নির্বাচনী রাজনীতির সাফল্যের অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল, তা আজও বামপন্থীদের কাছ থেকে দূরেই থেকে গেছে এই কার্যকারণের ফলে।

হাসিবুর, সুমন, ফরজেমÑ যাদের কথা দিয়ে এই নিবন্ধ শুরু হয়েছে, তাদের আজ এভাবে জীবন বাজি রেখে পেটের ভাতের জন্য ঘুরে মরতে হতো না, যদি পশ্চিমবঙ্গে যে শিল্পায়নের উদ্যোগ হুগলির সিঙ্গুরে বামফ্রন্ট সরকার নিয়েছিল, তা ফলপ্রসূত হতো। অত্যন্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাংলার গরিব খেটে খাওয়া মুসলমান সমাজ, তপশিলি জাতি-উপজাতি, আদিবাসী, ওবিসি সমস্ত অংশের মানুষকে অর্থনীতির মূল স্রোত থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যই, বামফ্রন্ট সরকারের আমলে, শিল্পায়ন ঘিরে বাধার পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তার সঙ্গী সাথীরা।

হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তি সীমান্তে উত্তেজনা বজায় রাখার স্বার্থে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বোড়ের চাল করে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন যাতে না ঘটে, সেই উদ্দেশ্য নিয়ে, সিঙ্গুরে টাটা কোম্পানির গাড়ির কারখানাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে, নরেন্দ্র মোদির গুজরাটে সানন্দে পাঠিয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেদিনের শিল্পবিরোধী আন্দোলন যে কেবল বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করবার জন্যই ছিল তা নয়। সে আন্দোলন ছিল সর্বতোভাবে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজ যাতে অর্থনৈতিকভাবে নিজের পায়ে না দাঁড়াতে পারে, সেই কাজটিকে পাকাপোক্ত করার তাগিদ।

আজ পশ্চিমবঙ্গে অর্থনৈতিক সংকটের দরুণ এখানকার বাঙালি মুসলমান সমাজের একটা বড় অংশ পরিযায়ী শ্রমিকে পরিণত হয়েছে। এমন ধরনের কায়িক শ্রমনির্ভর কাজের সঙ্গে এই রাজ্যেই তারা যুক্ত হতে বাধ্য হয়েছে যেখানে প্রাণ হাতে নিয়ে কাজ করতে হয়। কোনো ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা পাওয়ার সুযোগ পশ্চিমবঙ্গের গরিব মুসলমানের নেই। এই রাজ্য ক্রমশ উত্তরপ্রদেশে পরিণত হচ্ছে। আজ (৪ ফেব্রুয়ারি) নদিয়া জেলার রানাঘাট অঞ্চলের একটি ট্রেনে, রেজাউল ইসলাম নামক এক ব্যক্তিকে তার দাঁড়ি-টুপি এই বাহ্যিক পোশাকের জন্য হেনস্তা হতে হয়েছে। ঠিক এভাবেই উত্তরপ্রদেশে এককালে পহেলু খান থেকে শুরু করে একের পর এক মব লিঞ্চিংয়ের ঘটনা ঘটেছিল ।

রেজাউল ইসলামের ওপরে যে ধরনের অভাবনীয় আক্রমণ পশ্চিমবঙ্গে একটি চলন্ত রেলগাড়িতে ঘটেছে তা থেকেই বুঝতে পারা যাচ্ছে, আরএসএস-বিজেপির ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িকতা, কী সুন্দর তালে তাল মিলিয়ে, হাতে হাত ধরে এই রাজ্যটিকে রাজনৈতিক হিন্দুদের নতুন গবেষণাগারে পরিণত করতে উদ্যোগী হয়েছে।

[লেখক: ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

মাঘী পূর্ণিমা : সম্প্রীতির মধুময় স্মৃতি

ট্রাম্পের গাজা পরিকল্পনার বিপজ্জনক বাস্তবতা

পুলিশে কেমন সংস্কার চাই?

সত্যিই কি ইউএসএআইডি বন্ধ হয়ে যাবে

রম্যগদ্য: “গো টু দ্য ডেভিল”

এত ক্রোধ, প্রতিহিংসা আর অস্থিরতাÑ সবই কি স্বৈরাচারের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া!

কীভাবে আইন মেনে চলার সংস্কৃতি গড়ে তোলা যায়?

কেন এই ধ্বংস?

প্রসঙ্গ: সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ

দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ : উত্তরণের উপায়

কুষ্ঠ : স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারে ইস্যুটি কেন গুরুত্বপূর্ণ

ঔপনিবেশিকতা নাকি মানবতার অবমূল্যায়ন?

রম্যগদ্য : ‘নারী মানেই ব্যভিচারী...’

প্রসঙ্গ: সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫

ছবি

নীরদ সি চৌধুরী : পেন্ডুলামের মতো দোলায়মান এক বাঙালি চরিত্র

ভোজবাজি ও ভানুমতির খেলা

সড়কে কিশোর মোটরবাইকার : নিয়ন্ত্রণ জরুরি

মব জাস্টিস আইনের শাসনের পরিপন্থি

ছবি

গভীর সংকট আর বড় সম্ভাবনা পাশাপাশি হাঁটছে

জ্ঞানদায়িনী মা সরস্বতী দেবী

‘সংখ্যাস্বল্প’ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী

বিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা কেন প্রয়োজন?

সব ক্ষেত্রে বাংলাকে প্রাধান্য দিন

গুজব : মানবসৃষ্ট দুর্যোগ

অন্তর্বর্তী সরকার: নাগরিকদের প্রত্যাশা কি পূরণ হবে?

পাঠ্যবই সংকটে থমকে গেছে শিক্ষার চাকা

আরজি কর : শাসক রোষে ভিকটিমের পরিবার

চাই কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়ন

একটি দেয়ালচিত্র ও কিছু কথা

শুল্ক বনাম উদ্ভাবন যুদ্ধ

রম্যগদ্য : “ডক্টর.জ্বী-ভাগো...”

বায়ুদূষণ মনিটরিংয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার

ছবি

যোগেন ম-লের ‘বহুজনবাদী’ রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা

একটি দেয়ালচিত্র ও কিছু কথা

আলো, অন্ধকার ও চরিত্রবান জীবন

শিক্ষকরা কেন বারবার মার খাবে?

tab

উপ-সম্পাদকীয়

পশ্চিমবঙ্গ : রাজনৈতিক হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

গৌতম রায়

শনিবার, ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

মুসলমানদের নিয়ে রাজনীতির পাশা খেলা চলে। কেউ বা বলেন তাদের ‘দুধেল গাই’। অন্যে আক্রমণ শানায় আরও বুদ্ধি খরচ করে। কিন্তু মুসলমান কেমন আছেন এই বাংলায়, মুর্শিদাবাদের লালগোলার ফরজেম শেখ, হাসিবুর রহমান আর উত্তর চব্বিশ পরগনার ন্যাজাটের সুমন সর্দার নিজের জীবন দিয়ে তা দেখিয়ে গেলেন।

বিতর্ক চলবে, কে বা কারা সুপ্রিম কোর্টের রায় অগ্রাহ্য করে সাফাইয়ের কাজে শ্রমিক ব্যবহার করেÑ তা ঘিরে। শাসক আর বিরোধীদের তর্জা চলবেই।

কিন্তু কী ভয়াবহ আর্থিক সংকটে আজ বাংলার মুসলমান সমাজের রয়েছেÑ যার জেরে অমন প্রাণ হাতে করে ফরজেম, হাসিবুর সুমনদের কাজ করতে হচ্ছেÑ তা নিয়ে কোনও আলোচনা হবে।

এক শাসক বলবে, আমরা মুসলমানদের কত কিছু করে দিয়েছি। জিজ্ঞাসা করুন ধর্মাচারণে উৎসাহ দেয়ার বাইরে, তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিশেষ করে মেয়েদের, প্রসূতির স্বাস্থ্যÑ অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন-উত্তর পেলেও বাস্তবে তা মিলবে না।

আর এক শাসক, অন্য শাসকের মুসলমান তোষণের বাইরে কিছু দেখতেই পাবে না। মুসলমান বিদ্বেষের নক্ষত্রেই যে তাদের জন্ম।

বিচারপতি সাচারÑ তাকে ঘিরে, তার প্রতিবেদন ঘিরে শোরগোলÑ এত মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কল্যাণের জন্য? না, ভোটের জন্য? প্রশ্ন তুললেই বলা হবে, বাংলাদেশে চলে যান।

প্রদীপ জ্বলতে পিলসুজের উপরেই। আলো পাবেন বর্ণ হিন্দুরা। ফরজেম, হাসিবুরদের গায়ের উপর দিয়ে প্রদীপের তেল গড়িয়ে পড়বে না। ‘সভ্যতার পিলসুজ’ কে ঘিরে, আজ বেঁচে থাকলে রবীন্দ্রনাথ, তেল গড়িয়ে পড়ার বদলে হয়তো লিখতেন, প্রদীপের আগুনেই ওরা পুড়ে মরবেÑ পশ্চিমবঙ্গে সহনাগরিক মুসলমান সমাজের আর্থ- সামাজিক প্রেক্ষিত যদি আমরা ছয়ের দশক থেকে আজকের দিন পর্যন্ত পরিচালনা করি, তাহলে দেখতে পাব, ১৯৭২ সালে একটি বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের নেতৃত্বে এই রাজ্য সরকার গঠন করে। সিদ্ধার্থ শংকরের একটি পারিবারিক রাজনৈতিক উত্তরাধিকার ছিল। তিনি সম্পর্কে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের দৌহিত্র হতেন। সেই বিষয়টিকেই তিনি তার রাজনৈতিক মাইলেজ নেয়ার ক্ষেত্রে মারাত্মক রকম ভাবে ব্যবহার করেছিলেন মুসলমানদের ভোটব্যাংক হিসেবে সাব্যস্ত করে তাদের প্রতি কিছু নিছক সহানুভূতিশীল কথা বলবার মধ্য দিয়ে।

সিদ্ধার্থ শংকর নিজে যেহেতু অত্যন্ত দক্ষ আইনজীবী ছিলেন তাই কিছু কিছু ক্ষেত্রে মুসলমানদের আইনি হেনস্তার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তিনি ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নিতেন। এই উদ্যোগটা পরবর্তীকালে তিনি যখন আর মুখ্যমন্ত্রী নন পশ্চিমবঙ্গের, তখনো নিতেন। ফলে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের তার প্রতি একটা সহানুভূতির মানসিকতা ছিল। কিন্তু মুসলমান সমাজের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য যে ধরনের প্রশাসনিক উদ্যোগ নেয়া দরকার ছিল, তা সিদ্ধার্থ শংকরের আমলে আদৌ হয়নি।

এরপরই দীর্ঘদিন বামফ্রন্ট সরকার পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাশীল ছিল। বামফ্রন্ট সরকার একদম প্রাথমিক পর্যায়েই ভূমি সংস্কার, অপারেশন বার্গার মধ্য দিয়ে এমন একটি ইতিবাচক সামাজিক পরিস্থিতি তৈরি করতে পেরেছিলেন যেখানে গ্রামীণ বাংলার সর্বস্তরের পিছিয়ে পড়া মানুষ, আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকবার একটা উৎসাহ পেয়েছিলেন। এই জায়গাতে বাঙালি মুসলমান, তপশিলি জাতি-উপজাতি বা বিভিন্ন পিছিয়ে পড়া মানুষ, গ্রাম বাংলায় বর্ণ হিন্দুদের যে ভয়ংকর অত্যাচার, সামন্ততান্ত্রিক পরিকাঠামো, সেখান থেকে কিছুটা হলেও নিস্তার পেয়েছিলেন।

তবে ভূমি সংস্কারের যে ইতিবাচক দিক তার ধারাবাহিকতা সেভাবে বজায় থাকেনি। তার কারণ একটা সময় দেখতে পাওয়া গেল যে, বর্ণ হিন্দুরা, যে আধা সামন্ততান্ত্রিক প্রভুরা, মুসলমানসহ সমস্ত ধরনের প্রান্তিক মানুষের ওপর শোষণ চালিয়ে নিজেদের শ্রেণী স্বার্থকে বজায় রাখত, তারা পোশাক বদল করে ধীরে ধীরে শাসকদলের আঙিনার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। ফলে বর্ণ হিন্দুদের যে দাপট সেটা অতীতের মতো প্রকট না থাকলেও প্রথম বামফ্রন্ট সরকার বা দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকারের পর থেকে যেভাবে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েতে শুরু করেছিল। সেই ক্ষয়িষ্ণুতার মাত্রাটা আর বজায় রইল না। বরঞ্চ বলতে পারা যায়, বর্ণ হিন্দু এবং সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা সম্পন্ন একটা অংশের হিন্দু, তারা জমিকে কেন্দ্র করে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এমনভাবে নিজেদের বিবর্তিত করে ফেলল যার দাপটে, পশ্চিমবঙ্গের পিছিয়ে পড়া মুসলমান সমাজ, তপশিলি জাতি- উপজাতিভুক্ত সমাজ, তারা যে প্রথম বা দ্বিতীয় বামফ্রন্টের আমলে কিছুটা ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে শুরু করেছিল, সেটা ভীষণ রকম ভাবে বিঘিœত হলো।

এই অবস্থার মধ্যেও বাংলার মুসলমান সমাজ যাতে প্রথাগত শিক্ষার আঙিনায় নিজেদের মেলে ধরতে পারে সেজন্য মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকার বিশেষ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। মাদ্রাসার দুটি স্তরের পরীক্ষাকে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের উচ্চ মাধ্যমিকের সমকুল করা হলো মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকীকরণ এবং বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে। পশ্চিমবঙ্গের সাবেক রাজ্যপাল, তথা বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী এ আর কিদোয়াইয়ের নেতৃত্বে একটি কমিশন বামফ্রন্ট সরকার তৈরি করল। সেই কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক মাদ্রাসা শিক্ষায় আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত অথচ মুসলমান সমাজের ধর্মীয় চেতনার সঙ্গে সঙ্গতি সম্পন্ন একটি পাঠক্রম চালু করা হলো। মাদ্রাসায় যেমন বিজ্ঞান পড়ানো হচ্ছে, তেমনি নানা ধরনের রসায়নাগার স্থাপন করা হলো। ইংরেজি শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, সেই সঙ্গে ‘থিয়োজফি’, অর্থাৎ ধর্মীয় শিক্ষা প্রচলিত রইল।

এই যে ব্যবস্থাটা বামফ্রন্ট সরকার পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের সামাজিক উন্নতির লক্ষ্যে প্রচলন করল, সেটি কেবল ভারতে নয়, ভারতের বাইরে, আরব দেশেও বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছিল। মাদ্রাসা শিক্ষাতে বামফ্রন্ট সরকারের আমলের সেই মডেল ভারতের বাইরের বহু দেশ, তারা মডেল হিসেবে গ্রহণ করেছিল। এই সমস্ত ব্যবস্থাই লাগু ছিল কিন্তু সরকার অনুমোদিত মাদ্রাসাগুলোতে।

মুসলমান সমাজের নতুন প্রজন্মের জন্য সুনির্দিষ্ট ভাবনাচিন্তার প্রয়োগ শিক্ষা ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকার করতে পারলেও, সামগ্রিকভাবে মুসলমান সমাজের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের প্রশ্নে খুব একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারেনি তারা নানা ধরনের রাজনৈতিক প্রেক্ষিতের দরুণ।

বামফ্রন্ট সরকারের ক্ষমতায় থাকবার প্রথম দিকে সার্বিকভাবে রাজ্যের শিল্পায়নের পরিবেশ পরিস্থিতিগত ক্ষেত্রে ভারত সরকারের কিছু নিয়ম নীতির দরুণ অগ্রগতির পরিমাণে একটা শ্লথতা ছিল সেই সময়ের বিভিন্ন ধরনের লাইসেন্স রাজ, মাশুল সমীকরণ নীতি ইত্যাদির ফলে। এজন্যে নতুন শিল্পায়নের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ ইতিবাচক অবস্থা তৈরি হয়নি। তাই গরিব মানুষ, বিশেষ করে সংখ্যালঘু মুসলমান, তপশিলি জাতি-উপজাতি আদিবাসী, ওবিসিসহ সমস্ত ধরনের সামাজিক এবং আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষ, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা অসুবিধের মধ্যে পড়ে।

তাদের এই অসুবিধের মধ্যে পড়ার জন্য সেই সময়ের জাতীয় রাজনীতির নানা ধরনের প্রেক্ষিতের একটা বড় ভূমিকা ছিল। বামপন্থীদের সম্বন্ধে জাতীয় স্তরে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এমন অভিযোগ ওঠানো হয়েছিল যে, তার জেরে বড় বা মাঝারি শিল্প পশ্চিমবঙ্গে আসার ক্ষেত্রে যথেষ্ট চিন্তিত ছিল। বামপন্থীরা ধর্মঘটপ্রবণ। বামপন্থীরা শিল্পপতিদের ওপর আঘাত করে। এই ধরনের কায়েমি স্বার্থান্বেষীদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারের দরুণ শিল্পায়নের প্রশ্নটি সেই সময়ে, কৃষি ক্ষেত্রের অগ্রগতির সঙ্গে সমান সামঞ্জস্য রেখে এগিয়ে যেতে পারেনি। সমস্ত ধরনের পশ্চাদপদ মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি এবং অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের বিষয়টি বিশেষভাবে বাধা প্রাপ্ত হয়েছে।

এই ধরনের রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিবেশের কারণে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়েছে। এই বাঁধার মধ্যেই জাতীয় স্তরে ঐতিহাসিক বাবড়ি মসজিদ ধ্বংসের পরবর্তী যে রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি হয়, তার একটা প্রভাব, দেশের অন্যান্য রাজ্যের মতোই পশ্চিমবঙ্গের ওপরেও পড়তে শুরু করে। ফলে, মুসলমান সমাজের আর্থ-সামাজিক উন্নতির দিকটা বেশ ভালোভাবেই বাধাপ্রাপ্ত হয়। সেই সঙ্গে বাধাপ্রাপ্ত হয় বাংলার মুসলমান সমাজের অধিকারপূর্বক প্রতিনিধিত্বের দিকটিও।

বাঙালি মুসলমানের ওপর একটা বড় অংশের বাঙালি হিন্দুর সামাজিক সন্ত্রাস ধীরে ধীরে ভয়াবহ আকার নিতে শুরু করে। মুসলমান মাত্রই তাকে সন্ত্রাসী বলে দেগে দেয়া। মুসলমান মাত্রই বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলে তাকে দেগে দেয়াÑ এই জায়গাটিকে প্রায় সমস্ত অংশের রাজনীতিকদের একটা বড় গোষ্ঠী, নিজের নিজের মতো করে তোল্লা দিতে থাকে।

একদিকে যেমন পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মাদ্রাসা শিক্ষার সঙ্গে জঙ্গি প্রশিক্ষণের বিষয়টিকে যেভাবে উপস্থাপিত করেন, তার গুনাহগার কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে আজও বামপন্থীদের দিয়ে চলতে হচ্ছে। যে বাঙালি মুসলমান স্বাধীনতার পর বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই একমাত্র সামাজিক সম্মানের একটা জায়গায় নিজেদের উপস্থাপিত করতে শুরু করেছিল ধীরে ধীরে, বুদ্ধদেব বাবুর সেদিনের ওই ধরনের মন্তব্য, সেই বাঙালি মুসলমান সমাজকে, মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে ফেলে। অসম্মানিত করে অপমানিত করে। আর তার সুযোগটা পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

যে বাঙালি মুসলমানদের আস্থার ওপর বামফ্রন্ট সরকারের নির্বাচনী রাজনীতির সাফল্যের অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল, তা আজও বামপন্থীদের কাছ থেকে দূরেই থেকে গেছে এই কার্যকারণের ফলে।

হাসিবুর, সুমন, ফরজেমÑ যাদের কথা দিয়ে এই নিবন্ধ শুরু হয়েছে, তাদের আজ এভাবে জীবন বাজি রেখে পেটের ভাতের জন্য ঘুরে মরতে হতো না, যদি পশ্চিমবঙ্গে যে শিল্পায়নের উদ্যোগ হুগলির সিঙ্গুরে বামফ্রন্ট সরকার নিয়েছিল, তা ফলপ্রসূত হতো। অত্যন্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাংলার গরিব খেটে খাওয়া মুসলমান সমাজ, তপশিলি জাতি-উপজাতি, আদিবাসী, ওবিসি সমস্ত অংশের মানুষকে অর্থনীতির মূল স্রোত থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যই, বামফ্রন্ট সরকারের আমলে, শিল্পায়ন ঘিরে বাধার পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তার সঙ্গী সাথীরা।

হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তি সীমান্তে উত্তেজনা বজায় রাখার স্বার্থে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বোড়ের চাল করে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন যাতে না ঘটে, সেই উদ্দেশ্য নিয়ে, সিঙ্গুরে টাটা কোম্পানির গাড়ির কারখানাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে, নরেন্দ্র মোদির গুজরাটে সানন্দে পাঠিয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেদিনের শিল্পবিরোধী আন্দোলন যে কেবল বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করবার জন্যই ছিল তা নয়। সে আন্দোলন ছিল সর্বতোভাবে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজ যাতে অর্থনৈতিকভাবে নিজের পায়ে না দাঁড়াতে পারে, সেই কাজটিকে পাকাপোক্ত করার তাগিদ।

আজ পশ্চিমবঙ্গে অর্থনৈতিক সংকটের দরুণ এখানকার বাঙালি মুসলমান সমাজের একটা বড় অংশ পরিযায়ী শ্রমিকে পরিণত হয়েছে। এমন ধরনের কায়িক শ্রমনির্ভর কাজের সঙ্গে এই রাজ্যেই তারা যুক্ত হতে বাধ্য হয়েছে যেখানে প্রাণ হাতে নিয়ে কাজ করতে হয়। কোনো ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা পাওয়ার সুযোগ পশ্চিমবঙ্গের গরিব মুসলমানের নেই। এই রাজ্য ক্রমশ উত্তরপ্রদেশে পরিণত হচ্ছে। আজ (৪ ফেব্রুয়ারি) নদিয়া জেলার রানাঘাট অঞ্চলের একটি ট্রেনে, রেজাউল ইসলাম নামক এক ব্যক্তিকে তার দাঁড়ি-টুপি এই বাহ্যিক পোশাকের জন্য হেনস্তা হতে হয়েছে। ঠিক এভাবেই উত্তরপ্রদেশে এককালে পহেলু খান থেকে শুরু করে একের পর এক মব লিঞ্চিংয়ের ঘটনা ঘটেছিল ।

রেজাউল ইসলামের ওপরে যে ধরনের অভাবনীয় আক্রমণ পশ্চিমবঙ্গে একটি চলন্ত রেলগাড়িতে ঘটেছে তা থেকেই বুঝতে পারা যাচ্ছে, আরএসএস-বিজেপির ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িকতা, কী সুন্দর তালে তাল মিলিয়ে, হাতে হাত ধরে এই রাজ্যটিকে রাজনৈতিক হিন্দুদের নতুন গবেষণাগারে পরিণত করতে উদ্যোগী হয়েছে।

[লেখক: ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

back to top