alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

প্রসঙ্গ: সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: রোববার, ০৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য যে কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এই কমিশন সংবিধানের সাতটি ক্ষেত্রে সংশোধন, পরিবর্তন, বাতিল বা সংযোজনের সুপারিশ করেছে।সংবিধানের ‘প্রস্তাবনায়’ মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিদ্যমান সংবিধানের প্রস্তাবনায় মূলনীতি হিসেবে উল্লেখ করা আছে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাÑ এই চার মূলনীতির স্থলে সংস্কার কমিটি তাদের প্রস্তাবিত প্রস্তাবনায় উল্লেখ করেছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র। তবে প্রকৃত গণতন্ত্র অনুসৃত হলে ‘সাম্য’ ব্যতীত অন্য মূলনীতিগুলোর পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য কোন তাৎপর্য নেই। যে শাসনব্যবস্থায় মানবিক মর্যাদা, সুবিচার, বহুত্বের স্বীকৃতি থাকে না সেই শাসনব্যবস্থা কোনভাবেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণ্য হতে পারে না।

সুপারিশকৃত প্রস্তাবনায় ‘মুক্তি-সংগ্রাম’-এর স্থলে ‘জনযুদ্ধ’ বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রী’ ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দের পরিবর্তে লেখা হয়েছে ‘নাগরিকতন্ত্র’ ও ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’। কিন্তু গণ, জনÑ এই দুটি শব্দের অর্থই ‘জনসাধারণ’, ‘প্রজা’ অর্থও জনসাধারণ। প্রজার আরেকটি অর্থ হচ্ছে ‘রায়ত’, তাই বোধহয় ’প্রজা’ লিখতে মানসম্মানে বাঁধছে। যারা কর দিয়ে জমি ভোগ করে তারাই রায়ত। আগে কর আদায় করত জমিদার, এখন করে সরকার। পার্থক্যটা খুব বেশি নয়। সংস্কার কমিটির সুপারিশকৃত ‘প্রস্তাবনায়’ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পাশাপাশি চব্বিশের বৈষম্যহীন আদর্শের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনার কথাও উল্লেখ রয়েছে।

বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে ‘বাঙালি’ এবং নাগরিকগণ ‘বাংলাদেশি’। কমিশনের সুপারিশে জাতিসত্তা বাঙালির কথা বাদ দেয়া হয়েছে, বাংলাদেশের নাগরিকরা শুধু ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে পরিচিত হবেন। সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ও গুম থেকে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার, জামিনে মুক্তি পাওয়ার অধিকার এবং নিবর্তনমূলক আটক-সংক্রান্ত বিধান বিলুপ্তির কথা বলা হয়েছে। সাধারণত এমন ভালো ভালো কথা পৃথিবীর সব সংবিধানেই লেখা থাকে, বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানেও কোন নিবর্তনমূলক আটকের কথা নেই। কিন্তু অতীতের সবগুলো সরকার তাদের নিবর্তনমূলক আচরণকে আইনসম্মত বলে অভিহিত করেছে, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমকে আইনি আচ্ছাদন দিতে সক্ষম হয়েছে। ‘জামিন’ মুক্তি পাওয়ার অধিকারের কথা শুধু সংস্কার কমিশন নয়, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ীও জামিন পাওয়া প্রত্যেক আসামির মৌলিক অধিকার। কিন্তু জামিন অযোগ্য আইন অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও প্রয়োগ হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে নিরপরাধ লোকদেরও হত্যা মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে যাতে জামিন পাওয়া সহজ না হয়।

সংস্কার কমিশন দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার প্রস্তাব করেছে। জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত ৪০০ জন সদস্য নিয়ে নিম্নকক্ষ এবং ১০৫ সদস্য নিয়ে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। ৪০০ জনের মধ্যে ১০০ জন হবেন নারী সদস্য, যারা শুধু নারী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। উচ্চকক্ষের ১০৫ জনের মধ্যে ৫ জন মনোনীত হবেন প্রেসিডেন্ট কর্তৃক, যারা কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য নন। এরা সম্ভবত ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হবেন। বাকি ১০০ জনের মধ্যে ৫ জন মনোনীত হবেন অনগ্রসর সম্প্রদায় থেকে। বাকি ৯৫ জনকে মনোনীত করতে পারবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী যে সকল রাজনৈতিক দল মোট প্রদত্ত ভোটের ১ শতাংশ ভোট পাবে। কোন দল কতজনকে মনোনীত করতে পারবে তা নির্ধারিত হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে। এটা আসলে কোটা।

ছাত্র ও যুবশক্তিকে দেশ শাসনে সম্পৃক্ত করার অভিপ্রায়ে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীর সর্বনিম্ন বয়স ২৫ বছর থেকে হ্রাস করে ২১ বছর করার সুপারিশ করা হয়েছে এবং কমপক্ষে ১০ শতাংশ প্রার্থী তরুণদের মধ্য থেকে মনোনয়ন দেয়ার কথাও বলা হয়েছে। মন্দ নয়, রাজনীতিতে ছাত্র ও যুবকদের আকর্ষণ বাড়বে।রাজনৈতিক দলগুলো এসব শর্ত মানবে বলে মনে হয় না। কারণ দেশের রাজনীতিতে ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব অন্তর্ভুক্তি করার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের বাধ্যবাধকতা বহু আগে থেকে থাকলেও কোন রাজনৈতিক দল অদ্যাবধি তা মানেনি।

পৃথিবীর অধিকাংশ সংসদ এক কক্ষ বিশিষ্ট। সাধারণত ফেডারেল সিস্টেমে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা থাকে। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার ভালো-মন্দ দুটি দিকই আছে। বাংলাদেশে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা কেন উপযোগী তার কোন ব্যাখ্যা সংস্কার কমিশনের সুপারিশে দেখা গেল না। তবে এর মাধ্যমে অধিকসংখ্যক রাজনৈতিক নেতা আইনসভার সদস্য হওয়ার সুযোগ পাবেন, মনোনয়ন প্রদানে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও কিছুটা কমবে।

কিন্তু খরচ বাড়বে, কারণ নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সংসদে কখনো সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে মতভেদ হয়নি। অন্যদিকে একই বিল আইন সভার দুই কক্ষে পাসের শর্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিলম্বিত হবে। এছাড়া মন্ত্রিসভাকে দুই কক্ষের জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে, যা যুক্তিসঙ্গত নয়। জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত নিম্নকক্ষে কোন রাজনৈতিক দলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে উচ্চকক্ষেও সেই দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে। তাই নিম্নকক্ষের সিদ্ধান্ত উচ্চকক্ষে চ্যালেঞ্জ হবে না। দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে ভিন্নমত পোষণ করার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার প্রস্তাব করা হলেও তা কার্যকর করা সহজ হবে না; কারণ আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো স্বৈরতন্ত্র বিশ্বাস করে, শীর্ষ নেতার অনুগত না হলে কোন নেতাকর্মী মনোনয়ন পাবে না, দলের মধ্যে পচে যেতে হবে।

নিম্নকক্ষে দুজন ডেপুটি স্পিকার থাকবেন; একজন স্পিকার বিরোধী দল থেকে মনোনীত হবেন। উচ্চকক্ষের ডেপুটি স্পিকারও বিরোধী সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত হবেন। আমাদের দেশে রাজনীতির যে সংস্কৃতি তা অব্যাহত থাকলে বিরোধী দলের ডেপুটি স্পিকার কখনো সংসদ পরিচালনার সুযোগ পাবেন না। যিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন তিনি সংসদ নেতা বা দলীয় প্রধান থাকতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট সর্বোচ্চ দুইবারের বেশি অধিষ্ঠিত থাকবেন না। আইনসভার স্থায়ী কমিটিগুলোর সভাপতি হবেন বিরোধী দল থেকে। এই বিষয়গুলো দীর্ঘদিন ধরে মিডিয়ায় আলোচনা-পর্যালাচনা হচ্ছে, কিন্তু ক্ষমতাসীন কোন দল এই পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেনি। কমিশন রাষ্ট্রীয় কার্যাবলিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনায়ন ও রাষ্ট্রীয় অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ৯ সদস্য বিশিষ্ট একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি গঠনের সুপারিশ করেছে। এই কাউন্সিলে থাকবেন প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা, দুই কক্ষের দুজন স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, নিম্মকক্ষের বিরোধী দলের মনোনীত স্পিকার, ক্ষমতাসীন দল ও প্রধান বিরোধী দলের সাংসদ ব্যতীত অন্য সব সদস্যের মনোনীত একজন সাংসদ।

এ জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল নির্বাচন কমিশনার, অ্যাটর্নি জেনারেল, সরকারি কর্ম কমিশন ও দুদকের সব কমিশনার, প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর প্রধান এবং আইন দ্বারা নির্ধারিত অন্য যে কোন পদে নিয়োগ দেবে। সাংবিধানিক কাউন্সিল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকেও নিয়োগ দেবে। প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগে আগে যে প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি অনুসৃত হতো তার সঙ্গে কমিশনের সুপারিশের খুব বেশি পার্থক্য পরলক্ষিত হয়নি।তত্ত্বাবধায়ক সরকারে জনপ্রতিনিধিত্ব থাকে না বিধায় সুপ্রিম কোর্ট তাকে ২০১১ সনে অবৈধ বলেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিতের রাখার প্রভিশন থাকায় চাকুরিরত অবস্থায় বিচারপতিদের মধ্যে নিরপেক্ষতার বিচ্যুতি হওয়ার সম্ভাবনার কথাও রায়ে বলা হয়েছিল। সংস্কার কমিশন এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়নি।অবশ্য সুপ্রিম কোর্টের সেই রায় ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আদালতে বাতিল হয়ে গেছে।

জাতীয় পার্টি ক্ষমতা থাকাকালীন ১৯৮৮ সনে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয় এবং রাজধানীতে সুপ্রিম কোর্টের স্থায়ী আসন রেখে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, যশোর, রংপুর এবং সিলেটে হাইকোর্ট বিভাগের একটি করে স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন করা হয়। পরবর্তীকালে এই সংশোধনীর রাষ্ট্রধর্ম অক্ষুণœ রেখে ৬ বিভাগে হাইকোর্টের বেঞ্চ স্থাপনের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদটি এখতিয়ার বহির্ভূত ও অকার্যকর বলে আদালত ঘোষণা করে।

সংস্কার কমিশন পুনরায় উচ্চ আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ করে দেশের সব বিভাগে হাইকোর্ট বিভাগের সমান এখতিয়ার সম্পন্ন হাইকোর্টের স্থায়ী আসন প্রবর্তনের সুপারিশ করেছে। হোসেন মোহাম্মদ এরশাদের অষ্টম সংশোধনী পাস হওয়ার পর সব বিরোধী দলসহ আইনজীবীরা তার ঘোর বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু এবার কেউ এখনো সংস্কার কমিশনের উচ্চ আদালতের বিকেন্দ্রীকরণের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কথা বলেনি। সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কমিশন গঠন করার সুপারিশ করা হয়েছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ হচ্ছে, আপিল বিভাগের বিচারকদের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ জ্যেষ্ঠ বিচারককে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ প্রদানকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের একটি বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা। কমিশন বিচার বিভাগকে পূর্ণ আর্থিক স্বাধীনতা প্রদানেরও সুপারিশ করেছে।

বিচার বিভাগসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাগজে-কলমে স্বাধীনতা দেয়া সত্ত্বেও সরকারের কথায় চলে কেন তা সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে খতিয়ে দেখা হয়নি। রাজনৈতিক বিভাজন দেশের সর্বত্র। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কারা দেশ চালাচ্ছেন? মিডিয়ার বিভিন্ন তথ্য থেকে স্পষ্ট প্রতিপন্ন হয়, রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান জামায়াতে ইসলাম বা বিএনপির সমর্থক আমলা দিয়ে সাজানো হচ্ছে। তাহলে স্বাধীনতা দিয়ে লাভ কী! অবশ্য দলীয় লোক উপযুক্ত ও কার্য সম্পাদনে নিরপেক্ষ হলে কোন সমস্যা থাকে না। কার্য সম্পাদনে নিরপেক্ষ হলে দলের একনিষ্ঠ কর্মী দিয়েও প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা রক্ষা করা সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের কোন দলীয় সরকার নিয়োগ দেয় না।

সংস্কার কমিশন সংবিধান পুনর্লিখন করেনি, করেছে সংশোধন। কিন্তু কীভাবে এই সব সংশোধনী সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে তার কোন উল্লেখ সুপারিশে দেখা গেল না। বর্তমান আইন অনুযায়ী সংবিধানের কোন সংশোধনী আনতে গেলে সংসদের দুই তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের সমর্থন অপরিহার্য। কিন্তু সংস্কার কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক সংবিধান সংশোধনে উভয় কক্ষের দুই তৃতীয়াংশের সমর্থন যথেষ্ট নয়, গণভোটের মাধ্যমে তা পাস হতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় দুই-তৃতীয়াংশ সংস সদস্যের ভোটে ক্ষমতাসীন দল যখন-তখন সংবিধান পরিবর্তন করতে সক্ষম হবে না, জনগণের কাছে যেতে হবে।

বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষর গ্রহণপূর্বক দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে নাগরিকদের সংবিধান সম্মত কিছু অধিকার স্থগিত করতে পারেন। কিন্তু সংস্কার কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত ব্যতিরেকে প্রেসিডেন্ট দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন না এবং জরুরি অবস্থায় নাগরিকদের অধিকার রদ বা স্থগিত করাও যাবে না। কিন্তু নাগরিকদের সব অধিকার অক্ষুণœ রাখা হলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা অর্থহীন হবে। কমিশনের সুপারিশগুলো অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন পর্যায়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে সংযোজন-বিয়োজন করবে এবং তা সংসদে উপস্থাপিত হলে সেখানেও আলোচনা-পর্যালাচনা হবে। তাই এখনো কমিশনের সুপারিশ নিয়ে সিদ্ধান্তসূচক মন্তব্য করা নিরর্থক বলে মনে হয়।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]

স্বর্ণের মোহ ও মানবিক দ্বন্দ্ব

ভালোবাসার দেহধারণ: বড়দিনের তাৎপর্য

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট

বিনা-ভাড়ার ট্রেনযাত্রা

ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে এশিয়া

ছবি

নামে ইসলামী, কাজে আবু জাহেল!

জলবায়ু পরিবর্তন: স্বাস্থ্যঝুঁকি

ছবি

অস্থির পেঁয়াজের বাজার: আমদানি কি সত্যিই সমাধান?

মূল্যবৃদ্ধির ঘেরাটোপ: সংকটাক্রান্ত পরিবার ও সামাজিক রূপান্তর

বায়দূষণে অকালমৃত্যু

লাশের বদলে লাশই যদি চুড়ান্ত হয়, তবে রাষ্ট্রের দরকার কী?

ভিক্ষাবৃত্তি যেখানে অন্যতম পেশা

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

আদিবাসীদের ভূমি অধিকার ও নিরাপত্তা সংকট

“মুনীর চৌধুরীর কবর...”

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

জলবায়ু সংকট ও খাদ্য নিরাপত্তা

স্বাধীন তদন্ত কমিশন দাবির নেপথ্যে কি দায়মুক্তি?

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

প্রহর গুনি কোন আশাতে!

বিজয়ের রক্তাক্ত সূর্য ও আমাদের ঋণের হিসাব

বিজয় দিবস: নতুন প্রজন্মের রাষ্ট্রচিন্তার দিকদর্শন

ছবি

আমাদের বিজয়ের অন্তর্নিহিত বার্তা

প্রাণিসম্পদ: দেশীয় জাত, আধুনিক প্রযুক্তি

জমির জরিপ: ন্যায়বিচার প্রসঙ্গ

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

উন্নয়নের আড়ালে রোগীর ভোগান্তি: আস্থা সংকটে স্বাস্থ্যসেবা

ছবি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস: অমিত শক্তির উৎস

ছবি

বেগম রোকেয়া এখনো জাগ্রত

পশ্চিমবঙ্গ: বামপন্থীদের ‘বাংলা বাঁচাও’-এর ডাক

সবার বাংলাদেশ কবে প্রতিষ্ঠিত হবে?

বিদেশি বিনিয়োগ : প্রয়োজন আইনের শাসন ও সামাজিক স্থিতি

চিকিৎসা যখন অসহনীয় ব্যয়, তখন প্রতিবাদই ন্যায়

মস্কোর কৌশলগত পুনর্গঠন

“সব শিয়ালের এক রা’ মারা গেল কুমিরের ছা”

ছবি

বিচূর্ণ দর্পণের মুখ

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

প্রসঙ্গ: সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

রোববার, ০৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য যে কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এই কমিশন সংবিধানের সাতটি ক্ষেত্রে সংশোধন, পরিবর্তন, বাতিল বা সংযোজনের সুপারিশ করেছে।সংবিধানের ‘প্রস্তাবনায়’ মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিদ্যমান সংবিধানের প্রস্তাবনায় মূলনীতি হিসেবে উল্লেখ করা আছে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাÑ এই চার মূলনীতির স্থলে সংস্কার কমিটি তাদের প্রস্তাবিত প্রস্তাবনায় উল্লেখ করেছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র। তবে প্রকৃত গণতন্ত্র অনুসৃত হলে ‘সাম্য’ ব্যতীত অন্য মূলনীতিগুলোর পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য কোন তাৎপর্য নেই। যে শাসনব্যবস্থায় মানবিক মর্যাদা, সুবিচার, বহুত্বের স্বীকৃতি থাকে না সেই শাসনব্যবস্থা কোনভাবেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণ্য হতে পারে না।

সুপারিশকৃত প্রস্তাবনায় ‘মুক্তি-সংগ্রাম’-এর স্থলে ‘জনযুদ্ধ’ বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রী’ ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দের পরিবর্তে লেখা হয়েছে ‘নাগরিকতন্ত্র’ ও ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’। কিন্তু গণ, জনÑ এই দুটি শব্দের অর্থই ‘জনসাধারণ’, ‘প্রজা’ অর্থও জনসাধারণ। প্রজার আরেকটি অর্থ হচ্ছে ‘রায়ত’, তাই বোধহয় ’প্রজা’ লিখতে মানসম্মানে বাঁধছে। যারা কর দিয়ে জমি ভোগ করে তারাই রায়ত। আগে কর আদায় করত জমিদার, এখন করে সরকার। পার্থক্যটা খুব বেশি নয়। সংস্কার কমিটির সুপারিশকৃত ‘প্রস্তাবনায়’ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পাশাপাশি চব্বিশের বৈষম্যহীন আদর্শের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনার কথাও উল্লেখ রয়েছে।

বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে ‘বাঙালি’ এবং নাগরিকগণ ‘বাংলাদেশি’। কমিশনের সুপারিশে জাতিসত্তা বাঙালির কথা বাদ দেয়া হয়েছে, বাংলাদেশের নাগরিকরা শুধু ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে পরিচিত হবেন। সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ও গুম থেকে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার, জামিনে মুক্তি পাওয়ার অধিকার এবং নিবর্তনমূলক আটক-সংক্রান্ত বিধান বিলুপ্তির কথা বলা হয়েছে। সাধারণত এমন ভালো ভালো কথা পৃথিবীর সব সংবিধানেই লেখা থাকে, বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানেও কোন নিবর্তনমূলক আটকের কথা নেই। কিন্তু অতীতের সবগুলো সরকার তাদের নিবর্তনমূলক আচরণকে আইনসম্মত বলে অভিহিত করেছে, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমকে আইনি আচ্ছাদন দিতে সক্ষম হয়েছে। ‘জামিন’ মুক্তি পাওয়ার অধিকারের কথা শুধু সংস্কার কমিশন নয়, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ীও জামিন পাওয়া প্রত্যেক আসামির মৌলিক অধিকার। কিন্তু জামিন অযোগ্য আইন অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও প্রয়োগ হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে নিরপরাধ লোকদেরও হত্যা মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে যাতে জামিন পাওয়া সহজ না হয়।

সংস্কার কমিশন দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার প্রস্তাব করেছে। জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত ৪০০ জন সদস্য নিয়ে নিম্নকক্ষ এবং ১০৫ সদস্য নিয়ে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। ৪০০ জনের মধ্যে ১০০ জন হবেন নারী সদস্য, যারা শুধু নারী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। উচ্চকক্ষের ১০৫ জনের মধ্যে ৫ জন মনোনীত হবেন প্রেসিডেন্ট কর্তৃক, যারা কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য নন। এরা সম্ভবত ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হবেন। বাকি ১০০ জনের মধ্যে ৫ জন মনোনীত হবেন অনগ্রসর সম্প্রদায় থেকে। বাকি ৯৫ জনকে মনোনীত করতে পারবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী যে সকল রাজনৈতিক দল মোট প্রদত্ত ভোটের ১ শতাংশ ভোট পাবে। কোন দল কতজনকে মনোনীত করতে পারবে তা নির্ধারিত হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে। এটা আসলে কোটা।

ছাত্র ও যুবশক্তিকে দেশ শাসনে সম্পৃক্ত করার অভিপ্রায়ে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীর সর্বনিম্ন বয়স ২৫ বছর থেকে হ্রাস করে ২১ বছর করার সুপারিশ করা হয়েছে এবং কমপক্ষে ১০ শতাংশ প্রার্থী তরুণদের মধ্য থেকে মনোনয়ন দেয়ার কথাও বলা হয়েছে। মন্দ নয়, রাজনীতিতে ছাত্র ও যুবকদের আকর্ষণ বাড়বে।রাজনৈতিক দলগুলো এসব শর্ত মানবে বলে মনে হয় না। কারণ দেশের রাজনীতিতে ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব অন্তর্ভুক্তি করার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের বাধ্যবাধকতা বহু আগে থেকে থাকলেও কোন রাজনৈতিক দল অদ্যাবধি তা মানেনি।

পৃথিবীর অধিকাংশ সংসদ এক কক্ষ বিশিষ্ট। সাধারণত ফেডারেল সিস্টেমে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা থাকে। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার ভালো-মন্দ দুটি দিকই আছে। বাংলাদেশে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা কেন উপযোগী তার কোন ব্যাখ্যা সংস্কার কমিশনের সুপারিশে দেখা গেল না। তবে এর মাধ্যমে অধিকসংখ্যক রাজনৈতিক নেতা আইনসভার সদস্য হওয়ার সুযোগ পাবেন, মনোনয়ন প্রদানে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও কিছুটা কমবে।

কিন্তু খরচ বাড়বে, কারণ নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সংসদে কখনো সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে মতভেদ হয়নি। অন্যদিকে একই বিল আইন সভার দুই কক্ষে পাসের শর্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিলম্বিত হবে। এছাড়া মন্ত্রিসভাকে দুই কক্ষের জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে, যা যুক্তিসঙ্গত নয়। জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত নিম্নকক্ষে কোন রাজনৈতিক দলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে উচ্চকক্ষেও সেই দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে। তাই নিম্নকক্ষের সিদ্ধান্ত উচ্চকক্ষে চ্যালেঞ্জ হবে না। দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে ভিন্নমত পোষণ করার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার প্রস্তাব করা হলেও তা কার্যকর করা সহজ হবে না; কারণ আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো স্বৈরতন্ত্র বিশ্বাস করে, শীর্ষ নেতার অনুগত না হলে কোন নেতাকর্মী মনোনয়ন পাবে না, দলের মধ্যে পচে যেতে হবে।

নিম্নকক্ষে দুজন ডেপুটি স্পিকার থাকবেন; একজন স্পিকার বিরোধী দল থেকে মনোনীত হবেন। উচ্চকক্ষের ডেপুটি স্পিকারও বিরোধী সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত হবেন। আমাদের দেশে রাজনীতির যে সংস্কৃতি তা অব্যাহত থাকলে বিরোধী দলের ডেপুটি স্পিকার কখনো সংসদ পরিচালনার সুযোগ পাবেন না। যিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন তিনি সংসদ নেতা বা দলীয় প্রধান থাকতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট সর্বোচ্চ দুইবারের বেশি অধিষ্ঠিত থাকবেন না। আইনসভার স্থায়ী কমিটিগুলোর সভাপতি হবেন বিরোধী দল থেকে। এই বিষয়গুলো দীর্ঘদিন ধরে মিডিয়ায় আলোচনা-পর্যালাচনা হচ্ছে, কিন্তু ক্ষমতাসীন কোন দল এই পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেনি। কমিশন রাষ্ট্রীয় কার্যাবলিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনায়ন ও রাষ্ট্রীয় অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ৯ সদস্য বিশিষ্ট একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি গঠনের সুপারিশ করেছে। এই কাউন্সিলে থাকবেন প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা, দুই কক্ষের দুজন স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, নিম্মকক্ষের বিরোধী দলের মনোনীত স্পিকার, ক্ষমতাসীন দল ও প্রধান বিরোধী দলের সাংসদ ব্যতীত অন্য সব সদস্যের মনোনীত একজন সাংসদ।

এ জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল নির্বাচন কমিশনার, অ্যাটর্নি জেনারেল, সরকারি কর্ম কমিশন ও দুদকের সব কমিশনার, প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর প্রধান এবং আইন দ্বারা নির্ধারিত অন্য যে কোন পদে নিয়োগ দেবে। সাংবিধানিক কাউন্সিল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকেও নিয়োগ দেবে। প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগে আগে যে প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি অনুসৃত হতো তার সঙ্গে কমিশনের সুপারিশের খুব বেশি পার্থক্য পরলক্ষিত হয়নি।তত্ত্বাবধায়ক সরকারে জনপ্রতিনিধিত্ব থাকে না বিধায় সুপ্রিম কোর্ট তাকে ২০১১ সনে অবৈধ বলেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিতের রাখার প্রভিশন থাকায় চাকুরিরত অবস্থায় বিচারপতিদের মধ্যে নিরপেক্ষতার বিচ্যুতি হওয়ার সম্ভাবনার কথাও রায়ে বলা হয়েছিল। সংস্কার কমিশন এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়নি।অবশ্য সুপ্রিম কোর্টের সেই রায় ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আদালতে বাতিল হয়ে গেছে।

জাতীয় পার্টি ক্ষমতা থাকাকালীন ১৯৮৮ সনে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয় এবং রাজধানীতে সুপ্রিম কোর্টের স্থায়ী আসন রেখে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, যশোর, রংপুর এবং সিলেটে হাইকোর্ট বিভাগের একটি করে স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন করা হয়। পরবর্তীকালে এই সংশোধনীর রাষ্ট্রধর্ম অক্ষুণœ রেখে ৬ বিভাগে হাইকোর্টের বেঞ্চ স্থাপনের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদটি এখতিয়ার বহির্ভূত ও অকার্যকর বলে আদালত ঘোষণা করে।

সংস্কার কমিশন পুনরায় উচ্চ আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ করে দেশের সব বিভাগে হাইকোর্ট বিভাগের সমান এখতিয়ার সম্পন্ন হাইকোর্টের স্থায়ী আসন প্রবর্তনের সুপারিশ করেছে। হোসেন মোহাম্মদ এরশাদের অষ্টম সংশোধনী পাস হওয়ার পর সব বিরোধী দলসহ আইনজীবীরা তার ঘোর বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু এবার কেউ এখনো সংস্কার কমিশনের উচ্চ আদালতের বিকেন্দ্রীকরণের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কথা বলেনি। সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কমিশন গঠন করার সুপারিশ করা হয়েছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ হচ্ছে, আপিল বিভাগের বিচারকদের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ জ্যেষ্ঠ বিচারককে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ প্রদানকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের একটি বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা। কমিশন বিচার বিভাগকে পূর্ণ আর্থিক স্বাধীনতা প্রদানেরও সুপারিশ করেছে।

বিচার বিভাগসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাগজে-কলমে স্বাধীনতা দেয়া সত্ত্বেও সরকারের কথায় চলে কেন তা সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে খতিয়ে দেখা হয়নি। রাজনৈতিক বিভাজন দেশের সর্বত্র। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কারা দেশ চালাচ্ছেন? মিডিয়ার বিভিন্ন তথ্য থেকে স্পষ্ট প্রতিপন্ন হয়, রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান জামায়াতে ইসলাম বা বিএনপির সমর্থক আমলা দিয়ে সাজানো হচ্ছে। তাহলে স্বাধীনতা দিয়ে লাভ কী! অবশ্য দলীয় লোক উপযুক্ত ও কার্য সম্পাদনে নিরপেক্ষ হলে কোন সমস্যা থাকে না। কার্য সম্পাদনে নিরপেক্ষ হলে দলের একনিষ্ঠ কর্মী দিয়েও প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা রক্ষা করা সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের কোন দলীয় সরকার নিয়োগ দেয় না।

সংস্কার কমিশন সংবিধান পুনর্লিখন করেনি, করেছে সংশোধন। কিন্তু কীভাবে এই সব সংশোধনী সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে তার কোন উল্লেখ সুপারিশে দেখা গেল না। বর্তমান আইন অনুযায়ী সংবিধানের কোন সংশোধনী আনতে গেলে সংসদের দুই তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের সমর্থন অপরিহার্য। কিন্তু সংস্কার কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক সংবিধান সংশোধনে উভয় কক্ষের দুই তৃতীয়াংশের সমর্থন যথেষ্ট নয়, গণভোটের মাধ্যমে তা পাস হতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় দুই-তৃতীয়াংশ সংস সদস্যের ভোটে ক্ষমতাসীন দল যখন-তখন সংবিধান পরিবর্তন করতে সক্ষম হবে না, জনগণের কাছে যেতে হবে।

বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষর গ্রহণপূর্বক দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে নাগরিকদের সংবিধান সম্মত কিছু অধিকার স্থগিত করতে পারেন। কিন্তু সংস্কার কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত ব্যতিরেকে প্রেসিডেন্ট দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন না এবং জরুরি অবস্থায় নাগরিকদের অধিকার রদ বা স্থগিত করাও যাবে না। কিন্তু নাগরিকদের সব অধিকার অক্ষুণœ রাখা হলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা অর্থহীন হবে। কমিশনের সুপারিশগুলো অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন পর্যায়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে সংযোজন-বিয়োজন করবে এবং তা সংসদে উপস্থাপিত হলে সেখানেও আলোচনা-পর্যালাচনা হবে। তাই এখনো কমিশনের সুপারিশ নিয়ে সিদ্ধান্তসূচক মন্তব্য করা নিরর্থক বলে মনে হয়।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]

back to top