আনোয়ারুল হক
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র গণআন্দোলনের সময়ে ছাত্র নেতারা প্রায়শই ‘বয়ান’ করতেন দেশ এমন একটা রাজনৈতিক পরিসর খুঁজছে যেখানে সবাই সবার কথা বলতে পারবে, প্রত্যেকের কণ্ঠস্বর শোনা যাবে। সকলেই মৌলিক মানবাধিকার আর নাগরিক অধিকার ভোগ করবে। কিন্তু হচ্ছেটা কী দেশে?
কিছুদিন আগে দেখা গিয়েছিল সংবাদপত্র অফিসের সামনে গরু জবাই করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে বলা হচ্ছে বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা মানি না। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটার পর একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুর হলো। আমাদের দেখতে হলো কদিন আগের এক সাথের মিছিলের সাথীরা একে অপরকে ওবায়দুল কাদেরের ‘হেলমেট লীগের’ মতো আক্রমণ করছে। সাত অধিভুক্ত কলেজের আন্দোলনকে কেন্দ্র করেও এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি চলছে। চাঁদাবাজির অভিযোগে তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর উত্তরা পশ্চিম থানায় হামলা এবং পুলিশ সদস্যদের মারধরের ঘটনা কিসের ইঙ্গিত বহন করছে?
বাংলা একাডেমি পুরস্কার নিয়েও বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না। দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও বিশিষ্ট লেখক গবেষক ড. মোহাম্মদ হান্নানের নাম পুরস্কারের জন্য ঘোষণা করার পর আরেক ঘোষণা দিয়ে তা প্রত্যাহার করার পর মনে হচ্ছে পুরস্কার প্রদানকারীরা আগের মতো দলবাজদের পুরস্কার দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তবে নানা অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে এযাবতকালের সেরা ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে আলোচনায় এসেছেন প্রধান উপদেষ্টার ‘রাজনৈতিক’ প্রেস সেক্রেটারি জনাব শফিকুল আলম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে কিছু তরুণ বইমেলা প্রাঙ্গণে শেখ হাসিনার ছবি দিয়ে একটি ডাস্টবিন তৈরি করে প্রদর্শন করছে। দীর্ঘ সময়ের স্বৈরাচারী শাসনে গুম, খুনসহ জুলাই আন্দোলনে নির্বিচার হত্যাকা-ে তরুণ মনের ক্ষোভ নানাভাবেই প্রকাশ পেতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে তার বহিঃপ্রকাশ রুচিসম্মত হতে না-ও পারে। নেতৃত্বের দায়িত্ব, সমাজপতিদের কর্তব্য ভবিষ্যতে কী অর্জন করতে চাই সেই ধারায় তারুণ্যের ক্ষোভের প্রতিফলন ঘটানো। এক্ষেত্রে সমাজে প্রতিহিংসা বা ঘৃণা সৃষ্টি না করে সুস্থ প্রতিবাদী ধারায় স্বৈরাচার-স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের লড়াইটাই জরুরি। স্বেচ্ছাচারী কায়দায় বাদ-প্রতিবাদ তো সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। তাছাড়া যে কাজটা পছন্দ না হলেও স্বৈরাচারের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বা তারুন্যের অস্থিরতা হিসেবে মেনে নেয়া যায় সেই কাজ যদি বয়স্ক একজন জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি করেন সেটা শুধু বেমানান নয়, সমাজে ঘৃণা সৃষ্টির অপরাধের পর্যায় পড়ে।
উপরন্তু মুজিবভক্তি যদি অপরাধ হয় তা হলে আজকের বিপ্লবীদের অনেকেই সে অপরাধে দুষ্ট। প্রেস সচিব শফিকুল আলমের ২০০০ সালে দেয়া একটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, তিনি মুজিব কোট পরে কোন এক মুজিব বন্দনা শিবিরে আছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কারী সারজিস আলমসহ আন্দোলনের অনেকেই নাকি ছাত্রলীগ করতেন। সারজিস আলম তো ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ১০-১২টি প্যানেলের মধ্যে ছাত্রলীগের প্যানেলটিই বেছে নিয়েছিলেন এবং ছাত্রলীগের হয়ে হল সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আগ পর্যন্ত তো তাকে ছাত্রলীগ সভাপতির পাশেই দেখা যেত। তার সেদিনের ‘ঐতিহাসিক’ বক্তৃতা ‘আমার বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ’-এর বিষয়ে এখন তার বক্তব্য কী! মুজিব কোট পরিহিত শফিকুল আলম বা সারজিস আলমের সেসব ছবি দিয়ে কট্টর মুজিব বিরোধীরা যদি ডাস্টবিন বা টয়লেট বানায়, তারা কি সেটা মেনে নিতে পারবেন। সরকারের উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে বা বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী বই প্রসঙ্গে যে বক্তব্য বা আলোচনা সোশ্যাল মিডিয়ায় রয়েছে সেসব বক্তব্য কি তিনি প্রত্যাহার করেছেন? না করে থাকলে তো তিনিও ‘মুজিববাদী’!
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান যেহেতু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা ছিলেন, তাই শুধু আসিফ নজরুল নন অসংখ্য লেখক, সাহিত্যিক সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীর লেখনীতে নানা গবেষণাপত্রে পাঠ্যপুস্তকে শেখ মুজিব যথার্থভাবেই স্বাধীনতার ইতিহাসের নায়ক হিসেবে স্থান পেয়েছেন। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দলীয়করণ করে, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে অতিব্যবহার ও অপব্যবহার করে দেশবাসীর মনে বিরক্তির সৃষ্টি করেছিল। সে দায় তো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখক গবেষকদের নয়। কিন্তু এ সমস্ত লেখক সাহিত্যিক, গবেষকদের আজ গণহারে ট্যাগ দেয়া হচ্ছে।
সর্বক্ষেত্রে যে একধরনের নৈরাজ্যকর হাঁকডাক চলছে, বাংলা একাডেমির বইমেলায় ঘৃণা সংস্কৃতির যে আয়োজন ড. ইউনূসের মুখপত্র শফিকুল আলম করলেন তাতে করে ভাষার মাসে ডাস্টবিন মার্কা রুচি সংস্কৃতিই প্রকাশ পাচ্ছে। অথচ ৬ মাস আগেই পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। তখন আমাদের ছাত্র তরুণরা গুলির সামনে প্রতিজ্ঞায় অটল থেকেও আচরণে, বক্তব্যে, শারীরিক ভাষায় ছিলো বিনয়ী। আর স্বৈরাচার ছিল উদ্ধত, দূর্বীনিত। সেই ঔদ্ধত্যকে বাংলার মানুষ উপযুক্ত জবাব দিয়েছে।
আজ যেটা প্রয়োজন তা হল প্রতিটা হত্যাকা-ের, প্রতিটা গুমের, প্রতিটা অপরাধের বিচার করে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা যে বিচার সম্ভব, আইনের শাসন সম্ভব। কাজটা বেশ কঠিন। তাই সহজ পন্থা হিসেবে সেই একই ঘৃণা সংস্কৃতি চাষের ফ্যাসিবাদী পন্থা বেছে নেয়া হয়েছে।
পতিত স্বৈরাচারও কিন্তু বিরোধীদের প্রতি একধরনের বিদ্বেষ ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য দেখাতেন। শেখ হাসিনা কথায় কথায় বিরোধীদের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির দোষর বা সহযোগি আখ্যায়িত করতেন। তার সমালোচকদের ঘুষখোর এবং এতিমের টাকা চুরি ইত্যাদি নানা উপাধিতে ভূষিত করতেন।
নিশ্চয়ই অনেকের স্মরণে আছে পদ্মা সেতু নির্মাণে সাফল্যের পওে তিনি বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া এবং ড. ইউনূস কে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন টুক্ করে পদ্মায় ফেলে দিয়ে দুই চুবানি দিয়ে উঠিয়ে আনবেন, যা নিয়ে পত্রিকায় কার্টুন প্রকাশিত হয়েছিল।
কোথায় সেই বাহাদুরি! আজ কে কাকে চুবায়! প্রতিহিংসা, বিরোধী শক্তিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও অবমাননার ফলাফল শেখ হাসিনা নির্মমভাবে ভোগ করছেন। শফিকুল আলমদেরও ইতিহাসের এই শিক্ষা মনে রাখা উচিত। সাধারণত রাগের নেপথ্যে থাকে অপূর্ণ প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার ফলে দেখা দেয় হতাশা। আর সেই হতাশা থেকেই জন্ম নেয় রাগ বা ক্রোধ। বড় জানতে ইচ্ছে করে জনাব শফিকুল আলমের অপূর্ণ প্রত্যাশা কী?
ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে আকাক্সক্ষা ধ্বনিত হয়েছে, যে নতুন দিনের মশাল জ্বলেছে তাকে প্রজ্বলিত রাখাই এখন প্রধান কাজ। অস্থিরতা, ক্রোধ আর প্রতিহিংসার বুনো উল্লাস গণতান্ত্রিক উত্তরণের বদলে সৃষ্টি করবে নব্য ফ্যসিবাদ। যার চেহারা ইতোমধ্যে দেখলাম ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটি ভেঙে ফেলার মধ্য দিয়েÑ যে বাড়িকে কেন্দ্র করেই সম্পন্ন হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের আয়োজন পর্ব। এ বিষয়ে পরে লেখার ইচ্ছা রইল।
[লেখক: সাবেক সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়ন]
আনোয়ারুল হক
সোমবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র গণআন্দোলনের সময়ে ছাত্র নেতারা প্রায়শই ‘বয়ান’ করতেন দেশ এমন একটা রাজনৈতিক পরিসর খুঁজছে যেখানে সবাই সবার কথা বলতে পারবে, প্রত্যেকের কণ্ঠস্বর শোনা যাবে। সকলেই মৌলিক মানবাধিকার আর নাগরিক অধিকার ভোগ করবে। কিন্তু হচ্ছেটা কী দেশে?
কিছুদিন আগে দেখা গিয়েছিল সংবাদপত্র অফিসের সামনে গরু জবাই করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে বলা হচ্ছে বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা মানি না। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটার পর একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুর হলো। আমাদের দেখতে হলো কদিন আগের এক সাথের মিছিলের সাথীরা একে অপরকে ওবায়দুল কাদেরের ‘হেলমেট লীগের’ মতো আক্রমণ করছে। সাত অধিভুক্ত কলেজের আন্দোলনকে কেন্দ্র করেও এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি চলছে। চাঁদাবাজির অভিযোগে তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর উত্তরা পশ্চিম থানায় হামলা এবং পুলিশ সদস্যদের মারধরের ঘটনা কিসের ইঙ্গিত বহন করছে?
বাংলা একাডেমি পুরস্কার নিয়েও বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না। দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও বিশিষ্ট লেখক গবেষক ড. মোহাম্মদ হান্নানের নাম পুরস্কারের জন্য ঘোষণা করার পর আরেক ঘোষণা দিয়ে তা প্রত্যাহার করার পর মনে হচ্ছে পুরস্কার প্রদানকারীরা আগের মতো দলবাজদের পুরস্কার দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তবে নানা অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে এযাবতকালের সেরা ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে আলোচনায় এসেছেন প্রধান উপদেষ্টার ‘রাজনৈতিক’ প্রেস সেক্রেটারি জনাব শফিকুল আলম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে কিছু তরুণ বইমেলা প্রাঙ্গণে শেখ হাসিনার ছবি দিয়ে একটি ডাস্টবিন তৈরি করে প্রদর্শন করছে। দীর্ঘ সময়ের স্বৈরাচারী শাসনে গুম, খুনসহ জুলাই আন্দোলনে নির্বিচার হত্যাকা-ে তরুণ মনের ক্ষোভ নানাভাবেই প্রকাশ পেতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে তার বহিঃপ্রকাশ রুচিসম্মত হতে না-ও পারে। নেতৃত্বের দায়িত্ব, সমাজপতিদের কর্তব্য ভবিষ্যতে কী অর্জন করতে চাই সেই ধারায় তারুণ্যের ক্ষোভের প্রতিফলন ঘটানো। এক্ষেত্রে সমাজে প্রতিহিংসা বা ঘৃণা সৃষ্টি না করে সুস্থ প্রতিবাদী ধারায় স্বৈরাচার-স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের লড়াইটাই জরুরি। স্বেচ্ছাচারী কায়দায় বাদ-প্রতিবাদ তো সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। তাছাড়া যে কাজটা পছন্দ না হলেও স্বৈরাচারের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বা তারুন্যের অস্থিরতা হিসেবে মেনে নেয়া যায় সেই কাজ যদি বয়স্ক একজন জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি করেন সেটা শুধু বেমানান নয়, সমাজে ঘৃণা সৃষ্টির অপরাধের পর্যায় পড়ে।
উপরন্তু মুজিবভক্তি যদি অপরাধ হয় তা হলে আজকের বিপ্লবীদের অনেকেই সে অপরাধে দুষ্ট। প্রেস সচিব শফিকুল আলমের ২০০০ সালে দেয়া একটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, তিনি মুজিব কোট পরে কোন এক মুজিব বন্দনা শিবিরে আছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কারী সারজিস আলমসহ আন্দোলনের অনেকেই নাকি ছাত্রলীগ করতেন। সারজিস আলম তো ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ১০-১২টি প্যানেলের মধ্যে ছাত্রলীগের প্যানেলটিই বেছে নিয়েছিলেন এবং ছাত্রলীগের হয়ে হল সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আগ পর্যন্ত তো তাকে ছাত্রলীগ সভাপতির পাশেই দেখা যেত। তার সেদিনের ‘ঐতিহাসিক’ বক্তৃতা ‘আমার বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ’-এর বিষয়ে এখন তার বক্তব্য কী! মুজিব কোট পরিহিত শফিকুল আলম বা সারজিস আলমের সেসব ছবি দিয়ে কট্টর মুজিব বিরোধীরা যদি ডাস্টবিন বা টয়লেট বানায়, তারা কি সেটা মেনে নিতে পারবেন। সরকারের উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে বা বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী বই প্রসঙ্গে যে বক্তব্য বা আলোচনা সোশ্যাল মিডিয়ায় রয়েছে সেসব বক্তব্য কি তিনি প্রত্যাহার করেছেন? না করে থাকলে তো তিনিও ‘মুজিববাদী’!
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান যেহেতু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা ছিলেন, তাই শুধু আসিফ নজরুল নন অসংখ্য লেখক, সাহিত্যিক সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীর লেখনীতে নানা গবেষণাপত্রে পাঠ্যপুস্তকে শেখ মুজিব যথার্থভাবেই স্বাধীনতার ইতিহাসের নায়ক হিসেবে স্থান পেয়েছেন। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দলীয়করণ করে, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে অতিব্যবহার ও অপব্যবহার করে দেশবাসীর মনে বিরক্তির সৃষ্টি করেছিল। সে দায় তো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখক গবেষকদের নয়। কিন্তু এ সমস্ত লেখক সাহিত্যিক, গবেষকদের আজ গণহারে ট্যাগ দেয়া হচ্ছে।
সর্বক্ষেত্রে যে একধরনের নৈরাজ্যকর হাঁকডাক চলছে, বাংলা একাডেমির বইমেলায় ঘৃণা সংস্কৃতির যে আয়োজন ড. ইউনূসের মুখপত্র শফিকুল আলম করলেন তাতে করে ভাষার মাসে ডাস্টবিন মার্কা রুচি সংস্কৃতিই প্রকাশ পাচ্ছে। অথচ ৬ মাস আগেই পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। তখন আমাদের ছাত্র তরুণরা গুলির সামনে প্রতিজ্ঞায় অটল থেকেও আচরণে, বক্তব্যে, শারীরিক ভাষায় ছিলো বিনয়ী। আর স্বৈরাচার ছিল উদ্ধত, দূর্বীনিত। সেই ঔদ্ধত্যকে বাংলার মানুষ উপযুক্ত জবাব দিয়েছে।
আজ যেটা প্রয়োজন তা হল প্রতিটা হত্যাকা-ের, প্রতিটা গুমের, প্রতিটা অপরাধের বিচার করে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা যে বিচার সম্ভব, আইনের শাসন সম্ভব। কাজটা বেশ কঠিন। তাই সহজ পন্থা হিসেবে সেই একই ঘৃণা সংস্কৃতি চাষের ফ্যাসিবাদী পন্থা বেছে নেয়া হয়েছে।
পতিত স্বৈরাচারও কিন্তু বিরোধীদের প্রতি একধরনের বিদ্বেষ ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য দেখাতেন। শেখ হাসিনা কথায় কথায় বিরোধীদের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির দোষর বা সহযোগি আখ্যায়িত করতেন। তার সমালোচকদের ঘুষখোর এবং এতিমের টাকা চুরি ইত্যাদি নানা উপাধিতে ভূষিত করতেন।
নিশ্চয়ই অনেকের স্মরণে আছে পদ্মা সেতু নির্মাণে সাফল্যের পওে তিনি বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া এবং ড. ইউনূস কে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন টুক্ করে পদ্মায় ফেলে দিয়ে দুই চুবানি দিয়ে উঠিয়ে আনবেন, যা নিয়ে পত্রিকায় কার্টুন প্রকাশিত হয়েছিল।
কোথায় সেই বাহাদুরি! আজ কে কাকে চুবায়! প্রতিহিংসা, বিরোধী শক্তিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও অবমাননার ফলাফল শেখ হাসিনা নির্মমভাবে ভোগ করছেন। শফিকুল আলমদেরও ইতিহাসের এই শিক্ষা মনে রাখা উচিত। সাধারণত রাগের নেপথ্যে থাকে অপূর্ণ প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার ফলে দেখা দেয় হতাশা। আর সেই হতাশা থেকেই জন্ম নেয় রাগ বা ক্রোধ। বড় জানতে ইচ্ছে করে জনাব শফিকুল আলমের অপূর্ণ প্রত্যাশা কী?
ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে আকাক্সক্ষা ধ্বনিত হয়েছে, যে নতুন দিনের মশাল জ্বলেছে তাকে প্রজ্বলিত রাখাই এখন প্রধান কাজ। অস্থিরতা, ক্রোধ আর প্রতিহিংসার বুনো উল্লাস গণতান্ত্রিক উত্তরণের বদলে সৃষ্টি করবে নব্য ফ্যসিবাদ। যার চেহারা ইতোমধ্যে দেখলাম ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটি ভেঙে ফেলার মধ্য দিয়েÑ যে বাড়িকে কেন্দ্র করেই সম্পন্ন হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের আয়োজন পর্ব। এ বিষয়ে পরে লেখার ইচ্ছা রইল।
[লেখক: সাবেক সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়ন]