শতদল বড়–য়া
আজ শুভ মাঘী পূর্ণিমা। ফাল্গুনের লাল-নীলিমায় প্রকৃতি নবসাজে রূপান্তরের প্রাক্কালে আজকের মঙ্গলময় পুণ্যতিথিতে মহামানব বুদ্ধ নিজের আয়ু সংস্কার পরিত্যাগ করেছিলেন। বুদ্ধের প্রধান সেবক আনন্দকে বুদ্ধ বললেন, ‘আনন্দ- এ বৈশালী অত্যন্ত মনোরম স্থান।’ এখানকার উদ্যান চৈত্য, গৌতম চৈত্য, বহু পুত্রক চৈত্য বড়ই মনোরম ও মনোমুগ্ধকর স্থান। প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি যেমন চমৎকার, তেমনি প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদেও এসব এলাকা ভরপুর। বুদ্ধ আবার বললেন, ‘আনন্দ তথাগত ইচ্ছা করলে কল্পকাল স্বকীয় ঋদ্ধিবলে বর্তমান দেহ অবস্থান করতে পারেন।’ হে আনন্দ, তথাগতের চারি ঋদ্ধি পাদ ভাবিত, বহুলীকৃত রথগতি সদৃশ অনর্গল অভ্যস্ত, বাস্তুভূমি সদৃশ, সুপ্রতিষ্ঠিত, পরিচিত, সম্যকভাবে আপনার করায়ত্ত। আনন্দ, সেজন্য তথাগত ইচ্ছা করলে কল্পকাল কিংবা কল্পের অবশিষ্ট সময় অবস্থান করতে পারেন।
তথাগত বুদ্ধ কী বোঝাতে চাইলেন আনন্দ তা অনুধাবন করতে পারল না মারের দ্বারা প্রলুব্ধ হওয়ায়; কিন্তু মার বিরামহীনভাবে বুদ্ধকে শুধু একটি কথাই বারবার বলেছেনÑ ‘হে সুগত, আপনি পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হোন, আপনার পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হওয়ার এখনই সঠিক সময়। ভগবান মারকে বললেন, হে পাপি মার যত দিন আমার ভিক্ষুসংঘ ত্রিপিটকের বাণীসমূহ সুন্দররূপে ব্যাখ্যা করতে পারবেন না, তত দিন পর্যন্ত তথাগত নির্বাণ লাভ করতে পারেন না। মার বলল, ‘ভন্তে ভগবান, আপনার ভিক্ষুসংঘ এখন ধর্ম প্রচারে সিদ্ধহস্ত ও নিপুণ। সুতরাং ভন্তে ভগবান আপনি নির্বিঘেœ নির্বাণ লাভ করতে পারেন।’
পাপমতি মারকে ভগবান বললেন, হে পাপিষ্ঠা দুরাচার মার তাহলে শোন, অচিরেই তথাগত পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হবেন। এখানে উল্লেখ্য যে, তথাগত ভগবান বুদ্ধ তখনকার সময়ে যখন আশি বছর বয়সে পদার্পণ করেন, তখন রাজগৃহের বেলুরবনে পঁয়তাল্লিশ বর্ষা অর্থাৎ অন্তিম বর্ষা অধিষ্ঠান করেছিলেন। তিনি বর্ষাব্রতকালীন কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। একমাত্র প্রবল ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগে সাধনা দ্বারা রোগমুক্ত হয়েছিলেন। যাকে ছন্দ, বীর্য, চিত্ত মীমাংসা বলা হয়।
ভগবান চাপাল চৈত্যে সেই সময় আজকের মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে স্মৃতিমান ও সচেতন অবস্থায় স্বীয় আয়ু সংস্কার পরিত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে এই বলে ঘোষণা দিলেন, এখন থেকে তিন মাস পর বৈশাখী পূর্ণিমা পর্যন্ত আমার প্রাণবায়ু চলতে থাকুক, সজীব থাকুক, সচেতন থাকুক, অতঃপর নিরুদ্ধ হয়ে যাক। বুদ্ধ এ সংকল্প গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রবলভাবে ভূকম্পন শুরু হয়। মুহুর্মুহু প্রলয়দেব গর্জন করতে থাকে।
এই ভূকম্পনে আনন্দ বেশ ভয় পেয়ে গেলেন। এর হেতু কী জানতে আনন্দ দ্রুতগতিতে বুদ্ধের কাছে ছুটে যান এবং ভূকম্পনের কারণ জানতে চান। বুদ্ধ আনন্দকে বললেন, ‘শোন আনন্দ, বোধিসত্ত্ব যখন মাতৃজঠর থেকে ভূমিষ্ঠ হন, তখন তার পুণ্যতেজে ভূকম্পন হয়, যখন বোধিসত্ত্ব সম্বোধি জ্ঞান লাভ করেন তার তেজে ভূকম্পন হয়, বুদ্ধেও প্রবর্তনকালে একবিংশ ভূমির প্রাণীগণের সাধুবাদ ধ্বনিতে ভূকম্পন হয়, আর যখন তথাগত আয়ু সংস্কার পরিত্যাগ করেন, তখন পৃথিবী কারুণ্যে কম্পিত হয়। তিনি যখন নির্বাণ লাভ করেন, তখন পৃথিবী রোধন ধ্বনিতে কম্পিত হয়ে থাকে।
হে আনন্দ, আমি সম্বোধি লাভের অষ্টম সপ্তাহে উরুবিল্ল গ্রামের অজপাল নিগ্রোধমূলে উপবিষ্ট ছিলাম। সেই সময় পাপমতি মার এসে আমাকে বলল, ‘হে ভগবান, আপনি এখন পরিনির্বাণ লাভ করেন। আপনার এখন পরিনির্বাণ লাভের উপযুক্ত সময়।’ তখন আমি মারকে বলেছি, যত দিন আমার ভিক্ষু-ভিক্ষুনি, দায়ক-দায়িকা, উপাসক-উপাসিকারা যথার্থ ধর্মবেত্তা বিনীত বিশুদ্ধ জীবনযাপনের যোগ্যতা অর্জন না করে, যত দিন তারা সদ্ধার্মর ব্যাখ্যা ও বিস্তার করতে না পারেন, যত দিন আমার সদ্ধর্ম প্রভাবশালী ও বর্ধনশীল না হয়ে জনসাধারণের কাছে প্রকাশ ও তাদের দ্বারা অভিনন্দিত ও পরিগৃহীত না হয়, তত দিন আমি নির্বাণ লাভ করতে পারি না। হে আনন্দ, অদ্য সেই পাপমতি মার চাপাল সেজে আমার কাছে এসে আমাকে পরিনির্বাণের আবেদন জানায়। মারের প্রশ্নের উত্তরে আমি যা তাকে বলেছি তাতে সে সন্তুষ্ট হতে পারল না।
মার আমাকে বলল, ভান্তে ভগবান, আপনার জীবনের ব্রত সমাপ্ত হয়েছে। আপনার দায়ক-দায়িকারা সবাই আপনার অতীত ধর্ম উপলব্ধি করেছে। আপনার প্রচারিত ধর্ম দেব-মনুষ্য সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং আপনি এখন পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হতে পারেন। হে আনন্দ, তখন আমি মারকে বলেছিÑ হে পাপমতি মার তুমি শোনে খুশি হও, তথাগত আজ থেকে তিন মাস পর পরিনির্বাণ লাভ করবেন। হে আনন্দ, আজ মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে বৈশালীর চাপাল চৈত্যে তথাগত কর্তৃক আপন আয়ু সংস্কার জেনে-শোনে পরিত্যক্ত হয়েছে।
আনন্দ বুদ্ধের মুখে এ কথা শোনে শোকে কাতরকণ্ঠে বললেন, ‘ভন্তে ভগবান, কল্পকাল এ দেহে অবস্থান করুন। হে সুগত, বহুজনের সুখের জন্য, দেব-মনুষ্যগণের ঐহ্যিক পারত্রিক হিত সুখ কামনায় কল্পকাল এ দেহে অবস্থান করুন।
তথাগত আনন্দকে বললেন, হে আনন্দ তুমি বৃথা ক্রন্দন করো না, আর কোনো আবেদনও জানিও না। কারণ এতে কোনো ফল লাভ হবে না। ভুল তুমি আগেই করেছো, এটি তোমার মারাত্মক অপরাধ। কারণ আমি তোমাকে আকার-ইঙ্গিতে এ কথা বোঝাতে চেয়েছিলাম; কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় হলো, আমি যা তোমাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম তুমি তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারোনি।
এর আগে আমি তোমাকে যেখানে-যেখানে বারবার ইঙ্গিত দিয়েছিলাম, সে জায়গাগুলো হলো রাজগৃহের গৃধ্রকূট পর্বত, রাজগৃহের গৌতম ন্যাগ্রোধমূলে, রাজগৃহের চৌরপ্রপাতে বেভার পর্বতে, সপ্তপর্ণী গুহায়, ঋষিগিলি পর্বতে, কালশীলায়, শীতবনে, সর্প সোন্ডিক গুহায়, তপোদারামে, বেণুবনে, কলন্দক নিবানে, জীবক আম্রবনে, মদ্রকুক্ষিতে ও মৃগদাবে। এসব স্থানের কোনোখানে একবারও তুমি আমার ইঙ্গিতের মর্ম বুঝতে পারোনি এবং এ দেহে কল্পকাল অবস্থানের নিমিত্তে প্রার্থনাও করোনি।
ভগবান শোকগ্রস্ত আনন্দকে বললেন, ‘হে আনন্দ আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি, আমাদের সব প্রিয় ও মনোহর বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে, তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রাখা যাবে না। হে আনন্দ, তথাগত যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, তার অন্যথা কোনো অবস্থাতেই হবে না, এজন্য দুঃখ করো না, এতে মনের যাতনা বাড়তে থাকবে। শান্ত হও, জীবের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করো।’
ভিক্ষুদের উদ্দেশে ভগবান বললেন, হে ভিক্ষুরাÑ আমি তোমাদের অভিজ্ঞাবলে যে ধর্মসমূহ উপদেশ দিয়েছি, সেগুলো তোমরা উত্তমরূপে আয়ত্ত করো এবং নিখুঁতভাবে আচরণ করো। সেসব বিষয় গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করো এবং এসব বিষয় সর্বত্র প্রচার করো। এই নিষ্কলুষমূলক ধর্ম যাতে চিরকাল স্থায়ী হতে পারে এবং এ কারণে সব মহলে মঙ্গল হয়, সেই মোতাবেক নিজেদের পরিচালিত করবে। এতে প্রাণিজগতের প্রতি অনুকম্পা ও দেব-মনুষ্যগণের হিতসুখ অনন্তকাল অটুট থাকবে।
হে ভিক্ষুরা, তোমরা জেনে রেখো সংস্কারসমূহ ক্ষয়শীল, অপ্রমদের সহিত নির্বাণ সাধনায়ব্রতী হও। অচিরেই তথাগত পরিনির্বাণ লাভ করবেন। অর্থাৎ আজ থেকে তিন মাস পর বৈশাখী পূর্ণিমায় কুশীনগরের মল্লদের শালবনে তথাগত পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হবেন।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]
শতদল বড়–য়া
মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
আজ শুভ মাঘী পূর্ণিমা। ফাল্গুনের লাল-নীলিমায় প্রকৃতি নবসাজে রূপান্তরের প্রাক্কালে আজকের মঙ্গলময় পুণ্যতিথিতে মহামানব বুদ্ধ নিজের আয়ু সংস্কার পরিত্যাগ করেছিলেন। বুদ্ধের প্রধান সেবক আনন্দকে বুদ্ধ বললেন, ‘আনন্দ- এ বৈশালী অত্যন্ত মনোরম স্থান।’ এখানকার উদ্যান চৈত্য, গৌতম চৈত্য, বহু পুত্রক চৈত্য বড়ই মনোরম ও মনোমুগ্ধকর স্থান। প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি যেমন চমৎকার, তেমনি প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদেও এসব এলাকা ভরপুর। বুদ্ধ আবার বললেন, ‘আনন্দ তথাগত ইচ্ছা করলে কল্পকাল স্বকীয় ঋদ্ধিবলে বর্তমান দেহ অবস্থান করতে পারেন।’ হে আনন্দ, তথাগতের চারি ঋদ্ধি পাদ ভাবিত, বহুলীকৃত রথগতি সদৃশ অনর্গল অভ্যস্ত, বাস্তুভূমি সদৃশ, সুপ্রতিষ্ঠিত, পরিচিত, সম্যকভাবে আপনার করায়ত্ত। আনন্দ, সেজন্য তথাগত ইচ্ছা করলে কল্পকাল কিংবা কল্পের অবশিষ্ট সময় অবস্থান করতে পারেন।
তথাগত বুদ্ধ কী বোঝাতে চাইলেন আনন্দ তা অনুধাবন করতে পারল না মারের দ্বারা প্রলুব্ধ হওয়ায়; কিন্তু মার বিরামহীনভাবে বুদ্ধকে শুধু একটি কথাই বারবার বলেছেনÑ ‘হে সুগত, আপনি পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হোন, আপনার পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হওয়ার এখনই সঠিক সময়। ভগবান মারকে বললেন, হে পাপি মার যত দিন আমার ভিক্ষুসংঘ ত্রিপিটকের বাণীসমূহ সুন্দররূপে ব্যাখ্যা করতে পারবেন না, তত দিন পর্যন্ত তথাগত নির্বাণ লাভ করতে পারেন না। মার বলল, ‘ভন্তে ভগবান, আপনার ভিক্ষুসংঘ এখন ধর্ম প্রচারে সিদ্ধহস্ত ও নিপুণ। সুতরাং ভন্তে ভগবান আপনি নির্বিঘেœ নির্বাণ লাভ করতে পারেন।’
পাপমতি মারকে ভগবান বললেন, হে পাপিষ্ঠা দুরাচার মার তাহলে শোন, অচিরেই তথাগত পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হবেন। এখানে উল্লেখ্য যে, তথাগত ভগবান বুদ্ধ তখনকার সময়ে যখন আশি বছর বয়সে পদার্পণ করেন, তখন রাজগৃহের বেলুরবনে পঁয়তাল্লিশ বর্ষা অর্থাৎ অন্তিম বর্ষা অধিষ্ঠান করেছিলেন। তিনি বর্ষাব্রতকালীন কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। একমাত্র প্রবল ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগে সাধনা দ্বারা রোগমুক্ত হয়েছিলেন। যাকে ছন্দ, বীর্য, চিত্ত মীমাংসা বলা হয়।
ভগবান চাপাল চৈত্যে সেই সময় আজকের মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে স্মৃতিমান ও সচেতন অবস্থায় স্বীয় আয়ু সংস্কার পরিত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে এই বলে ঘোষণা দিলেন, এখন থেকে তিন মাস পর বৈশাখী পূর্ণিমা পর্যন্ত আমার প্রাণবায়ু চলতে থাকুক, সজীব থাকুক, সচেতন থাকুক, অতঃপর নিরুদ্ধ হয়ে যাক। বুদ্ধ এ সংকল্প গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রবলভাবে ভূকম্পন শুরু হয়। মুহুর্মুহু প্রলয়দেব গর্জন করতে থাকে।
এই ভূকম্পনে আনন্দ বেশ ভয় পেয়ে গেলেন। এর হেতু কী জানতে আনন্দ দ্রুতগতিতে বুদ্ধের কাছে ছুটে যান এবং ভূকম্পনের কারণ জানতে চান। বুদ্ধ আনন্দকে বললেন, ‘শোন আনন্দ, বোধিসত্ত্ব যখন মাতৃজঠর থেকে ভূমিষ্ঠ হন, তখন তার পুণ্যতেজে ভূকম্পন হয়, যখন বোধিসত্ত্ব সম্বোধি জ্ঞান লাভ করেন তার তেজে ভূকম্পন হয়, বুদ্ধেও প্রবর্তনকালে একবিংশ ভূমির প্রাণীগণের সাধুবাদ ধ্বনিতে ভূকম্পন হয়, আর যখন তথাগত আয়ু সংস্কার পরিত্যাগ করেন, তখন পৃথিবী কারুণ্যে কম্পিত হয়। তিনি যখন নির্বাণ লাভ করেন, তখন পৃথিবী রোধন ধ্বনিতে কম্পিত হয়ে থাকে।
হে আনন্দ, আমি সম্বোধি লাভের অষ্টম সপ্তাহে উরুবিল্ল গ্রামের অজপাল নিগ্রোধমূলে উপবিষ্ট ছিলাম। সেই সময় পাপমতি মার এসে আমাকে বলল, ‘হে ভগবান, আপনি এখন পরিনির্বাণ লাভ করেন। আপনার এখন পরিনির্বাণ লাভের উপযুক্ত সময়।’ তখন আমি মারকে বলেছি, যত দিন আমার ভিক্ষু-ভিক্ষুনি, দায়ক-দায়িকা, উপাসক-উপাসিকারা যথার্থ ধর্মবেত্তা বিনীত বিশুদ্ধ জীবনযাপনের যোগ্যতা অর্জন না করে, যত দিন তারা সদ্ধার্মর ব্যাখ্যা ও বিস্তার করতে না পারেন, যত দিন আমার সদ্ধর্ম প্রভাবশালী ও বর্ধনশীল না হয়ে জনসাধারণের কাছে প্রকাশ ও তাদের দ্বারা অভিনন্দিত ও পরিগৃহীত না হয়, তত দিন আমি নির্বাণ লাভ করতে পারি না। হে আনন্দ, অদ্য সেই পাপমতি মার চাপাল সেজে আমার কাছে এসে আমাকে পরিনির্বাণের আবেদন জানায়। মারের প্রশ্নের উত্তরে আমি যা তাকে বলেছি তাতে সে সন্তুষ্ট হতে পারল না।
মার আমাকে বলল, ভান্তে ভগবান, আপনার জীবনের ব্রত সমাপ্ত হয়েছে। আপনার দায়ক-দায়িকারা সবাই আপনার অতীত ধর্ম উপলব্ধি করেছে। আপনার প্রচারিত ধর্ম দেব-মনুষ্য সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং আপনি এখন পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হতে পারেন। হে আনন্দ, তখন আমি মারকে বলেছিÑ হে পাপমতি মার তুমি শোনে খুশি হও, তথাগত আজ থেকে তিন মাস পর পরিনির্বাণ লাভ করবেন। হে আনন্দ, আজ মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে বৈশালীর চাপাল চৈত্যে তথাগত কর্তৃক আপন আয়ু সংস্কার জেনে-শোনে পরিত্যক্ত হয়েছে।
আনন্দ বুদ্ধের মুখে এ কথা শোনে শোকে কাতরকণ্ঠে বললেন, ‘ভন্তে ভগবান, কল্পকাল এ দেহে অবস্থান করুন। হে সুগত, বহুজনের সুখের জন্য, দেব-মনুষ্যগণের ঐহ্যিক পারত্রিক হিত সুখ কামনায় কল্পকাল এ দেহে অবস্থান করুন।
তথাগত আনন্দকে বললেন, হে আনন্দ তুমি বৃথা ক্রন্দন করো না, আর কোনো আবেদনও জানিও না। কারণ এতে কোনো ফল লাভ হবে না। ভুল তুমি আগেই করেছো, এটি তোমার মারাত্মক অপরাধ। কারণ আমি তোমাকে আকার-ইঙ্গিতে এ কথা বোঝাতে চেয়েছিলাম; কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় হলো, আমি যা তোমাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম তুমি তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারোনি।
এর আগে আমি তোমাকে যেখানে-যেখানে বারবার ইঙ্গিত দিয়েছিলাম, সে জায়গাগুলো হলো রাজগৃহের গৃধ্রকূট পর্বত, রাজগৃহের গৌতম ন্যাগ্রোধমূলে, রাজগৃহের চৌরপ্রপাতে বেভার পর্বতে, সপ্তপর্ণী গুহায়, ঋষিগিলি পর্বতে, কালশীলায়, শীতবনে, সর্প সোন্ডিক গুহায়, তপোদারামে, বেণুবনে, কলন্দক নিবানে, জীবক আম্রবনে, মদ্রকুক্ষিতে ও মৃগদাবে। এসব স্থানের কোনোখানে একবারও তুমি আমার ইঙ্গিতের মর্ম বুঝতে পারোনি এবং এ দেহে কল্পকাল অবস্থানের নিমিত্তে প্রার্থনাও করোনি।
ভগবান শোকগ্রস্ত আনন্দকে বললেন, ‘হে আনন্দ আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি, আমাদের সব প্রিয় ও মনোহর বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে, তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রাখা যাবে না। হে আনন্দ, তথাগত যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, তার অন্যথা কোনো অবস্থাতেই হবে না, এজন্য দুঃখ করো না, এতে মনের যাতনা বাড়তে থাকবে। শান্ত হও, জীবের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করো।’
ভিক্ষুদের উদ্দেশে ভগবান বললেন, হে ভিক্ষুরাÑ আমি তোমাদের অভিজ্ঞাবলে যে ধর্মসমূহ উপদেশ দিয়েছি, সেগুলো তোমরা উত্তমরূপে আয়ত্ত করো এবং নিখুঁতভাবে আচরণ করো। সেসব বিষয় গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করো এবং এসব বিষয় সর্বত্র প্রচার করো। এই নিষ্কলুষমূলক ধর্ম যাতে চিরকাল স্থায়ী হতে পারে এবং এ কারণে সব মহলে মঙ্গল হয়, সেই মোতাবেক নিজেদের পরিচালিত করবে। এতে প্রাণিজগতের প্রতি অনুকম্পা ও দেব-মনুষ্যগণের হিতসুখ অনন্তকাল অটুট থাকবে।
হে ভিক্ষুরা, তোমরা জেনে রেখো সংস্কারসমূহ ক্ষয়শীল, অপ্রমদের সহিত নির্বাণ সাধনায়ব্রতী হও। অচিরেই তথাগত পরিনির্বাণ লাভ করবেন। অর্থাৎ আজ থেকে তিন মাস পর বৈশাখী পূর্ণিমায় কুশীনগরের মল্লদের শালবনে তথাগত পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হবেন।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]