মানজার চৌধুরী সুইট
আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। আজ পহেলা ফাল্গুন, ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত। ঋতুর আবর্তনে বারে-বারেই আমাদের মাঝে ঋতুরাজ বসন্ত ফিরে আসে এই নাগরিক জীবনে। এ দিন সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় বসন্ত আবাহনের মহোৎসব। নৃত্য-সঙ্গীত আবৃত্তিতে, প্রীতিবন্ধনী আর আবিরের রঙে সবার সঙ্গে মিলনের এ উৎসব চলবে সারাদিন। নাগরিক জীবনে উৎসবে শুরুর আনুষ্ঠানিক বিষয় বিস্তারিত জানাবার আগে প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানোর মতো উৎসবের প্রারম্ভ বিষয়ে কিছু জ্ঞাতব্য বিষয় বিনীতভাবে জানাতে চাই।
বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, মূলত বাংলাভাষাভাষী মানুষদের শিকড়ে ফেরার কাল। এর সূত্রপাত হয় বাংলা ভাষার বদলে উর্দু ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে। এ দেশের মানুষ বুঝতে পারল- মধ্যপ্রাচ্য আরব তুরান, নয় এই উপমহাদেশই- বাংলাই তার আপন মাতৃভূমি, যার আছে হাজার বছরের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা। এরপর পাকিস্তান সরকার যখন রবীন্দ্রনাথকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো, তখন আমাদের যেন অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন হলো শুরু, এ দেশের সংবদেনশীল মানুষ তীব্র প্রতিবাদ করে এবং রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করেই সংস্কৃতির সংগ্রামের ভেতর দিয়ে আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনেরও শুরু হলো এবং ক্রমশ আরও এগিয়ে গেল। নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, দেশীয় নানা উৎসব পালনের মাধ্যমে শুরু হলো আপনভূবনে ফেরার পালা। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন জন্মও হলো সেই সন্ধিক্ষণে যাদের মধ্যে প্রধান ছায়ানট, বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতির রক্ষা ও প্রচলনে তারা নিল অগ্রপথিকের ভূমিকা। বাংলা নববর্ষ পালনের সাথে তারা বাংলার অন্যান্য সাংস্কৃতিক ধারাকেও সামনে নিয়ে এলো- শারদোৎসব, বসন্ত উৎসব পালনেরও শুরু তখন।
নববর্ষ পালনের সার্বজনীন একটি ধারা থাকলেও বসন্ত উৎসব পালনের সার্বজনীন কোন ধারা ছিল না- এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের শান্তি নিকেতনে বসন্ত উৎসব কেই দৃষ্টান্ত হিসেবে নেয়া হলো। কেবল একটি বিষয় ছাড়া উৎসবের তারিখ। এ ব্যপারে ছায়ানটের সন্জীদা খাতুন বলেন ‘ঢাকা প্রথম বসন্ত উৎসব করা হয় কোন বিশেষ দিন মনে করে নয়, ফালগুনের কোন এক ছুটির দিনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটি বাসার গ্যারেজের সামনে সাদা চাদর টাঙিয়ে, তার উপর লতা পাতা ফুল দিয়ে মঞ্চ, নির্বাচিত কিছু গান কবিতা ও নৃত্য পরিবেশনার মাধ্যমে। অনুষ্ঠান শেষে সবাই ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি দান- যে এই গানটি গাইতে গাইতে সবাই পাশের একটি পুকুরের চারপাশ প্রদক্ষিণ করে। সেই সময়ে এটি ছিল একটি অভিনব প্রয়াস। পরে এইটে বসন্তের শোভাযাত্রা হিসেবে পালন করা হয়।’
শান্তি নিকেতনের ‘বসন্ত উৎসবে’ সনাতন ধর্মীয় অনুষঙ্গটি বাদ গেলেও পালিত হত দোল উৎসবের একই দিনে; কিন্তু এখানে এটি পালন করা হতো ফাল্গুনের কোন ছুটির দিনে। দোলের দিনে উৎসব না করার কারন মূলত যে তখনকার পাকিস্তান সরকার এটিকেও যেন হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি বলে নিষিদ্ধ করার সুযোগ না পায়। সে অনুষ্ঠানে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা, বিশেষ করে মেয়েরা সবাই হলুদ শাড়ি পরতো এবং কোথাও একত্রে বসে বসন্তের উপর গান কবিতা, নাচ পরিবেশন করে পালন করতো। অন্য কোথাও পালন না করা হলেও হলুদ শাড়ি পরে, মাথায় হলুদ ফুল লাগিয়ে ফাল্গুনের প্রথম দিনে ঘরের বাইরে ফাগুনের প্রথম দিনটি পালনেরও শুরুও হয় সম্ভবত তখনই।
পহেলা ফাল্গুন কবে কখন হলুদ শাড়ি পরে তরুণ-তরুণীরা ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল এর সঠিক ইতিহাস বের করা বেশ দূরূহ। নবপর্যায়ে বসন্ত উৎসবকে কেবল সংস্কৃতিমনা ও ছাত্র-ছাত্রীদের নিজস্ব অঙ্গন থেকে বের করে সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে দেবার কৃতিত্ব অবশ্য ‘জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ’-এর। সাংস্কৃতিক কর্মীদের উদ্যোগে এবং ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও এ দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় সঙ্গীত গুরু ও সংগঠক ওয়াহিদুল হকের সার্বিক তত্ত্বাবধানে দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান’কে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় ‘জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ’। সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের বরেণ্য ব্যক্তিত্বদের উপদেষ্টা করে, বিভিন্ন সঙ্গীত ও নৃত্য বিদ্যালয়, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে যোগাযোগ করে এবং তাদের সবার অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে চারুকলার বকুলতলায় ১৪০১ বঙ্গাব্দে প্রথম পালিত হয় বসন্ত উৎসব। তখনই ঠিক করা হয় প্রতিবছর বাংলাবর্ষের ফাল্গুন মাসের প্রথম দিন বসন্ত উৎসব পালিত হবে। সেই উৎসবের আহ্বান ছিল- ‘এসো মিলি প্রাণের উৎসবে’। সেবার অংশ নিয়েছিল ছায়ানট, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা পরিচালিত সুরের ধারা, কলিম শরাফী পরিচালিত সঙ্গীত ভবন, ওয়াহিদুল হক পরিচালিত আনন্দধ্বনি, উদীচী ও খেলাঘর।
বসন্ত উৎসবে কবি শামসুর রাহমান সবাইকে আহ্বান জানালেন- ‘সমাজ ভিতরে বাহিরে যত দীন হচ্ছে, মানুষও জীবনে মননে ততই হতশ্রী হচ্ছে। বর্ষা বসন্তে তবু মানুষ বিমনা হয়, অজান্তে উৎফুল্ল হয়। কেউ হয়তো বিচ্ছিন্নভাবে বাসন্তি রঙ বসনও তুলে নেয়। কিন্তু সকলে মিলে বসন্ত বরণ হয়না। সকলের মিলবার এবং মেলাবার এই প্রাণময় ক্ষেত্রটি আমরা করতে চাইছি। প্রকৃতির সুরে, রঙে আমাদের এক করে নিতে পহেলা ফালগুনে আমরা উৎসবে একত্র হব। আপনি আসুন, আসুন সকলে আপনারা মিলে। বসন্ত উৎসব তারুণ্যেরই উৎসব। তরুণ-তরুণীরা এসো, সকল তরুণ প্রাণ মানুষ এসো-এসো প্রফুল্ল শিশু কিশোরেরা।’ এরপর থেকেই এটি নিয়মিতভাবে পালিত হয়ে আসছে।
১৯৯৪ বঙ্গাব্দ ১৪০১ বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে নাগরিক জীবনে শুরু হলো বসন্ত উৎসব-১৪০১। ‘এসো মিলি প্রাণের উৎসবে’ এ সেøাগান নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার মনমুগ্ধকর বৃক্ষরাজির মধ্যে অপূর্ব এক অনুষ্ঠান ‘বসন্ত উৎসব’। এ ব্যাপারে ভাবনাটি প্রথম নিয়ে আসেন এক সময়কার প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক স্থপতি সফিউদ্দিন আহমেদ। তখন তিনি কাজ করতেন জনকন্ঠ ভবনে। গ্লোব নিবাস রিয়েল এস্টেটের স্থপতি হিসেবে তার দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় ১৯৯৪ সালে আরও কিছু সতীর্থদের নিয়ে এ যাত্রা শুরু হয়। প্রথমদিকে জনকন্ঠ পত্রিকার মালিক আতিকুল্লাহ মাসুদ যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। এ দিনে জনকন্ঠ পত্রিকায় বসন্তের একটি বিশেষ পাতাও বের হয়, যদিও পরে সে ধারাবাহিকতা ধরে রাখা যায়নি। তার কাছে আর্থিক সহায়তাও পেয়েছি আমরা। ওয়াহিদ ভাই যুক্ত হওয়ায় এ উৎসব আয়োজনের সার্থকতা আরও অনেক বেড়ে যায়। ওয়াহিদ ভাই এ উৎসবের সাথে আরও যুক্ত করেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি শামছুর রহমান, আবৃত্তি শিল্পী কাজী আরিফ ও রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী মিতা হককে। শুরুর সময়ে আরেক স্থপতি কবি রবিউল হুসাইন অনেক সহযোগিতা করেছেন। বিশেষ করে তিনি অটোবি প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত আমাদের এ আয়োজনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে দিতেন। এ উৎসব প্রতি বছর আয়োজনের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবার প্রিয় অনুষ্ঠান হয়ে দাঁড়ালো। যদিও তখন বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী কখনো বারো কখনো তের তারিখে ১ ফাল্গুন পালিত হতো। বাংলা একাডেমি কর্তৃক ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লা প্রণিত বাংলা পঞ্জিকা চালু করার পরে দীর্ঘকাল ১৩ ফেব্রুয়ারি এ উৎসব পালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে আরেক দফা বাংলা পঞ্জিকা পরিবর্তনের কারণে ১৪ ফেব্রুয়ারি ১ ফাল্গুন নির্দিষ্ট হয়েছে। শুরুর সময়ে সংগঠনগতভাবে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ও ছায়ানট-এর ব্যাপক সহযোগিতা পাওয়া গেছে। প্রথমদিকে বসন্ত উৎসবের একটি উদ্বোধনী সঙ্গীত ছিলো। যে সঙ্গীতটি তৎকালীন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ সেলিম বহু বছর সত্যজিৎ রায়ের ‘আহা কি আনন্দ আকাশে-বাতাসে’ দর্শকদের মাঝখান থেকে গেয়ে মাতিয়ে রাখতেন।
ছায়ানটের সকালের বৈশাখী অনুষ্ঠান আয়োজনের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের প্রথম বসন্ত উৎসব সকালে আয়োজনের ধারাবাহিকতা শুরু করে। আবার ১৪০১ বঙ্গাব্দের পরে আরও অনেকগুলো ঋতু উৎসব প্রতিবছর নিয়মিত পালিত হয়ে আসছে। এ উৎসবগুলো বসন্ত উৎসবের ধারাবাহিকতা থেকেই শুরু হয়। যেমন- পৌষমেলা, নবান্ন উৎসব, শরৎ উৎসব ও বর্ষা উৎসব তথা আষাঢ়স্য প্রথম দিবস।
বসন্ত উৎসব অসংখ্য মানুষের সহযোগিতা ও ভালবাসায় জাতীয় অনুষ্ঠান হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায় এবং সারাদেশে এর দোলা ছড়িয়ে পড়ে। ওয়াহেদ ভাই এটাই চাইতেন ‘আমরাই শুধু এ উৎসবের আয়োজন করবো না, সারাদেশেই নিজেদের মতো করে এ উৎসব পালিত হবে।’ বিশেষ করে যখন ইলেকট্রনিক মিডিয়া বিটিভি ছিল এরপরে অনেকগুলো প্রাইভেট চ্যানেল চালু হলো তার মধ্যে চ্যানেল আই প্রায় দীর্ঘ ২০-২২ বছর সকালের অনুষ্ঠানটি চারুকলার বকুলতলা থেকে সরাসরি সম্প্রচার করেছে। এছাড়াও বাংলাদেশের প্রিন্ট মিডিয়ার প্রায় সকল সাংবাদিক বন্ধুরা এ উৎসবের প্রচারকে অন্যমাত্রায় নিয়ে গিয়েছেন। শুরু হবার পর গত বছর যাবত এ উৎসবের পরিধি আরও অনেক বড় করা হয়েছে। এখন উত্তরার ৩নং সেক্টর, কাবাব ফ্যাক্টরির সাথে উন্মুক্ত মঞ্চ, ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর ও পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ্ পার্ক এবং দুই বেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায় এ উৎসব পালিত হয়ে আসছে।
[লেখক: সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্যাপন পরিষৎ]
মানজার চৌধুরী সুইট
রোববার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। আজ পহেলা ফাল্গুন, ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত। ঋতুর আবর্তনে বারে-বারেই আমাদের মাঝে ঋতুরাজ বসন্ত ফিরে আসে এই নাগরিক জীবনে। এ দিন সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় বসন্ত আবাহনের মহোৎসব। নৃত্য-সঙ্গীত আবৃত্তিতে, প্রীতিবন্ধনী আর আবিরের রঙে সবার সঙ্গে মিলনের এ উৎসব চলবে সারাদিন। নাগরিক জীবনে উৎসবে শুরুর আনুষ্ঠানিক বিষয় বিস্তারিত জানাবার আগে প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানোর মতো উৎসবের প্রারম্ভ বিষয়ে কিছু জ্ঞাতব্য বিষয় বিনীতভাবে জানাতে চাই।
বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, মূলত বাংলাভাষাভাষী মানুষদের শিকড়ে ফেরার কাল। এর সূত্রপাত হয় বাংলা ভাষার বদলে উর্দু ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে। এ দেশের মানুষ বুঝতে পারল- মধ্যপ্রাচ্য আরব তুরান, নয় এই উপমহাদেশই- বাংলাই তার আপন মাতৃভূমি, যার আছে হাজার বছরের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা। এরপর পাকিস্তান সরকার যখন রবীন্দ্রনাথকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো, তখন আমাদের যেন অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন হলো শুরু, এ দেশের সংবদেনশীল মানুষ তীব্র প্রতিবাদ করে এবং রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করেই সংস্কৃতির সংগ্রামের ভেতর দিয়ে আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনেরও শুরু হলো এবং ক্রমশ আরও এগিয়ে গেল। নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, দেশীয় নানা উৎসব পালনের মাধ্যমে শুরু হলো আপনভূবনে ফেরার পালা। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন জন্মও হলো সেই সন্ধিক্ষণে যাদের মধ্যে প্রধান ছায়ানট, বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতির রক্ষা ও প্রচলনে তারা নিল অগ্রপথিকের ভূমিকা। বাংলা নববর্ষ পালনের সাথে তারা বাংলার অন্যান্য সাংস্কৃতিক ধারাকেও সামনে নিয়ে এলো- শারদোৎসব, বসন্ত উৎসব পালনেরও শুরু তখন।
নববর্ষ পালনের সার্বজনীন একটি ধারা থাকলেও বসন্ত উৎসব পালনের সার্বজনীন কোন ধারা ছিল না- এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের শান্তি নিকেতনে বসন্ত উৎসব কেই দৃষ্টান্ত হিসেবে নেয়া হলো। কেবল একটি বিষয় ছাড়া উৎসবের তারিখ। এ ব্যপারে ছায়ানটের সন্জীদা খাতুন বলেন ‘ঢাকা প্রথম বসন্ত উৎসব করা হয় কোন বিশেষ দিন মনে করে নয়, ফালগুনের কোন এক ছুটির দিনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটি বাসার গ্যারেজের সামনে সাদা চাদর টাঙিয়ে, তার উপর লতা পাতা ফুল দিয়ে মঞ্চ, নির্বাচিত কিছু গান কবিতা ও নৃত্য পরিবেশনার মাধ্যমে। অনুষ্ঠান শেষে সবাই ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি দান- যে এই গানটি গাইতে গাইতে সবাই পাশের একটি পুকুরের চারপাশ প্রদক্ষিণ করে। সেই সময়ে এটি ছিল একটি অভিনব প্রয়াস। পরে এইটে বসন্তের শোভাযাত্রা হিসেবে পালন করা হয়।’
শান্তি নিকেতনের ‘বসন্ত উৎসবে’ সনাতন ধর্মীয় অনুষঙ্গটি বাদ গেলেও পালিত হত দোল উৎসবের একই দিনে; কিন্তু এখানে এটি পালন করা হতো ফাল্গুনের কোন ছুটির দিনে। দোলের দিনে উৎসব না করার কারন মূলত যে তখনকার পাকিস্তান সরকার এটিকেও যেন হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি বলে নিষিদ্ধ করার সুযোগ না পায়। সে অনুষ্ঠানে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা, বিশেষ করে মেয়েরা সবাই হলুদ শাড়ি পরতো এবং কোথাও একত্রে বসে বসন্তের উপর গান কবিতা, নাচ পরিবেশন করে পালন করতো। অন্য কোথাও পালন না করা হলেও হলুদ শাড়ি পরে, মাথায় হলুদ ফুল লাগিয়ে ফাল্গুনের প্রথম দিনে ঘরের বাইরে ফাগুনের প্রথম দিনটি পালনেরও শুরুও হয় সম্ভবত তখনই।
পহেলা ফাল্গুন কবে কখন হলুদ শাড়ি পরে তরুণ-তরুণীরা ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল এর সঠিক ইতিহাস বের করা বেশ দূরূহ। নবপর্যায়ে বসন্ত উৎসবকে কেবল সংস্কৃতিমনা ও ছাত্র-ছাত্রীদের নিজস্ব অঙ্গন থেকে বের করে সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে দেবার কৃতিত্ব অবশ্য ‘জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ’-এর। সাংস্কৃতিক কর্মীদের উদ্যোগে এবং ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও এ দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় সঙ্গীত গুরু ও সংগঠক ওয়াহিদুল হকের সার্বিক তত্ত্বাবধানে দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান’কে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় ‘জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ’। সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের বরেণ্য ব্যক্তিত্বদের উপদেষ্টা করে, বিভিন্ন সঙ্গীত ও নৃত্য বিদ্যালয়, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে যোগাযোগ করে এবং তাদের সবার অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে চারুকলার বকুলতলায় ১৪০১ বঙ্গাব্দে প্রথম পালিত হয় বসন্ত উৎসব। তখনই ঠিক করা হয় প্রতিবছর বাংলাবর্ষের ফাল্গুন মাসের প্রথম দিন বসন্ত উৎসব পালিত হবে। সেই উৎসবের আহ্বান ছিল- ‘এসো মিলি প্রাণের উৎসবে’। সেবার অংশ নিয়েছিল ছায়ানট, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা পরিচালিত সুরের ধারা, কলিম শরাফী পরিচালিত সঙ্গীত ভবন, ওয়াহিদুল হক পরিচালিত আনন্দধ্বনি, উদীচী ও খেলাঘর।
বসন্ত উৎসবে কবি শামসুর রাহমান সবাইকে আহ্বান জানালেন- ‘সমাজ ভিতরে বাহিরে যত দীন হচ্ছে, মানুষও জীবনে মননে ততই হতশ্রী হচ্ছে। বর্ষা বসন্তে তবু মানুষ বিমনা হয়, অজান্তে উৎফুল্ল হয়। কেউ হয়তো বিচ্ছিন্নভাবে বাসন্তি রঙ বসনও তুলে নেয়। কিন্তু সকলে মিলে বসন্ত বরণ হয়না। সকলের মিলবার এবং মেলাবার এই প্রাণময় ক্ষেত্রটি আমরা করতে চাইছি। প্রকৃতির সুরে, রঙে আমাদের এক করে নিতে পহেলা ফালগুনে আমরা উৎসবে একত্র হব। আপনি আসুন, আসুন সকলে আপনারা মিলে। বসন্ত উৎসব তারুণ্যেরই উৎসব। তরুণ-তরুণীরা এসো, সকল তরুণ প্রাণ মানুষ এসো-এসো প্রফুল্ল শিশু কিশোরেরা।’ এরপর থেকেই এটি নিয়মিতভাবে পালিত হয়ে আসছে।
১৯৯৪ বঙ্গাব্দ ১৪০১ বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে নাগরিক জীবনে শুরু হলো বসন্ত উৎসব-১৪০১। ‘এসো মিলি প্রাণের উৎসবে’ এ সেøাগান নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার মনমুগ্ধকর বৃক্ষরাজির মধ্যে অপূর্ব এক অনুষ্ঠান ‘বসন্ত উৎসব’। এ ব্যাপারে ভাবনাটি প্রথম নিয়ে আসেন এক সময়কার প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক স্থপতি সফিউদ্দিন আহমেদ। তখন তিনি কাজ করতেন জনকন্ঠ ভবনে। গ্লোব নিবাস রিয়েল এস্টেটের স্থপতি হিসেবে তার দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় ১৯৯৪ সালে আরও কিছু সতীর্থদের নিয়ে এ যাত্রা শুরু হয়। প্রথমদিকে জনকন্ঠ পত্রিকার মালিক আতিকুল্লাহ মাসুদ যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। এ দিনে জনকন্ঠ পত্রিকায় বসন্তের একটি বিশেষ পাতাও বের হয়, যদিও পরে সে ধারাবাহিকতা ধরে রাখা যায়নি। তার কাছে আর্থিক সহায়তাও পেয়েছি আমরা। ওয়াহিদ ভাই যুক্ত হওয়ায় এ উৎসব আয়োজনের সার্থকতা আরও অনেক বেড়ে যায়। ওয়াহিদ ভাই এ উৎসবের সাথে আরও যুক্ত করেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি শামছুর রহমান, আবৃত্তি শিল্পী কাজী আরিফ ও রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী মিতা হককে। শুরুর সময়ে আরেক স্থপতি কবি রবিউল হুসাইন অনেক সহযোগিতা করেছেন। বিশেষ করে তিনি অটোবি প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত আমাদের এ আয়োজনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে দিতেন। এ উৎসব প্রতি বছর আয়োজনের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবার প্রিয় অনুষ্ঠান হয়ে দাঁড়ালো। যদিও তখন বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী কখনো বারো কখনো তের তারিখে ১ ফাল্গুন পালিত হতো। বাংলা একাডেমি কর্তৃক ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লা প্রণিত বাংলা পঞ্জিকা চালু করার পরে দীর্ঘকাল ১৩ ফেব্রুয়ারি এ উৎসব পালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে আরেক দফা বাংলা পঞ্জিকা পরিবর্তনের কারণে ১৪ ফেব্রুয়ারি ১ ফাল্গুন নির্দিষ্ট হয়েছে। শুরুর সময়ে সংগঠনগতভাবে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ও ছায়ানট-এর ব্যাপক সহযোগিতা পাওয়া গেছে। প্রথমদিকে বসন্ত উৎসবের একটি উদ্বোধনী সঙ্গীত ছিলো। যে সঙ্গীতটি তৎকালীন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ সেলিম বহু বছর সত্যজিৎ রায়ের ‘আহা কি আনন্দ আকাশে-বাতাসে’ দর্শকদের মাঝখান থেকে গেয়ে মাতিয়ে রাখতেন।
ছায়ানটের সকালের বৈশাখী অনুষ্ঠান আয়োজনের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের প্রথম বসন্ত উৎসব সকালে আয়োজনের ধারাবাহিকতা শুরু করে। আবার ১৪০১ বঙ্গাব্দের পরে আরও অনেকগুলো ঋতু উৎসব প্রতিবছর নিয়মিত পালিত হয়ে আসছে। এ উৎসবগুলো বসন্ত উৎসবের ধারাবাহিকতা থেকেই শুরু হয়। যেমন- পৌষমেলা, নবান্ন উৎসব, শরৎ উৎসব ও বর্ষা উৎসব তথা আষাঢ়স্য প্রথম দিবস।
বসন্ত উৎসব অসংখ্য মানুষের সহযোগিতা ও ভালবাসায় জাতীয় অনুষ্ঠান হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায় এবং সারাদেশে এর দোলা ছড়িয়ে পড়ে। ওয়াহেদ ভাই এটাই চাইতেন ‘আমরাই শুধু এ উৎসবের আয়োজন করবো না, সারাদেশেই নিজেদের মতো করে এ উৎসব পালিত হবে।’ বিশেষ করে যখন ইলেকট্রনিক মিডিয়া বিটিভি ছিল এরপরে অনেকগুলো প্রাইভেট চ্যানেল চালু হলো তার মধ্যে চ্যানেল আই প্রায় দীর্ঘ ২০-২২ বছর সকালের অনুষ্ঠানটি চারুকলার বকুলতলা থেকে সরাসরি সম্প্রচার করেছে। এছাড়াও বাংলাদেশের প্রিন্ট মিডিয়ার প্রায় সকল সাংবাদিক বন্ধুরা এ উৎসবের প্রচারকে অন্যমাত্রায় নিয়ে গিয়েছেন। শুরু হবার পর গত বছর যাবত এ উৎসবের পরিধি আরও অনেক বড় করা হয়েছে। এখন উত্তরার ৩নং সেক্টর, কাবাব ফ্যাক্টরির সাথে উন্মুক্ত মঞ্চ, ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর ও পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ্ পার্ক এবং দুই বেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায় এ উৎসব পালিত হয়ে আসছে।
[লেখক: সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্যাপন পরিষৎ]