গাজী তারেক আজিজ
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে দেশের মানুষের সন্তুষ্ট থাকার সঙ্গত কোন কারণ নেই। ঢাকার অলিগলি এখন সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই রাহাজানির মতো রোমহষর্ক ঘটনাবলি। তার ওপর আবার যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের মতো ঘটনা জনমনে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট করেছে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, দেশে কি আদৌ কোন সরকার আছে? যদি থেকে থাকে তবে তার কাজইবা কী? দেশের কতিপয় সুশীল বুদ্ধিজীবী সব সময় চিবিয়ে কথা বললেও এখনকার সময়ে বেশ সাবলীল হয়ে বলছেন, ‘বিপ্লবোত্তর যে কোন দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়া স্বাভাবিক ঘটনা!’
সেই সব বুদ্ধিজীবীদের প্রতি বিনয়ের সহিত প্রশ্ন রাখতে চাই, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি তথা স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে কি জনগণকেই আবার মাঠে নামতে হবে? এবার বোধ করি, এই ত্রাসের একচেটিয়া রাজত্বের এখনই লাগাম টানতে হবে। না হলে মানুষের মনে যে পুঞ্জিভূত ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে তার বহিঃপ্রকাশ আরও কোন চরমভাবে ঘটতে পারে। কারণ যে কোন কারণ ছাড়াই আক্রান্ত হবে, সে-ও নিশ্চয়ই তার নিজের নিরাপত্তার জন্য কোন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দিকে চেয়ে থাকার সঙ্গত কোন কারণ না-ও দেখতে পারে। জানি না কীভাবে সরকার এতটা চুপ বা নির্বিকার থাকতে পারে! যদিও সরকার থেকে বলা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে! এই কথা কোন সুস্থ বোধ সম্পন্ন মানুষ বিশ্বাস করার যৌক্তিক কোন কারণও দেখছি না। সারাদেশে চলমান অপারেশন ডেভিল হান্ট কার্যক্রমের মধ্যেই লাগাতার অপরাধ পরিক্রমা সাধারণ নাগরিকদের কতটা অসহায় করে তুলেছে সেটা বলে কয়ে দিতে হয় না। রাস্তায় চলাচলরত মানুষের চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট! আর সরকার দায় সারে বিবৃতি দিয়ে! এভাবে আর কত? আর কত প্রাণ ঝরলে বোধদয় হবে আমাদের? অপারেশন ডেভিল হান্ট নামক সন্ত্রাস দমনে যৌথ বাহিনীর অভিযানও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। দেশে আইন আছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট বাহিনী মাঠে আছে। তারপরও পরিস্থিতির কেন উন্নতি হচ্ছে না? জনমনে কেন স্বস্তি ফিরছে না? রোববার মধ্যরাতে রামপুরা বনশ্রী এলাকায় একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী তারই বাসার সামনে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হন। সঙ্গে থাকা ২শ ভরি স্বর্ণ ও নগদ দেড় লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়, যা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ফলশ্রুতিতে কী দাঁড়াল? আমরা দেখতে পেলাম অপরাধী চক্রের দৌরাত্ম্যে একজন ব্যবসায়ী নিঃস্ব তো হলেনই উপরন্তু জীবন বিসর্জনের পথে! রাত ৩টার দিকে হাজারীবাগে ডাকাতির খবর পাওয়া গেছে।
এই পরিস্থিতি যেন গোটা দেশের চিত্র! কোনটা আলোচনায় আসে, আর অন্যটা আসে না। বলেই ধামাচাপা পড়ে যায়। মানুষ এখন ওপেন আকুতি জানিয়ে সেনাশাসন আহ্বান করছে! একটা বিষয় মানুষকেও বুঝতে হবে সেনাবাহিনী মেজিস্ট্রেসি পাওয়ার নিয়েই মাঠে আছে। কার্যত কি হচ্ছে? কতটুকু হচ্ছে? আদতে মানুষ একটা বিষয়ই চাইছে, স্বস্তি! গত ৫ আগস্ট থেকে এই পর্যন্ত বিচারবর্হিভূত হত্যা। আগুন দিয়ে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া প্রত্যক্ষ করেছে, যা দেখে মানুষ স্তম্ভিত হয়েছে। যার থেকে উত্তরণ ঘটানো হয়তো অনেক সময়সাপেক্ষ। আর জুলাই থেকে অভ্যুত্থান চলাকালীন সময়ে ছাত্র-জনতা হত্যার ভিডিও স্থিরচিত্র সব মিলিয়ে মানুষ কতদিন পর স্বাভাবিক হবে, তা অনিশ্চিত! এরই মধ্যে অনেকটা অপ্রত্যাশিত স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সাংবাদিক সম্মেলন, যা রাত ৩টার পর অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিনি গতানুগতিক ধারায় তার ব্রিফিং করেছেন। আর তার পদত্যাগ চেয়ে মধ্যরাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মিছিল করতেও দেখা গেছে। মিছিল থেকে তাকে সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে পরদিন দুপুর পর্যন্ত। যদিও এ-সংক্রান্তে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারলে তো আর পদত্যাগের দরকার পড়ছে না। সাধারণ নাগরিকরা কি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মহোদয়ের এমনতর আশ্বাসে আস্থা রাখতে পারছেন? যদি আস্থার সংকট থেকে থাকে তবে সমাধান কোন পথে? যদিও অন্তর্বর্তী সরকার তথাপিও ধরে নেয়া হচ্ছে সেনাসমর্থিত। তাহলে সেনাবাহিনী প্রধান কি এসব দেখেও দেখছেন না? দেখে থাকলে এতটা ভাবলেশহীন হয় কি করে! তিনি গত ৫ আগস্ট মানুষের জানমালের হেফাজতে তার ওপর আস্থা রাখতে বলেছেন! তারপর থেকে আমরা যা দেখছি রীতিমতো শিউরে ওঠার মতো অবস্থা। আমাদের এখনো বিশ্বাস করতে হচ্ছে দেশে আইন আছে।
আইনের হেফাজতকারী আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আছে। তার মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে সচেষ্ট! এই যখন দেশের অবস্থা। একটা টালমাটাল পরিস্থিতি উতরিয়ে আমরা আর কতদিনে স্বাভাবিক হবো? অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কিংবা জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং জামায়াত ও বিচ্ছিন্ন কিছু দল নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মতবিনিময় করে অবস্থান স্পষ্ট করলেও জট কিংবা নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি। কারণ সবাই যেখানে সংস্কার দাবিতে সোচ্চার সেখানে বিএনপি নির্বাচন দাবিতে চাপ সৃষ্টি করে আসছে। দলটির দাবি দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হলে নির্বাচিত সরকারের বিকল্প নেই। আর অন্যদিন জামায়াতও তাদের প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করতে শুরু করেছে। যদিও দলটি এত তড়িঘড়ি নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে নয়! তারা সংস্কার দাবি যতটুকু করছে। আবার ক্ষণে ক্ষণে নির্বাচন দাবিও করে আসছে। দলটির একেক পর্যায়ের নেতৃত্ব থেকে একেক সময় একেক ধরনের দাবি চাউর হতে শুরু করায় সাধারণ জনগণ কিছুটা হলেও দ্বিধান্বিত! তার ওপর দলটি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে বেশ শক্তপোক্ত অবস্থান নিয়ে মাঠে বিএনপির সঙ্গে বেশ ভালোই টক্কর দিতে দেখা যাচ্ছে। অবশ্য নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে নিশ্চুপ! তারা চাইছে সরকার যেভাবে নির্দেশনা দিবে ঠিক সেভাবেই করতে চায়।
এদিকে জাতীয় নাগরিক কমিটি কর্তৃক রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়টি আলোচনায় এলে বিএনপি তথাকথিত কিংস পার্টি গঠনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে সাফ জানিয়ে দিয়েছে সরকারে থেকে রাজনৈতিক দল গঠন জনগণ ভালোভাবে নিবে না। এই বার্তার মধ্যে দিয়ে মূলত নিজেদের মতামতের প্রতিফলন ঘটিয়েছে। দেখা যাক মানুষকে প্রত্যাশা বাণী শুনিয়ে কতটুকু সফলকাম হতে পারেন নতুন রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব। সবকিছু সময়ের হাতেই তোলা থাকুক। বিএনপি যতটা না রাজনীতি করে তার কমই বোঝে বলেও মনে করার কারণ অনুসন্ধান করা অতিশয় উক্তি হওয়ার কারণ নয়। যদিও তারা ধরে নিয়েছিল পটপরিবর্তন তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। আদতে তেমন কোন লক্ষণই পরিলক্ষিত হতে দেখা যাচ্ছে না। যতই দিন গড়াচ্ছে, ততই দলটি বিচ্যুত হতে হতে মূল ট্র্যাক থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে বলেও বোদ্ধা মহলের ধারণা। দলটি মুখে যত যা-ই বলুক কার্যত স্বস্তিতে নেই তার নেতারা। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের প্রত্যাশার মাত্রা অনুযায়ী চাপ সামলাতেও হিমশিম খেতে দেখা যাচ্ছে। কর্মীদের যে আশা দেখিয়ে রাজনীতিতে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো নিজেদের অনুগত করে রাখার প্রচেষ্টা এই মুহূর্তে ঠিক কোন কাজেই আসছে বলেও মনে হচ্ছে না। দলীয় হাইকমান্ড প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছে শৃঙ্খলা নামক শব্দটি মেনে চলতে। কিন্তু এক্ষেত্রে কর্মীদের মনোভাব অনেকটাই চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনীর মতো। অভিযোগ পেলে শীর্ষ নেতার স্বাক্ষরিত আদেশে বহিষ্কারের খড়্গ কি তাদের দমিয়ে রাখতে পেরেছে? তাহলে তাদের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা কতটুকু প্রতিফলন ঘটবে? সে প্রশ্নটিও তোলা রইল ভবিষ্যতের খাতায়। ক্ষমতায় কে আসবে তা নয়, জনগণ স্বস্তি চায়। নিজ জীবনের নিরাপত্তা চায়। অধিকন্তু, বিএনপি মাঠের রাজনীতিতে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যে হারে মামলাবাজি ও বাণিজ্য করে কিছু মানুষকে নিঃস্ব করে চলেছে নিরন্তর তার থেকে উত্তরণ ঘটানো কিংবা প্রতিকার পেতে করণীয় কী সেটা যদি জনগণ নির্ধারণ করে তাহলে ওই জনগণই সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
তারপর যারা মামলা বাণিজ্য করে চলেছেন তাদের পরিণতি কী হতে পারে ভাবা যেতে পারে, যা ৫ আগস্ট থেকে শিক্ষা নেয়ার আছে। যদি সেই পুরনো পথের পথিক হয়ে থাকে দলটির কর্মীরা তাহলে আর যা-ই হোক সহসাই ক্ষমতার পালাবদলের রায় তাদের পক্ষে যাওয়ার কোন কারণও দেখছি না। এমনও দেখা গেছে জাস্ট ব্যক্তিগত কিংবা প্রফেশনাল জেলাসি থেকে মামলায় আসামি শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে বিজ্ঞ অ্যাডভোকেটদেরও। যেখানে একজন আইনজ্ঞ আইন পেশার মতো জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে থেকেও নিজেকে অনিরাপদ বোধ করার কারণ হয়েছেন সেই দলটি কিংবা তাদের মতো আর যে দলই আছে মানুষ তাদের গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়! অন্যদিকে সরকার-সংশ্লিষ্ট সবাই বলছেন, ঢালাও মামলায় যেনতেন গ্রেপ্তার নয়। তারপরও আদালত কিংবা পেশাগত কোন স্থানেও নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়ে স্বয়ং আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল নিজেও ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে। মিডিয়ার বরাতে আমাদের তা-ও দেখতে হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা তো বলেছেনই দায়িত্ব গ্রহণকালীন সময় থেকে বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক উন্নত হয়েছে! বারবার উচ্চারণের ফলে একসময় মানুষও ভাবতে শুরু করবে হ্যাঁ আমরা ভালো আছি। বাকিটা নিয়তি! পরিশেষে সাধারণ মানুষ ওইসব রাজনৈতিক জটাজাল কিংবা ঘোরপ্যাঁচ বুঝে না। বুঝতেও চায় না। নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা চেয়ে সরকারের কাছে আর কীভাবে আর্জি জানালে নিরাপত্তা পাওয়া যায়? আমরা ক্রমেই গুম, খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি ও ধর্ষণের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না। আমরা চাই না সরকার ব্যর্থ হোক।
[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]
গাজী তারেক আজিজ
শনিবার, ০১ মার্চ ২০২৫
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে দেশের মানুষের সন্তুষ্ট থাকার সঙ্গত কোন কারণ নেই। ঢাকার অলিগলি এখন সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই রাহাজানির মতো রোমহষর্ক ঘটনাবলি। তার ওপর আবার যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের মতো ঘটনা জনমনে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট করেছে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, দেশে কি আদৌ কোন সরকার আছে? যদি থেকে থাকে তবে তার কাজইবা কী? দেশের কতিপয় সুশীল বুদ্ধিজীবী সব সময় চিবিয়ে কথা বললেও এখনকার সময়ে বেশ সাবলীল হয়ে বলছেন, ‘বিপ্লবোত্তর যে কোন দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়া স্বাভাবিক ঘটনা!’
সেই সব বুদ্ধিজীবীদের প্রতি বিনয়ের সহিত প্রশ্ন রাখতে চাই, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি তথা স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে কি জনগণকেই আবার মাঠে নামতে হবে? এবার বোধ করি, এই ত্রাসের একচেটিয়া রাজত্বের এখনই লাগাম টানতে হবে। না হলে মানুষের মনে যে পুঞ্জিভূত ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে তার বহিঃপ্রকাশ আরও কোন চরমভাবে ঘটতে পারে। কারণ যে কোন কারণ ছাড়াই আক্রান্ত হবে, সে-ও নিশ্চয়ই তার নিজের নিরাপত্তার জন্য কোন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দিকে চেয়ে থাকার সঙ্গত কোন কারণ না-ও দেখতে পারে। জানি না কীভাবে সরকার এতটা চুপ বা নির্বিকার থাকতে পারে! যদিও সরকার থেকে বলা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে! এই কথা কোন সুস্থ বোধ সম্পন্ন মানুষ বিশ্বাস করার যৌক্তিক কোন কারণও দেখছি না। সারাদেশে চলমান অপারেশন ডেভিল হান্ট কার্যক্রমের মধ্যেই লাগাতার অপরাধ পরিক্রমা সাধারণ নাগরিকদের কতটা অসহায় করে তুলেছে সেটা বলে কয়ে দিতে হয় না। রাস্তায় চলাচলরত মানুষের চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট! আর সরকার দায় সারে বিবৃতি দিয়ে! এভাবে আর কত? আর কত প্রাণ ঝরলে বোধদয় হবে আমাদের? অপারেশন ডেভিল হান্ট নামক সন্ত্রাস দমনে যৌথ বাহিনীর অভিযানও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। দেশে আইন আছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট বাহিনী মাঠে আছে। তারপরও পরিস্থিতির কেন উন্নতি হচ্ছে না? জনমনে কেন স্বস্তি ফিরছে না? রোববার মধ্যরাতে রামপুরা বনশ্রী এলাকায় একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী তারই বাসার সামনে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হন। সঙ্গে থাকা ২শ ভরি স্বর্ণ ও নগদ দেড় লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়, যা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ফলশ্রুতিতে কী দাঁড়াল? আমরা দেখতে পেলাম অপরাধী চক্রের দৌরাত্ম্যে একজন ব্যবসায়ী নিঃস্ব তো হলেনই উপরন্তু জীবন বিসর্জনের পথে! রাত ৩টার দিকে হাজারীবাগে ডাকাতির খবর পাওয়া গেছে।
এই পরিস্থিতি যেন গোটা দেশের চিত্র! কোনটা আলোচনায় আসে, আর অন্যটা আসে না। বলেই ধামাচাপা পড়ে যায়। মানুষ এখন ওপেন আকুতি জানিয়ে সেনাশাসন আহ্বান করছে! একটা বিষয় মানুষকেও বুঝতে হবে সেনাবাহিনী মেজিস্ট্রেসি পাওয়ার নিয়েই মাঠে আছে। কার্যত কি হচ্ছে? কতটুকু হচ্ছে? আদতে মানুষ একটা বিষয়ই চাইছে, স্বস্তি! গত ৫ আগস্ট থেকে এই পর্যন্ত বিচারবর্হিভূত হত্যা। আগুন দিয়ে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া প্রত্যক্ষ করেছে, যা দেখে মানুষ স্তম্ভিত হয়েছে। যার থেকে উত্তরণ ঘটানো হয়তো অনেক সময়সাপেক্ষ। আর জুলাই থেকে অভ্যুত্থান চলাকালীন সময়ে ছাত্র-জনতা হত্যার ভিডিও স্থিরচিত্র সব মিলিয়ে মানুষ কতদিন পর স্বাভাবিক হবে, তা অনিশ্চিত! এরই মধ্যে অনেকটা অপ্রত্যাশিত স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সাংবাদিক সম্মেলন, যা রাত ৩টার পর অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিনি গতানুগতিক ধারায় তার ব্রিফিং করেছেন। আর তার পদত্যাগ চেয়ে মধ্যরাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মিছিল করতেও দেখা গেছে। মিছিল থেকে তাকে সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে পরদিন দুপুর পর্যন্ত। যদিও এ-সংক্রান্তে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারলে তো আর পদত্যাগের দরকার পড়ছে না। সাধারণ নাগরিকরা কি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মহোদয়ের এমনতর আশ্বাসে আস্থা রাখতে পারছেন? যদি আস্থার সংকট থেকে থাকে তবে সমাধান কোন পথে? যদিও অন্তর্বর্তী সরকার তথাপিও ধরে নেয়া হচ্ছে সেনাসমর্থিত। তাহলে সেনাবাহিনী প্রধান কি এসব দেখেও দেখছেন না? দেখে থাকলে এতটা ভাবলেশহীন হয় কি করে! তিনি গত ৫ আগস্ট মানুষের জানমালের হেফাজতে তার ওপর আস্থা রাখতে বলেছেন! তারপর থেকে আমরা যা দেখছি রীতিমতো শিউরে ওঠার মতো অবস্থা। আমাদের এখনো বিশ্বাস করতে হচ্ছে দেশে আইন আছে।
আইনের হেফাজতকারী আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আছে। তার মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে সচেষ্ট! এই যখন দেশের অবস্থা। একটা টালমাটাল পরিস্থিতি উতরিয়ে আমরা আর কতদিনে স্বাভাবিক হবো? অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কিংবা জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং জামায়াত ও বিচ্ছিন্ন কিছু দল নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মতবিনিময় করে অবস্থান স্পষ্ট করলেও জট কিংবা নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি। কারণ সবাই যেখানে সংস্কার দাবিতে সোচ্চার সেখানে বিএনপি নির্বাচন দাবিতে চাপ সৃষ্টি করে আসছে। দলটির দাবি দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হলে নির্বাচিত সরকারের বিকল্প নেই। আর অন্যদিন জামায়াতও তাদের প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করতে শুরু করেছে। যদিও দলটি এত তড়িঘড়ি নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে নয়! তারা সংস্কার দাবি যতটুকু করছে। আবার ক্ষণে ক্ষণে নির্বাচন দাবিও করে আসছে। দলটির একেক পর্যায়ের নেতৃত্ব থেকে একেক সময় একেক ধরনের দাবি চাউর হতে শুরু করায় সাধারণ জনগণ কিছুটা হলেও দ্বিধান্বিত! তার ওপর দলটি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে বেশ শক্তপোক্ত অবস্থান নিয়ে মাঠে বিএনপির সঙ্গে বেশ ভালোই টক্কর দিতে দেখা যাচ্ছে। অবশ্য নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে নিশ্চুপ! তারা চাইছে সরকার যেভাবে নির্দেশনা দিবে ঠিক সেভাবেই করতে চায়।
এদিকে জাতীয় নাগরিক কমিটি কর্তৃক রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়টি আলোচনায় এলে বিএনপি তথাকথিত কিংস পার্টি গঠনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে সাফ জানিয়ে দিয়েছে সরকারে থেকে রাজনৈতিক দল গঠন জনগণ ভালোভাবে নিবে না। এই বার্তার মধ্যে দিয়ে মূলত নিজেদের মতামতের প্রতিফলন ঘটিয়েছে। দেখা যাক মানুষকে প্রত্যাশা বাণী শুনিয়ে কতটুকু সফলকাম হতে পারেন নতুন রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব। সবকিছু সময়ের হাতেই তোলা থাকুক। বিএনপি যতটা না রাজনীতি করে তার কমই বোঝে বলেও মনে করার কারণ অনুসন্ধান করা অতিশয় উক্তি হওয়ার কারণ নয়। যদিও তারা ধরে নিয়েছিল পটপরিবর্তন তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। আদতে তেমন কোন লক্ষণই পরিলক্ষিত হতে দেখা যাচ্ছে না। যতই দিন গড়াচ্ছে, ততই দলটি বিচ্যুত হতে হতে মূল ট্র্যাক থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে বলেও বোদ্ধা মহলের ধারণা। দলটি মুখে যত যা-ই বলুক কার্যত স্বস্তিতে নেই তার নেতারা। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের প্রত্যাশার মাত্রা অনুযায়ী চাপ সামলাতেও হিমশিম খেতে দেখা যাচ্ছে। কর্মীদের যে আশা দেখিয়ে রাজনীতিতে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো নিজেদের অনুগত করে রাখার প্রচেষ্টা এই মুহূর্তে ঠিক কোন কাজেই আসছে বলেও মনে হচ্ছে না। দলীয় হাইকমান্ড প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছে শৃঙ্খলা নামক শব্দটি মেনে চলতে। কিন্তু এক্ষেত্রে কর্মীদের মনোভাব অনেকটাই চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনীর মতো। অভিযোগ পেলে শীর্ষ নেতার স্বাক্ষরিত আদেশে বহিষ্কারের খড়্গ কি তাদের দমিয়ে রাখতে পেরেছে? তাহলে তাদের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা কতটুকু প্রতিফলন ঘটবে? সে প্রশ্নটিও তোলা রইল ভবিষ্যতের খাতায়। ক্ষমতায় কে আসবে তা নয়, জনগণ স্বস্তি চায়। নিজ জীবনের নিরাপত্তা চায়। অধিকন্তু, বিএনপি মাঠের রাজনীতিতে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যে হারে মামলাবাজি ও বাণিজ্য করে কিছু মানুষকে নিঃস্ব করে চলেছে নিরন্তর তার থেকে উত্তরণ ঘটানো কিংবা প্রতিকার পেতে করণীয় কী সেটা যদি জনগণ নির্ধারণ করে তাহলে ওই জনগণই সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
তারপর যারা মামলা বাণিজ্য করে চলেছেন তাদের পরিণতি কী হতে পারে ভাবা যেতে পারে, যা ৫ আগস্ট থেকে শিক্ষা নেয়ার আছে। যদি সেই পুরনো পথের পথিক হয়ে থাকে দলটির কর্মীরা তাহলে আর যা-ই হোক সহসাই ক্ষমতার পালাবদলের রায় তাদের পক্ষে যাওয়ার কোন কারণও দেখছি না। এমনও দেখা গেছে জাস্ট ব্যক্তিগত কিংবা প্রফেশনাল জেলাসি থেকে মামলায় আসামি শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে বিজ্ঞ অ্যাডভোকেটদেরও। যেখানে একজন আইনজ্ঞ আইন পেশার মতো জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে থেকেও নিজেকে অনিরাপদ বোধ করার কারণ হয়েছেন সেই দলটি কিংবা তাদের মতো আর যে দলই আছে মানুষ তাদের গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়! অন্যদিকে সরকার-সংশ্লিষ্ট সবাই বলছেন, ঢালাও মামলায় যেনতেন গ্রেপ্তার নয়। তারপরও আদালত কিংবা পেশাগত কোন স্থানেও নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়ে স্বয়ং আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল নিজেও ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে। মিডিয়ার বরাতে আমাদের তা-ও দেখতে হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা তো বলেছেনই দায়িত্ব গ্রহণকালীন সময় থেকে বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক উন্নত হয়েছে! বারবার উচ্চারণের ফলে একসময় মানুষও ভাবতে শুরু করবে হ্যাঁ আমরা ভালো আছি। বাকিটা নিয়তি! পরিশেষে সাধারণ মানুষ ওইসব রাজনৈতিক জটাজাল কিংবা ঘোরপ্যাঁচ বুঝে না। বুঝতেও চায় না। নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা চেয়ে সরকারের কাছে আর কীভাবে আর্জি জানালে নিরাপত্তা পাওয়া যায়? আমরা ক্রমেই গুম, খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি ও ধর্ষণের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না। আমরা চাই না সরকার ব্যর্থ হোক।
[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]