alt

উপ-সম্পাদকীয়

জনতুষ্টিবাদীরা এগিয়ে আছে যেদিক থেকে

রুশাইদ আহমেদ

: বৃহস্পতিবার, ০৬ মার্চ ২০২৫

বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে বিশ্ব রাজনীতিতে অভিষিক্ত হয় জনতুষ্টিবাদ তথা লোকরঞ্জনবাদ। এর ফলে কোনো একক মতাদর্শের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে নানা ইস্যুতে রাজনীতিবিদদের এজেন্ডা নির্ধারণ, বাকযুদ্ধ, প্রচারণা এবং জাতীয়তাবাদের ধুয়ো।

১৯২০ থেকে ১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপে এ ধারণা পায় নতুন প্রাণ। জার্মানির এডলফ হিটলার ও ইতালির বেনিতো মুসোলিনির মতো একনায়কের হাত ধরে লোকরঞ্জনবাদ পৌঁছে যায় অনন্য উচ্চতায়। স্বয়ং হিটলারই নিজের আত্মজীবনীতে এ নিয়ে লিখেছিলেন- বাগাড়ম্বরতার মধ্য দিয়ে মানুষকে প্রভাবিত করা যতা সহজ, অন্য কোনো উপায়ে তা সম্ভব নয়।

নানা ইস্যুতে বাগাড়ম্বর বয়ান উপস্থাপনের কৌশল জনতুষ্টিবাদীদের প্রধানতম হাতিয়ার হলেও নানা ধরনের কট্টর সিদ্ধান্ত ও অঙ্গীকার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেশকিছু দিক থেকে উদারবাদী অর্থাৎ লিবারেলদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন জনতুষ্টিবাদীরা। এডলফ হিটলার ও বেনিতো মুসোলিনি থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভিক্টর অরবান কিংবা নরেন্দ্র মোদির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করলে এই সত্যই আমাদের সামনে এসে ধরা দেবে।

উচ্চাকাক্সক্ষী প্রতিশ্রুতি পালনে আগ্রাসী

জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিবিদরা সর্বদাই উচ্চাকাক্সক্ষী প্রতিশ্রুতি দেওয়ার প্রবণতা লালন করে থাকেন। এর মধ্য দিয়ে তারা জনগণকে দেখাতে চানÑ নিজেদের অবস্থানে তারা কতা দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। এক্ষেত্রে তাদের ভাষ্যে সাধারণত স্থান পায় জাতীয়তাবাদের প্রতিধ্বনি। তাই ক্ষমতায় আরোহণের পর হিটলার যেমন করে জার্মান জাতির বিশুদ্ধতার কথা সবসময় উচ্চারণ করতেন, একইভাবে দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পও মার্কিনীদের রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন অবৈধ অভিবাসন কঠোরভাবে দমন করার।

এ লক্ষ্যে দ্বিতীয়বার হোয়াইট হাউসে প্রবেশের একদিনের মাথায় ‘প্রোটেকটিং দ্য মিনিং অ্যান্ড ভ্যালু অব আমেরিকান সিটিজেনশিপ’ শীর্ষক নির্বাহী আদেশে ২০২৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারির পর যুক্তরাষ্ট্রে জন্মানো বাইরের দেশের শিশুদের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব প্রদানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন তিনি।

এ উদাহরণের মতো বিশ্বের সব জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিবিদই তাদের প্রতিশ্রুতি পালনে আগ্রাসী মনোভাব পোষণ করে থাকেন। কেননা এটি শুধু তাদের অঙ্গীকার পালনের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগত ইমেজ গড়ে তোলে না, বরং পরবর্তী ভোটযুদ্ধের রসদও উল্লেখযোগ্য হারে সম্প্রসারিত করে।

জাতীয় অর্থনীতির প্রতি গুরুত্বারোপ

বিশ্বজুড়ে সকল পপুলিস্ট রাজনৈতিক শক্তি আবহমানকাল ধরে জাতীয় অর্থনীতি এবং দেশজ উৎপাদনের ওপর গুরুত্বারোপ করে এসেছে। কারণ যা কিছুই ঘটে যাক না কেন, জনগণ যখন একটি দেশের অভ্যন্তরীণ অগ্রগতির নেপথ্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে দেখতে পায় তারা সেটিকে সাদরে গ্রহণ করে।

এ কারণেই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিরবচ্ছিন্ন অগ্রযাত্রার সুগঠিত বুলি নিয়ে হাজির হন জনতুষ্টিবাদীরা। জনগণকে দেশের অর্থনীতিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেখান তারা। আরোপ করেন নতুন নতুন খাতে কর। বৃদ্ধি করেন আমদানি শুল্ক।

উল্লেখ্য, এ পর্যায়ে সকল জনতুষ্টিবাদীদের প্রথম পছন্দ হয়ে দাঁড়ায় মুক্তবাজার অর্থনীতি। ২০১৯ সালে প্রস্তাবিত ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশ এবং মার্কোসুরভুক্ত লাতিন আমেরিকার মুক্তবাজার অর্থনীতির সমর্থক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার চুক্তির প্রতি ব্রাজিলের কট্টর ডানপন্থি সাবেক প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোর অকুণ্ঠ সমর্থন কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে কানাডা, মেক্সিকো ও চীন থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর ডোনাল্ড ট্রাম্পের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ সেটাই প্রমাণ করে।

মূল্যবোধের উচ্চকিত ঝা-া

জনতুষ্টিবাদীদের আরেকটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তারা নিজেদের নির্দিষ্ট কিছু মূল্যবোধের ধারক ও বাহক হিসেবে তুলে ধরেন। তাদের প্রচারাভিযান এবং নীতি-নির্ধারণে জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সুর অনুরণিত হয় বারবার।

তাই ভিক্টর অরবান হাঙ্গেরির ঐতিহ্য ও খ্রিস্টান মূল্যবোধ রক্ষার নামে অভিবাসনবিরোধী আইন প্রণয়ন করেছেন। প্রসার ঘটিয়েছেন দেশটিতে ইসলামোফোবিয়ার। হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে সামনে রেখে গরু হত্যা নিষিদ্ধকরণ থেকে শুরু করে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (ঈঅঅ) বাস্তবায়ন করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। একইভাবে ইভানজেলিক্যাল খ্রিস্টানদের কা-ারি হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন ট্রাম্প। আর ‘ব্রাজিল সবার ওপরে, ঈশ্বর সবার ওপরে’ সেøাগান নিয়ে মাদক ও সমকামিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে হাজির হয়েছেন বলসোনারো।

কারণ এ ধরনের নীতি গ্রহণ ও বুলি আওড়ানোর মধ্য দিয়ে জনগণের মধ্যে একধরনের নস্টালজিয়া বা অতীতমুখী আবেগ তৈরি করে তাদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়Ñ দেশ ও সমাজের অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনতে হলে এই মূল্যবোধগুলো রক্ষা করতেই হবে। আর এটিই সহায়তা করে জনতুষ্টিবাদীদের নির্দিষ্ট ভোটব্যাংককে সুসংহত করতে।

আমলাতন্ত্রের প্রতি অবিশ্বাস

জনতুষ্টিবাদীরা প্রায়শই আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তাদের মতে, আমলাতন্ত্র দুর্নীতিগ্রস্ত, জনবিচ্ছিন্ন এবং সময়ের অপচয়কারী। তাই তারা প্রশাসনিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করেন এবং আমলাতন্ত্রের পরিবর্তে সরাসরি জনগণের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা উচ্চারণ করেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে যখন তিনি প্রশাসনের নানা স্তরে পরিবর্তন এনে আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা খর্ব করেছিলেন তখন এই প্রবণতাই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল। একইভাবে, লাতিন আমেরিকার ‘ট্রাম্প’ বলে খ্যাত বলসোনারোও বারবার আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে মন্তব্য করে সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর কর্তৃত্ব ফলানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন ক্ষমতায় থাকতে।

আদতে এ ধরনের নীতির মাধ্যমে জনতুষ্টিবাদীরা জনগণের কাছে নিজেদের ‘সিস্টেমের বাইরের নেতা’ হিসেবে তুলে ধরে জনগণকে অনুভব করান যে, প্রচলিত রাজনৈতিক কাঠামোর বিরুদ্ধে তারা লড়ছেন। এর ফলে তাদের প্রতি জন্ম হয় সাধারণ জনগণের একধরনের সহানুভূতির।

জনতার আবেগের কার্যকর ব্যবহার

জনতুষ্টিবাদীরা জানেন, জনগণের আবেগ রাজনীতিতে কতা গুরুত্বপূর্ণ। তারা কৌশলে জনগণের অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে তাদের পক্ষে জনসমর্থন তৈরির চেষ্টা করেন এবং এটা এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছায় যে, তাদের একটা পাড় সমর্থকগোষ্ঠীও গড়ে ওঠে। ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের পরাজয়ের পর ক্যাপিটাল হিলের ঘটনা এক্ষেত্রে প্রণিধান করা যায়।

এর পাশাপাশি, চলমান সামাজিক বা অর্থনৈতিক সংকটের সময় জনতুষ্টিবাদীরা জনগণের ক্ষোভকে নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত করেন। ইউরোপের অভিবাসন সংকটের সময় ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও ঋষি সুনাকের মতো দক্ষিণপন্থি জনতুষ্টিবাদীরা অভিবাসীদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসন অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।

জনগণের আবেগকে কাজে লাগানোর এই ক্ষমতাই জনতুষ্টিবাদীদের সবচেয়ে বড় শক্তি। এই শক্তি ব্যবহার করেই তারা প্রতিপক্ষকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং জনগণকে বোঝান যে, তারা সেই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করছেন।

ফলে জনতুষ্টিবাদীরা রাজনৈতিকভাবে কতটা কার্যকর, তা তাদের উচ্চাকাক্সক্ষী প্রতিশ্রুতি, জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বারোপ, মূল্যবোধের প্রচার, আমলাতন্ত্রের প্রতি অবিশ্বাস এবং জনসাধারণের আবেগ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এজন্যই ষাটের দশকে ২০১৮ সালের মধ্যে গোটা বিশ্বে ডানপন্থি জনতুষ্টিবাদের আবেদন লোপ পাওয়ার যে ভবিষ্যদ্বাণী ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক ইথেয়েল ডে সোলা পুল করেছিলেন, তা আজও সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।

[লেখক: প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক]

ভিক্ষাবৃত্তি : প্রয়োজন নাকি পেশা?

ছবি

বিনিময় কৌশল নাকি বাণিজ্য যুদ্ধ?

শিশু আদালতের বিচার-প্রক্রিয়ার আইনি ও বাস্তবিক দিক

জনদুর্ভোগের অপসংস্কৃতি ও জনশিক্ষা : আগামীর দিকনির্দেশনা

প্রসঙ্গ : নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি

হরিজনদের পদবি : ঐক্যের পথে বাধা

এল নিনো : দেশের কৃষির চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

আর কীভাবে আর্জি জানালে নিরাপত্তা পাওয়া যায়?

স্বপ্ন ভাঙল সাঁওতাল মুংলু বেসরার

কোনো স্কুলই খারাপ না

ঢাকার যানজটের টেকসই সমাধান কী

বই কেন পড়বেন

ডায়াবেটিসের জটিলতা বাড়ায় তামাক ও ধূমপান

জাতীয় বিমা দিবস

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থা

ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়া ভুল হয়ে থাকলে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা সঠিক ছিল!

শিক্ষার গুণগত মান পরিবর্তনে শিক্ষকের মূল্যায়ন

দেশে প্রোগ্রামিংয়ের চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা

তর্কে সময়, সামর্থ্য এবং শক্তির অপচয় রোধ করুন

পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও দেশপ্রেমে জাতীয় অগ্রগতি

শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রাথমিকের লেখাপড়ায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে

ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের সংস্কার

বই পড়ে কী হবে

জনস্বাস্থ্যের আরেক আতঙ্কের নাম ডিমেনশিয়া

ভারতে সঙ্ঘের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য

রম্যগদ্য : “বঙ্গ হবে কলিঙ্গ”

আদিবাসী ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ নিন

ছবি

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও চেতনার অন্বেষণে

প্রযুক্তি, জলবায়ু ও জনসংখ্যার মোকাবিলায় উন্নয়নশীল অর্থনীতির

চাই একটি জাতীয় ভাষানীতি

অস্বাভাবিকের চেয়ে অস্বাভাবিক বায়ুদূষণ

আদিবাসীদের কাঁটাতারে বন্দি জীবন

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজন : বাংলাদেশের কৌশল

শিক্ষক আন্দোলন প্রসঙ্গে

আর জি কর ঘিরে শাসক কৌশল প্রসঙ্গে

নিজের পথে ইউরোপ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

জনতুষ্টিবাদীরা এগিয়ে আছে যেদিক থেকে

রুশাইদ আহমেদ

বৃহস্পতিবার, ০৬ মার্চ ২০২৫

বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে বিশ্ব রাজনীতিতে অভিষিক্ত হয় জনতুষ্টিবাদ তথা লোকরঞ্জনবাদ। এর ফলে কোনো একক মতাদর্শের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে নানা ইস্যুতে রাজনীতিবিদদের এজেন্ডা নির্ধারণ, বাকযুদ্ধ, প্রচারণা এবং জাতীয়তাবাদের ধুয়ো।

১৯২০ থেকে ১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপে এ ধারণা পায় নতুন প্রাণ। জার্মানির এডলফ হিটলার ও ইতালির বেনিতো মুসোলিনির মতো একনায়কের হাত ধরে লোকরঞ্জনবাদ পৌঁছে যায় অনন্য উচ্চতায়। স্বয়ং হিটলারই নিজের আত্মজীবনীতে এ নিয়ে লিখেছিলেন- বাগাড়ম্বরতার মধ্য দিয়ে মানুষকে প্রভাবিত করা যতা সহজ, অন্য কোনো উপায়ে তা সম্ভব নয়।

নানা ইস্যুতে বাগাড়ম্বর বয়ান উপস্থাপনের কৌশল জনতুষ্টিবাদীদের প্রধানতম হাতিয়ার হলেও নানা ধরনের কট্টর সিদ্ধান্ত ও অঙ্গীকার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেশকিছু দিক থেকে উদারবাদী অর্থাৎ লিবারেলদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন জনতুষ্টিবাদীরা। এডলফ হিটলার ও বেনিতো মুসোলিনি থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভিক্টর অরবান কিংবা নরেন্দ্র মোদির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করলে এই সত্যই আমাদের সামনে এসে ধরা দেবে।

উচ্চাকাক্সক্ষী প্রতিশ্রুতি পালনে আগ্রাসী

জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিবিদরা সর্বদাই উচ্চাকাক্সক্ষী প্রতিশ্রুতি দেওয়ার প্রবণতা লালন করে থাকেন। এর মধ্য দিয়ে তারা জনগণকে দেখাতে চানÑ নিজেদের অবস্থানে তারা কতা দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। এক্ষেত্রে তাদের ভাষ্যে সাধারণত স্থান পায় জাতীয়তাবাদের প্রতিধ্বনি। তাই ক্ষমতায় আরোহণের পর হিটলার যেমন করে জার্মান জাতির বিশুদ্ধতার কথা সবসময় উচ্চারণ করতেন, একইভাবে দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পও মার্কিনীদের রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন অবৈধ অভিবাসন কঠোরভাবে দমন করার।

এ লক্ষ্যে দ্বিতীয়বার হোয়াইট হাউসে প্রবেশের একদিনের মাথায় ‘প্রোটেকটিং দ্য মিনিং অ্যান্ড ভ্যালু অব আমেরিকান সিটিজেনশিপ’ শীর্ষক নির্বাহী আদেশে ২০২৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারির পর যুক্তরাষ্ট্রে জন্মানো বাইরের দেশের শিশুদের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব প্রদানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন তিনি।

এ উদাহরণের মতো বিশ্বের সব জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিবিদই তাদের প্রতিশ্রুতি পালনে আগ্রাসী মনোভাব পোষণ করে থাকেন। কেননা এটি শুধু তাদের অঙ্গীকার পালনের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগত ইমেজ গড়ে তোলে না, বরং পরবর্তী ভোটযুদ্ধের রসদও উল্লেখযোগ্য হারে সম্প্রসারিত করে।

জাতীয় অর্থনীতির প্রতি গুরুত্বারোপ

বিশ্বজুড়ে সকল পপুলিস্ট রাজনৈতিক শক্তি আবহমানকাল ধরে জাতীয় অর্থনীতি এবং দেশজ উৎপাদনের ওপর গুরুত্বারোপ করে এসেছে। কারণ যা কিছুই ঘটে যাক না কেন, জনগণ যখন একটি দেশের অভ্যন্তরীণ অগ্রগতির নেপথ্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে দেখতে পায় তারা সেটিকে সাদরে গ্রহণ করে।

এ কারণেই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিরবচ্ছিন্ন অগ্রযাত্রার সুগঠিত বুলি নিয়ে হাজির হন জনতুষ্টিবাদীরা। জনগণকে দেশের অর্থনীতিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেখান তারা। আরোপ করেন নতুন নতুন খাতে কর। বৃদ্ধি করেন আমদানি শুল্ক।

উল্লেখ্য, এ পর্যায়ে সকল জনতুষ্টিবাদীদের প্রথম পছন্দ হয়ে দাঁড়ায় মুক্তবাজার অর্থনীতি। ২০১৯ সালে প্রস্তাবিত ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশ এবং মার্কোসুরভুক্ত লাতিন আমেরিকার মুক্তবাজার অর্থনীতির সমর্থক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার চুক্তির প্রতি ব্রাজিলের কট্টর ডানপন্থি সাবেক প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোর অকুণ্ঠ সমর্থন কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে কানাডা, মেক্সিকো ও চীন থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর ডোনাল্ড ট্রাম্পের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ সেটাই প্রমাণ করে।

মূল্যবোধের উচ্চকিত ঝা-া

জনতুষ্টিবাদীদের আরেকটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তারা নিজেদের নির্দিষ্ট কিছু মূল্যবোধের ধারক ও বাহক হিসেবে তুলে ধরেন। তাদের প্রচারাভিযান এবং নীতি-নির্ধারণে জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সুর অনুরণিত হয় বারবার।

তাই ভিক্টর অরবান হাঙ্গেরির ঐতিহ্য ও খ্রিস্টান মূল্যবোধ রক্ষার নামে অভিবাসনবিরোধী আইন প্রণয়ন করেছেন। প্রসার ঘটিয়েছেন দেশটিতে ইসলামোফোবিয়ার। হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে সামনে রেখে গরু হত্যা নিষিদ্ধকরণ থেকে শুরু করে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (ঈঅঅ) বাস্তবায়ন করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। একইভাবে ইভানজেলিক্যাল খ্রিস্টানদের কা-ারি হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন ট্রাম্প। আর ‘ব্রাজিল সবার ওপরে, ঈশ্বর সবার ওপরে’ সেøাগান নিয়ে মাদক ও সমকামিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে হাজির হয়েছেন বলসোনারো।

কারণ এ ধরনের নীতি গ্রহণ ও বুলি আওড়ানোর মধ্য দিয়ে জনগণের মধ্যে একধরনের নস্টালজিয়া বা অতীতমুখী আবেগ তৈরি করে তাদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়Ñ দেশ ও সমাজের অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনতে হলে এই মূল্যবোধগুলো রক্ষা করতেই হবে। আর এটিই সহায়তা করে জনতুষ্টিবাদীদের নির্দিষ্ট ভোটব্যাংককে সুসংহত করতে।

আমলাতন্ত্রের প্রতি অবিশ্বাস

জনতুষ্টিবাদীরা প্রায়শই আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তাদের মতে, আমলাতন্ত্র দুর্নীতিগ্রস্ত, জনবিচ্ছিন্ন এবং সময়ের অপচয়কারী। তাই তারা প্রশাসনিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করেন এবং আমলাতন্ত্রের পরিবর্তে সরাসরি জনগণের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা উচ্চারণ করেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে যখন তিনি প্রশাসনের নানা স্তরে পরিবর্তন এনে আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা খর্ব করেছিলেন তখন এই প্রবণতাই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল। একইভাবে, লাতিন আমেরিকার ‘ট্রাম্প’ বলে খ্যাত বলসোনারোও বারবার আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে মন্তব্য করে সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর কর্তৃত্ব ফলানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন ক্ষমতায় থাকতে।

আদতে এ ধরনের নীতির মাধ্যমে জনতুষ্টিবাদীরা জনগণের কাছে নিজেদের ‘সিস্টেমের বাইরের নেতা’ হিসেবে তুলে ধরে জনগণকে অনুভব করান যে, প্রচলিত রাজনৈতিক কাঠামোর বিরুদ্ধে তারা লড়ছেন। এর ফলে তাদের প্রতি জন্ম হয় সাধারণ জনগণের একধরনের সহানুভূতির।

জনতার আবেগের কার্যকর ব্যবহার

জনতুষ্টিবাদীরা জানেন, জনগণের আবেগ রাজনীতিতে কতা গুরুত্বপূর্ণ। তারা কৌশলে জনগণের অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে তাদের পক্ষে জনসমর্থন তৈরির চেষ্টা করেন এবং এটা এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছায় যে, তাদের একটা পাড় সমর্থকগোষ্ঠীও গড়ে ওঠে। ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের পরাজয়ের পর ক্যাপিটাল হিলের ঘটনা এক্ষেত্রে প্রণিধান করা যায়।

এর পাশাপাশি, চলমান সামাজিক বা অর্থনৈতিক সংকটের সময় জনতুষ্টিবাদীরা জনগণের ক্ষোভকে নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত করেন। ইউরোপের অভিবাসন সংকটের সময় ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও ঋষি সুনাকের মতো দক্ষিণপন্থি জনতুষ্টিবাদীরা অভিবাসীদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসন অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।

জনগণের আবেগকে কাজে লাগানোর এই ক্ষমতাই জনতুষ্টিবাদীদের সবচেয়ে বড় শক্তি। এই শক্তি ব্যবহার করেই তারা প্রতিপক্ষকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং জনগণকে বোঝান যে, তারা সেই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করছেন।

ফলে জনতুষ্টিবাদীরা রাজনৈতিকভাবে কতটা কার্যকর, তা তাদের উচ্চাকাক্সক্ষী প্রতিশ্রুতি, জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বারোপ, মূল্যবোধের প্রচার, আমলাতন্ত্রের প্রতি অবিশ্বাস এবং জনসাধারণের আবেগ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এজন্যই ষাটের দশকে ২০১৮ সালের মধ্যে গোটা বিশ্বে ডানপন্থি জনতুষ্টিবাদের আবেদন লোপ পাওয়ার যে ভবিষ্যদ্বাণী ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক ইথেয়েল ডে সোলা পুল করেছিলেন, তা আজও সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।

[লেখক: প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক]

back to top