alt

উপ-সম্পাদকীয়

আইনের শাসন না গণপিটুনি?

এ জি কায়কোবাদ

: রোববার, ০৯ মার্চ ২০২৫

ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য দেশে সুস্পষ্ট আইনি কাঠামো রয়েছে। অপরাধীকে চিহ্নিত করা, যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণ উপস্থাপন করা এবং আদালতের রায়ে শাস্তি দেয়াÑ এটাই আইনসম্মত পদ্ধতি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে, উত্তেজিত জনতা মুহূর্তের আবেগে কাউকে অপরাধী ভেবে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা বা গুরুতর আহত করছে। অনেক সময় নিরপরাধ ব্যক্তিরাও এই বর্বরতার শিকার হচ্ছেন, যা মানবাধিকার ও আইনের শাসনের পরিপন্থি।

সম্প্রতি দেশে উচ্ছৃঙ্খল গণবিচারের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আইন-শৃঙ্খলার তোয়াক্কা না করে কিছু মানুষ নিজেদের হাতে আইন তুলে নিচ্ছেন, যা কেবল অরাজকতা সৃষ্টি করছে না, বরং সমাজে ভয় ও অনিরাপত্তার পরিবেশ তৈরি করছে। গণপিটুনি বা উচ্ছৃঙ্খল বিচার প্রক্রিয়া শুধু নিরীহ মানুষকে প্রাণ হারানোর ঝুঁকিতে ফেলে না, এটি পুরো বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাকে নষ্ট করে দেয়। মব জাস্টিস, যা আমরা গণপিটুনির নামে জানি, মানবাধিকার ও আইনের প্রতি চরম অবহেলার এক অন্ধকার উদাহরণ। গণপিটুনি, যেখানে জনতা নিজ হাতে অপরাধী বা সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়, তা আইনগত, নৈতিক এবং মানবিকভাবে একটি বিপজ্জনক প্রবণতা। এটি সমাজে অনির্দিষ্ট একধরনের ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে, যা সমাজের উন্নয়ন ও শান্তির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। গণপিটুনি সাধারণত তখনই ঘটে যখন জনগণ মনে করে, অপরাধীকে যথাযথ শাস্তি দেয়া হবে না বা আইন যথাযথভাবে কাজ করছে না। চুরি, ছিনতাই, শিশু অপহরণ বা গুজবের ফলে অনেক সময় নিরপরাধ মানুষও গণপিটুনির শিকার হয়। ফলে ব্যক্তিগত প্রতিশোধ ও গুজবের কারণে বিচারহীনতার শিকার হতে পারে অনেক নির্দোষ মানুষ।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ছিনতাইকারী সন্দেহে বেশ কিছু গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, উত্তরার বিএনএস সেন্টারের সামনে ফুটওভার ব্রিজে দুই যুবককে ছিনতাইকারী সন্দেহে উল্টো করে ঝুলিয়ে গণপিটুনি দেয়া হয়। পরে পুলিশ তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে, যেখানে তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল। গুলিস্তানে ছিনতাইকারী সন্দেহে একজনকে গণপিটুনি দেওয়া হয়, তবে তার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় এক যুবককে ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। মারাত্মক আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হলে তিনি মারা যান। টঙ্গীতে মোবাইল ছিনতাই করে পালানোর সময় জনতার গণপিটুনিতে অজ্ঞাতনামা এক যুবক নিহত হন। স্থানীয়রা জানান, সাম্প্রতিক সময়ে ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ায় পথচারীরা সংঘবদ্ধভাবে চলাচল করছিল। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গণপিটুনির বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ছিনতাইকারীদের সন্দেহের ভিত্তিতে মারধর করা হয়েছে। কিছু ঘটনায় সন্দেহভাজনরা গুরুতর আহত হয়েছে, আবার কিছু ক্ষেত্রে তারা প্রাণ হারিয়েছে। এই ধরনের গণপিটুনির ঘটনা উদ্বেগজনক, কারণ এতে সন্দেহভাজনদের আইনি বিচার পাওয়ার সুযোগ নষ্ট হয়, এবং অনেক সময় নিরীহ মানুষও ভুক্তভোগী হতে পারে। যদিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাধারণ জনগণকে আইন হাতে তুলে না নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে।

গণবিচারের পেছনে কয়েকটি মূল কারণ রয়েছেÑ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর দীর্ঘ তদন্ত, মামলা পরিচালনার দীর্ঘসূত্রিতা এবং ক্ষমতাশালীদের প্রভাবের কারণে অপরাধীরা শাস্তি এড়িয়ে যায়। এতে সাধারণ জনগণের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয় এবং তারা আইন নিজের হাতে তুলে নিতে উৎসাহী হয়। আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রক্রিয়া সম্পর্কে সচেতনতার অভাবে অনেক মানুষ মনে করেন, নিজস্বভাবে বিচার করলে দ্রুত ফল পাওয়া যাবে। ফলে মুহূর্তের উত্তেজনায় সংঘবদ্ধ হয়ে অপরাধী সন্দেহে নিরীহ মানুষকেও আক্রমণ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সময়মতো ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়, যার ফলে জনরোষ বাড়ে এবং তারা নিজেরাই বিচার করতে উদ্যোগী হয়।

উচ্ছৃঙ্খল গণবিচার সমাজের জন্য ভয়াবহ কিছু পরিণতি বয়ে আনতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে ভুয়া অভিযোগের ভিত্তিতে মানুষ গণপিটুনির শিকার হয়। জনগণ যদি নিজেরাই বিচার করতে শুরু করে, তাহলে রাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। গণপিটুনির ঘটনাগুলো সমাজে ভয় ও অনিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি করে। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত শত্রুতার সুযোগ নিয়ে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে নির্দোষ ব্যক্তিকে গণবিচারের লক্ষ্যবস্তু বানাতে পারে।

গণবিচার রোধে সরকার, প্রশাসন ও সাধারণ জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও দক্ষ ও সক্রিয় হতে হবে। সন্দেহভাজন অপরাধীকে দ্রুত গ্রেফতার করে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসতে হবে। গণমাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে জনগণকে বোঝাতে হবে যে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া মারাত্মক অপরাধ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ঠেকাতে সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত প্রচারণা চালাতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ও উসকানিমূলক প্রচারণা বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিচার প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ, দ্রুত ও নিরপেক্ষ করতে হবে। বিচার ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে, যাতে তারা আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়।

রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থা অপরাধীদের যথাযথ তদন্ত ও সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে শাস্তি নিশ্চিত করে। আইন ছাড়া সমাজে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। উচ্ছৃঙ্খল গণবিচার সভ্য সমাজের জন্য এক ভয়ংকর ব্যাধি। এটি বন্ধ করতে হলে রাষ্ট্র, প্রশাসন ও নাগরিকদের সম্মিলিতভাবে সচেষ্ট হতে হবে। জনগণকে বুঝতে হবে, আইন নিজের হাতে তুলে নিলে তা আরও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে এবং নিরপরাধ ব্যক্তির জীবন ঝুঁকিতে পড়ে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব কেবল আইন ও আদালতের, ব্যক্তিবিশেষ বা জনতার নয়। আইন অমান্য করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা যায় নাÑ বরং এতে আরও বড় অন্যায় ঘটে। এখনই সময়, আমরা ন্যায়বিচারের পথে ফিরে আসি, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই এবং একটি সুস্থ ও ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ গড়ে তুলি।

[লেখক : কলেজ শিক্ষক]

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

কুষ্ঠ ও বৈষম্য : মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি অবহেলিত অধ্যায়

ছবি

প্রান্তজনের বাংলাদেশ

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

সাইবার নিরাপত্তা : অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে আমাদের প্রস্তুতি

ছবি

বাহান্নর গর্ভে জন্ম নেয়া এক ঝড়ের পাখি

প্রবাসী শ্রমিক : অর্থের যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের সহযোদ্ধা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

ভোগবাদের বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিসের জলবায়ু বার্তা

রম্যগদ্য : হাসি নিষেধ...

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : দাবি ও সমাধানের পথ

সিরিয়ার পতন কিভাবে আমেরিকার স্বার্থকে হুমকিতে ফেলছে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধানে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

আইনের শাসন না গণপিটুনি?

এ জি কায়কোবাদ

রোববার, ০৯ মার্চ ২০২৫

ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য দেশে সুস্পষ্ট আইনি কাঠামো রয়েছে। অপরাধীকে চিহ্নিত করা, যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণ উপস্থাপন করা এবং আদালতের রায়ে শাস্তি দেয়াÑ এটাই আইনসম্মত পদ্ধতি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে, উত্তেজিত জনতা মুহূর্তের আবেগে কাউকে অপরাধী ভেবে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা বা গুরুতর আহত করছে। অনেক সময় নিরপরাধ ব্যক্তিরাও এই বর্বরতার শিকার হচ্ছেন, যা মানবাধিকার ও আইনের শাসনের পরিপন্থি।

সম্প্রতি দেশে উচ্ছৃঙ্খল গণবিচারের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আইন-শৃঙ্খলার তোয়াক্কা না করে কিছু মানুষ নিজেদের হাতে আইন তুলে নিচ্ছেন, যা কেবল অরাজকতা সৃষ্টি করছে না, বরং সমাজে ভয় ও অনিরাপত্তার পরিবেশ তৈরি করছে। গণপিটুনি বা উচ্ছৃঙ্খল বিচার প্রক্রিয়া শুধু নিরীহ মানুষকে প্রাণ হারানোর ঝুঁকিতে ফেলে না, এটি পুরো বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাকে নষ্ট করে দেয়। মব জাস্টিস, যা আমরা গণপিটুনির নামে জানি, মানবাধিকার ও আইনের প্রতি চরম অবহেলার এক অন্ধকার উদাহরণ। গণপিটুনি, যেখানে জনতা নিজ হাতে অপরাধী বা সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়, তা আইনগত, নৈতিক এবং মানবিকভাবে একটি বিপজ্জনক প্রবণতা। এটি সমাজে অনির্দিষ্ট একধরনের ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে, যা সমাজের উন্নয়ন ও শান্তির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। গণপিটুনি সাধারণত তখনই ঘটে যখন জনগণ মনে করে, অপরাধীকে যথাযথ শাস্তি দেয়া হবে না বা আইন যথাযথভাবে কাজ করছে না। চুরি, ছিনতাই, শিশু অপহরণ বা গুজবের ফলে অনেক সময় নিরপরাধ মানুষও গণপিটুনির শিকার হয়। ফলে ব্যক্তিগত প্রতিশোধ ও গুজবের কারণে বিচারহীনতার শিকার হতে পারে অনেক নির্দোষ মানুষ।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ছিনতাইকারী সন্দেহে বেশ কিছু গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, উত্তরার বিএনএস সেন্টারের সামনে ফুটওভার ব্রিজে দুই যুবককে ছিনতাইকারী সন্দেহে উল্টো করে ঝুলিয়ে গণপিটুনি দেয়া হয়। পরে পুলিশ তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে, যেখানে তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল। গুলিস্তানে ছিনতাইকারী সন্দেহে একজনকে গণপিটুনি দেওয়া হয়, তবে তার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় এক যুবককে ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। মারাত্মক আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হলে তিনি মারা যান। টঙ্গীতে মোবাইল ছিনতাই করে পালানোর সময় জনতার গণপিটুনিতে অজ্ঞাতনামা এক যুবক নিহত হন। স্থানীয়রা জানান, সাম্প্রতিক সময়ে ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ায় পথচারীরা সংঘবদ্ধভাবে চলাচল করছিল। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গণপিটুনির বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ছিনতাইকারীদের সন্দেহের ভিত্তিতে মারধর করা হয়েছে। কিছু ঘটনায় সন্দেহভাজনরা গুরুতর আহত হয়েছে, আবার কিছু ক্ষেত্রে তারা প্রাণ হারিয়েছে। এই ধরনের গণপিটুনির ঘটনা উদ্বেগজনক, কারণ এতে সন্দেহভাজনদের আইনি বিচার পাওয়ার সুযোগ নষ্ট হয়, এবং অনেক সময় নিরীহ মানুষও ভুক্তভোগী হতে পারে। যদিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাধারণ জনগণকে আইন হাতে তুলে না নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে।

গণবিচারের পেছনে কয়েকটি মূল কারণ রয়েছেÑ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর দীর্ঘ তদন্ত, মামলা পরিচালনার দীর্ঘসূত্রিতা এবং ক্ষমতাশালীদের প্রভাবের কারণে অপরাধীরা শাস্তি এড়িয়ে যায়। এতে সাধারণ জনগণের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয় এবং তারা আইন নিজের হাতে তুলে নিতে উৎসাহী হয়। আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রক্রিয়া সম্পর্কে সচেতনতার অভাবে অনেক মানুষ মনে করেন, নিজস্বভাবে বিচার করলে দ্রুত ফল পাওয়া যাবে। ফলে মুহূর্তের উত্তেজনায় সংঘবদ্ধ হয়ে অপরাধী সন্দেহে নিরীহ মানুষকেও আক্রমণ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সময়মতো ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়, যার ফলে জনরোষ বাড়ে এবং তারা নিজেরাই বিচার করতে উদ্যোগী হয়।

উচ্ছৃঙ্খল গণবিচার সমাজের জন্য ভয়াবহ কিছু পরিণতি বয়ে আনতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে ভুয়া অভিযোগের ভিত্তিতে মানুষ গণপিটুনির শিকার হয়। জনগণ যদি নিজেরাই বিচার করতে শুরু করে, তাহলে রাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। গণপিটুনির ঘটনাগুলো সমাজে ভয় ও অনিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি করে। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত শত্রুতার সুযোগ নিয়ে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে নির্দোষ ব্যক্তিকে গণবিচারের লক্ষ্যবস্তু বানাতে পারে।

গণবিচার রোধে সরকার, প্রশাসন ও সাধারণ জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও দক্ষ ও সক্রিয় হতে হবে। সন্দেহভাজন অপরাধীকে দ্রুত গ্রেফতার করে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসতে হবে। গণমাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে জনগণকে বোঝাতে হবে যে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া মারাত্মক অপরাধ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ঠেকাতে সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত প্রচারণা চালাতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ও উসকানিমূলক প্রচারণা বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিচার প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ, দ্রুত ও নিরপেক্ষ করতে হবে। বিচার ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে, যাতে তারা আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়।

রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থা অপরাধীদের যথাযথ তদন্ত ও সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে শাস্তি নিশ্চিত করে। আইন ছাড়া সমাজে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। উচ্ছৃঙ্খল গণবিচার সভ্য সমাজের জন্য এক ভয়ংকর ব্যাধি। এটি বন্ধ করতে হলে রাষ্ট্র, প্রশাসন ও নাগরিকদের সম্মিলিতভাবে সচেষ্ট হতে হবে। জনগণকে বুঝতে হবে, আইন নিজের হাতে তুলে নিলে তা আরও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে এবং নিরপরাধ ব্যক্তির জীবন ঝুঁকিতে পড়ে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব কেবল আইন ও আদালতের, ব্যক্তিবিশেষ বা জনতার নয়। আইন অমান্য করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা যায় নাÑ বরং এতে আরও বড় অন্যায় ঘটে। এখনই সময়, আমরা ন্যায়বিচারের পথে ফিরে আসি, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই এবং একটি সুস্থ ও ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ গড়ে তুলি।

[লেখক : কলেজ শিক্ষক]

back to top