alt

উপ-সম্পাদকীয়

মনে কী দ্বিধা রেখে নতুন প্রত্যাশায় নতুন দল!

আনোয়ারুল হক

: মঙ্গলবার, ১১ মার্চ ২০২৫

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘ছাত্ররা প্রস্তুত। দেশজুড়ে সংগঠিত হচ্ছে। তারা একটা সুযোগ নিতে চেয়েছে, তাদের সুযোগ দেই।’ এ ঘোষণার ঠিক এক মাসের মাথায় নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি এক আড়ম্বরপূর্ণ সমাবেশের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করলো।

দেশের রাজনীতিতে দীর্ঘ সময় যাবত যে দ্বিদলীয় মেরুকরণ চলে আসছিল, তার বাইরে তৃতীয় কোন মধ্যমপন্থার দল জায়গা করে নিতে পারেনি। সেদিক থেকে দ্বিদলীয় মেরুকরণ এবং পারিবারিক জমিদারি কায়েমের রাজনীতির প্রতি বিরক্তি, এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষকে তৃতীয় শক্তির উত্থানের প্রতি আগ্রহী করেছে। পাকিস্তানি আমল থেকে বাংলাদেশের প্রতিটি গণসংগ্রামে বামপন্থিদের অসামান্য অবদান থাকলেও তৃতীয় শক্তি বা বিকল্প হিসেবে তারা অবস্থান নিতে পারেনি। আশির দশক জুড়ে বামপন্থিরা বিশেষত সিপিবি আশাজাগানিয়া এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পেরেছিলো। বাসদও এই সময়ে বেশ সুসংগঠিত হয়ে উঠেছিলো কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে আবার ভাটার টান ও উভয় দলেই বিভক্তি। বামপন্থিদের প্রতি সহানুভূতিশীল জনসাধারণের একটা অংশ মনে করে, ‘রুটি কে লিয়ে লাল ঝান্ডা, আওর ভোট কে লিয়ে...’। অর্থাৎ রুটি-রুজির লড়াইয়ে লাল ঝান্ডা বিশ্বস্ত পার্টি এবং তার সাথে আছেন। কিন্তু ভোটের ময়দানে যেহেতু তারা ভালো করে না তাই ভোটটা কথিত ক্ষমতাবানদের দেবেন। সম্প্রতি বামপন্থিরা অবশ্য সমমনা বাম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন, পেশাজীবী সংগঠন এবং ব্যক্তি সমন্বয়ে একটি ব্যাপকভিত্তিক যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলার প্রচেষ্টা শুরু করেছে। এক্ষেত্রে তারা কতটুকু সফল হন তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা একটা দলের দেশের রাজনীতিতে জায়গা করে নেয়ার অবস্থা রয়েছে বলে মন হয়। তবে তরুণদের নেতৃত্বে যে রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ হলো তার ভবিষ্যৎ কী? তারা কি সেই সম্ভাব্য তৃতীয় শক্তি হয়ে উঠতে পারবে? এক্ষেত্রে প্রথম বিচার্য বিষয় হচ্ছে তাদের রাজনীতিটা কি? ২৮ ফেব্রুয়ারি তাদের আত্মপ্রকাশ জমায়েত থেকে ঘোষণা করা হয়েছেÑ ‘এটি হবে একটি গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক ও জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল।’ নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়ার সময়েই বলা হয়েছিল দলটি মধ্যপন্থি রাজনীতি করবে; কিন্তু দলটির রাজনৈতিক বা আদর্শগত অবস্থান শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে এবং নেতৃত্বের মধ্যে টানাপড়েন রয়েছে। নেতৃত্বে নানা মত-পথের এমনকি সম্পূর্ণ বিপরীত মতাদর্শের তরুণরাও রয়েছেন। দলের অন্যতম তাত্ত্বিক মাহফুজ আলম কয়েকটি বিষয় বিভিন্ন সময়ে স্পষ্ট করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধ মানেই বাংলাদেশ’। আবার এটাও বলেছেন ‘রাষ্ট্র কখনও এক-ধর্ম কেন্দ্রিক হয়ে দাঁড়াতে পারে না। যে বাস্তবতায় আছি, সেই বাস্তবতায় বাংলাদেশে কখনও ধর্মরাষ্ট্র বা ইসলামি রাষ্ট্র সম্ভব নয়।’ এ বক্তব্যের একেবারে বিপরীত অবস্থানের তরুণরাও নতুন দলের নেতৃত্বে আছেন।আবার মাহফুজ আলমও ঘটনা পরম্পরায় মাঝেমধ্যে বয়ানের সুর পাল্টে দেন। তবে নতুন দলের সবাই মিলে জাতীয় স্মৃতি সৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। ‘মুক্তিযুদ্ধের’ সকল তীর্থস্থান গুঁড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো নেতাও সেখানে ছিলেন।

নতুন দল রাজনীতিতে ভারত ও পাকিস্তানপন্থি হবে না, বাংলাদেশপন্থি হবে- এ ঘোষণায় কোন নতুনত্ব নেই। এটাই তো স্বাভাবিক। আবার নতুন দলের নেতারা বিভিন্ন সময়ে ভারত বর্ষের আধিপত্যবাদী মনোভাব এবং পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখালেও সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের আভ্যন্তরীন রাজনীতি বিষয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ উক্তি করেছেন এবং পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর আমির বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের অংশ বানানোর যে হুঙ্কার দিয়েছেন সে সব বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেননি।

বৈষম্যবিরোধী সমাজের যে আকাক্সক্ষা এবারের গণসংগ্রামের মধ্য দিয়ে সামনে এসেছে তা বাস্তবায়নে তাদের আর্থিক নীতি কি হবে তাও স্পষ্ট নয়। শুধু ব্যক্তি বিশেষের আর্থিক লুন্ঠনের বিরুদ্ধে বলে তো লুন্ঠন বন্ধ করা যাবে না। এক দরবেশ জেলে থাকলেও নতুন দরবেশের উত্থান ঘটছে। ব্যাংক লুট, অর্থ পাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বললেও এসবের উৎস বিরাজমান লুটেরা পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিরুদ্ধে নতুন দলের কোনো বক্তব্য চোখে পড়ছে না। ভারত পাকিস্তানের তাবেদারি করবো না, কিন্তু বিশ্ব পুঁজিবাদের মোড়ল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দুনিয়া জুড়ে যে লুন্ঠন, আগ্রাসন ও আধিপত্য বিস্তার তার বিরুদ্ধেও কোন বক্তব্য নেই। তাই নতুন দলের ঘোষিত মধ্যপন্থার ভরকেন্দ্র এখন পর্যন্ত ডানদিকে হেলে আছে। মধ্য ডানপন্থা কি সমাজে বৈষম্য দূর করবে না বাড়াবে?

নতুন দলের সফলতা অর্জনের পথে এক বড় বাধা তাদের শর্টকাট পথে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার মানসিকতা এবং নিজেদের বর্তমান পরিবর্তনের সোল এজেন্ট ভাবা; কিন্তু ৫ আগস্টের ক্ষমতার পরিবর্তন শুধু এক দিনের বা এক মাসের ঘটনা নয়। দেশের বিরোধী দলসমূহ কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে, গুম খুন নির্যাতন,আর্থিক লুন্ঠনের প্রতিবাদে ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘকাল যাবৎ লড়াই করে আসছিলো। ২০২৩ সালের একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে এমন আন্দোলন গড়ে উঠেছিল যে একপর্যায়ে তৎকালীন সরকারই নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল এবং তারা সন্দিহান হয়ে পড়েছিল যে একতরফাভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারবে কিনা। এসব আন্দোলন এবং আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে তীব্র দমননীতি ও নিপীড়ন চালিয়ে হাস্যকর এক নির্বাচন আয়োজন করে সরকারই কিন্তু জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতি এবং লুটেরা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অভ্যন্তরীন সংকট রাষ্ট্র ক্ষমতার কাঠামোকেও ভেতরে ভেতরে ঝাঁজরা করে দিয়েছিল।

ছাত্র-গণআন্দোলনকে পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে মোকাবেলা করার নীতি নিয়ে অগ্রসর হওয়ার এক পর্যায়ে সেনাবাহিনীকে জাতিসংঘ সতর্ক করে যে যদি তারা এতে জড়িত হয়, তার অর্থ দাঁড়াবে তারা হয়ত আর শান্তিরক্ষী পাঠানোর দেশ থাকতে পারবে না। এই প্রতিক্রিয়ায় বন্দুকের নল শাসকদের দিকে ঘুরে যায় এবং সরকারের পতনই শুধু হয় না, শেখ হাসিনাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়। জাতিসংঘের এ ভূমিকায় প্রশ্ন উঠেছে আসল মাস্টার মাইন্ড কে। তিনি কি নিজেকে আড়াল করার জন্য বিশ্ব দরবারে আরেকজনকে দিয়ে প্রক্সি দেওয়ালেন! মাস্টার মাইন্ডরা মাইন্ড পরিষ্কার না করায় মানুষের মাঝেও নানা বিভ্রান্তি আছে। নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে ঢাকায় তিনবার কূটনীতিকের দায়িত্ব পালনকারী সাবেক মার্কিন কূটনীতিক জন এফ ড্যানিলোভিচের বক্তব্যে। তিনি বলেছেন ২০০৭-০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিরাট ভুল করেছিল। কী ভুল? এক এগারোর সরকার যে সংস্কারের এজেন্ডা নিয়ে এগোচ্ছিল তা বাদ দিয়ে একটা সময় এসে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরকে অগ্রাধিকার দেওয়া। এতে যুক্তরাষ্ট্রের ভুলের প্রশ্ন আসছে কেন? অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলে তার ভূমিকা রাখছিলো বলেই ভুলের প্রশ্ন আসছে। আর এক-এগারোর সরকারের কাছে সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রধান অগ্রাধিকার ছিল মাইনাস টু ফর্মুলা কার্যকর করাÑ যাতে যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতি বা সমর্থন ছিল। এবারেও ক্ষমতার পালাবদলে মার্কিনি ইঙ্গিতে শান্তি রক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশের সেনা প্রতিনিধিত্বকে ইস্যু করা হয়েছিল বলে ইতোমধ্যেই জাতিসংঘের কর্মকর্তারা বলেছেন। অর্থাৎ বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে শুধুমাত্র ভারতবর্ষ নয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ সম্পর্কে নীরব থেকে মাস্টার মাইন্ডের শিষ্যরা বুকের ছাতি ফুলিয়ে ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’ হাঁকডাক দিলেই নিজেদের স্বদেশি প্রমাণ করতে পারবেন না। বরং কিংস পার্টির সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা স্বার্থের পাহারাদারের তকমা জুটে যাবে।

রাজনৈতিক দলসমূহের এত বছরের সংগ্রামকে তারা সম্মানের সাথে না দেখলেও দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের যে নেতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতি রয়েছে অর্থাৎ চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, নিয়োগ বাণিজ্য ইত্যাদিকে সম্মান করে নতুন দলের একাংশ তা দ্রুত রপ্ত করে নিয়েছে। সচিবালয়, সরকারি অফিস আদালত, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সকল ক্ষেত্রে কথিত সমন্বয়ক নামে হস্তক্ষেপ চলছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনা হচ্ছে দেশে স্বৈরতন্ত্রের বদলে সমন্বয়কতন্ত্র কায়েম হলো কিনা।

অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দল গঠন এবং সেটা নিয়ে লুকোচুরি সরকার ও নতুন দলের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণœ করছে। রাজনৈতিক অঙ্গনের খবরাখবর যারা রাখেন তারা সবাই জানেন বিভিন্ন সময় নাহিদ ইসলাম (অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, বর্তমানে এনসিপির আহ্বায়ক), আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ আলম (বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা) এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃত্বসহ মন্ত্রীপাড়ায় তাদের যেখানে বাসা সেখানেই দল গঠন থেকে শুরু করে জোট গঠন বা বিভিন্ন ইস্যুতে বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়ে নিয়মিত বৈঠক হয়েছে, হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা তো আগেই বলেছেন ছাত্ররা দল করার জন্য প্রস্তুত, তাদের সুযোগ দেই। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব তো ভুলেই যান যে তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা। তিনি নতুন দলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। আইন উপদেষ্টাসহ অনেকেই অভিনন্দন জানিয়েছেন। এতে করে সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় প্রধান উপদেষ্টা যদি নিরপেক্ষতা ক্ষুণœ করেন তাহলে আর অবশিষ্ট রইলো কী? এবং দেশে বিদেশে তার যে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তা ক্ষুণœ হলে শুধু তিনি নন পুরো দেশ বিপদে পড়ে যাবে।

অন্যান্য রাজনৈতিক দল যে জাতীয় নাগরিক পার্টিকে কিংস পার্টি বলছে সে তকমা তারা নিজেরাই অর্জন করছেন। সারা দেশেই তারা প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে প্রথম থেকেই কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। সব সরকারি কর্মকর্তা পিরোজপুরের ডিসির ন্যায় লিখিত প্রমাণ রাখেন না। মৌখিক নির্দেশেই সহযোগিতার কাজ চলছে। এর মধ্যে দিয়ে কিন্তু একটা বিরাট রাজনৈতিক জটিলতার সৃষ্টি করা হচ্ছে যার দায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেই নিতে হবে। জাতীয় নাগরিক পার্টি যে ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে সেখান থেকে তারা আর বের হতে চাইছে না। তাই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে গনপরিষদ নির্বাচন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন, সেকেন্ড রিপাবলিক ইত্যাদি দাবি তুলছে। এসব দাবিতে ছাত্র গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়নি। তাই এসব দাবি উত্থাপন রাজনৈতিক জট সৃষ্টি করবে।

শেখ হাসিনা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকে ভয় পেতেন। তাই চোরাই ভোট করতেন। নতুন দলও নির্বাচনকে ভয় পায়। তারা চুরিটুরির ধার ধারে না। ভোটই করবে না। প্রাক্তন ছাত্রলীগ সৈনিক, ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দামের আস্থাভাজন প্রাক্তন সহচর নাগরিক পার্টির নেতা সারজিস আলম বলছেন, হাসিনার বিচার না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনের কথা যেন কেউ মুখেও না আনে। তারা তো সাত মাস ধরে ক্ষমতায় আছেন, বিচার করছেন না কেন? কে না করেছে? বরং এমনভাবে, যাচ্ছেতাইভাবে মামলা করেছেন যাতে মামলা দুর্বল হয়। ট্রাইব্যুনাল নিয়েই তো ইতোমধ্যে দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। জাতিসংঘ স্পষ্ট করে বলেছে, চাইলে সরকার শেখ হাসিনার বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে। হচ্ছেন না কেন? ‘হাসিনার বিচার’ হলো নাগরিক পার্টি ও অন্তর্বর্তী সরকারের মুলা। এ মুলা জাতিসংঘকে দিয়ে দিলে তারা ঝুলাবেন কি? নির্বাচনই বা ঝুলিয়ে রাখবেন কি বলে? আর যে সরকার দেশের আইন শৃঙ্খলাই নিয়ন্ত্রন করতে পারছেননা, অব্যাহত নারী নির্যাতন-নিপীড়ন এবং মব সৃষ্টিকারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না বা করছেন না তারা জুলাই হত্যাকা-ের বিচার করতে পারবেন কিনা জনমনে সে সন্দেহ ইতিমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। ভুল মানুষদের হাতে কি বাঁধা পড়েছে জুলাই! তারা কি ডেমোক্রেসির বদলে মবক্রেসি দিয়ে দেশ চালাতে চান?

এদিকে নাহিদ ইসলাম উপদেষ্টা থেকে পদত্যাগ করার পর কথাবার্তা বলছেন সরকারের উপদেষ্টার মতোই। তিনি বলেছেন, এ বছর নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হবে না। এ কথা বলার তিনি এখন কে? তিনি তো সরকারেও নেই, নির্বাচন কমিশনেও নেই; কিন্তু ভাবেসাবে তারাই ক্ষমতায়। তারাই সরকারকে ‘ডিকটেট’ করতে চায় বা করছে। এভাবে তো কিংস পার্টির খেতাব তারা নিজেরাই আমন্ত্রণ করে নিচ্ছেন। আন্দোলনের সময় তাদের পাশে ছিল শ্রমজীবীরা, এখন পাশে টাকাওয়ালারা। আবার টাকার উৎস নাকি বলা যাবে না। সূচনালগ্ন থেকেই পুরাতন ধারায় অগ্রসর হওয়ায় দেশবাসীর মাঝেও তারা নতুন কোনো প্রত্যাশা সৃষ্টি করতে পারছেন বলে মনে হয় না। নতুন দল রাজনৈতিক বিতর্কে যুক্তি মেনে নেওয়ার নমনীয়তা দেখাতে পারলে এবং দ্বিধা না রেখে দ্রুত তারা এবং সরকারে থাকা তাদের পরামর্শদাতারা মনের কথা খুলে বললে দল সৃষ্টির যৌক্তিকতা স্পষ্ট হতে পারে। আসলে কী আছে তাদের মনে?

[লেখক : সাবেক সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়ন]

ভূমিকম্পের আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে

নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতেই হবে

ছবি

উন্নত বিশ্বের নাগরিকত্ব ও দুর্নীতি

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় : শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ির নিচে ছাত্র

নারীর অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন

আদালতের ভেতরে ভিডিও ধারণের আইনি দিক

আইনের শাসন না গণপিটুনি?

নারীর ভূমি ও কৃষি অধিকার : ন্যায়বিচারের পথে কতদূর?

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের হালচাল

জনতুষ্টিবাদীরা এগিয়ে আছে যেদিক থেকে

ভিক্ষাবৃত্তি : প্রয়োজন নাকি পেশা?

ছবি

বিনিময় কৌশল নাকি বাণিজ্য যুদ্ধ?

শিশু আদালতের বিচার-প্রক্রিয়ার আইনি ও বাস্তবিক দিক

জনদুর্ভোগের অপসংস্কৃতি ও জনশিক্ষা : আগামীর দিকনির্দেশনা

প্রসঙ্গ : নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি

হরিজনদের পদবি : ঐক্যের পথে বাধা

এল নিনো : দেশের কৃষির চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

আর কীভাবে আর্জি জানালে নিরাপত্তা পাওয়া যায়?

স্বপ্ন ভাঙল সাঁওতাল মুংলু বেসরার

কোনো স্কুলই খারাপ না

ঢাকার যানজটের টেকসই সমাধান কী

বই কেন পড়বেন

ডায়াবেটিসের জটিলতা বাড়ায় তামাক ও ধূমপান

জাতীয় বিমা দিবস

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থা

ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়া ভুল হয়ে থাকলে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা সঠিক ছিল!

শিক্ষার গুণগত মান পরিবর্তনে শিক্ষকের মূল্যায়ন

দেশে প্রোগ্রামিংয়ের চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা

তর্কে সময়, সামর্থ্য এবং শক্তির অপচয় রোধ করুন

পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও দেশপ্রেমে জাতীয় অগ্রগতি

শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রাথমিকের লেখাপড়ায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে

ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের সংস্কার

বই পড়ে কী হবে

জনস্বাস্থ্যের আরেক আতঙ্কের নাম ডিমেনশিয়া

ভারতে সঙ্ঘের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য

রম্যগদ্য : “বঙ্গ হবে কলিঙ্গ”

tab

উপ-সম্পাদকীয়

মনে কী দ্বিধা রেখে নতুন প্রত্যাশায় নতুন দল!

আনোয়ারুল হক

মঙ্গলবার, ১১ মার্চ ২০২৫

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘ছাত্ররা প্রস্তুত। দেশজুড়ে সংগঠিত হচ্ছে। তারা একটা সুযোগ নিতে চেয়েছে, তাদের সুযোগ দেই।’ এ ঘোষণার ঠিক এক মাসের মাথায় নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি এক আড়ম্বরপূর্ণ সমাবেশের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করলো।

দেশের রাজনীতিতে দীর্ঘ সময় যাবত যে দ্বিদলীয় মেরুকরণ চলে আসছিল, তার বাইরে তৃতীয় কোন মধ্যমপন্থার দল জায়গা করে নিতে পারেনি। সেদিক থেকে দ্বিদলীয় মেরুকরণ এবং পারিবারিক জমিদারি কায়েমের রাজনীতির প্রতি বিরক্তি, এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষকে তৃতীয় শক্তির উত্থানের প্রতি আগ্রহী করেছে। পাকিস্তানি আমল থেকে বাংলাদেশের প্রতিটি গণসংগ্রামে বামপন্থিদের অসামান্য অবদান থাকলেও তৃতীয় শক্তি বা বিকল্প হিসেবে তারা অবস্থান নিতে পারেনি। আশির দশক জুড়ে বামপন্থিরা বিশেষত সিপিবি আশাজাগানিয়া এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পেরেছিলো। বাসদও এই সময়ে বেশ সুসংগঠিত হয়ে উঠেছিলো কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে আবার ভাটার টান ও উভয় দলেই বিভক্তি। বামপন্থিদের প্রতি সহানুভূতিশীল জনসাধারণের একটা অংশ মনে করে, ‘রুটি কে লিয়ে লাল ঝান্ডা, আওর ভোট কে লিয়ে...’। অর্থাৎ রুটি-রুজির লড়াইয়ে লাল ঝান্ডা বিশ্বস্ত পার্টি এবং তার সাথে আছেন। কিন্তু ভোটের ময়দানে যেহেতু তারা ভালো করে না তাই ভোটটা কথিত ক্ষমতাবানদের দেবেন। সম্প্রতি বামপন্থিরা অবশ্য সমমনা বাম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন, পেশাজীবী সংগঠন এবং ব্যক্তি সমন্বয়ে একটি ব্যাপকভিত্তিক যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলার প্রচেষ্টা শুরু করেছে। এক্ষেত্রে তারা কতটুকু সফল হন তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা একটা দলের দেশের রাজনীতিতে জায়গা করে নেয়ার অবস্থা রয়েছে বলে মন হয়। তবে তরুণদের নেতৃত্বে যে রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ হলো তার ভবিষ্যৎ কী? তারা কি সেই সম্ভাব্য তৃতীয় শক্তি হয়ে উঠতে পারবে? এক্ষেত্রে প্রথম বিচার্য বিষয় হচ্ছে তাদের রাজনীতিটা কি? ২৮ ফেব্রুয়ারি তাদের আত্মপ্রকাশ জমায়েত থেকে ঘোষণা করা হয়েছেÑ ‘এটি হবে একটি গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক ও জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল।’ নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়ার সময়েই বলা হয়েছিল দলটি মধ্যপন্থি রাজনীতি করবে; কিন্তু দলটির রাজনৈতিক বা আদর্শগত অবস্থান শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে এবং নেতৃত্বের মধ্যে টানাপড়েন রয়েছে। নেতৃত্বে নানা মত-পথের এমনকি সম্পূর্ণ বিপরীত মতাদর্শের তরুণরাও রয়েছেন। দলের অন্যতম তাত্ত্বিক মাহফুজ আলম কয়েকটি বিষয় বিভিন্ন সময়ে স্পষ্ট করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধ মানেই বাংলাদেশ’। আবার এটাও বলেছেন ‘রাষ্ট্র কখনও এক-ধর্ম কেন্দ্রিক হয়ে দাঁড়াতে পারে না। যে বাস্তবতায় আছি, সেই বাস্তবতায় বাংলাদেশে কখনও ধর্মরাষ্ট্র বা ইসলামি রাষ্ট্র সম্ভব নয়।’ এ বক্তব্যের একেবারে বিপরীত অবস্থানের তরুণরাও নতুন দলের নেতৃত্বে আছেন।আবার মাহফুজ আলমও ঘটনা পরম্পরায় মাঝেমধ্যে বয়ানের সুর পাল্টে দেন। তবে নতুন দলের সবাই মিলে জাতীয় স্মৃতি সৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। ‘মুক্তিযুদ্ধের’ সকল তীর্থস্থান গুঁড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো নেতাও সেখানে ছিলেন।

নতুন দল রাজনীতিতে ভারত ও পাকিস্তানপন্থি হবে না, বাংলাদেশপন্থি হবে- এ ঘোষণায় কোন নতুনত্ব নেই। এটাই তো স্বাভাবিক। আবার নতুন দলের নেতারা বিভিন্ন সময়ে ভারত বর্ষের আধিপত্যবাদী মনোভাব এবং পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখালেও সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের আভ্যন্তরীন রাজনীতি বিষয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ উক্তি করেছেন এবং পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর আমির বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের অংশ বানানোর যে হুঙ্কার দিয়েছেন সে সব বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেননি।

বৈষম্যবিরোধী সমাজের যে আকাক্সক্ষা এবারের গণসংগ্রামের মধ্য দিয়ে সামনে এসেছে তা বাস্তবায়নে তাদের আর্থিক নীতি কি হবে তাও স্পষ্ট নয়। শুধু ব্যক্তি বিশেষের আর্থিক লুন্ঠনের বিরুদ্ধে বলে তো লুন্ঠন বন্ধ করা যাবে না। এক দরবেশ জেলে থাকলেও নতুন দরবেশের উত্থান ঘটছে। ব্যাংক লুট, অর্থ পাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বললেও এসবের উৎস বিরাজমান লুটেরা পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিরুদ্ধে নতুন দলের কোনো বক্তব্য চোখে পড়ছে না। ভারত পাকিস্তানের তাবেদারি করবো না, কিন্তু বিশ্ব পুঁজিবাদের মোড়ল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দুনিয়া জুড়ে যে লুন্ঠন, আগ্রাসন ও আধিপত্য বিস্তার তার বিরুদ্ধেও কোন বক্তব্য নেই। তাই নতুন দলের ঘোষিত মধ্যপন্থার ভরকেন্দ্র এখন পর্যন্ত ডানদিকে হেলে আছে। মধ্য ডানপন্থা কি সমাজে বৈষম্য দূর করবে না বাড়াবে?

নতুন দলের সফলতা অর্জনের পথে এক বড় বাধা তাদের শর্টকাট পথে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার মানসিকতা এবং নিজেদের বর্তমান পরিবর্তনের সোল এজেন্ট ভাবা; কিন্তু ৫ আগস্টের ক্ষমতার পরিবর্তন শুধু এক দিনের বা এক মাসের ঘটনা নয়। দেশের বিরোধী দলসমূহ কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে, গুম খুন নির্যাতন,আর্থিক লুন্ঠনের প্রতিবাদে ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘকাল যাবৎ লড়াই করে আসছিলো। ২০২৩ সালের একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে এমন আন্দোলন গড়ে উঠেছিল যে একপর্যায়ে তৎকালীন সরকারই নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল এবং তারা সন্দিহান হয়ে পড়েছিল যে একতরফাভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারবে কিনা। এসব আন্দোলন এবং আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে তীব্র দমননীতি ও নিপীড়ন চালিয়ে হাস্যকর এক নির্বাচন আয়োজন করে সরকারই কিন্তু জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতি এবং লুটেরা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অভ্যন্তরীন সংকট রাষ্ট্র ক্ষমতার কাঠামোকেও ভেতরে ভেতরে ঝাঁজরা করে দিয়েছিল।

ছাত্র-গণআন্দোলনকে পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে মোকাবেলা করার নীতি নিয়ে অগ্রসর হওয়ার এক পর্যায়ে সেনাবাহিনীকে জাতিসংঘ সতর্ক করে যে যদি তারা এতে জড়িত হয়, তার অর্থ দাঁড়াবে তারা হয়ত আর শান্তিরক্ষী পাঠানোর দেশ থাকতে পারবে না। এই প্রতিক্রিয়ায় বন্দুকের নল শাসকদের দিকে ঘুরে যায় এবং সরকারের পতনই শুধু হয় না, শেখ হাসিনাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়। জাতিসংঘের এ ভূমিকায় প্রশ্ন উঠেছে আসল মাস্টার মাইন্ড কে। তিনি কি নিজেকে আড়াল করার জন্য বিশ্ব দরবারে আরেকজনকে দিয়ে প্রক্সি দেওয়ালেন! মাস্টার মাইন্ডরা মাইন্ড পরিষ্কার না করায় মানুষের মাঝেও নানা বিভ্রান্তি আছে। নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে ঢাকায় তিনবার কূটনীতিকের দায়িত্ব পালনকারী সাবেক মার্কিন কূটনীতিক জন এফ ড্যানিলোভিচের বক্তব্যে। তিনি বলেছেন ২০০৭-০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিরাট ভুল করেছিল। কী ভুল? এক এগারোর সরকার যে সংস্কারের এজেন্ডা নিয়ে এগোচ্ছিল তা বাদ দিয়ে একটা সময় এসে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরকে অগ্রাধিকার দেওয়া। এতে যুক্তরাষ্ট্রের ভুলের প্রশ্ন আসছে কেন? অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলে তার ভূমিকা রাখছিলো বলেই ভুলের প্রশ্ন আসছে। আর এক-এগারোর সরকারের কাছে সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রধান অগ্রাধিকার ছিল মাইনাস টু ফর্মুলা কার্যকর করাÑ যাতে যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতি বা সমর্থন ছিল। এবারেও ক্ষমতার পালাবদলে মার্কিনি ইঙ্গিতে শান্তি রক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশের সেনা প্রতিনিধিত্বকে ইস্যু করা হয়েছিল বলে ইতোমধ্যেই জাতিসংঘের কর্মকর্তারা বলেছেন। অর্থাৎ বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে শুধুমাত্র ভারতবর্ষ নয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ সম্পর্কে নীরব থেকে মাস্টার মাইন্ডের শিষ্যরা বুকের ছাতি ফুলিয়ে ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’ হাঁকডাক দিলেই নিজেদের স্বদেশি প্রমাণ করতে পারবেন না। বরং কিংস পার্টির সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা স্বার্থের পাহারাদারের তকমা জুটে যাবে।

রাজনৈতিক দলসমূহের এত বছরের সংগ্রামকে তারা সম্মানের সাথে না দেখলেও দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের যে নেতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতি রয়েছে অর্থাৎ চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, নিয়োগ বাণিজ্য ইত্যাদিকে সম্মান করে নতুন দলের একাংশ তা দ্রুত রপ্ত করে নিয়েছে। সচিবালয়, সরকারি অফিস আদালত, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সকল ক্ষেত্রে কথিত সমন্বয়ক নামে হস্তক্ষেপ চলছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনা হচ্ছে দেশে স্বৈরতন্ত্রের বদলে সমন্বয়কতন্ত্র কায়েম হলো কিনা।

অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দল গঠন এবং সেটা নিয়ে লুকোচুরি সরকার ও নতুন দলের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণœ করছে। রাজনৈতিক অঙ্গনের খবরাখবর যারা রাখেন তারা সবাই জানেন বিভিন্ন সময় নাহিদ ইসলাম (অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, বর্তমানে এনসিপির আহ্বায়ক), আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ আলম (বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা) এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃত্বসহ মন্ত্রীপাড়ায় তাদের যেখানে বাসা সেখানেই দল গঠন থেকে শুরু করে জোট গঠন বা বিভিন্ন ইস্যুতে বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়ে নিয়মিত বৈঠক হয়েছে, হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা তো আগেই বলেছেন ছাত্ররা দল করার জন্য প্রস্তুত, তাদের সুযোগ দেই। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব তো ভুলেই যান যে তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা। তিনি নতুন দলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। আইন উপদেষ্টাসহ অনেকেই অভিনন্দন জানিয়েছেন। এতে করে সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় প্রধান উপদেষ্টা যদি নিরপেক্ষতা ক্ষুণœ করেন তাহলে আর অবশিষ্ট রইলো কী? এবং দেশে বিদেশে তার যে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তা ক্ষুণœ হলে শুধু তিনি নন পুরো দেশ বিপদে পড়ে যাবে।

অন্যান্য রাজনৈতিক দল যে জাতীয় নাগরিক পার্টিকে কিংস পার্টি বলছে সে তকমা তারা নিজেরাই অর্জন করছেন। সারা দেশেই তারা প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে প্রথম থেকেই কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। সব সরকারি কর্মকর্তা পিরোজপুরের ডিসির ন্যায় লিখিত প্রমাণ রাখেন না। মৌখিক নির্দেশেই সহযোগিতার কাজ চলছে। এর মধ্যে দিয়ে কিন্তু একটা বিরাট রাজনৈতিক জটিলতার সৃষ্টি করা হচ্ছে যার দায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেই নিতে হবে। জাতীয় নাগরিক পার্টি যে ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে সেখান থেকে তারা আর বের হতে চাইছে না। তাই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে গনপরিষদ নির্বাচন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন, সেকেন্ড রিপাবলিক ইত্যাদি দাবি তুলছে। এসব দাবিতে ছাত্র গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়নি। তাই এসব দাবি উত্থাপন রাজনৈতিক জট সৃষ্টি করবে।

শেখ হাসিনা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকে ভয় পেতেন। তাই চোরাই ভোট করতেন। নতুন দলও নির্বাচনকে ভয় পায়। তারা চুরিটুরির ধার ধারে না। ভোটই করবে না। প্রাক্তন ছাত্রলীগ সৈনিক, ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দামের আস্থাভাজন প্রাক্তন সহচর নাগরিক পার্টির নেতা সারজিস আলম বলছেন, হাসিনার বিচার না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনের কথা যেন কেউ মুখেও না আনে। তারা তো সাত মাস ধরে ক্ষমতায় আছেন, বিচার করছেন না কেন? কে না করেছে? বরং এমনভাবে, যাচ্ছেতাইভাবে মামলা করেছেন যাতে মামলা দুর্বল হয়। ট্রাইব্যুনাল নিয়েই তো ইতোমধ্যে দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। জাতিসংঘ স্পষ্ট করে বলেছে, চাইলে সরকার শেখ হাসিনার বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে। হচ্ছেন না কেন? ‘হাসিনার বিচার’ হলো নাগরিক পার্টি ও অন্তর্বর্তী সরকারের মুলা। এ মুলা জাতিসংঘকে দিয়ে দিলে তারা ঝুলাবেন কি? নির্বাচনই বা ঝুলিয়ে রাখবেন কি বলে? আর যে সরকার দেশের আইন শৃঙ্খলাই নিয়ন্ত্রন করতে পারছেননা, অব্যাহত নারী নির্যাতন-নিপীড়ন এবং মব সৃষ্টিকারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না বা করছেন না তারা জুলাই হত্যাকা-ের বিচার করতে পারবেন কিনা জনমনে সে সন্দেহ ইতিমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। ভুল মানুষদের হাতে কি বাঁধা পড়েছে জুলাই! তারা কি ডেমোক্রেসির বদলে মবক্রেসি দিয়ে দেশ চালাতে চান?

এদিকে নাহিদ ইসলাম উপদেষ্টা থেকে পদত্যাগ করার পর কথাবার্তা বলছেন সরকারের উপদেষ্টার মতোই। তিনি বলেছেন, এ বছর নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হবে না। এ কথা বলার তিনি এখন কে? তিনি তো সরকারেও নেই, নির্বাচন কমিশনেও নেই; কিন্তু ভাবেসাবে তারাই ক্ষমতায়। তারাই সরকারকে ‘ডিকটেট’ করতে চায় বা করছে। এভাবে তো কিংস পার্টির খেতাব তারা নিজেরাই আমন্ত্রণ করে নিচ্ছেন। আন্দোলনের সময় তাদের পাশে ছিল শ্রমজীবীরা, এখন পাশে টাকাওয়ালারা। আবার টাকার উৎস নাকি বলা যাবে না। সূচনালগ্ন থেকেই পুরাতন ধারায় অগ্রসর হওয়ায় দেশবাসীর মাঝেও তারা নতুন কোনো প্রত্যাশা সৃষ্টি করতে পারছেন বলে মনে হয় না। নতুন দল রাজনৈতিক বিতর্কে যুক্তি মেনে নেওয়ার নমনীয়তা দেখাতে পারলে এবং দ্বিধা না রেখে দ্রুত তারা এবং সরকারে থাকা তাদের পরামর্শদাতারা মনের কথা খুলে বললে দল সৃষ্টির যৌক্তিকতা স্পষ্ট হতে পারে। আসলে কী আছে তাদের মনে?

[লেখক : সাবেক সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়ন]

back to top