রেজাউল করিম খোকন
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনায় তরুণদের নেতৃত্বে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করেছে। এক সমাবেশের মাধ্যমে দলটি যাত্রা শুরু করেছে। দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ (দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র) প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন তাদের মূল লক্ষ্য। এই প্রজাতন্ত্রে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা, ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন এবং গণতান্ত্রিক চরিত্র ধরে রাখা তাদের অগ্রাধিকার। তারা ২০২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনায় সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে দেশ গড়তে চান। তাদের মতে, বর্তমান সংবিধান এসব নিশ্চিত করতে ব্যর্থ, তাই নতুন সংবিধান প্রয়োজন।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা অনেক থাকলেও গণতান্ত্রিক কাঠামো মজবুত হয়নি। এর কারণ, দলগুলো জাতীয় স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে এবং জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় নাগরিক পার্টির উত্থান মূল্যায়ন করতে হবে। দলটির নেতারা গত জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তারা সবাই তরুণ, তাদের প্রধান শক্তি তরুণ্যের উচ্ছ্বাস। তারা বিভাজনের রাজনীতির বদলে ঐক্য, নতুন সংবিধান প্রণয়ন, প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন এবং গণতন্ত্র, সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাদের বক্তব্য, শহীদদের আত্মত্যাগ শুধু একটি সরকার পতনের জন্য নয়, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা ভেঙে জনগণের অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ার জন্য। তারা পরিবারতন্ত্রের বদলে মেধা ও যোগ্যতায় নেতৃত্ব এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় আনার কথাও বলেছেন।
ইতিহাসে দেখা যায়, বাংলাদেশের গণআন্দোলনে তরুণরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনে ছাত্ররা প্রবীণ নেতাদের অমান্য করে জীবন দিয়েছিলেন। ১৯৬৯ ও ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানেও তরুণেরা ছিলেন অগ্রভাগে। কিন্তু এসব আন্দোলনের পর রাজনীতি তরুণদের হাতে থাকেনি। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রতিশ্রুতি নেতারা রক্ষা করেননি। ক্ষমতায় গিয়ে তারা ব্যক্তিস্বার্থে মগ্ন হয়েছেন। তিনটি নির্বাচনে ভোটাধিকার হরণ করে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই বাস্তবতায় তরুণদের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রস্তাব আশার সঞ্চার করেছে।
নতুন দলের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সবাই একমত নাও হতে পারেন। তবে ঐক্য, ন্যায়বিচার, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন এবং মেধাভিত্তিক নেতৃত্বের আকাক্সক্ষার সঙ্গে দ্বিমত করা কঠিন। তবে তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, পুরোনো রাজনীতির দুর্বলতা থেকে মুক্ত থাকতে হবে। অর্থায়ন ও কর্মকা-ে স্বচ্ছতা, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতৃত্ব নির্বাচন জরুরি। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির দুর্বলতা হলো, অগণতান্ত্রিক দল দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। আশা করি, এই দল সেই পথে হাঁটবে না।
তারা ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ও গণপরিষদ নির্বাচনের কথা বলছেন। এটি জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া সম্ভব নয়। তারা জনমত গড়ে আন্দোলন বা নির্বাচনের মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করবেন। কিন্তু সরকার যদি তাদের দাবিতে জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে দেয়, রাজনৈতিক সংকট তৈরি হতে পারে। বর্তমান সংবিধানে গণপরিষদ নির্বাচনের সুযোগ নেই। তাই দ্রুত জাতীয় নির্বাচনই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার পথ।
পুরোনো রাজনীতি মিথ্যা, দুর্নীতিতে ভরা ছিল। ২০২৪-এর ৫ আগস্ট ক্ষমতার পরিবর্তন শুধু সরকার পতন নয়, নতুন রাজনীতির সূচনা। এর ফল হলো অবাধ নির্বাচন ও সংস্কারের দাবি। নতুন দল গঠন তারই একটি ধাপ। আগে যা অসম্ভব ছিল, আজ তর্ক-বিতর্কও সম্ভব হচ্ছে। ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’Ñবাংলাদেশ এখন নতুন যুগের সন্ধিক্ষণে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির চ্যালেঞ্জ হলো বিকল্প রাজনীতির মডেল দেয়া। তাদের কর্মকা- স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক হতে হবে। জনগণ যদি তাদের গ্রহণ করে, নির্বাচনে ক্ষমতায় গিয়ে তারা লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে পারবেন। অন্যথায় রাজনৈতিক সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে। রাজনীতি জনকল্যাণে কাজ করুক এবং রাজনীতিকেরা জনগণের সমস্যা বুঝুক। নতুন রাজনীতি যদি যোগ্যতা প্রমাণ করে, তবেই সমাজ ও জাতির পথ দেখাতে পারবে।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ]
রেজাউল করিম খোকন
শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনায় তরুণদের নেতৃত্বে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করেছে। এক সমাবেশের মাধ্যমে দলটি যাত্রা শুরু করেছে। দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ (দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র) প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন তাদের মূল লক্ষ্য। এই প্রজাতন্ত্রে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা, ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন এবং গণতান্ত্রিক চরিত্র ধরে রাখা তাদের অগ্রাধিকার। তারা ২০২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনায় সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে দেশ গড়তে চান। তাদের মতে, বর্তমান সংবিধান এসব নিশ্চিত করতে ব্যর্থ, তাই নতুন সংবিধান প্রয়োজন।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা অনেক থাকলেও গণতান্ত্রিক কাঠামো মজবুত হয়নি। এর কারণ, দলগুলো জাতীয় স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে এবং জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় নাগরিক পার্টির উত্থান মূল্যায়ন করতে হবে। দলটির নেতারা গত জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তারা সবাই তরুণ, তাদের প্রধান শক্তি তরুণ্যের উচ্ছ্বাস। তারা বিভাজনের রাজনীতির বদলে ঐক্য, নতুন সংবিধান প্রণয়ন, প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন এবং গণতন্ত্র, সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাদের বক্তব্য, শহীদদের আত্মত্যাগ শুধু একটি সরকার পতনের জন্য নয়, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা ভেঙে জনগণের অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ার জন্য। তারা পরিবারতন্ত্রের বদলে মেধা ও যোগ্যতায় নেতৃত্ব এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় আনার কথাও বলেছেন।
ইতিহাসে দেখা যায়, বাংলাদেশের গণআন্দোলনে তরুণরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনে ছাত্ররা প্রবীণ নেতাদের অমান্য করে জীবন দিয়েছিলেন। ১৯৬৯ ও ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানেও তরুণেরা ছিলেন অগ্রভাগে। কিন্তু এসব আন্দোলনের পর রাজনীতি তরুণদের হাতে থাকেনি। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রতিশ্রুতি নেতারা রক্ষা করেননি। ক্ষমতায় গিয়ে তারা ব্যক্তিস্বার্থে মগ্ন হয়েছেন। তিনটি নির্বাচনে ভোটাধিকার হরণ করে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই বাস্তবতায় তরুণদের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রস্তাব আশার সঞ্চার করেছে।
নতুন দলের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সবাই একমত নাও হতে পারেন। তবে ঐক্য, ন্যায়বিচার, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন এবং মেধাভিত্তিক নেতৃত্বের আকাক্সক্ষার সঙ্গে দ্বিমত করা কঠিন। তবে তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, পুরোনো রাজনীতির দুর্বলতা থেকে মুক্ত থাকতে হবে। অর্থায়ন ও কর্মকা-ে স্বচ্ছতা, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতৃত্ব নির্বাচন জরুরি। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির দুর্বলতা হলো, অগণতান্ত্রিক দল দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। আশা করি, এই দল সেই পথে হাঁটবে না।
তারা ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ও গণপরিষদ নির্বাচনের কথা বলছেন। এটি জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া সম্ভব নয়। তারা জনমত গড়ে আন্দোলন বা নির্বাচনের মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করবেন। কিন্তু সরকার যদি তাদের দাবিতে জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে দেয়, রাজনৈতিক সংকট তৈরি হতে পারে। বর্তমান সংবিধানে গণপরিষদ নির্বাচনের সুযোগ নেই। তাই দ্রুত জাতীয় নির্বাচনই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার পথ।
পুরোনো রাজনীতি মিথ্যা, দুর্নীতিতে ভরা ছিল। ২০২৪-এর ৫ আগস্ট ক্ষমতার পরিবর্তন শুধু সরকার পতন নয়, নতুন রাজনীতির সূচনা। এর ফল হলো অবাধ নির্বাচন ও সংস্কারের দাবি। নতুন দল গঠন তারই একটি ধাপ। আগে যা অসম্ভব ছিল, আজ তর্ক-বিতর্কও সম্ভব হচ্ছে। ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’Ñবাংলাদেশ এখন নতুন যুগের সন্ধিক্ষণে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির চ্যালেঞ্জ হলো বিকল্প রাজনীতির মডেল দেয়া। তাদের কর্মকা- স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক হতে হবে। জনগণ যদি তাদের গ্রহণ করে, নির্বাচনে ক্ষমতায় গিয়ে তারা লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে পারবেন। অন্যথায় রাজনৈতিক সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে। রাজনীতি জনকল্যাণে কাজ করুক এবং রাজনীতিকেরা জনগণের সমস্যা বুঝুক। নতুন রাজনীতি যদি যোগ্যতা প্রমাণ করে, তবেই সমাজ ও জাতির পথ দেখাতে পারবে।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ]