alt

উপ-সম্পাদকীয়

রামনবমী ঘিরে সাম্প্রদায়িক কৌশল

গৌতম রায়

: রোববার, ২৩ মার্চ ২০২৫

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে (’২৬ সালে ভোট) ততই দিল্লির শাসক বিজেপি আর বঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ঘিরে দড়ি টানাটানি বেড়েই চলেছে। গত বেশ কয়েক বছর ধরে রামনবমীকে কেন্দ্র করে গোটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি, ধর্মের নামে রাজনৈতিক হিংসায় মেতে ওঠে। রাজ্যের প্রশাসন বা শাসক দল, কেন্দ্রের শাসক দলের এই হিংসা বন্ধে কোনোরকম প্রশাসনিক অবস্থান নেয় না। রাজনৈতিক অবস্থানও নেয় না। ফলে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু মিশ্র জনজাতির এলাকায় সম্প্রদায়িক উত্তেজনা চরমে ওঠে। বহু ক্ষেত্রে সেসব উত্তেজনা থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নয়। একতরফাভাবে মুসলমান সমাজের মানুষের ওপরে চলে নানা ধরনের শারীরিক হামলা। চলে অর্থনৈতিক হামলা। তাদের দোকানপাট অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে লুটপাট করা হয়। তাদের ওপর শারীরিক নিগ্রহ এমন জায়গায় যায়, বহু ক্ষেত্রেই তা তাদের জীবন সংশয়ের কারণ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে নারীর সম্ভ্রম রক্ষার প্রশ্নে এক ভয়াবহ আকার ধারণ করে।

রামনবমীকে কেন্দ্র করে আপামর হিন্দু বাঙালিদের উচ্ছ্বাস-- এটি পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিতে জোর করে চাপিয়ে দিয়েছে ধর্মান্ধ সম্প্রদায়িক শক্তি বিজেপি- আরএসএস। আর তাকে সাধারণের জীবন জীবিকার প্রশ্নে একটা দুর্বিসহ জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক শক্তি তৃণমূল কংগ্রেস। রামনবমী ঘিরে আবেগ পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু বাঙালির তেমন ছিল না। বাংলায় কয়েকশ বছর আগে হিন্দি বলয়ের যে সমস্ত মানুষ নানা ধরনের রুটি রুজির স্বার্থে এসে ক্রমশ নিজেদের হিন্দি বলের সত্ত্বাকে বাঙালি সত্ত্বার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে, মিশিয়ে দিয়েছে, যাদের পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ বলা হয়, ব্রাহ্মণ সমাজে বা দক্ষিণাত্য থেকে আসা দাক্ষিণাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ, তারা তাদের ধর্মীয় সংস্কৃতিতে, অতীতের ধারাবাহিকতা আজও প্রবাহিত করবার চেষ্টা করে।

আর সেই চেষ্টা থেকেই পাশ্চাত্য বৈদিক বাঙালি ব্রাহ্মণ যারা পশ্চিমবঙ্গে রয়েছেন, যারা প্রকৃতপক্ষে বাঙালি নন। দীর্ঘদিন বাংলায় থাকার দরুণ ভাষা- সংস্কৃতি ইত্যাদির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়লেও, বাংলার ধর্মীয় আচার-আচরণ, বিশেষ করে লোকায়ত সংস্কৃতির সঙ্গে এদের একটা দুস্তর ফারাক রয়েছে। সেই অংশের বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে দশরথনন্দন রামকে ঘিরে উৎসাহ বেশি দেখা যায়। রামনবমী ঘিরে তারা ধর্মীয় উৎসব পালন করেন। আরএসএস-বিজেপি এবং তাদের স্বাভাবিক মিত্র তৃণমূল কংগ্রেস, যেভাবে আজকের হিন্দি বলয়ের ধর্মীয় সংস্কৃতির রাজনৈতিক রূপান্তর হিসেবে রামনবমী কে পালন করে, হিংসাত্মক রামনবমীকে পালন করে, বাংলায় প্রবাহিত রামনবমীর সঙ্গে তার এতটুকু সংযোগ নেই। এতটুকু সম্পর্ক নেই।

অথচ তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন হওয়ার অব্যবহিত আগের সময় থেকে, তারা এই রাজ্যে ক্ষমতাসীন হওয়া এবং তার অল্প সময় পর, কেন্দ্রে বিজেপি সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরের সময় থেকে, পশ্চিমবঙ্গের ধর্মীয় সংস্কৃতিতে যে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ধারা সংমিশ্রিত হতে শুরু করে, সেই ধারাই এক নগ্ন প্রকাশ আমরা দেখতে পাই এই রামনবমীকে কেন্দ্র করে।

হিন্দি বলয়ে দীর্ঘদিন এই রামনবমীকে কেন্দ্র করে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি বিভৎস সাম্প্রদায়িক তা-ব চালায়। সাম্প্রতিক অতীতে এই রামনবমীকে কেন্দ্র করে হিন্দি বলয়ে সন্ত্রাসী, হিংসাত্মক রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রাদুর্ভাব শুরু হয়, কেন্দ্রে যখন মোরারজি দেশাইয়ের সরকার ক্ষমতায় রয়েছে সেই সময়কালে অবিভক্ত বিহারের জামশেদপুরে।

এই সময়ে রামনবমীর পতাকাবাহী মিছিল ঘিরে কে আগে যাবে, কে পড়ে যাবে-- এইরকম একটি সংঘাতের পরিবেশ তৈরি করে অবিভক্ত বিহারের জামশেদপুরে প্রথম সম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু করে আরএসএস এবং তাদের সহযোগী শক্তিগুলো।

অবিভক্ত বিহারে জামশেদপুরে ’৭৯ সালে রামনবমী কে কেন্দ্র করে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির দাঙ্গা বাঁধানো তার পেছনে অবশ্যই কংগ্রেসেরও একটা বড় ভূমিকা ছিল। কারণ, মোরারজি দেশাই সরকারকে বিধ্বস্ত করে, সেই সরকারের পতন ঘটিয়ে, ক্ষমতায় ফিরে আসার লক্ষ্যে কংগ্রেস তখন কার্যত দিশাহারা। তাই গোটা হিন্দুত্ববাদী শক্তিকে রামনবমী ঘিরে ’৭৯ সালে জামশেদপুরে দাঙ্গা বাঁধাবার ক্ষেত্রে সেসময় কংগ্রেসের ও যথেষ্ট ভূমিকা ছিল।

রামনবমীকে ঘিরে উৎসব এবং ধর্মের একধরনের রাজনৈতিক আগ্রাসন, সেটি একটা সময় পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল ভারতের হিন্দি বলয়, বা গোবলয় নামে যে অংশটি পরিচিত, উত্তরপ্রদেশ ,বিহার ইত্যাদি জায়গাতে। এই নিবন্ধকার ’৭৯ সালের রামনবমীর সময়কালে, জম্মু তাওয়াই এক্সপ্রেসের করে জম্মু থেকে ফিরছিলেন। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা হল; ট্রেনের সংরক্ষিত কামরায় উঠবার তাগিদে উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে ফৈজাবাদ জেলার বিভিন্ন জায়গায়, এই তথাকথিত ‘রাম ভক্ত’রা সশস্ত্র হামলা চালিয়েছিল। ট্রেনের সংরক্ষিত কামরার মধ্যে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেক যাত্রীকে তখন কার্যত প্রাণ হাতে করে বসে থাকতে হয়েছিল। সংরক্ষিত কামরায় যে পুলিশ পাহারা ছিল, তারাই ট্রেনের দরজা খুলে দেয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছিল।

আজ ১২-১৪ বছর ধরে রামনবমীকে কেন্দ্র করে গোটা পশ্চিমবঙ্গ এইরকম হিন্দুত্বের গবেষণাগার হয়ে উঠেছে। ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান মহাকাব্য রাম কাহিনী নায়ক রামচন্দ্রকে ঘিরে কিছু মানুষের ব্যক্তিগত আবেগ আছে। ধর্মীয় বিশ্বাস আছে। পশ্চিমবঙ্গে মূলত শুধু যারা হিন্দি বলয় থেকে এসেছেন এবং কালক্রমে উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলার সংস্কৃতিকে অনেকখানি একাত্ম করে, পশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ সমাজ, যারা প্রকৃতপক্ষে বাঙালি নন , তারা এই রামনবমীকে নিয়ে কেন্দ্র করে এতকাল নিজেদের নিজেদের বাড়িতে নানা ধরনের ধর্মীয় পূজার্চনা করতেন।

এছাড়াও হাওড়ার রামরাজাতলা অঞ্চলে রাম কাহিনী নায়ককে ঘিরে কিছু মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় আবেগ ইত্যাদি রয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন ঘিরে যদি আমরা আলোচনা করি তাহলে দেখতে পাবো, তাঁর সাধন পর্বে উত্তর ভারতীয় এক সাধক দক্ষিণেশ্বর ত্যাগ করবার সময় নিজের উপাস্য একটি শিশুরামের ধাতব মূর্তি শ্রীরামকৃষ্ণকে দিয়ে গিয়েছিলেন।

সেই শিশুরামকে রামলালা হিসেবে একেবারে শ্রীকৃষ্ণের বাল্যকাল, যেটিকে গোপাল হিসেবে পূজাদি করা হয়, তেমনটাই শ্রীরামকৃষ্ণ করতেন।

রামনবভূমিকে ঘিরে পারস্পরিক রাজনৈতিক তরজা এবং ধর্মান্ধ সম্প্রদায়িক শক্তি বিজেপি, আরএসএস, তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরা আর প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক শক্তি তৃণমূলের পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে মেরুকরণের রাজনীতি ভয়ংকর আকার ধারণ করে ২০১৮ সালের রামনবমীর সময়কাল থেকে। ২০১০-১১ থেকে শুরু করে, তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যের ক্ষমতায় আসা বা কেন্দ্রে বিজেপির ক্ষমতায় আসাÑ এই সময়কালেও কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বুকে হিংসাত্মক রামনবমী এই ব্যাপারটা কিছুটা হলেও সংযত আকারে পালন করতো দুই সাম্প্রদায়িক শিবির বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস।

চলতি বছরের (’২৫) রামনবমীকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতিকে লাগামহীন করে দেয়ার প্ররোচনা ছড়াতে শুরু করেছে বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী। তৃণমূল ও তার পাল্টা অবস্থান নিতে , যাতে আখেরে বিজেপি সুবিধা হয়, সেই জায়গা নিতে কসুর করছে না।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

বয়নামা দলিল কখন স্বত্বের দলিল হিসেবে পরিগণিত হয়?

বর্ষার আগেই নদীভাঙনের আতঙ্কে উপকূলবাসী

ছবি

ভূমিকম্প ঝুঁকিতে দেশ : মোকাবিলায় প্রস্তুতি প্রয়োজন

‘রিসেটের’ পরাকৌশল কী হওয়া প্রয়োজন

প্রসঙ্গ : জাতীয় বাজেট

ব্রুনোর শ্মশান মঞ্চ

দুর্নীতির অবিশ্বাস্য খতিয়ান

সাম্য, ন্যায়বিচার, সুশাসন, বহুত্ববাদ : সবকা সাথ্ সবকা বিকাশ!

পশ্চিমবঙ্গে ভয়াবহ সংকটে ধর্মনিরপেক্ষতা

পেশাগত দায় ও নৈতিকতা

বিনোদনের রূপান্তর : সংস্কৃতির সংকোচন ও নতুন পথ

রম্যগদ্য : ‘চোর চাই, চোর...’

শুভ-অশুভ বলে কিছু কি আছে

পহেলা বৈশাখের সঙ্গে মিশে আছে কৃষি ও কৃষক

বাংলাদেশে ঘটনা অঘটন: প্রায় সবক্ষেত্রেই ইস্যু নির্বাচন

ছবি

নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদ

বৈসাবি : সম্মিলনের জাতীয় উৎসব

সংকট ও সংক্রান্তির শক্তি

ছবি

গাজার অশ্রু : ইসরায়েলের বর্বরতা ও বিশ্বের নীরবতা

দেশের কৃষি অর্থনীতির নীরব নায়িকারা

বহুমাত্রিক দ্বন্দ্বের ফেরে বিএনপি ও এনসিপি

ফৌজদারি মামলায় অপরাধের আলামত উদ্ধারে আইন মানতে বাধা কোথায়?

জলবায়ুর নতুন ছকে বদলে যাচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ভারতে ওয়াকফ সংশোধনী আইন নিয়ে বিতর্ক

কীটনাশকের বিষচক্র : উন্নয়নের নামে শোষণ ও বিপর্যয়

বোরো ধান উৎপাদনে প্রধান অন্তরায় বিদ্যুৎ-বিভ্রাট

ঢাকার বাসিন্দাদের নিঃশ্বাসে এক বিপন্নতা

‘রিফাইন্ড’ আওয়ামী লীগ হলে ‘ওয়াশিং মেশিন পার্টি’ বেকার হয়ে পড়বে না তো!

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশে সংক্ষুব্ধ ‘আমরা’ কারা?

বাসন্তী পূজা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস : বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার চিত্র

মার্কিন নীতির পরিবর্তনে ইউক্রেনের পরিণতি

গাজা : ক্রমবর্ধমান মানবিক ও রাজনৈতিক সংকট

নিষিদ্ধ পলিথিনে বিপন্ন প্রকৃতি

রাজনৈতিক রূপান্তরের এক সতর্কবার্তা

ধর্ষণের বিরুদ্ধে লড়াই : আইনের শক্তি ও সমাজের দুর্বলতা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

রামনবমী ঘিরে সাম্প্রদায়িক কৌশল

গৌতম রায়

রোববার, ২৩ মার্চ ২০২৫

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে (’২৬ সালে ভোট) ততই দিল্লির শাসক বিজেপি আর বঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ঘিরে দড়ি টানাটানি বেড়েই চলেছে। গত বেশ কয়েক বছর ধরে রামনবমীকে কেন্দ্র করে গোটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি, ধর্মের নামে রাজনৈতিক হিংসায় মেতে ওঠে। রাজ্যের প্রশাসন বা শাসক দল, কেন্দ্রের শাসক দলের এই হিংসা বন্ধে কোনোরকম প্রশাসনিক অবস্থান নেয় না। রাজনৈতিক অবস্থানও নেয় না। ফলে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু মিশ্র জনজাতির এলাকায় সম্প্রদায়িক উত্তেজনা চরমে ওঠে। বহু ক্ষেত্রে সেসব উত্তেজনা থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নয়। একতরফাভাবে মুসলমান সমাজের মানুষের ওপরে চলে নানা ধরনের শারীরিক হামলা। চলে অর্থনৈতিক হামলা। তাদের দোকানপাট অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে লুটপাট করা হয়। তাদের ওপর শারীরিক নিগ্রহ এমন জায়গায় যায়, বহু ক্ষেত্রেই তা তাদের জীবন সংশয়ের কারণ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে নারীর সম্ভ্রম রক্ষার প্রশ্নে এক ভয়াবহ আকার ধারণ করে।

রামনবমীকে কেন্দ্র করে আপামর হিন্দু বাঙালিদের উচ্ছ্বাস-- এটি পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিতে জোর করে চাপিয়ে দিয়েছে ধর্মান্ধ সম্প্রদায়িক শক্তি বিজেপি- আরএসএস। আর তাকে সাধারণের জীবন জীবিকার প্রশ্নে একটা দুর্বিসহ জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক শক্তি তৃণমূল কংগ্রেস। রামনবমী ঘিরে আবেগ পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু বাঙালির তেমন ছিল না। বাংলায় কয়েকশ বছর আগে হিন্দি বলয়ের যে সমস্ত মানুষ নানা ধরনের রুটি রুজির স্বার্থে এসে ক্রমশ নিজেদের হিন্দি বলের সত্ত্বাকে বাঙালি সত্ত্বার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে, মিশিয়ে দিয়েছে, যাদের পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ বলা হয়, ব্রাহ্মণ সমাজে বা দক্ষিণাত্য থেকে আসা দাক্ষিণাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ, তারা তাদের ধর্মীয় সংস্কৃতিতে, অতীতের ধারাবাহিকতা আজও প্রবাহিত করবার চেষ্টা করে।

আর সেই চেষ্টা থেকেই পাশ্চাত্য বৈদিক বাঙালি ব্রাহ্মণ যারা পশ্চিমবঙ্গে রয়েছেন, যারা প্রকৃতপক্ষে বাঙালি নন। দীর্ঘদিন বাংলায় থাকার দরুণ ভাষা- সংস্কৃতি ইত্যাদির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়লেও, বাংলার ধর্মীয় আচার-আচরণ, বিশেষ করে লোকায়ত সংস্কৃতির সঙ্গে এদের একটা দুস্তর ফারাক রয়েছে। সেই অংশের বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে দশরথনন্দন রামকে ঘিরে উৎসাহ বেশি দেখা যায়। রামনবমী ঘিরে তারা ধর্মীয় উৎসব পালন করেন। আরএসএস-বিজেপি এবং তাদের স্বাভাবিক মিত্র তৃণমূল কংগ্রেস, যেভাবে আজকের হিন্দি বলয়ের ধর্মীয় সংস্কৃতির রাজনৈতিক রূপান্তর হিসেবে রামনবমী কে পালন করে, হিংসাত্মক রামনবমীকে পালন করে, বাংলায় প্রবাহিত রামনবমীর সঙ্গে তার এতটুকু সংযোগ নেই। এতটুকু সম্পর্ক নেই।

অথচ তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন হওয়ার অব্যবহিত আগের সময় থেকে, তারা এই রাজ্যে ক্ষমতাসীন হওয়া এবং তার অল্প সময় পর, কেন্দ্রে বিজেপি সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরের সময় থেকে, পশ্চিমবঙ্গের ধর্মীয় সংস্কৃতিতে যে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ধারা সংমিশ্রিত হতে শুরু করে, সেই ধারাই এক নগ্ন প্রকাশ আমরা দেখতে পাই এই রামনবমীকে কেন্দ্র করে।

হিন্দি বলয়ে দীর্ঘদিন এই রামনবমীকে কেন্দ্র করে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি বিভৎস সাম্প্রদায়িক তা-ব চালায়। সাম্প্রতিক অতীতে এই রামনবমীকে কেন্দ্র করে হিন্দি বলয়ে সন্ত্রাসী, হিংসাত্মক রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রাদুর্ভাব শুরু হয়, কেন্দ্রে যখন মোরারজি দেশাইয়ের সরকার ক্ষমতায় রয়েছে সেই সময়কালে অবিভক্ত বিহারের জামশেদপুরে।

এই সময়ে রামনবমীর পতাকাবাহী মিছিল ঘিরে কে আগে যাবে, কে পড়ে যাবে-- এইরকম একটি সংঘাতের পরিবেশ তৈরি করে অবিভক্ত বিহারের জামশেদপুরে প্রথম সম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু করে আরএসএস এবং তাদের সহযোগী শক্তিগুলো।

অবিভক্ত বিহারে জামশেদপুরে ’৭৯ সালে রামনবমী কে কেন্দ্র করে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির দাঙ্গা বাঁধানো তার পেছনে অবশ্যই কংগ্রেসেরও একটা বড় ভূমিকা ছিল। কারণ, মোরারজি দেশাই সরকারকে বিধ্বস্ত করে, সেই সরকারের পতন ঘটিয়ে, ক্ষমতায় ফিরে আসার লক্ষ্যে কংগ্রেস তখন কার্যত দিশাহারা। তাই গোটা হিন্দুত্ববাদী শক্তিকে রামনবমী ঘিরে ’৭৯ সালে জামশেদপুরে দাঙ্গা বাঁধাবার ক্ষেত্রে সেসময় কংগ্রেসের ও যথেষ্ট ভূমিকা ছিল।

রামনবমীকে ঘিরে উৎসব এবং ধর্মের একধরনের রাজনৈতিক আগ্রাসন, সেটি একটা সময় পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল ভারতের হিন্দি বলয়, বা গোবলয় নামে যে অংশটি পরিচিত, উত্তরপ্রদেশ ,বিহার ইত্যাদি জায়গাতে। এই নিবন্ধকার ’৭৯ সালের রামনবমীর সময়কালে, জম্মু তাওয়াই এক্সপ্রেসের করে জম্মু থেকে ফিরছিলেন। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা হল; ট্রেনের সংরক্ষিত কামরায় উঠবার তাগিদে উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে ফৈজাবাদ জেলার বিভিন্ন জায়গায়, এই তথাকথিত ‘রাম ভক্ত’রা সশস্ত্র হামলা চালিয়েছিল। ট্রেনের সংরক্ষিত কামরার মধ্যে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেক যাত্রীকে তখন কার্যত প্রাণ হাতে করে বসে থাকতে হয়েছিল। সংরক্ষিত কামরায় যে পুলিশ পাহারা ছিল, তারাই ট্রেনের দরজা খুলে দেয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছিল।

আজ ১২-১৪ বছর ধরে রামনবমীকে কেন্দ্র করে গোটা পশ্চিমবঙ্গ এইরকম হিন্দুত্বের গবেষণাগার হয়ে উঠেছে। ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান মহাকাব্য রাম কাহিনী নায়ক রামচন্দ্রকে ঘিরে কিছু মানুষের ব্যক্তিগত আবেগ আছে। ধর্মীয় বিশ্বাস আছে। পশ্চিমবঙ্গে মূলত শুধু যারা হিন্দি বলয় থেকে এসেছেন এবং কালক্রমে উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলার সংস্কৃতিকে অনেকখানি একাত্ম করে, পশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ সমাজ, যারা প্রকৃতপক্ষে বাঙালি নন , তারা এই রামনবমীকে নিয়ে কেন্দ্র করে এতকাল নিজেদের নিজেদের বাড়িতে নানা ধরনের ধর্মীয় পূজার্চনা করতেন।

এছাড়াও হাওড়ার রামরাজাতলা অঞ্চলে রাম কাহিনী নায়ককে ঘিরে কিছু মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় আবেগ ইত্যাদি রয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন ঘিরে যদি আমরা আলোচনা করি তাহলে দেখতে পাবো, তাঁর সাধন পর্বে উত্তর ভারতীয় এক সাধক দক্ষিণেশ্বর ত্যাগ করবার সময় নিজের উপাস্য একটি শিশুরামের ধাতব মূর্তি শ্রীরামকৃষ্ণকে দিয়ে গিয়েছিলেন।

সেই শিশুরামকে রামলালা হিসেবে একেবারে শ্রীকৃষ্ণের বাল্যকাল, যেটিকে গোপাল হিসেবে পূজাদি করা হয়, তেমনটাই শ্রীরামকৃষ্ণ করতেন।

রামনবভূমিকে ঘিরে পারস্পরিক রাজনৈতিক তরজা এবং ধর্মান্ধ সম্প্রদায়িক শক্তি বিজেপি, আরএসএস, তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরা আর প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক শক্তি তৃণমূলের পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে মেরুকরণের রাজনীতি ভয়ংকর আকার ধারণ করে ২০১৮ সালের রামনবমীর সময়কাল থেকে। ২০১০-১১ থেকে শুরু করে, তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যের ক্ষমতায় আসা বা কেন্দ্রে বিজেপির ক্ষমতায় আসাÑ এই সময়কালেও কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বুকে হিংসাত্মক রামনবমী এই ব্যাপারটা কিছুটা হলেও সংযত আকারে পালন করতো দুই সাম্প্রদায়িক শিবির বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস।

চলতি বছরের (’২৫) রামনবমীকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতিকে লাগামহীন করে দেয়ার প্ররোচনা ছড়াতে শুরু করেছে বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী। তৃণমূল ও তার পাল্টা অবস্থান নিতে , যাতে আখেরে বিজেপি সুবিধা হয়, সেই জায়গা নিতে কসুর করছে না।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

back to top