alt

উপ-সম্পাদকীয়

ঈদে বাড়ি ফেরা নিরাপদ হোক

কামরুজ্জামান

: শনিবার, ২৯ মার্চ ২০২৫

কাজের প্রয়োজনে মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে কর্মস্থলের আশপাশেই বসবাস করে। যখন উৎসব পার্বণে ছুটি একটু বেশি পায় তখন নাড়ীর টানে বাড়ি ফিরে। আমাদের দেশে নব্বইয়ের দশকের দিকে শিল্পায়ন শুরু হলে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সাভার ও গাজীপুরে শিল্প কারখানা গড় উঠতে থাকে। বিশেষ তৈরি পোশাক শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয় কর্মসংস্থানের। যার ফলে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ কাজের সন্ধানে ঢাকাসহ আশপাশের জেলায় আসতে থাকে। এবং শিল্প কারখানায় চাকরির সুযোগ তৈরি করে নেয়। শিল্প কারখানায় নিয়োজিত এই সব লোক বছরের দুই ঈদ উৎসবে একযোগে বাড়ি গিয়ে থাকে।

অতিরিক্ত জনসংখ্যার এই দেশে কাজের সন্ধানে মানুষ সবসময়ই ঢাকামুখী। আর এ কারণে ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফেরার ধুম লেগে যায়। একই সময়ে সবার ছুটি কার্যকর হওয়ায় বাড়ি ফেরার চাপও বেড়ে যায়। আর এর প্রভাব গিয়ে পড়ে সড়ক মহাসড়ক, জনপথ ও গণপরিবহনের ওপর।

আমাদের দেশের জনসংখ্যা প্রায় বিশ কোটি। গণপরিবহন আছে পঞ্চাশ লাখের একটু বেশি। আর বৈধ লাইসেন্সধারী ড্রাইভার আছে চল্লিশ লাখের মতো। এর বাইরে সড়ক মহাসড়কে চলাচল করে থ্রি হুইলার, অটোরিকশা ও ফিটনেসবিহীন অসংখ্য পরিবহন। আছে লেগুনা, তাকওয়ার মতো অবৈধ পরিবহনের রামরাজত্ব।

দেশের মানুষ চলাচলের জন্য অভ্যন্তরীণ পথে আকাশপথ, রেলপথ, নৌপথ ও সড়কপথ এই চারটি পথই ব্যবহার করে। তবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে সড়ক পথ। এরপর নৌপথ ও রেলপথ ব্যবহার করে।

আমাদের দেশে গণপরিবহনে অব্যবস্থাপনা ও অসচেতনতার কারণে সারা বছরই সড়ক মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটে। তবে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে ঈদ যাত্রায়। বিগত বছরগুলোতে আমরা দেখেছি ঈদযাত্রায় সড়ক মহাসড়কে অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটতে এবং অনেক মানুষকে মারা যেতে। সড়ক মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটার অনেক কারণ রয়েছে।

ঈদকে সামনে রেখে গণপরিবহনে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা হয়। এর কারণও আছে। সবার একসাথে ছুটি হওয়ার কারণে বাড়িতে যাওয়ার চাপ একসাথে পড়ে। এর ফলে গণপরিবহনের সংকট দেখা দেয়। এই সুযোগটি কাজে লাগায় পরিবহন মালিক ও শ্রমিকশ্রেণী। বেশির ভাগ গাড়িতেই অতিরিক্ত যাত্রী বহন করে যাত্রা শুরু করে। এর ফলে সড়কে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। অতিরিক্ত ওজনের কারণে গাড়ি গতি নিয়ন্ত্রণ হারায়। ঘটে সড়ক দুর্ঘটনা।

সড়ক মহাসড়কে সবসময় অটোরিকশা ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির আধিক্য থাকে। ঈদের সামনে এদের দৌরাত্ম আরও বেড়ে যায়। অতিরিক্ত টাকা আয় করার জন্য এরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এদের কারণে সড়ক মহাসড়কে দূরপাল্লার গাড়ি ও অন্যান্য গণপরিবহন চলাচলে অসুবিধার সৃষ্টি হয়। ফলে ঘটে দুর্ঘটনা। এছাড়া ড্রাইভাররা গাড়ি নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। কার আগে কে যাবে। একবার যাত্রী নামিয়ে এসে আবার যাত্রী নেয়ার প্রতিযোগিতা করে। এ কারণে দ্রুতগতিতে তারা গাড়ি চালায়। আর ঘটে সড়ক দুর্ঘটনা।

আমাদের দেশে এমনিতেই গণপরিবহনের তুলনায় দক্ষ ও বৈধ লাইসেন্সধারী ড্রাইভারের সংখ্যা কম। ঈদ উৎসবে এই বিষয়টি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। অর্থাৎ লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভাররা গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে টাকা উপার্জনের জন্য। যার ফলে এদের অদক্ষতায় সড়কে ঘটে দুর্ঘটনা।

হকারদের কারণে রাস্তার পাশের ফুটপাত দখল ও সড়ক মহাসড়কে ভাসমান দোকান গড়ে ওঠায় প্রতিনিয়ত যানজট লেগেই থাকে। এর প্রভাব পড়ে রাস্তায় চলাচলকারী পরিবহনের ওপর। ড্রাইভিং করার সময় রাস্তায় যানজট, রাস্তা দখল ও অবৈধ অন্যান্য পরিবহন বেড়ে যাওয়ায় ড্রাইভাররা বিরক্ত হয়ে ওঠে। যার জন্য ধৈর্য হারিয়ে ড্রাইভাররা দুর্ঘটনা ঘটায়। তাছাড়া গাড়ি চালানোর সময় অতিরিক্ত গতি ও ওভারটেকিংয়ের জন্যও সড়ক মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটে।

রাস্তার শৃঙ্খলা ধরে রাখার জন্য ঈদে ঘর ফেরা মানুষের নিরাপত্তায় সবসময়ই দেখি অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাও থাকে সচেষ্ট। কিন্তু তারপরও ঘটে যায় সড়ক দুর্ঘটনা। এক্ষেত্রে সড়ক মহাসড়কে শৃঙ্খলা আনয়ন এবং ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশি তৎপরতা আরও কার্যকর হওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে যেসব অবৈধ ও ফিটনেসবিহীন পরিবহন রয়েছে সেগুলো কোনোভাবেই চলতে দেয়া উচিত নয়। আমাদের দেশে সবসময়ই দেখা যায়Ñ সড়ক মহাসড়ক ও জলপথে পরিবহন দুর্ঘটনা ঘটলে বলা হয় যানটির ফিটনেস ছিল না কিংবা ড্রাইভারের ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিন না। সেজন্য অবৈধ গাড়ি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভারদের দৌরাত্ম বন্ধ করা প্রয়োজন। আর এ কাজটি অবশ্যই পুলিশকে করতে হবে।

ফিটনেসবিহীন পরিবহন ও লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ ড্রাইভারদের কারণে সড়ক ও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। তখন ট্রাফিক পুলিশের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যায়। যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, যাত্রী উঠানো নামানো ইত্যাদি কারণে অনেক সময় যাত্রী সাধারণও দুর্ঘটনায় পতিত হয়। ঈদে ঘর ফেরা মানুষের মানসিক চঞ্চলতা, বাড়ির প্রতি নাড়ির টান অস্থিরতায় ফেলে দেয়। তখন তাড়াহুড়ো করতে গিয়েও দুর্ঘটনায় পতিত হয়।

দেশের দক্ষিণ বঙ্গে বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোতে যোগাযোগে এখনও জলপথ ব্যবহার করা হয়। পদ্মা সেতু নির্মাণের আগে অবশ্য জলপথই একমাত্র মাধ্যম ছিল। তখন দেখতাম মাঝেমধ্যে নদীপথে যাত্রী নিয়ে লঞ্চ স্টিমার ডুবে যেতো। শয়ে শয়ে মানুষ মারা যেতো। পদ্মা সেতু হওয়ায় জলপথে যাতায়াত অনেক কমে গেছে। তারপরও যেসকল জাহাজ, লঞ্চ ও স্টিমার চলাচল করছে সেগুলো অতিরিক্ত যাত্রী বহনের কারণে ঝুঁকি থেকেই যায়। তাছাড়া ঈদকে সামনে রেখে একশ্রেণীর অসাধু লোভি লঞ্চ-স্টিমার মালিক ফিটনেসবিহীন লঞ্চ ও স্টিমার যাত্রী পরিবহনে ব্যবহার করে যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ।

সড়ক মহাসড়কে পরিবহন দুর্ঘটনা ঘটলে মানুষ যেমন মারা যায় তেমনি অসংখ্য মানুষ আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে। একটা মানুষের জীবনে পঙ্গুত্ব বরণ করার মতো এতো বড় দুর্বিষহ যন্ত্রণা আর কিছু নেই। তিলে তিলে একটি পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়। পরিবহন ক্ষতিগ্রস্ত হলে মালিক পক্ষও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। মোট কথাÑ একটা সড়ক দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না।

ঈদযাত্রা নিরাপদ করার জন্য কিছু নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চললে সড়ক মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব। যেমনÑ সড়ক মহাসড়কে শৃঙ্খলা ধরে রাখার জন্য অতিরিক্ত ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন। অবৈধ অটোরিকশা, থ্রি হুইলার, ফিটনেসবিহীন পরিবহন সড়ক মহাসড়কে চলাচলে কড়াকড়ি আরোপ। অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভারদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ ও ওভারটেকিং বন্ধ করা। এক্ষেত্রে ড্রাইভারদের সচেতন করতে হবে। অতিরিক্ত যাত্রী বহন অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। সড়ক মহাসড়কে গাড়ি চালানোর সময় প্রতিযোগী মনোভাব ত্যাগ করতে হবে। এই কাজগুলো করতে পারলে ঈদযাত্রায় দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সুফল পাওয়া সম্ভব।

ঈদযাত্রায় নিরাপদ ভ্রমণের জন্য সচেতনতার বিকল্প নেই। বিশেষ করে পরিবহন মালিক ও ড্রাইভারদের সবচেয়ে বেশি সচেতনতা প্রয়োজন। যাত্রী সাধারণেরও বুঝেশুনে গাড়িতে ভ্রমণ করা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবেÑ সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি।

[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, গাজীপুর]

ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়

প্রযুক্তির ফাঁদে শৈশব : স্ক্রিন টাইম গিলে খাচ্ছে খেলার মাঠ

রমগদ্য : সিরাজগঞ্জে ‘ব্রিটিশ প্রেতাত্মা’

বামপন্থা : নীতির সঙ্গে নেতৃত্বের ভূমিকা

দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ : জনশিক্ষা ও সুশাসনের পথ

ইমাম রইস উদ্দিন হত্যাকাণ্ড : সুবিচার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব

কারাগার, সংশোধনাগার ও ভবঘুরে কেন্দ্রগুলোর সংস্কার কি হবে

জ্বালানির বদল, জীবিকার ঝুঁকি

প্রসঙ্গ : রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও চট্টগ্রামে এস্কর্ট ডিউটি

দেশটা কারো বাপের নয়!

বুদ্ধের বাণীতে বিশ্বশান্তির প্রার্থনা

আর কত ধর্ষণের খবর শুনতে হবে?

সংস্কারের স্বপ্ন বনাম বাস্তবতার রাজনীতি

মধুমাসের স্মৃতি ও দেশীয় ফলের রসাল সমারোহ

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

লিঙ্গের রাজনীতি বা বিবাদ নয়, চাই মানবিকতার নিবিড় বন্ধন

বাজেট : বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পারমাণবিক আলোচনার স্থবিরতা

রম্যগদ্য: “বাঙালি আমরা, নহি তো মেষ...”

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ঈদে বাড়ি ফেরা নিরাপদ হোক

কামরুজ্জামান

শনিবার, ২৯ মার্চ ২০২৫

কাজের প্রয়োজনে মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে কর্মস্থলের আশপাশেই বসবাস করে। যখন উৎসব পার্বণে ছুটি একটু বেশি পায় তখন নাড়ীর টানে বাড়ি ফিরে। আমাদের দেশে নব্বইয়ের দশকের দিকে শিল্পায়ন শুরু হলে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সাভার ও গাজীপুরে শিল্প কারখানা গড় উঠতে থাকে। বিশেষ তৈরি পোশাক শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয় কর্মসংস্থানের। যার ফলে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ কাজের সন্ধানে ঢাকাসহ আশপাশের জেলায় আসতে থাকে। এবং শিল্প কারখানায় চাকরির সুযোগ তৈরি করে নেয়। শিল্প কারখানায় নিয়োজিত এই সব লোক বছরের দুই ঈদ উৎসবে একযোগে বাড়ি গিয়ে থাকে।

অতিরিক্ত জনসংখ্যার এই দেশে কাজের সন্ধানে মানুষ সবসময়ই ঢাকামুখী। আর এ কারণে ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফেরার ধুম লেগে যায়। একই সময়ে সবার ছুটি কার্যকর হওয়ায় বাড়ি ফেরার চাপও বেড়ে যায়। আর এর প্রভাব গিয়ে পড়ে সড়ক মহাসড়ক, জনপথ ও গণপরিবহনের ওপর।

আমাদের দেশের জনসংখ্যা প্রায় বিশ কোটি। গণপরিবহন আছে পঞ্চাশ লাখের একটু বেশি। আর বৈধ লাইসেন্সধারী ড্রাইভার আছে চল্লিশ লাখের মতো। এর বাইরে সড়ক মহাসড়কে চলাচল করে থ্রি হুইলার, অটোরিকশা ও ফিটনেসবিহীন অসংখ্য পরিবহন। আছে লেগুনা, তাকওয়ার মতো অবৈধ পরিবহনের রামরাজত্ব।

দেশের মানুষ চলাচলের জন্য অভ্যন্তরীণ পথে আকাশপথ, রেলপথ, নৌপথ ও সড়কপথ এই চারটি পথই ব্যবহার করে। তবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে সড়ক পথ। এরপর নৌপথ ও রেলপথ ব্যবহার করে।

আমাদের দেশে গণপরিবহনে অব্যবস্থাপনা ও অসচেতনতার কারণে সারা বছরই সড়ক মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটে। তবে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে ঈদ যাত্রায়। বিগত বছরগুলোতে আমরা দেখেছি ঈদযাত্রায় সড়ক মহাসড়কে অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটতে এবং অনেক মানুষকে মারা যেতে। সড়ক মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটার অনেক কারণ রয়েছে।

ঈদকে সামনে রেখে গণপরিবহনে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা হয়। এর কারণও আছে। সবার একসাথে ছুটি হওয়ার কারণে বাড়িতে যাওয়ার চাপ একসাথে পড়ে। এর ফলে গণপরিবহনের সংকট দেখা দেয়। এই সুযোগটি কাজে লাগায় পরিবহন মালিক ও শ্রমিকশ্রেণী। বেশির ভাগ গাড়িতেই অতিরিক্ত যাত্রী বহন করে যাত্রা শুরু করে। এর ফলে সড়কে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। অতিরিক্ত ওজনের কারণে গাড়ি গতি নিয়ন্ত্রণ হারায়। ঘটে সড়ক দুর্ঘটনা।

সড়ক মহাসড়কে সবসময় অটোরিকশা ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির আধিক্য থাকে। ঈদের সামনে এদের দৌরাত্ম আরও বেড়ে যায়। অতিরিক্ত টাকা আয় করার জন্য এরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এদের কারণে সড়ক মহাসড়কে দূরপাল্লার গাড়ি ও অন্যান্য গণপরিবহন চলাচলে অসুবিধার সৃষ্টি হয়। ফলে ঘটে দুর্ঘটনা। এছাড়া ড্রাইভাররা গাড়ি নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। কার আগে কে যাবে। একবার যাত্রী নামিয়ে এসে আবার যাত্রী নেয়ার প্রতিযোগিতা করে। এ কারণে দ্রুতগতিতে তারা গাড়ি চালায়। আর ঘটে সড়ক দুর্ঘটনা।

আমাদের দেশে এমনিতেই গণপরিবহনের তুলনায় দক্ষ ও বৈধ লাইসেন্সধারী ড্রাইভারের সংখ্যা কম। ঈদ উৎসবে এই বিষয়টি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। অর্থাৎ লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভাররা গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে টাকা উপার্জনের জন্য। যার ফলে এদের অদক্ষতায় সড়কে ঘটে দুর্ঘটনা।

হকারদের কারণে রাস্তার পাশের ফুটপাত দখল ও সড়ক মহাসড়কে ভাসমান দোকান গড়ে ওঠায় প্রতিনিয়ত যানজট লেগেই থাকে। এর প্রভাব পড়ে রাস্তায় চলাচলকারী পরিবহনের ওপর। ড্রাইভিং করার সময় রাস্তায় যানজট, রাস্তা দখল ও অবৈধ অন্যান্য পরিবহন বেড়ে যাওয়ায় ড্রাইভাররা বিরক্ত হয়ে ওঠে। যার জন্য ধৈর্য হারিয়ে ড্রাইভাররা দুর্ঘটনা ঘটায়। তাছাড়া গাড়ি চালানোর সময় অতিরিক্ত গতি ও ওভারটেকিংয়ের জন্যও সড়ক মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটে।

রাস্তার শৃঙ্খলা ধরে রাখার জন্য ঈদে ঘর ফেরা মানুষের নিরাপত্তায় সবসময়ই দেখি অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাও থাকে সচেষ্ট। কিন্তু তারপরও ঘটে যায় সড়ক দুর্ঘটনা। এক্ষেত্রে সড়ক মহাসড়কে শৃঙ্খলা আনয়ন এবং ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশি তৎপরতা আরও কার্যকর হওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে যেসব অবৈধ ও ফিটনেসবিহীন পরিবহন রয়েছে সেগুলো কোনোভাবেই চলতে দেয়া উচিত নয়। আমাদের দেশে সবসময়ই দেখা যায়Ñ সড়ক মহাসড়ক ও জলপথে পরিবহন দুর্ঘটনা ঘটলে বলা হয় যানটির ফিটনেস ছিল না কিংবা ড্রাইভারের ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিন না। সেজন্য অবৈধ গাড়ি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভারদের দৌরাত্ম বন্ধ করা প্রয়োজন। আর এ কাজটি অবশ্যই পুলিশকে করতে হবে।

ফিটনেসবিহীন পরিবহন ও লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ ড্রাইভারদের কারণে সড়ক ও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। তখন ট্রাফিক পুলিশের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যায়। যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, যাত্রী উঠানো নামানো ইত্যাদি কারণে অনেক সময় যাত্রী সাধারণও দুর্ঘটনায় পতিত হয়। ঈদে ঘর ফেরা মানুষের মানসিক চঞ্চলতা, বাড়ির প্রতি নাড়ির টান অস্থিরতায় ফেলে দেয়। তখন তাড়াহুড়ো করতে গিয়েও দুর্ঘটনায় পতিত হয়।

দেশের দক্ষিণ বঙ্গে বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোতে যোগাযোগে এখনও জলপথ ব্যবহার করা হয়। পদ্মা সেতু নির্মাণের আগে অবশ্য জলপথই একমাত্র মাধ্যম ছিল। তখন দেখতাম মাঝেমধ্যে নদীপথে যাত্রী নিয়ে লঞ্চ স্টিমার ডুবে যেতো। শয়ে শয়ে মানুষ মারা যেতো। পদ্মা সেতু হওয়ায় জলপথে যাতায়াত অনেক কমে গেছে। তারপরও যেসকল জাহাজ, লঞ্চ ও স্টিমার চলাচল করছে সেগুলো অতিরিক্ত যাত্রী বহনের কারণে ঝুঁকি থেকেই যায়। তাছাড়া ঈদকে সামনে রেখে একশ্রেণীর অসাধু লোভি লঞ্চ-স্টিমার মালিক ফিটনেসবিহীন লঞ্চ ও স্টিমার যাত্রী পরিবহনে ব্যবহার করে যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ।

সড়ক মহাসড়কে পরিবহন দুর্ঘটনা ঘটলে মানুষ যেমন মারা যায় তেমনি অসংখ্য মানুষ আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে। একটা মানুষের জীবনে পঙ্গুত্ব বরণ করার মতো এতো বড় দুর্বিষহ যন্ত্রণা আর কিছু নেই। তিলে তিলে একটি পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়। পরিবহন ক্ষতিগ্রস্ত হলে মালিক পক্ষও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। মোট কথাÑ একটা সড়ক দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না।

ঈদযাত্রা নিরাপদ করার জন্য কিছু নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চললে সড়ক মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব। যেমনÑ সড়ক মহাসড়কে শৃঙ্খলা ধরে রাখার জন্য অতিরিক্ত ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন। অবৈধ অটোরিকশা, থ্রি হুইলার, ফিটনেসবিহীন পরিবহন সড়ক মহাসড়কে চলাচলে কড়াকড়ি আরোপ। অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভারদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ ও ওভারটেকিং বন্ধ করা। এক্ষেত্রে ড্রাইভারদের সচেতন করতে হবে। অতিরিক্ত যাত্রী বহন অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। সড়ক মহাসড়কে গাড়ি চালানোর সময় প্রতিযোগী মনোভাব ত্যাগ করতে হবে। এই কাজগুলো করতে পারলে ঈদযাত্রায় দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সুফল পাওয়া সম্ভব।

ঈদযাত্রায় নিরাপদ ভ্রমণের জন্য সচেতনতার বিকল্প নেই। বিশেষ করে পরিবহন মালিক ও ড্রাইভারদের সবচেয়ে বেশি সচেতনতা প্রয়োজন। যাত্রী সাধারণেরও বুঝেশুনে গাড়িতে ভ্রমণ করা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবেÑ সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি।

[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, গাজীপুর]

back to top