alt

উপ-সম্পাদকীয়

নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদ

শেখর ভট্টাচার্য

: বুধবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৫
image

ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাংলা ভূখ-ের সব মানুষের প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ

পৃথিবীতে প্রচলিত অধিকাংশ বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি কোনো না কোনো ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত; কিন্তু বাংলা নববর্ষের সঙ্গে ধর্মীয় অনুষঙ্গ নেই। বাংলা নববর্ষ অনন্য বৈশিষ্ট্যময় অনিন্দ্য সুন্দর এক উৎসব। খাজনা সংগ্রহের ব্যবস্থাকে ঘিরে এর প্রচলন। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যবসা-বাণিজ্যের দেনা-পাওনার হিসাব মেটানো। পহেলা বৈশাখ তাই ক্রমান্বয়ে হয়ে ওঠে এক সর্বজনীন আনন্দ-উৎসব। ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাংলা ভূখ-ের সব মানুষের প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। নববর্ষের প্রথম দিনকে অনেক পন্ডিতেরা বাঙালির ‘কার্নিভাল’ বলে উল্লেখ করেন। বাঙালির এ কার্নিভালে অসাম্প্রদায়িক দিকটি ফুটে ওঠে। বাংলা নববর্ষে বেশ কিছু নতুন বিষয় সংযুক্ত হয়ে দিনে দিনে এটি নতুন রূপ রঙ নিয়ে হাজির হয় বাঙালির মন ও মননে।

মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সম্রাট আকবর সিংহাসন আরোহনের সময় (৯৬৩ হিজরি) ‘ফসলি সন’ নামে যে সন প্রবর্তন করেন, তা কালক্রমে ‘বাংলা সন’ নামে পরিচিতি লাভ করে। তখন হিজরি সনের ভিত্তিতে এ দেশে বছর গণনা হতো। হিজরি বছর সৌর বছর থেকে ১১ দিন ছোট হওয়ায় কৃষির হিসাব-নিকাশ এলোমেলো হয়ে যেত। এতে কৃষকদের ‘ফসলি সন’ গণনায় সমস্যা তৈরি হয়। ফলে কৃষকের কাছ থেকে জমিদারের খাজনা আদায় করতেও সমস্যা দেখা দেয়। জমিদার ও কৃষকদের সুবিধার্থে এ সমস্যা দূর করতে মূলত বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ কৃষিপ্রধান দেশ। তাই বাংলা নববর্ষের উৎসবের আমেজটা কৃষকের একটু বেশিই থাকে।

একসময় রাজা-বাদশাহ-জমিদার-ব্যবসায়ীরা খাজনা আদায়ের উদ্দেশ্যে নববর্ষকে বেছে নিয়েছিলেন। শ্রেণিভেদে এর নাম ছিল পুণ্যাহÑহালখাতা। মানুষ কষ্ট করে টাকা সংগ্রহের পর পুণ্য লাভের আশায় রাজদর্শনে উপস্থিত হতেন। সামান্য মিষ্টান্ন পেলেই তারা গদগদ হতেন। আজকের পহেলা বৈশাখ ভিন্ন চিত্রের। সরকার তার কর্মীবাহিনীকে স্বচ্ছন্দে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের জন্য ভাতা দিচ্ছে। এতেও আমরা খুশি নই। বলি, কেন সবাইকে ভাতা দেওয়া হলো না। আমরা বুঝি না বাজারে অর্থ সরবরাহ বাড়লে খেটেখাওয়া মানুষের আয়-রোজগার বৃদ্ধি পায়। কারণ বাড়তি ভোগের জিনিস প্রস্তুতে তাদের সহযোগিতা লাগে। তারা অতিরিক্ত টাকা উপার্জন করতে পারে। ফলে আনন্দ ভাগাভাগি হয়ে যায়। এটা আমাদের কম পাওয়া নয়। পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ আমাদের সংস্কৃতির অংশ। আমরা এখন থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখে জীবনকে ঐতিহ্য বিমুখ হতে দিতে পরি না। যদি বিমুখ হই, তবে ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমাদের নিমন্ত্রণ’ বৃথা হয়ে যাবে।

নববর্ষ উদযাপনে গ্রামীণ সংস্কৃতি প্রাধান্য পেতে আমরা দেখি। মানববিধ্বংসী ব্যক্তিস্বার্থবাদীরা এসব সংস্কৃতিকে সেকেলে আখ্যা দেয়। সেই তথাকথিত সেকেলে আবার নতুনরূপে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে রমনার বটমূলকে কেন্দ্র করে। বাংলা নববর্ষ আমাদের আদি সংস্কৃতির অঙ্গ। প্রাণের টানে আনন্দ উপভোগের জন্য কিছু করার অর্থ অন্যকে উপহাস করা নয়। স্রোতহীন নদী যেমন শুকিয়ে যায়, তেমনি বৈচিত্র্যহীন সংস্কৃতি অবলুপ্ত হতে থাকে। সংস্কৃতির ওপর মতবাদের রং লাগালে তা আর সর্বজনীন থাকে না। বাংলাদেশে নববর্ষ উদযাপন মতবাদীরা একেবারে দখল করতে পারেনি; যদিও তাদের চেষ্টার বিরাম নেই। কে জানে হয়তো একদিন তা দখল হয়ে যাবে। তা যদি সম্ভব হয়, তখন নববর্ষের ‘সবারে বাসরে ভালো’ এর বৈশিষ্ট্য ক্ষুণœ হবে।

‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় নজরুল বলেছেন, ধ্বংস আর যুদ্ধ থেকেই নতুনের সৃষ্টি হয়! তেমনই বাংলা নববর্ষের কালবৈশাখী ঝড় বা রুদ্র রূপ থেকেই অনুপ্রেরণা পায় বাঙালি। বাংলাদেশে আমাদের অস্তিত্ব ‘স্বাধীনতা অর্জন’। বাঙালির লড়াকু মনোভাবের প্রতিফলন আমরা যেমন দেখতে পাই আমাদের প্রকৃতিতে একইভাবে দেখতে পাই প্রকৃতি কেন্দ্রিক আমাদের অনেক উৎসবের মধ্যেও। চৈত্র ও বৈশাখ মাসের কালবৈশাখীর তা-বকে দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলা করে পহেলা বৈশাখ যেনো এর রঙিন উদযাপন। এই দৃঢ়তা আমরা লক্ষ্য করি ফসল রক্ষার লড়াইয়ে আবার ঝড়ের রুদ্ররূপের প্রভাব থেকে জীবন রক্ষার লড়াইও বাঙালির লড়াকু মনোভাবের প্রতিচ্ছবি।

পহেলা বৈশাখ উৎসব শুরুর দিক ছিল মূলত গ্রামাঞ্চল। গ্রামীণ মেলা, লোকজ খেলাধুলা ও নৃত্য-সংগীত ছিল প্রধান আকর্ষণ। দিনে-দিনে তা শহরাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালির আদি সাংস্কৃতিক পরিচয় বহনকারী এ অসাম্প্রদায়িক উৎসব বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে আমাদের বিশেষ প্রেরণা জুগিয়েছে। এ ভূখ-ের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছে এ সাংস্কৃতিক-উৎসব ও চেতনা।

বাঙালি নজরুলের কথার অনুরণন তোলে ধরে জীবন সংগ্রামে, প্রকৃতির সাথে লড়াইয়ে একই ভাবে বিজয় লাভ করে তার উদযাপনের মধ্য দিয়েও। বাংলা নববর্ষ তাই সময়ের আবর্তে হয়ে উঠছে বাঙালির জীবন ও কর্মের চলচ্চিত্র। বাংলা নববর্ষের সাথে ছায়ানট ওতপ্রোত ভাবে যেনো জড়িয়ে আছে। ছায়ানটের নববর্ষ উদযাপন আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে রূপায়িত হয়ে পড়েছে। ষাটের দশকে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসব বাঙালির সশস্ত্র-মুক্তি সংগ্রামসহ বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্রামকে বেগবান করেছে। বৈশাখের সংস্কৃতি আমাদের জীবন-সাহিত্য ও বাঙালি জীবনে জড়িয়ে পড়ে ওতপ্রোতভাবে। নৃ-তাত্ত্বিক, সামাজিক অনন্য বৈশিষ্ট্য মিলে নববর্ষ উৎসব এখন বাঙালির প্রাণের উৎসব, প্রাণবন্ত এক মিলনমেলা।

বাংলা নববর্ষ এ দেশের সবচেয়ে বর্ণিল এবং সর্বজনীন ঐতিহ্য। পহেলা বৈশাখের উৎসবের মধ্যদিয়ে এ দেশের মানুষ এ ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। নববর্ষের উৎসব ধর্মাশ্রয়ী না হওয়া এবং এর সর্বজনীনতা বাংলা নববর্ষকে সময়ের স্রোতের সাথে আরও মাধুর্যম-িত এবং তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলবে বলে সবাই বিশ্বাস করেন। নববর্ষের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গের মেল বন্ধনের মধ্যেই এর টিকে থাকার সকল উপাদান বিদ্যমান আছে। বৈশাখী মেলায় সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষের আনাগোনা। মৈত্রী-সম্প্রীতির এক উদার মিলনক্ষেত্র। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর সবাই আসে মেলায়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিকিকিনির আশা আর বিনোদনের টান। কৃষিক্ষেত্রেও বৈশাখ মাসের গুরুত্ব অনেক। বৃক্ষের ক্ষেত্রেও নবউদ্যমে নতুন জীবন শুরু হয়- নতুন পাতা গজিয়ে।

আমরা সমগ্র বিশ্বকে একটি পরিবার হিসেবে বিবেচনা করি। বিশ্ব পরিবারে ঐতিহ্য নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম কবি টিএস ইলিয়ট। বৃক্ষের সঙ্গে তিনি তুলনা করেছেন ঐতিহ্যকে। বৃক্ষের সমস্ত শক্তি যেমন শেকড়ে সঞ্চিত থাকে, একটি সমাজেরও সব নান্দনিক সৌন্দর্যের উৎস লুকিয়ে থাকে ঐতিহ্যের মধ্যে। বৃক্ষ যেমন শেকড়চ্যুত হয়ে বেঁচে থাকতে পারে না, সমাজও ঐতিহ্য বিস্মৃত হয়ে পথহারা হয়ে পড়ে। শুধু পথকেই হারায় না, ঐতিহ্য হারিয়ে সভ্যতার পথ থেকেও দূরে সরে আসে। আমরা মাটির উপর থেকে বৃক্ষকে নানা রূপে দেখতে পাই। পত্র-পল্লবে সুশোভিত। মাটির নিচে শেকড়ের সাহায্যে প্রাণরস সংগ্রহ করে বৃক্ষ সুশোভিত হওয়ার সুযোগ পায়।

আমাদের প্রাণের উৎসব যার মধ্যে জাতির গৌরবের উপাদান বিদ্যমান, সেই উৎসবকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে আমাদের বৈচিত্র্য এবং বহুত্ববাদকে ধারণ করতে হবে। নববর্ষের এই শুভক্ষণে আমরা আমাদের শেকড় রক্ষার শপথ করি। শেকড়কে দৃঢ় করে এর ভেতরে প্রাণরস সঞ্চারের মাধ্যম আমারা দীপ্ত পায়ে এগিয়ে যাই। শুভ নববর্ষ।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

tab

উপ-সম্পাদকীয়

নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদ

শেখর ভট্টাচার্য

image

ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাংলা ভূখ-ের সব মানুষের প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ

বুধবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৫

পৃথিবীতে প্রচলিত অধিকাংশ বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি কোনো না কোনো ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত; কিন্তু বাংলা নববর্ষের সঙ্গে ধর্মীয় অনুষঙ্গ নেই। বাংলা নববর্ষ অনন্য বৈশিষ্ট্যময় অনিন্দ্য সুন্দর এক উৎসব। খাজনা সংগ্রহের ব্যবস্থাকে ঘিরে এর প্রচলন। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যবসা-বাণিজ্যের দেনা-পাওনার হিসাব মেটানো। পহেলা বৈশাখ তাই ক্রমান্বয়ে হয়ে ওঠে এক সর্বজনীন আনন্দ-উৎসব। ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাংলা ভূখ-ের সব মানুষের প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। নববর্ষের প্রথম দিনকে অনেক পন্ডিতেরা বাঙালির ‘কার্নিভাল’ বলে উল্লেখ করেন। বাঙালির এ কার্নিভালে অসাম্প্রদায়িক দিকটি ফুটে ওঠে। বাংলা নববর্ষে বেশ কিছু নতুন বিষয় সংযুক্ত হয়ে দিনে দিনে এটি নতুন রূপ রঙ নিয়ে হাজির হয় বাঙালির মন ও মননে।

মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সম্রাট আকবর সিংহাসন আরোহনের সময় (৯৬৩ হিজরি) ‘ফসলি সন’ নামে যে সন প্রবর্তন করেন, তা কালক্রমে ‘বাংলা সন’ নামে পরিচিতি লাভ করে। তখন হিজরি সনের ভিত্তিতে এ দেশে বছর গণনা হতো। হিজরি বছর সৌর বছর থেকে ১১ দিন ছোট হওয়ায় কৃষির হিসাব-নিকাশ এলোমেলো হয়ে যেত। এতে কৃষকদের ‘ফসলি সন’ গণনায় সমস্যা তৈরি হয়। ফলে কৃষকের কাছ থেকে জমিদারের খাজনা আদায় করতেও সমস্যা দেখা দেয়। জমিদার ও কৃষকদের সুবিধার্থে এ সমস্যা দূর করতে মূলত বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ কৃষিপ্রধান দেশ। তাই বাংলা নববর্ষের উৎসবের আমেজটা কৃষকের একটু বেশিই থাকে।

একসময় রাজা-বাদশাহ-জমিদার-ব্যবসায়ীরা খাজনা আদায়ের উদ্দেশ্যে নববর্ষকে বেছে নিয়েছিলেন। শ্রেণিভেদে এর নাম ছিল পুণ্যাহÑহালখাতা। মানুষ কষ্ট করে টাকা সংগ্রহের পর পুণ্য লাভের আশায় রাজদর্শনে উপস্থিত হতেন। সামান্য মিষ্টান্ন পেলেই তারা গদগদ হতেন। আজকের পহেলা বৈশাখ ভিন্ন চিত্রের। সরকার তার কর্মীবাহিনীকে স্বচ্ছন্দে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের জন্য ভাতা দিচ্ছে। এতেও আমরা খুশি নই। বলি, কেন সবাইকে ভাতা দেওয়া হলো না। আমরা বুঝি না বাজারে অর্থ সরবরাহ বাড়লে খেটেখাওয়া মানুষের আয়-রোজগার বৃদ্ধি পায়। কারণ বাড়তি ভোগের জিনিস প্রস্তুতে তাদের সহযোগিতা লাগে। তারা অতিরিক্ত টাকা উপার্জন করতে পারে। ফলে আনন্দ ভাগাভাগি হয়ে যায়। এটা আমাদের কম পাওয়া নয়। পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ আমাদের সংস্কৃতির অংশ। আমরা এখন থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখে জীবনকে ঐতিহ্য বিমুখ হতে দিতে পরি না। যদি বিমুখ হই, তবে ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমাদের নিমন্ত্রণ’ বৃথা হয়ে যাবে।

নববর্ষ উদযাপনে গ্রামীণ সংস্কৃতি প্রাধান্য পেতে আমরা দেখি। মানববিধ্বংসী ব্যক্তিস্বার্থবাদীরা এসব সংস্কৃতিকে সেকেলে আখ্যা দেয়। সেই তথাকথিত সেকেলে আবার নতুনরূপে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে রমনার বটমূলকে কেন্দ্র করে। বাংলা নববর্ষ আমাদের আদি সংস্কৃতির অঙ্গ। প্রাণের টানে আনন্দ উপভোগের জন্য কিছু করার অর্থ অন্যকে উপহাস করা নয়। স্রোতহীন নদী যেমন শুকিয়ে যায়, তেমনি বৈচিত্র্যহীন সংস্কৃতি অবলুপ্ত হতে থাকে। সংস্কৃতির ওপর মতবাদের রং লাগালে তা আর সর্বজনীন থাকে না। বাংলাদেশে নববর্ষ উদযাপন মতবাদীরা একেবারে দখল করতে পারেনি; যদিও তাদের চেষ্টার বিরাম নেই। কে জানে হয়তো একদিন তা দখল হয়ে যাবে। তা যদি সম্ভব হয়, তখন নববর্ষের ‘সবারে বাসরে ভালো’ এর বৈশিষ্ট্য ক্ষুণœ হবে।

‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় নজরুল বলেছেন, ধ্বংস আর যুদ্ধ থেকেই নতুনের সৃষ্টি হয়! তেমনই বাংলা নববর্ষের কালবৈশাখী ঝড় বা রুদ্র রূপ থেকেই অনুপ্রেরণা পায় বাঙালি। বাংলাদেশে আমাদের অস্তিত্ব ‘স্বাধীনতা অর্জন’। বাঙালির লড়াকু মনোভাবের প্রতিফলন আমরা যেমন দেখতে পাই আমাদের প্রকৃতিতে একইভাবে দেখতে পাই প্রকৃতি কেন্দ্রিক আমাদের অনেক উৎসবের মধ্যেও। চৈত্র ও বৈশাখ মাসের কালবৈশাখীর তা-বকে দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলা করে পহেলা বৈশাখ যেনো এর রঙিন উদযাপন। এই দৃঢ়তা আমরা লক্ষ্য করি ফসল রক্ষার লড়াইয়ে আবার ঝড়ের রুদ্ররূপের প্রভাব থেকে জীবন রক্ষার লড়াইও বাঙালির লড়াকু মনোভাবের প্রতিচ্ছবি।

পহেলা বৈশাখ উৎসব শুরুর দিক ছিল মূলত গ্রামাঞ্চল। গ্রামীণ মেলা, লোকজ খেলাধুলা ও নৃত্য-সংগীত ছিল প্রধান আকর্ষণ। দিনে-দিনে তা শহরাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালির আদি সাংস্কৃতিক পরিচয় বহনকারী এ অসাম্প্রদায়িক উৎসব বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে আমাদের বিশেষ প্রেরণা জুগিয়েছে। এ ভূখ-ের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছে এ সাংস্কৃতিক-উৎসব ও চেতনা।

বাঙালি নজরুলের কথার অনুরণন তোলে ধরে জীবন সংগ্রামে, প্রকৃতির সাথে লড়াইয়ে একই ভাবে বিজয় লাভ করে তার উদযাপনের মধ্য দিয়েও। বাংলা নববর্ষ তাই সময়ের আবর্তে হয়ে উঠছে বাঙালির জীবন ও কর্মের চলচ্চিত্র। বাংলা নববর্ষের সাথে ছায়ানট ওতপ্রোত ভাবে যেনো জড়িয়ে আছে। ছায়ানটের নববর্ষ উদযাপন আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে রূপায়িত হয়ে পড়েছে। ষাটের দশকে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসব বাঙালির সশস্ত্র-মুক্তি সংগ্রামসহ বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্রামকে বেগবান করেছে। বৈশাখের সংস্কৃতি আমাদের জীবন-সাহিত্য ও বাঙালি জীবনে জড়িয়ে পড়ে ওতপ্রোতভাবে। নৃ-তাত্ত্বিক, সামাজিক অনন্য বৈশিষ্ট্য মিলে নববর্ষ উৎসব এখন বাঙালির প্রাণের উৎসব, প্রাণবন্ত এক মিলনমেলা।

বাংলা নববর্ষ এ দেশের সবচেয়ে বর্ণিল এবং সর্বজনীন ঐতিহ্য। পহেলা বৈশাখের উৎসবের মধ্যদিয়ে এ দেশের মানুষ এ ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। নববর্ষের উৎসব ধর্মাশ্রয়ী না হওয়া এবং এর সর্বজনীনতা বাংলা নববর্ষকে সময়ের স্রোতের সাথে আরও মাধুর্যম-িত এবং তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলবে বলে সবাই বিশ্বাস করেন। নববর্ষের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গের মেল বন্ধনের মধ্যেই এর টিকে থাকার সকল উপাদান বিদ্যমান আছে। বৈশাখী মেলায় সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষের আনাগোনা। মৈত্রী-সম্প্রীতির এক উদার মিলনক্ষেত্র। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর সবাই আসে মেলায়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিকিকিনির আশা আর বিনোদনের টান। কৃষিক্ষেত্রেও বৈশাখ মাসের গুরুত্ব অনেক। বৃক্ষের ক্ষেত্রেও নবউদ্যমে নতুন জীবন শুরু হয়- নতুন পাতা গজিয়ে।

আমরা সমগ্র বিশ্বকে একটি পরিবার হিসেবে বিবেচনা করি। বিশ্ব পরিবারে ঐতিহ্য নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম কবি টিএস ইলিয়ট। বৃক্ষের সঙ্গে তিনি তুলনা করেছেন ঐতিহ্যকে। বৃক্ষের সমস্ত শক্তি যেমন শেকড়ে সঞ্চিত থাকে, একটি সমাজেরও সব নান্দনিক সৌন্দর্যের উৎস লুকিয়ে থাকে ঐতিহ্যের মধ্যে। বৃক্ষ যেমন শেকড়চ্যুত হয়ে বেঁচে থাকতে পারে না, সমাজও ঐতিহ্য বিস্মৃত হয়ে পথহারা হয়ে পড়ে। শুধু পথকেই হারায় না, ঐতিহ্য হারিয়ে সভ্যতার পথ থেকেও দূরে সরে আসে। আমরা মাটির উপর থেকে বৃক্ষকে নানা রূপে দেখতে পাই। পত্র-পল্লবে সুশোভিত। মাটির নিচে শেকড়ের সাহায্যে প্রাণরস সংগ্রহ করে বৃক্ষ সুশোভিত হওয়ার সুযোগ পায়।

আমাদের প্রাণের উৎসব যার মধ্যে জাতির গৌরবের উপাদান বিদ্যমান, সেই উৎসবকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে আমাদের বৈচিত্র্য এবং বহুত্ববাদকে ধারণ করতে হবে। নববর্ষের এই শুভক্ষণে আমরা আমাদের শেকড় রক্ষার শপথ করি। শেকড়কে দৃঢ় করে এর ভেতরে প্রাণরস সঞ্চারের মাধ্যম আমারা দীপ্ত পায়ে এগিয়ে যাই। শুভ নববর্ষ।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

back to top