alt

উপ-সম্পাদকীয়

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

গৌতম রায়

: শনিবার, ১০ মে ২০২৫

পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সূতি থানার সাজুর মোড়ে গত ১১ এপ্রিল , ’২৫, নতুন ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মিছিল পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। গুলি চালিয়ে ইজাজ আহমেদ নামের এক সিপিআই (এম) কর্মীকে হত্যা করে। ওইদিনই কাছাকাছি সামশেরগঞ্জ থানার শহরকেন্দ্র ধুলিয়ানে একই দাবিতে চলা একটি মিছিলে ইট মারার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বচসা হয়।

ধুলিয়ান শহরের মূল রাস্তার উপরেই সামশেরগঞ্জ থানা। ১২ এপ্রিল সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত এই থানার একেবারে নাকের ডগায়, ধুলিয়ান বাজার এলাকায়, মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর প্রকাশ্যে ভয়াবহ সন্ত্রাস চলে।

বেছে বেছে বেশ কিছু বাড়ির সামনে খোলা তরোয়াল নিয়ে চলতে থাকে হুঙ্কার। আলাদা করে আর এখন বলে দেয়ার দরকার নেই, সেইসব বাড়ির মালিক কারা ছিলেন। চিহ্নিত দোকানগুলোতে চলতে থাকে অবাধে অগ্নিসংযোগ। আগুন দেয়ার আগে অবশ্য সেইসব দোকানগুলোতে লুটপাট চালাতে ভোলেনি হামলাকারীরা। এই দুষ্কৃৃতি সন্ত্রাসীরা তাদের আত্মপরিচয়, চেহারা এবং রাজনৈতিক অবস্থান এতটুকু গোপন করেনি।

ঠিক সেই একই দিনে, থানা থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে, শহর লাগোয়া বেতবোনা, জাফরাবাদÑ এই এলাকাগুলোর হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে মুখঢাকা দেয়া দস্যু বাহিনী প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে ঢুকে তা-ব চালায়। থানা নীরব দর্শক থাকে। পুলিশের মুখ দেখা যায়নি।

এখানকার সরকারপাড়ায় এই গোপন বাহিনী দুজনকে হত্যা করে। প্রায় একই সময়ে, সকাল ১১টা নাগাদ, ধুলিয়ান শহরের তারবাগানে বিএসএফ বাহিনী অথবা, স্থানীয়দের ভাষায় ‘বিএসএফের পোশাক পরা একটি দল’, পাড়ার ছেলেদের ওপর গুলি চালায়। যেখানে গুলিবিদ্ধ চারজন বহরমপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। যাদের মধ্যে একজন, ১২ বছর বয়সী হাসান শেখ, মরণাপন্ন অবস্থায় আছে। কিডনিতে মারাত্মক আঘাত নিয়ে এখন ও সে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষছে হাসপাতালেই।

যে ওসি, এসআই শিব প্রসাদ ঘোষের নেতৃত্বে পরিচালিত থানা এই বিদ্বেষ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ করে দেয়, তাকে অনেক পরে অপসারিত করা হয়। কিন্তু তার এই অপরাধমূলক কাজের কঠোর শাস্তি প্রয়োজন। তাকে ‘ক্লোজ’ করে তদন্তের আওতায় আনা দরকার। সেটা এখনও পর্যন্ত হয়নি।

সুতি থানার কাশেমনগর ও কুমড়াপুর গ্রামে ১১ এপ্রিল রাত থেকে ১২ এপ্রিল, ’২৫ ভোর পর্যন্ত পুলিশ বাহিনী ঘরে ঘরে ব্যাপক সন্ত্রাস চালায়। ছেলেদের নির্মমভাবে পিটিয়ে, অনেককে তুলে নিয়ে যায়। অস্বাভাবিক সব ধারায় মামলা দিয়ে জেলে ভরে। সূতি থানার ওসিকেও রাজ্য সরকার বদলি করেছে, কিন্তু সেই রাতের এই অপারেশন যে অফিসারের নির্দেশে ঘটেছে তাকেও ‘ক্লোজ’ করে তদন্তের অধীনে আনা দরকার। আজ পর্যন্ত তা হয়নি।

সামশেরগঞ্জ থানার অন্তর্গত ধুলিয়ান বাজার ও জাফরাবাদ গ্রামের ঘটনাবলি সুনির্দিষ্ট পূর্ব পরিকল্পনায় সংগঠিত করা হয়েছে। ঘোষপাড়ার আরএসএস কর্মীরা প্রকাশ্যেই সন্ত্রাস চালিয়েছে। তারা তাদের পরিচয় গোপন রাখেনি। রাজ্যের বিজেপি নেতৃত্ব এবং একটা অংশের প্রচারযন্ত্র প্রকাশ্যেই সাম্প্রদায়িক জিঘাংসা প্রচার করেছে। এইসব নেতাদের সঙ্গে নিয়ে খোদ পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল আক্রান্ত ও ক্ষুব্ধ মানুষগুলিকে নিয়ে বিদ্বেষের রাজনীতি উসকিয়ে দিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। পুলিশের মধ্যে আরএসএস চক্রান্তকারীদের গভীর ও প্রত্যক্ষ প্রভাবের প্রসার প্রতিরোধ করতে রাজ্য সরকার এতটুকু ইতিবাচক ভূমিকা নেয়নি।

শতবর্ষ পালনকে কেন্দ্র করে আরএসএস বহুদিন আগে থেকেই নানা ধরনের পরিকল্পনা করতে শুরু করে। এই ধরনের দাঙ্গা সংগঠিত করে সামাজিক বিভাজন তৈরি করাÑ এটা সঙ্ঘের কর্মসূচির একটা অংশ। ভারতের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করবার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রদেশে, প্রাদেশিক সংস্কৃতি, আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যÑ এই সমস্তগুলোকে বিধ্বস্ত করতে তারা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের এক এক জায়গায় এক এক রকমের কর্মসূচি নেয়।

সেই লক্ষ্যেই পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলা, যেটি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী একটি জেলা। সেখানে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময়কাল থেকে অত্যন্ত পরিকল্পনামাফিক এই কাজ করে চলেছে আরএসএস। লোকসভা নির্বাচনের আগে এই জেলার বেলডাঙ্গাতে দাঙ্গার পরিস্থিতি যখন তৈরি হয়, রাজ্য সরকারের কাছে গোয়েন্দা সূত্রে সমস্ত ধরনের খবর থাকা সত্ত্বেও, কেবল লোকসভা ভোটে শাসকদলের প্রার্থীকে জেতানোর লক্ষ্যে কোনরকম সতর্কতা অবলম্বন করেনি রাজ্য সরকার।

বেলডাঙ্গা দাঙ্গার ফলে সামাজিক বিভাজন এমন একটা জায়গায় পৌঁছে যায়, যার জেরে খুব সহজেই মুর্শিদাবাদ জেলার দুটি আসন জিতে নিতে পারে তৃণমূল কংগ্রেস। অধীররঞ্জন চৌধুরী এবং মোহাম্মদ সেলিমÑ এই দুজনকে হারানোর লক্ষ্যে বিজেপি আর তৃণমূল কংগ্রেস একদম যৌথ কর্মসূচি হিসেবে এই দাঙ্গা সংগঠিত করেছিল। সঙ্ঘ পরিবারের শাখা সংগঠন হিসেবে কর্মরত একটি সশস্ত্র ধর্মীয় সংগঠন এই দাঙ্গা সংগঠিত করতে খুব বড় ভূমিকা পালন করেছিল। সংশ্লিষ্ট সংগঠনের পক্ষ থেকে যে দাঙ্গা সংঘটিত করতে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, সেই ব্যক্তিটিকে পরবর্তীকালে ভারত সরকার পদ্মশ্রী উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেছে।

পশ্চিমবঙ্গের জন্য যে ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা চলে, সেটা কিন্তু বিহারের ক্ষেত্রে চলে না। আবার বিহারের ক্ষেত্রে যা নিয়ে চলে, সেটা তারা তামিলনাড়–র ক্ষেত্রে চলে না। বাংলার ক্ষেত্রে নিজেদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে নিজেদের সামাজিক সংস্কৃতিকেই সর্বসমক্ষে বিস্তারের লক্ষ্যে কাজ করে হিন্দুত্ববাদীরা। তাই আক্রমণের কেন্দ্রস্থল হিসেবে তারা বেছে নিয়েছে বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বয়ী ধারা। যুগ যুগ ধরে হিন্দু-মুসলমান, পরস্পর পরস্পরের পাশাপাশি থাকার জন্যে যে যৌথ সংস্কৃতির ধারা, একটা নিজস্ব গতিবেগে বাংলায় প্রসার লাভ করেছে, সেই ধারাকে বিনষ্ট করবার মধ্যে দিয়ে, নিজেদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে পশ্চিমবঙ্গের বুকে দেগে দেয়ার লক্ষ্যে ঐতিহাসিক বাবড়ি মসজিদ ধ্বংসের পরবর্তী সময়কাল থেকেই হিন্দুত্ববাদীরা অত্যন্ত সক্রিয়।

বাংলার সংস্কৃতিকে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত করবার যে প্রচেষ্টা নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়কাল থেকে আরএসএস, পশ্চিমবঙ্গের বুকে শুরু করেছিল, সেই কাজ তারা সেইসময় একা করার মতো সামাজিক ভিত্তি সম্পন্ন ছিল না। বাংলার বুকে হিন্দুত্ববাদীরা, সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে রাজ্য সরকার দ্বারা। ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর যে তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল বিভাজনের, যে অক্ষরেখাটা সাধারণ মানুষদের একটা অংশের মধ্যে প্রবল হয়েছিল, সেটি কিন্তু কোন অবস্থাতেই ’৯৮ সালের ১ জানুয়ারির পর থেকে যে পরিপ্রেক্ষিত তৈরি হয়, তার আগে এভাবে প্রবল ছিল না। ডালপালা বিস্তারেরও সুযোগ পায়নি।

বামপন্থীরা এ রাজ্যে প্রশাসনের থাকার কারণে বাবড়ি মসজিদ ধ্বংসের পরে সাম্প্রদায়িক শক্তি অনেক ধরনের চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত খুব একটা সাফল্য পায়নি। তার বাইরে রাজনৈতিকভাবে বামপন্থীদের যে কর্মকা-, তার ফলশ্রুতি হিসেবে হিন্দু সম্প্রদায়িকরা শত চেষ্টা করলেও এই সময়কালে সামাজিক জীবনে হিন্দু-মুসলমানের বিভাজন, তাদের যে রাজনৈতিক কর্মসূচি, সেটা কোনো অবস্থাতেই ফলপ্রসূ করে তুলতে পারেনি হিন্দুত্ববাদীরা।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

মধুমাসের স্মৃতি ও দেশীয় ফলের রসাল সমারোহ

লিঙ্গের রাজনীতি বা বিবাদ নয়, চাই মানবিকতার নিবিড় বন্ধন

বাজেট : বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পারমাণবিক আলোচনার স্থবিরতা

রম্যগদ্য: “বাঙালি আমরা, নহি তো মেষ...”

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

কুষ্ঠ ও বৈষম্য : মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি অবহেলিত অধ্যায়

ছবি

প্রান্তজনের বাংলাদেশ

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

সাইবার নিরাপত্তা : অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে আমাদের প্রস্তুতি

ছবি

বাহান্নর গর্ভে জন্ম নেয়া এক ঝড়ের পাখি

প্রবাসী শ্রমিক : অর্থের যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের সহযোদ্ধা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

গৌতম রায়

শনিবার, ১০ মে ২০২৫

পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সূতি থানার সাজুর মোড়ে গত ১১ এপ্রিল , ’২৫, নতুন ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মিছিল পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। গুলি চালিয়ে ইজাজ আহমেদ নামের এক সিপিআই (এম) কর্মীকে হত্যা করে। ওইদিনই কাছাকাছি সামশেরগঞ্জ থানার শহরকেন্দ্র ধুলিয়ানে একই দাবিতে চলা একটি মিছিলে ইট মারার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বচসা হয়।

ধুলিয়ান শহরের মূল রাস্তার উপরেই সামশেরগঞ্জ থানা। ১২ এপ্রিল সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত এই থানার একেবারে নাকের ডগায়, ধুলিয়ান বাজার এলাকায়, মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর প্রকাশ্যে ভয়াবহ সন্ত্রাস চলে।

বেছে বেছে বেশ কিছু বাড়ির সামনে খোলা তরোয়াল নিয়ে চলতে থাকে হুঙ্কার। আলাদা করে আর এখন বলে দেয়ার দরকার নেই, সেইসব বাড়ির মালিক কারা ছিলেন। চিহ্নিত দোকানগুলোতে চলতে থাকে অবাধে অগ্নিসংযোগ। আগুন দেয়ার আগে অবশ্য সেইসব দোকানগুলোতে লুটপাট চালাতে ভোলেনি হামলাকারীরা। এই দুষ্কৃৃতি সন্ত্রাসীরা তাদের আত্মপরিচয়, চেহারা এবং রাজনৈতিক অবস্থান এতটুকু গোপন করেনি।

ঠিক সেই একই দিনে, থানা থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে, শহর লাগোয়া বেতবোনা, জাফরাবাদÑ এই এলাকাগুলোর হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে মুখঢাকা দেয়া দস্যু বাহিনী প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে ঢুকে তা-ব চালায়। থানা নীরব দর্শক থাকে। পুলিশের মুখ দেখা যায়নি।

এখানকার সরকারপাড়ায় এই গোপন বাহিনী দুজনকে হত্যা করে। প্রায় একই সময়ে, সকাল ১১টা নাগাদ, ধুলিয়ান শহরের তারবাগানে বিএসএফ বাহিনী অথবা, স্থানীয়দের ভাষায় ‘বিএসএফের পোশাক পরা একটি দল’, পাড়ার ছেলেদের ওপর গুলি চালায়। যেখানে গুলিবিদ্ধ চারজন বহরমপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। যাদের মধ্যে একজন, ১২ বছর বয়সী হাসান শেখ, মরণাপন্ন অবস্থায় আছে। কিডনিতে মারাত্মক আঘাত নিয়ে এখন ও সে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষছে হাসপাতালেই।

যে ওসি, এসআই শিব প্রসাদ ঘোষের নেতৃত্বে পরিচালিত থানা এই বিদ্বেষ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ করে দেয়, তাকে অনেক পরে অপসারিত করা হয়। কিন্তু তার এই অপরাধমূলক কাজের কঠোর শাস্তি প্রয়োজন। তাকে ‘ক্লোজ’ করে তদন্তের আওতায় আনা দরকার। সেটা এখনও পর্যন্ত হয়নি।

সুতি থানার কাশেমনগর ও কুমড়াপুর গ্রামে ১১ এপ্রিল রাত থেকে ১২ এপ্রিল, ’২৫ ভোর পর্যন্ত পুলিশ বাহিনী ঘরে ঘরে ব্যাপক সন্ত্রাস চালায়। ছেলেদের নির্মমভাবে পিটিয়ে, অনেককে তুলে নিয়ে যায়। অস্বাভাবিক সব ধারায় মামলা দিয়ে জেলে ভরে। সূতি থানার ওসিকেও রাজ্য সরকার বদলি করেছে, কিন্তু সেই রাতের এই অপারেশন যে অফিসারের নির্দেশে ঘটেছে তাকেও ‘ক্লোজ’ করে তদন্তের অধীনে আনা দরকার। আজ পর্যন্ত তা হয়নি।

সামশেরগঞ্জ থানার অন্তর্গত ধুলিয়ান বাজার ও জাফরাবাদ গ্রামের ঘটনাবলি সুনির্দিষ্ট পূর্ব পরিকল্পনায় সংগঠিত করা হয়েছে। ঘোষপাড়ার আরএসএস কর্মীরা প্রকাশ্যেই সন্ত্রাস চালিয়েছে। তারা তাদের পরিচয় গোপন রাখেনি। রাজ্যের বিজেপি নেতৃত্ব এবং একটা অংশের প্রচারযন্ত্র প্রকাশ্যেই সাম্প্রদায়িক জিঘাংসা প্রচার করেছে। এইসব নেতাদের সঙ্গে নিয়ে খোদ পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল আক্রান্ত ও ক্ষুব্ধ মানুষগুলিকে নিয়ে বিদ্বেষের রাজনীতি উসকিয়ে দিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। পুলিশের মধ্যে আরএসএস চক্রান্তকারীদের গভীর ও প্রত্যক্ষ প্রভাবের প্রসার প্রতিরোধ করতে রাজ্য সরকার এতটুকু ইতিবাচক ভূমিকা নেয়নি।

শতবর্ষ পালনকে কেন্দ্র করে আরএসএস বহুদিন আগে থেকেই নানা ধরনের পরিকল্পনা করতে শুরু করে। এই ধরনের দাঙ্গা সংগঠিত করে সামাজিক বিভাজন তৈরি করাÑ এটা সঙ্ঘের কর্মসূচির একটা অংশ। ভারতের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করবার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রদেশে, প্রাদেশিক সংস্কৃতি, আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যÑ এই সমস্তগুলোকে বিধ্বস্ত করতে তারা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের এক এক জায়গায় এক এক রকমের কর্মসূচি নেয়।

সেই লক্ষ্যেই পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলা, যেটি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী একটি জেলা। সেখানে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময়কাল থেকে অত্যন্ত পরিকল্পনামাফিক এই কাজ করে চলেছে আরএসএস। লোকসভা নির্বাচনের আগে এই জেলার বেলডাঙ্গাতে দাঙ্গার পরিস্থিতি যখন তৈরি হয়, রাজ্য সরকারের কাছে গোয়েন্দা সূত্রে সমস্ত ধরনের খবর থাকা সত্ত্বেও, কেবল লোকসভা ভোটে শাসকদলের প্রার্থীকে জেতানোর লক্ষ্যে কোনরকম সতর্কতা অবলম্বন করেনি রাজ্য সরকার।

বেলডাঙ্গা দাঙ্গার ফলে সামাজিক বিভাজন এমন একটা জায়গায় পৌঁছে যায়, যার জেরে খুব সহজেই মুর্শিদাবাদ জেলার দুটি আসন জিতে নিতে পারে তৃণমূল কংগ্রেস। অধীররঞ্জন চৌধুরী এবং মোহাম্মদ সেলিমÑ এই দুজনকে হারানোর লক্ষ্যে বিজেপি আর তৃণমূল কংগ্রেস একদম যৌথ কর্মসূচি হিসেবে এই দাঙ্গা সংগঠিত করেছিল। সঙ্ঘ পরিবারের শাখা সংগঠন হিসেবে কর্মরত একটি সশস্ত্র ধর্মীয় সংগঠন এই দাঙ্গা সংগঠিত করতে খুব বড় ভূমিকা পালন করেছিল। সংশ্লিষ্ট সংগঠনের পক্ষ থেকে যে দাঙ্গা সংঘটিত করতে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, সেই ব্যক্তিটিকে পরবর্তীকালে ভারত সরকার পদ্মশ্রী উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেছে।

পশ্চিমবঙ্গের জন্য যে ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা চলে, সেটা কিন্তু বিহারের ক্ষেত্রে চলে না। আবার বিহারের ক্ষেত্রে যা নিয়ে চলে, সেটা তারা তামিলনাড়–র ক্ষেত্রে চলে না। বাংলার ক্ষেত্রে নিজেদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে নিজেদের সামাজিক সংস্কৃতিকেই সর্বসমক্ষে বিস্তারের লক্ষ্যে কাজ করে হিন্দুত্ববাদীরা। তাই আক্রমণের কেন্দ্রস্থল হিসেবে তারা বেছে নিয়েছে বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বয়ী ধারা। যুগ যুগ ধরে হিন্দু-মুসলমান, পরস্পর পরস্পরের পাশাপাশি থাকার জন্যে যে যৌথ সংস্কৃতির ধারা, একটা নিজস্ব গতিবেগে বাংলায় প্রসার লাভ করেছে, সেই ধারাকে বিনষ্ট করবার মধ্যে দিয়ে, নিজেদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে পশ্চিমবঙ্গের বুকে দেগে দেয়ার লক্ষ্যে ঐতিহাসিক বাবড়ি মসজিদ ধ্বংসের পরবর্তী সময়কাল থেকেই হিন্দুত্ববাদীরা অত্যন্ত সক্রিয়।

বাংলার সংস্কৃতিকে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত করবার যে প্রচেষ্টা নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়কাল থেকে আরএসএস, পশ্চিমবঙ্গের বুকে শুরু করেছিল, সেই কাজ তারা সেইসময় একা করার মতো সামাজিক ভিত্তি সম্পন্ন ছিল না। বাংলার বুকে হিন্দুত্ববাদীরা, সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে রাজ্য সরকার দ্বারা। ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর যে তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল বিভাজনের, যে অক্ষরেখাটা সাধারণ মানুষদের একটা অংশের মধ্যে প্রবল হয়েছিল, সেটি কিন্তু কোন অবস্থাতেই ’৯৮ সালের ১ জানুয়ারির পর থেকে যে পরিপ্রেক্ষিত তৈরি হয়, তার আগে এভাবে প্রবল ছিল না। ডালপালা বিস্তারেরও সুযোগ পায়নি।

বামপন্থীরা এ রাজ্যে প্রশাসনের থাকার কারণে বাবড়ি মসজিদ ধ্বংসের পরে সাম্প্রদায়িক শক্তি অনেক ধরনের চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত খুব একটা সাফল্য পায়নি। তার বাইরে রাজনৈতিকভাবে বামপন্থীদের যে কর্মকা-, তার ফলশ্রুতি হিসেবে হিন্দু সম্প্রদায়িকরা শত চেষ্টা করলেও এই সময়কালে সামাজিক জীবনে হিন্দু-মুসলমানের বিভাজন, তাদের যে রাজনৈতিক কর্মসূচি, সেটা কোনো অবস্থাতেই ফলপ্রসূ করে তুলতে পারেনি হিন্দুত্ববাদীরা।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

back to top