alt

উপ-সম্পাদকীয়

বামপন্থা : নীতির সঙ্গে নেতৃত্বের ভূমিকা

গৌতম রায়

: শনিবার, ১৭ মে ২০২৫

সাহিত্য থেকে সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি থেকে অর্থনীতিÑ অবাধ বিচরণ মানুষটির। জীবনানন্দ থেকে শামসুর রাহমান- ঠোটস্থ; কিন্তু কোনো দেখনদারি নেই। আত্মপ্রচার নেই নিজের পা-িত্য ঘিরে।

তেমন মানুষের কাছেই শোনা এই গল্পটিÑ

জেলবন্দি নজরুল গান দিয়ে মাতোয়ারা করে রাখেন বন্দিশালা। গানের পর গান গেয়ে চলেন। সমস্ত স্তরের বন্দিই তার গানে পাগল। নজরুলের জনপ্রিয়তা গগণচুম্বী।

প্রমাদ গুনলো জেল কর্তৃপক্ষ। জেলে বন্দি অরাজনৈতিক, অবাঙালি বন্দিদের বোঝালো; তোমাদের উদ্দেশেই গানের ভিতরে শালা শব্দ আছে। তোমাদেরকে আগুন জ্বেলে পুড়িয়ে মারবার কথাই লোকটা বলছে এসব কথা, আর লোকদের ক্ষেপাচ্ছে তোমাদের পুড়িয়ে মারতে।

নজরুলের ব্যক্তিত্ব এমনই ছিল যে, চেষ্টা করেও ইংরেজ, অরাজনৈতিক বন্দিদের ভিতরে এই বিভাজনের খেলাকে স্থায়ী করতে পারল না। নজরুল সবটা জেনে যখন অরাজনৈতিক বন্দিদের, কারার ওই লৌহকপাটের সম্পূর্ণ অর্থ বোঝালেন, তখন ইংরেজদের অভিপ্রায় তো সিদ্ধ হলোই না, বরং অরাজনৈতিক বন্দিদের ক্রোধ জেগে উঠলো ইংরেজদের ওপর।

প্রগতিশীল শিবিরে বুদ্ধিজীবী হিসেবে নিজেকে প্রতিপন্ন করবার এক ধরনের আশ্চর্যের জনক প্রতিযোগিতা আছে। সেই প্রতিযোগিতার নির্দিষ্ট ড্রেস কোড আছে। সেই প্রতিযোগিতার নিজস্ব কিছু শারীরিক ভঙ্গিমা, যাকে আজকাল বলে, বডি লাঙ্গুয়েজ, তা আছে। সেটা পোশাক পরিচ্ছদ, কেশ বিন্যাস থেকে শুরু করে হাঁটাচলা সবকিছুর মধ্যেই ফুটে ওঠে। এই প্রতিযোগিতার ধারা অবশ্য এপার বাংলায় ক্রমশ জোরদার হয়ে উঠেছে তখনই, যখন বুদ্ধিদীপ্ত বিভাষা ধীরে ধীরে অস্তগামী হয়েছে। দর্শনধারী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রেই বেশি তাগিদ। গুণবিচারী হওয়ার দিকে তাগিদ কেউ অনুভব করেন না। চার-পাঁচ-ছয়ের দশকেও এমনকি সাতের দশকের উত্তালকালেও এমনটা বুদ্ধি সৈনিক এপার বাংলায় খুব একটা উঠে আসতে দেখা যায়নি।

ধীরে ধীরে এমন একটা আবরণ এপার বাংলার প্রগতিশীল রাজনৈতিক মহলে পড়তে শুরু করল, যার দরুন দেখতে পাওয়া গেল, সাহিত্য- সংস্কৃতি ঘিরে চর্চাকারী মানুষজনদের মধ্যে একদিকে শাসক ঘনিষ্ঠতা এবং সেই ঘনিষ্ঠতাকে বাজারে প্রতিষ্ঠিত করবার ক্ষেত্রে প্রগতিশীল বামপন্থার একটা আবরণ রাখা। কারণ বাজার দক্ষিণপন্থার বুদ্ধিজীবীÑ এই ব্যাপারটা খায় না। তাই দক্ষিণপন্থি বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের খানিকটা প্রগতিশীল বলে দেখানোর চেষ্টা করেন। এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য।

তাই যারা মন-মানসিকতায় চরম প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থি, তারাও কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তির জগতে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বা আরও স্পষ্টভাষায় বলতে গেলে বলা ভালোÑ বাজার তৈরি করতে আশ্রয় নেন বামপন্থার ভেকের। প্রগতিশীলতার ভেকের।

তাই ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারকারী শিবির যেমন পৈতে-টিকি-টুপি-টোপরের মধ্যেই একটা ভেকধারী আচরণে নিমজ্জিত হয়ে নিজের অস্তিত্বকে জানান দেওয়ার কঠিন এবং অবশ্যই ফাঁপা চেষ্টা করে যান। ঠিক তেমন প্রবণতা কিন্তু একাংশের লোক নিজে বুকে প্রগতিশীলতার, বামপন্থার পোস্টার আটকে সামাজিক জীবনে, সাংস্কৃতিক জীবনে, এমনকি রাজনৈতিক জীবনেও পরিপূর্ণ থাকবার চেষ্টায় আজীবন নিজেকে নিমজ্জিত করেন।

গোটা মানবসমাজ এখন ক্রমেই কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছে। বাঙালি সমাজ সেই কঠিন সময়কে অতিবাহিত করবার মধ্যে দিয়েই চেষ্টা করছে উত্তরণের। আর সেই চেষ্টার মধ্য দিয়ে যে জিনিসটা দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঘটছে সেটি হলো, শাসক প্রসাদ লাভে আকাক্সক্ষা। তাই প্রতিবাদকে নিছক একটা প্রতীকী আঙ্গিক দিয়েই প্রতিবাদের মঞ্চ থেকে নিজেকে অপসারিত করবার কায়দা তারা খুব সহজেই আয়ত্ত করে নিয়েছে। প্রতিবাদ নয়। অন্যায়ের সঙ্গে একটা সহজ সহাবস্থান। বিনিময়ে শাসক প্রসাদে প্রাসাদ নির্মাণ।

বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষদের একটা বড় অংশের গত প্রায় ১৫-১৮ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের বুকে যেভাবে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দল এবং শাসকের প্রতি নিজেদের বিকিয়ে দেওয়ার প্রবণতা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়েছে। এটা আর যাই হোক চিন্তা চেতনার দুনিয়া, মুক্তবুদ্ধির পরিসরÑ এগুলোকে কোনও কিছুকেই একটা সুস্থিত বোধের ওপর স্থাপন করতে সক্ষম হয়নি।

সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের শাসনকালের একদম শেষদিকে, যখন শিল্পায়ন ঘিরে একটা কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের বুকে। ঠিক তখনই গোটা শিল্পায়নের পরিকল্পনাকে ভেস্তে দিতে পশ্চিমবঙ্গের বুকে এক ধরনের আন্দোলনের নামে অরাজকতা তৈরি হয়। সমস্ত ধরনের প্রতিক্রিয়াশির শক্তি, এমনকি প্রত্যক্ষভাবে হিন্দু সম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তি এ আন্দোলনের নামে অরাজকতার অংশীদার হয়ে ওঠে।

সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের শাসনকালে ভারতজুড়ে ধীরে ধীরে হিন্দু সম্প্রদায়িক এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির মাথা চাড়া দিয়ে ওঠবার প্রবণতাটা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ড. মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন প্রথম ইউপিআই সরকারের ওপর থেকে বামপন্থিরা সমর্থন প্রত্যাহার করে আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তিকে কেন্দ্র করে। বামপন্থিরা সমর্থন প্রত্যাহার করার ফলে মনমোহনের সরকার পড়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা প্রবল হয়। অদৃশ্য শক্তির সাহায্য নিয়ে কংগ্রেস সেই সরকারকে রক্ষা করে। বামপন্থিরা যে আদর্শগত জায়গা থেকে পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা করেছিল এবং সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করেছিল, কংগ্রেস দল সেটিকে গ্রহণ করে কার্যত একটা ব্যক্তিগত বিদ্বেষের জায়গা থেকে।

ফলে পশ্চিমবঙ্গে সেই সময় শিল্পায়নের লক্ষ্যে বামফ্রন্ট সরকারের যে উদ্যোগ, সিঙ্গুরে টাটা কোম্পানির গাড়ির কারখানা তৈরি করা নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাব তৈরি করা ইত্যাদি প্রশ্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুরু করেন একটা গেল গেল রব। সাধারণ মানুষদের জমি কেড়ে নিচ্ছে রাজ্য সরকারÑ এই জিগির তুলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সমস্ত স্তরের বামপন্থা বিরোধীদের ধীরে ধীরে সমবেত করেন। তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্বের একটা বড় অংশ থেকে শুরু করে হিন্দু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তি বিজেপি এবং তার সঙ্গী-সাথীরা এতে জড়ো হয়। একটা বড় অংশের অতিবাম জড়ো হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এনজিওগুলো, যারা বিদেশি টাকায় পরিপুষ্টÑ তারা আসে। বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় সংগঠন আসে। তার পাশাপাশি শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি, অভিনেতা-অভিনেত্রীÑ এদের একটা বড় অংশকে সমবেত করে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নে একটা বাধার প্রাচীর তুলে ধরেন মমতা।

গোটা বাংলায় শিক্ষক নিয়োগ ঘিরে দুর্নীতির প্রশ্নে একটা ভয়ংকর পরিস্থিতি এখন তৈরি হয়েছে। বহু মানুষ স্কুল শিক্ষকের চাকরি হারিয়েছেন আদালতের নির্দেশে। যারা চাকরি হারিয়েছেন তাদের একটা বড় অংশ ঘুষ দিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরি পেয়েছিলেন। যারা চাকরি থেকে ছাঁটাই হয়েছে, তাদের মধ্যে কিছু মানুষ আছে, যারা যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি পেয়েছিল; কিন্তু রাজ্য সরকার সেই সমস্ত যোগ্য প্রার্থীদের প্রতি আদৌ সময়োচিত এবং শাসকোচিত কোন আচরণ এখনো পর্যন্ত দেখাচ্ছেন না। যোগ্য-অযোগ্যের তালিকা ঘিরে একটা ভয়ংকর লুকোচুরি খেলা খেলছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার।

শিক্ষা দপ্তরের বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকরিচ্যুত মানুষজনেরা যখন বিক্ষোভ দেখাতে গেছেন, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পুলিশ তাদের ওপরে অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছে। এমনকি পা দিয়ে লাথি মারছে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর। সেই ছবি ও সমাজের মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর ভূমিকা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। কখনো তিনি সরাসরি বলছেন, তৃণমূল করলেই চাকরি পাওয়া যাবে। তৃণমূলের লোকেদের জন্য চাকরির কোটা আছে শিক্ষক হিসেবে। আবার চাকরিচ্যুতদের হয়ে নানা ধরনের পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা বলছেন। এইরকম একটা অবস্থায় যদি কোন প্রবীণ বামপন্থি বুদ্ধিজীবী ব্রাত্য বসু এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রসাদ ধন্য কোন চিত্রশিল্পীর সঙ্গে মঞ্চ শেয়ার করেন। পাশাপাশি বসে তাদের সঙ্গে ছবি তোলেন। আর সেই ছবি সমাজ মাধ্যমে ছেয়ে যায়। তাহলে আর যাই হোক সেটা সার্বিকভাবে কখনও মানুষের পক্ষে কল্যাণকর হতে পারে না।

ঘুষ না দিয়ে নিজেদের যোগ্যতায় চাকরি পেয়েও যে সমস্ত যুবক-যুবতীরা আদালতের নির্দেশে আজ চাকরিচ্যুত হয়েছেন, বামপন্থি বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ চিত্রশিল্পীর এক আসনে বসে ছবি, আর যাই হোক তাদের মনে কখনও কোনোরকম শাস্তি দিতে পারে না। তার পাশাপাশি এ ধরনের ছবি, এ ধরনের অবস্থান, ভারতে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক শক্তি উভয়ের বিরুদ্ধে বামপন্থিদের যে আপোসহীন সংগ্রাম, তাকেও একটা সাধারণ মানুষের কাছে সন্দেহজনক অবস্থায় পৌঁছে দেয়।

এ ধরনের অবস্থান সাধারণ মানুষের মধ্যে এ সন্দেহের উদ্বেগ তৈরি করে যে, তাহলে কি বামপন্থিদের যে বিজেপির বিরুদ্ধে অবস্থান, রাজনৈতিক লড়াই, তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অবস্থান এবং রাজনৈতিক সংগ্রামÑ এগুলো কার্যত লোক দেখানো? তার মধ্যে কোন আন্তরিকতা নেই? তার মধ্যে কোন প্রকৃত সংগ্রাম নেই?

এ ধরনের দোস্তির মানসিকতা প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুষদের মধ্যে বামপন্থিদের বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গাটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যন্ত্রণা জাগে এখান থেকে যে, মোহম্মদ সেলিম এবং টিম সেলিম যেভাবে জীবনপণ লড়াই করে সাধারণ মানুষকে একটা অশুভ শক্তির হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে চলেছেন, তাদের সেই চেষ্টায়, তাদের ঘরের ভেতর থেকেই কেউ কেউ যেভাবে এক বালতি দুধে এক ফোঁটা কেরোসিন তেল মিশিয়ে দিচ্ছেন, তা আর যাই হোক পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষদের বেঁচে থাকার প্রশ্নে, জীবন-জীবিকার প্রশ্নে কখনই ইতিবাচক হতে পারে না।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়

প্রযুক্তির ফাঁদে শৈশব : স্ক্রিন টাইম গিলে খাচ্ছে খেলার মাঠ

রমগদ্য : সিরাজগঞ্জে ‘ব্রিটিশ প্রেতাত্মা’

দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ : জনশিক্ষা ও সুশাসনের পথ

ইমাম রইস উদ্দিন হত্যাকাণ্ড : সুবিচার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব

কারাগার, সংশোধনাগার ও ভবঘুরে কেন্দ্রগুলোর সংস্কার কি হবে

জ্বালানির বদল, জীবিকার ঝুঁকি

প্রসঙ্গ : রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও চট্টগ্রামে এস্কর্ট ডিউটি

দেশটা কারো বাপের নয়!

বুদ্ধের বাণীতে বিশ্বশান্তির প্রার্থনা

আর কত ধর্ষণের খবর শুনতে হবে?

সংস্কারের স্বপ্ন বনাম বাস্তবতার রাজনীতি

মধুমাসের স্মৃতি ও দেশীয় ফলের রসাল সমারোহ

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

লিঙ্গের রাজনীতি বা বিবাদ নয়, চাই মানবিকতার নিবিড় বন্ধন

বাজেট : বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পারমাণবিক আলোচনার স্থবিরতা

রম্যগদ্য: “বাঙালি আমরা, নহি তো মেষ...”

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বামপন্থা : নীতির সঙ্গে নেতৃত্বের ভূমিকা

গৌতম রায়

শনিবার, ১৭ মে ২০২৫

সাহিত্য থেকে সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি থেকে অর্থনীতিÑ অবাধ বিচরণ মানুষটির। জীবনানন্দ থেকে শামসুর রাহমান- ঠোটস্থ; কিন্তু কোনো দেখনদারি নেই। আত্মপ্রচার নেই নিজের পা-িত্য ঘিরে।

তেমন মানুষের কাছেই শোনা এই গল্পটিÑ

জেলবন্দি নজরুল গান দিয়ে মাতোয়ারা করে রাখেন বন্দিশালা। গানের পর গান গেয়ে চলেন। সমস্ত স্তরের বন্দিই তার গানে পাগল। নজরুলের জনপ্রিয়তা গগণচুম্বী।

প্রমাদ গুনলো জেল কর্তৃপক্ষ। জেলে বন্দি অরাজনৈতিক, অবাঙালি বন্দিদের বোঝালো; তোমাদের উদ্দেশেই গানের ভিতরে শালা শব্দ আছে। তোমাদেরকে আগুন জ্বেলে পুড়িয়ে মারবার কথাই লোকটা বলছে এসব কথা, আর লোকদের ক্ষেপাচ্ছে তোমাদের পুড়িয়ে মারতে।

নজরুলের ব্যক্তিত্ব এমনই ছিল যে, চেষ্টা করেও ইংরেজ, অরাজনৈতিক বন্দিদের ভিতরে এই বিভাজনের খেলাকে স্থায়ী করতে পারল না। নজরুল সবটা জেনে যখন অরাজনৈতিক বন্দিদের, কারার ওই লৌহকপাটের সম্পূর্ণ অর্থ বোঝালেন, তখন ইংরেজদের অভিপ্রায় তো সিদ্ধ হলোই না, বরং অরাজনৈতিক বন্দিদের ক্রোধ জেগে উঠলো ইংরেজদের ওপর।

প্রগতিশীল শিবিরে বুদ্ধিজীবী হিসেবে নিজেকে প্রতিপন্ন করবার এক ধরনের আশ্চর্যের জনক প্রতিযোগিতা আছে। সেই প্রতিযোগিতার নির্দিষ্ট ড্রেস কোড আছে। সেই প্রতিযোগিতার নিজস্ব কিছু শারীরিক ভঙ্গিমা, যাকে আজকাল বলে, বডি লাঙ্গুয়েজ, তা আছে। সেটা পোশাক পরিচ্ছদ, কেশ বিন্যাস থেকে শুরু করে হাঁটাচলা সবকিছুর মধ্যেই ফুটে ওঠে। এই প্রতিযোগিতার ধারা অবশ্য এপার বাংলায় ক্রমশ জোরদার হয়ে উঠেছে তখনই, যখন বুদ্ধিদীপ্ত বিভাষা ধীরে ধীরে অস্তগামী হয়েছে। দর্শনধারী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রেই বেশি তাগিদ। গুণবিচারী হওয়ার দিকে তাগিদ কেউ অনুভব করেন না। চার-পাঁচ-ছয়ের দশকেও এমনকি সাতের দশকের উত্তালকালেও এমনটা বুদ্ধি সৈনিক এপার বাংলায় খুব একটা উঠে আসতে দেখা যায়নি।

ধীরে ধীরে এমন একটা আবরণ এপার বাংলার প্রগতিশীল রাজনৈতিক মহলে পড়তে শুরু করল, যার দরুন দেখতে পাওয়া গেল, সাহিত্য- সংস্কৃতি ঘিরে চর্চাকারী মানুষজনদের মধ্যে একদিকে শাসক ঘনিষ্ঠতা এবং সেই ঘনিষ্ঠতাকে বাজারে প্রতিষ্ঠিত করবার ক্ষেত্রে প্রগতিশীল বামপন্থার একটা আবরণ রাখা। কারণ বাজার দক্ষিণপন্থার বুদ্ধিজীবীÑ এই ব্যাপারটা খায় না। তাই দক্ষিণপন্থি বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের খানিকটা প্রগতিশীল বলে দেখানোর চেষ্টা করেন। এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য।

তাই যারা মন-মানসিকতায় চরম প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থি, তারাও কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তির জগতে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বা আরও স্পষ্টভাষায় বলতে গেলে বলা ভালোÑ বাজার তৈরি করতে আশ্রয় নেন বামপন্থার ভেকের। প্রগতিশীলতার ভেকের।

তাই ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারকারী শিবির যেমন পৈতে-টিকি-টুপি-টোপরের মধ্যেই একটা ভেকধারী আচরণে নিমজ্জিত হয়ে নিজের অস্তিত্বকে জানান দেওয়ার কঠিন এবং অবশ্যই ফাঁপা চেষ্টা করে যান। ঠিক তেমন প্রবণতা কিন্তু একাংশের লোক নিজে বুকে প্রগতিশীলতার, বামপন্থার পোস্টার আটকে সামাজিক জীবনে, সাংস্কৃতিক জীবনে, এমনকি রাজনৈতিক জীবনেও পরিপূর্ণ থাকবার চেষ্টায় আজীবন নিজেকে নিমজ্জিত করেন।

গোটা মানবসমাজ এখন ক্রমেই কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছে। বাঙালি সমাজ সেই কঠিন সময়কে অতিবাহিত করবার মধ্যে দিয়েই চেষ্টা করছে উত্তরণের। আর সেই চেষ্টার মধ্য দিয়ে যে জিনিসটা দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঘটছে সেটি হলো, শাসক প্রসাদ লাভে আকাক্সক্ষা। তাই প্রতিবাদকে নিছক একটা প্রতীকী আঙ্গিক দিয়েই প্রতিবাদের মঞ্চ থেকে নিজেকে অপসারিত করবার কায়দা তারা খুব সহজেই আয়ত্ত করে নিয়েছে। প্রতিবাদ নয়। অন্যায়ের সঙ্গে একটা সহজ সহাবস্থান। বিনিময়ে শাসক প্রসাদে প্রাসাদ নির্মাণ।

বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষদের একটা বড় অংশের গত প্রায় ১৫-১৮ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের বুকে যেভাবে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দল এবং শাসকের প্রতি নিজেদের বিকিয়ে দেওয়ার প্রবণতা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়েছে। এটা আর যাই হোক চিন্তা চেতনার দুনিয়া, মুক্তবুদ্ধির পরিসরÑ এগুলোকে কোনও কিছুকেই একটা সুস্থিত বোধের ওপর স্থাপন করতে সক্ষম হয়নি।

সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের শাসনকালের একদম শেষদিকে, যখন শিল্পায়ন ঘিরে একটা কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের বুকে। ঠিক তখনই গোটা শিল্পায়নের পরিকল্পনাকে ভেস্তে দিতে পশ্চিমবঙ্গের বুকে এক ধরনের আন্দোলনের নামে অরাজকতা তৈরি হয়। সমস্ত ধরনের প্রতিক্রিয়াশির শক্তি, এমনকি প্রত্যক্ষভাবে হিন্দু সম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তি এ আন্দোলনের নামে অরাজকতার অংশীদার হয়ে ওঠে।

সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের শাসনকালে ভারতজুড়ে ধীরে ধীরে হিন্দু সম্প্রদায়িক এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির মাথা চাড়া দিয়ে ওঠবার প্রবণতাটা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ড. মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন প্রথম ইউপিআই সরকারের ওপর থেকে বামপন্থিরা সমর্থন প্রত্যাহার করে আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তিকে কেন্দ্র করে। বামপন্থিরা সমর্থন প্রত্যাহার করার ফলে মনমোহনের সরকার পড়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা প্রবল হয়। অদৃশ্য শক্তির সাহায্য নিয়ে কংগ্রেস সেই সরকারকে রক্ষা করে। বামপন্থিরা যে আদর্শগত জায়গা থেকে পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা করেছিল এবং সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করেছিল, কংগ্রেস দল সেটিকে গ্রহণ করে কার্যত একটা ব্যক্তিগত বিদ্বেষের জায়গা থেকে।

ফলে পশ্চিমবঙ্গে সেই সময় শিল্পায়নের লক্ষ্যে বামফ্রন্ট সরকারের যে উদ্যোগ, সিঙ্গুরে টাটা কোম্পানির গাড়ির কারখানা তৈরি করা নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাব তৈরি করা ইত্যাদি প্রশ্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুরু করেন একটা গেল গেল রব। সাধারণ মানুষদের জমি কেড়ে নিচ্ছে রাজ্য সরকারÑ এই জিগির তুলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সমস্ত স্তরের বামপন্থা বিরোধীদের ধীরে ধীরে সমবেত করেন। তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্বের একটা বড় অংশ থেকে শুরু করে হিন্দু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তি বিজেপি এবং তার সঙ্গী-সাথীরা এতে জড়ো হয়। একটা বড় অংশের অতিবাম জড়ো হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এনজিওগুলো, যারা বিদেশি টাকায় পরিপুষ্টÑ তারা আসে। বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় সংগঠন আসে। তার পাশাপাশি শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি, অভিনেতা-অভিনেত্রীÑ এদের একটা বড় অংশকে সমবেত করে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নে একটা বাধার প্রাচীর তুলে ধরেন মমতা।

গোটা বাংলায় শিক্ষক নিয়োগ ঘিরে দুর্নীতির প্রশ্নে একটা ভয়ংকর পরিস্থিতি এখন তৈরি হয়েছে। বহু মানুষ স্কুল শিক্ষকের চাকরি হারিয়েছেন আদালতের নির্দেশে। যারা চাকরি হারিয়েছেন তাদের একটা বড় অংশ ঘুষ দিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরি পেয়েছিলেন। যারা চাকরি থেকে ছাঁটাই হয়েছে, তাদের মধ্যে কিছু মানুষ আছে, যারা যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি পেয়েছিল; কিন্তু রাজ্য সরকার সেই সমস্ত যোগ্য প্রার্থীদের প্রতি আদৌ সময়োচিত এবং শাসকোচিত কোন আচরণ এখনো পর্যন্ত দেখাচ্ছেন না। যোগ্য-অযোগ্যের তালিকা ঘিরে একটা ভয়ংকর লুকোচুরি খেলা খেলছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার।

শিক্ষা দপ্তরের বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকরিচ্যুত মানুষজনেরা যখন বিক্ষোভ দেখাতে গেছেন, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পুলিশ তাদের ওপরে অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছে। এমনকি পা দিয়ে লাথি মারছে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর। সেই ছবি ও সমাজের মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর ভূমিকা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। কখনো তিনি সরাসরি বলছেন, তৃণমূল করলেই চাকরি পাওয়া যাবে। তৃণমূলের লোকেদের জন্য চাকরির কোটা আছে শিক্ষক হিসেবে। আবার চাকরিচ্যুতদের হয়ে নানা ধরনের পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা বলছেন। এইরকম একটা অবস্থায় যদি কোন প্রবীণ বামপন্থি বুদ্ধিজীবী ব্রাত্য বসু এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রসাদ ধন্য কোন চিত্রশিল্পীর সঙ্গে মঞ্চ শেয়ার করেন। পাশাপাশি বসে তাদের সঙ্গে ছবি তোলেন। আর সেই ছবি সমাজ মাধ্যমে ছেয়ে যায়। তাহলে আর যাই হোক সেটা সার্বিকভাবে কখনও মানুষের পক্ষে কল্যাণকর হতে পারে না।

ঘুষ না দিয়ে নিজেদের যোগ্যতায় চাকরি পেয়েও যে সমস্ত যুবক-যুবতীরা আদালতের নির্দেশে আজ চাকরিচ্যুত হয়েছেন, বামপন্থি বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ চিত্রশিল্পীর এক আসনে বসে ছবি, আর যাই হোক তাদের মনে কখনও কোনোরকম শাস্তি দিতে পারে না। তার পাশাপাশি এ ধরনের ছবি, এ ধরনের অবস্থান, ভারতে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক শক্তি উভয়ের বিরুদ্ধে বামপন্থিদের যে আপোসহীন সংগ্রাম, তাকেও একটা সাধারণ মানুষের কাছে সন্দেহজনক অবস্থায় পৌঁছে দেয়।

এ ধরনের অবস্থান সাধারণ মানুষের মধ্যে এ সন্দেহের উদ্বেগ তৈরি করে যে, তাহলে কি বামপন্থিদের যে বিজেপির বিরুদ্ধে অবস্থান, রাজনৈতিক লড়াই, তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অবস্থান এবং রাজনৈতিক সংগ্রামÑ এগুলো কার্যত লোক দেখানো? তার মধ্যে কোন আন্তরিকতা নেই? তার মধ্যে কোন প্রকৃত সংগ্রাম নেই?

এ ধরনের দোস্তির মানসিকতা প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুষদের মধ্যে বামপন্থিদের বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গাটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যন্ত্রণা জাগে এখান থেকে যে, মোহম্মদ সেলিম এবং টিম সেলিম যেভাবে জীবনপণ লড়াই করে সাধারণ মানুষকে একটা অশুভ শক্তির হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে চলেছেন, তাদের সেই চেষ্টায়, তাদের ঘরের ভেতর থেকেই কেউ কেউ যেভাবে এক বালতি দুধে এক ফোঁটা কেরোসিন তেল মিশিয়ে দিচ্ছেন, তা আর যাই হোক পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষদের বেঁচে থাকার প্রশ্নে, জীবন-জীবিকার প্রশ্নে কখনই ইতিবাচক হতে পারে না।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

back to top