বাবুল রবিদাস
ছেলে বা মেয়েÑবিয়ের বিষয়টি প্রতিটি অভিভাবকের জন্যই একধরনের মানসিক চাপ। উপযুক্ত পাত্র-পাত্রীর সন্ধানে তারা ছুটে যান ঘটকের কাছে; দেন অর্থ, শুরু হয় খোঁজ-খবর। বিয়ে হলো সমাজ স্বীকৃত একটি বন্ধনÑযার মাধ্যমে নারী-পুরুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ধর্ম ও সংস্কৃতি অনুযায়ী এর রীতিনীতি ভিন্ন হলেও উদ্দেশ্য একইÑএকটি পরিবার গঠন।
কিন্তু আজকের সমাজে বিয়ে মানেই যেন এক মহাআয়োজন, যেখানে ব্যয়ের শেষ নেই। নতুন পোশাক, গহনা, ডেকোরেশন, গানের দল, ভিডিও, নিমন্ত্রণপত্র, গাড়ি ভাড়া, মিষ্টি-খাবারÑসব মিলিয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এক দুঃস্বপ্নের নাম। শুধু সামাজিক প্রথা রক্ষার জন্য অনেকেই দেনা করে, জমি বন্ধক রাখে, এমনকি সাহায্যের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘোরেন।
আমরা কি কখনও ভাবিÑএই বিয়ের আয়োজনগুলো আমাদের কী দিচ্ছে আর কী নিচ্ছে? আসুন, বিষয়গুলো একবার খোলাখুলি দেখিÑ
১. নিরক্ষণ অনুষ্ঠান
কনে বা বর দেখার সময় আত্মীয়স্বজন নিয়ে গিয়ে উপহার আদান-প্রদান, খাওয়া-দাওয়া এসবের প্রয়োজন কী? বরং শুধু অভিভাবকের উপস্থিতিতেই কাজটা শেষ করা যায়। এতে দুই পক্ষই বাঁচবে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় থেকে।
২. শুভ দিন নির্ধারণ
পুরোহিত বা ধর্মীয় ব্যক্তির কাছ থেকে শুভ দিন নির্ধারণ করতে অর্থ ব্যয় হয়। অথচ বাস্তবে ‘শুভ দিন’ বলে কিছু নেইÑশুধু একটি ভালো সিদ্ধান্তই যথেষ্ট।
৩. নিমন্ত্রণপত্র ছাপানো
অতিথিরা কার্ডের তারিখ দেখেন, বাকিটুকু চলে যায় ডাস্টবিনে। তাহলে এত টাকা খরচের মানে কী? ফোন বা ডিজিটাল মেসেজে নিমন্ত্রণই যথেষ্ট হতে পারে।
৪. বাদ্যযন্ত্র ও সাউন্ড সিস্টেম
ঢাকঢোল, সানাই, সাউন্ড বক্সÑএসব শুধু শব্দদূষণ করে। এতে শিশু ও বৃদ্ধরা বিরক্ত হন, পরিবেশের ক্ষতিও হয়।
৫. ভিডিও ও ক্যামেরা
স্মৃতি ধরে রাখতে ভিডিও করা হয় ঠিকই, কিন্তু পরবর্তীতে অনেকেই এসব ব্যবহার করেন না। বরং জরুরি খরচে ওই টাকা কাজে লাগতে পারত।
৬. গহনা ও পোশাকের ফরমালিটি
অনেক পরিবার সোনা-রুপার গহনার জন্য ঋণ করে। অথচ এসব গহনার প্রয়োজন হয় কেবল সামাজিক চোখ রাঙানির জন্য। স্বাভাবিক সাজ-পোশাকেই বিয়েটা সুন্দর হতে পারে।
৭. চাল-ধান ছিটানো
আশীর্বাদ হিসেবে চাল-ধান ছিটানোর রীতি আছে ঠিকই, কিন্তু এতে খাদ্যের অপচয় হয়। এর বদলে ফুল ছিটিয়ে আশীর্বাদ করলেই হয়।
৮. ছায়া ম-প বা ‘মারোয়া’ তৈরি
কলাগাছ কেটে আলপনা, বাতি, হলুদ মাখানো ইত্যাদি কুসংস্কারমূলক প্রথা কেবল অর্থ, সময় ও শ্রমের অপচয়Ñএর বাস্তব কোনো প্রয়োজন নেই।
৯. ডেকোরেশন
চকচকে লাইট, ডিজাইন করা মঞ্চ, মেহেদি-রং করা চেয়ারÑএসব কিছু এক রাতের বাহুল্য ছাড়া আর কিছুই নয়।
১০. বিউটি পার্লার
বউ ও বরকে অপ্রাকৃতিকভাবে সাজিয়ে ফেলার সংস্কৃতি চলছে। এটি শুধু বাহ্যিক রূপ বদলায়, বাস্তবতায় এর কোনো মূল্য নেই।
১১. ঋণ নেয়া
বিয়ে উপলক্ষে কেউ কেউ ঘরবাড়ি বন্ধক রেখে, গরু-ছাগল বিক্রি করে, মানুষের কাছে হাত পেতে আয়োজন করেন। এমন ঋণের বোঝা সংসার শুরু হওয়ার আগেই চাপিয়ে দেয় উদ্বেগ আর অশান্তি।
১২. সময় ও শ্রমের অপচয়
তিন দিন ধরে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন, বিভিন্ন লোকাচার পালনের নামে মূল্যবান সময় ও শ্রম অপচয় হয়, অথচ এসব বাদ দিলেই হয়।
১৩. গাড়ি ও যানবাহন ভাড়া
কার, মাইক্রো, বাসÑএমনকি হেলিকপ্টার বা বিমান ভাড়া করে অনেকে দম্ভ প্রকাশ করেন। এগুলো বাহুল্য ব্যয়ের চরম দৃষ্টান্ত।
১৪. বউভাত
বিয়ের পর ‘বউভাত’ অনুষ্ঠানে বিশাল খরচ হয়, তবু অতিথিদের থেকে ব্যয়ের সমপরিমাণ উপহার ওঠে না। অনেক সময় এই অনুষ্ঠানে বিশৃঙ্খলাও ঘটে।
১৫. মধুচন্দ্রিমা
হোটেল, রিসোর্ট, ভ্রমণÑসব মিলিয়ে ‘মধুচন্দ্রিমা’য় অপচয়ের আরেক উৎস। নতুন দম্পতির জন্য শান্তিপূর্ণ কিছু সময় যথেষ্ট, তার জন্য চড়া খরচে বিলাসিতা নয়।
আজ সময় এসেছে আমাদের চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন ঘটানোর। কুসংস্কার, লোকাচার আর দেখনদারির কারণে আমরা নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনছি। ঋণে জর্জরিত একটি পরিবারে শান্তি থাকে না, সম্পর্ক টেকে না। তাই সমাজে নতুন সংস্কৃতি চালু হোকÑঅল্প খরচে, সহজ ও সুন্দরভাবে বিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজনের সংস্কৃতি। এতে করে আমরা শুধু নিজেরাই স্বস্তিতে থাকব না, বরং সমাজেও একটা ইতিবাচক বার্তা যাবে।
সুস্থ সংস্কৃতি হোক আমাদের গর্ব, অমিতব্যয় নয়। সবার জন্য শুভ হোক বিয়ের আয়োজনÑসৌন্দর্য হোক সরলতায়, শ্রদ্ধা হোক মিতব্যয়ীতায়।
[লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]
বাবুল রবিদাস
রোববার, ১৮ মে ২০২৫
ছেলে বা মেয়েÑবিয়ের বিষয়টি প্রতিটি অভিভাবকের জন্যই একধরনের মানসিক চাপ। উপযুক্ত পাত্র-পাত্রীর সন্ধানে তারা ছুটে যান ঘটকের কাছে; দেন অর্থ, শুরু হয় খোঁজ-খবর। বিয়ে হলো সমাজ স্বীকৃত একটি বন্ধনÑযার মাধ্যমে নারী-পুরুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ধর্ম ও সংস্কৃতি অনুযায়ী এর রীতিনীতি ভিন্ন হলেও উদ্দেশ্য একইÑএকটি পরিবার গঠন।
কিন্তু আজকের সমাজে বিয়ে মানেই যেন এক মহাআয়োজন, যেখানে ব্যয়ের শেষ নেই। নতুন পোশাক, গহনা, ডেকোরেশন, গানের দল, ভিডিও, নিমন্ত্রণপত্র, গাড়ি ভাড়া, মিষ্টি-খাবারÑসব মিলিয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এক দুঃস্বপ্নের নাম। শুধু সামাজিক প্রথা রক্ষার জন্য অনেকেই দেনা করে, জমি বন্ধক রাখে, এমনকি সাহায্যের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘোরেন।
আমরা কি কখনও ভাবিÑএই বিয়ের আয়োজনগুলো আমাদের কী দিচ্ছে আর কী নিচ্ছে? আসুন, বিষয়গুলো একবার খোলাখুলি দেখিÑ
১. নিরক্ষণ অনুষ্ঠান
কনে বা বর দেখার সময় আত্মীয়স্বজন নিয়ে গিয়ে উপহার আদান-প্রদান, খাওয়া-দাওয়া এসবের প্রয়োজন কী? বরং শুধু অভিভাবকের উপস্থিতিতেই কাজটা শেষ করা যায়। এতে দুই পক্ষই বাঁচবে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় থেকে।
২. শুভ দিন নির্ধারণ
পুরোহিত বা ধর্মীয় ব্যক্তির কাছ থেকে শুভ দিন নির্ধারণ করতে অর্থ ব্যয় হয়। অথচ বাস্তবে ‘শুভ দিন’ বলে কিছু নেইÑশুধু একটি ভালো সিদ্ধান্তই যথেষ্ট।
৩. নিমন্ত্রণপত্র ছাপানো
অতিথিরা কার্ডের তারিখ দেখেন, বাকিটুকু চলে যায় ডাস্টবিনে। তাহলে এত টাকা খরচের মানে কী? ফোন বা ডিজিটাল মেসেজে নিমন্ত্রণই যথেষ্ট হতে পারে।
৪. বাদ্যযন্ত্র ও সাউন্ড সিস্টেম
ঢাকঢোল, সানাই, সাউন্ড বক্সÑএসব শুধু শব্দদূষণ করে। এতে শিশু ও বৃদ্ধরা বিরক্ত হন, পরিবেশের ক্ষতিও হয়।
৫. ভিডিও ও ক্যামেরা
স্মৃতি ধরে রাখতে ভিডিও করা হয় ঠিকই, কিন্তু পরবর্তীতে অনেকেই এসব ব্যবহার করেন না। বরং জরুরি খরচে ওই টাকা কাজে লাগতে পারত।
৬. গহনা ও পোশাকের ফরমালিটি
অনেক পরিবার সোনা-রুপার গহনার জন্য ঋণ করে। অথচ এসব গহনার প্রয়োজন হয় কেবল সামাজিক চোখ রাঙানির জন্য। স্বাভাবিক সাজ-পোশাকেই বিয়েটা সুন্দর হতে পারে।
৭. চাল-ধান ছিটানো
আশীর্বাদ হিসেবে চাল-ধান ছিটানোর রীতি আছে ঠিকই, কিন্তু এতে খাদ্যের অপচয় হয়। এর বদলে ফুল ছিটিয়ে আশীর্বাদ করলেই হয়।
৮. ছায়া ম-প বা ‘মারোয়া’ তৈরি
কলাগাছ কেটে আলপনা, বাতি, হলুদ মাখানো ইত্যাদি কুসংস্কারমূলক প্রথা কেবল অর্থ, সময় ও শ্রমের অপচয়Ñএর বাস্তব কোনো প্রয়োজন নেই।
৯. ডেকোরেশন
চকচকে লাইট, ডিজাইন করা মঞ্চ, মেহেদি-রং করা চেয়ারÑএসব কিছু এক রাতের বাহুল্য ছাড়া আর কিছুই নয়।
১০. বিউটি পার্লার
বউ ও বরকে অপ্রাকৃতিকভাবে সাজিয়ে ফেলার সংস্কৃতি চলছে। এটি শুধু বাহ্যিক রূপ বদলায়, বাস্তবতায় এর কোনো মূল্য নেই।
১১. ঋণ নেয়া
বিয়ে উপলক্ষে কেউ কেউ ঘরবাড়ি বন্ধক রেখে, গরু-ছাগল বিক্রি করে, মানুষের কাছে হাত পেতে আয়োজন করেন। এমন ঋণের বোঝা সংসার শুরু হওয়ার আগেই চাপিয়ে দেয় উদ্বেগ আর অশান্তি।
১২. সময় ও শ্রমের অপচয়
তিন দিন ধরে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন, বিভিন্ন লোকাচার পালনের নামে মূল্যবান সময় ও শ্রম অপচয় হয়, অথচ এসব বাদ দিলেই হয়।
১৩. গাড়ি ও যানবাহন ভাড়া
কার, মাইক্রো, বাসÑএমনকি হেলিকপ্টার বা বিমান ভাড়া করে অনেকে দম্ভ প্রকাশ করেন। এগুলো বাহুল্য ব্যয়ের চরম দৃষ্টান্ত।
১৪. বউভাত
বিয়ের পর ‘বউভাত’ অনুষ্ঠানে বিশাল খরচ হয়, তবু অতিথিদের থেকে ব্যয়ের সমপরিমাণ উপহার ওঠে না। অনেক সময় এই অনুষ্ঠানে বিশৃঙ্খলাও ঘটে।
১৫. মধুচন্দ্রিমা
হোটেল, রিসোর্ট, ভ্রমণÑসব মিলিয়ে ‘মধুচন্দ্রিমা’য় অপচয়ের আরেক উৎস। নতুন দম্পতির জন্য শান্তিপূর্ণ কিছু সময় যথেষ্ট, তার জন্য চড়া খরচে বিলাসিতা নয়।
আজ সময় এসেছে আমাদের চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন ঘটানোর। কুসংস্কার, লোকাচার আর দেখনদারির কারণে আমরা নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনছি। ঋণে জর্জরিত একটি পরিবারে শান্তি থাকে না, সম্পর্ক টেকে না। তাই সমাজে নতুন সংস্কৃতি চালু হোকÑঅল্প খরচে, সহজ ও সুন্দরভাবে বিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজনের সংস্কৃতি। এতে করে আমরা শুধু নিজেরাই স্বস্তিতে থাকব না, বরং সমাজেও একটা ইতিবাচক বার্তা যাবে।
সুস্থ সংস্কৃতি হোক আমাদের গর্ব, অমিতব্যয় নয়। সবার জন্য শুভ হোক বিয়ের আয়োজনÑসৌন্দর্য হোক সরলতায়, শ্রদ্ধা হোক মিতব্যয়ীতায়।
[লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]