মাহতাব হোসাইন মাজেদ
সম্প্রতি রাজশাহী ও কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খোসপাঁচড়া জাতীয় সংক্রামক ত্বক রোগ স্ক্যাবিসের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। এটি এক ধরনের ক্ষুদ্র মাইট বা উকুন জাতীয় পরজীবীর সংক্রমণে হয়। রোগটি অত্যন্ত চুলকানিযুক্ত এবং সংক্রামক। সঠিক সময় চিকিৎসা না নিলে এটি দ্রুত আশপাশের লোকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
স্ক্যাবিস কী?
স্ক্যাবিস হলো একটি চুলকানিযুক্ত ত্বকজনিত অবস্থা, যা সারকোপ্টেস স্ক্যাবিই নামক মাইটের সংক্রমণে ঘটে। এটি সংক্রমণ নয় বরং মাইট উপদ্রব, যা মানুষে মানুষের সরাসরি শারীরিক যোগাযোগে ছড়ায়। স্ত্রী মাইট ত্বকে গর্ত করে ডিম পাড়ে এবং এর বর্জ্য ও উপস্থিতি শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে উদ্দীপ্ত করে তীব্র চুলকানি ও প্রদাহ সৃষ্টি করে।
স্ক্যাবিসের ধরন
১. সাধারণ স্ক্যাবিস
সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এই ধরন। ত্বকে চুলকানি, ফুসকুড়ি, ফোস্কা ও লালচে দাগ দেখা যায়। শিশু, বৃদ্ধ ও গাদাগাদি পরিবেশে বসবাসকারী মানুষদের মধ্যে দ্রুত ছড়ায়।
২. নোডুলার স্ক্যাবিস
এটি স্ক্যাবিসের একটি জটিল রূপ, যেখানে ত্বকে শক্ত এবং বেদনাদায়ক গাঁট বা নোডিউল তৈরি হয়। এটি বেশি সময় ধরে সংক্রমণ থাকলে বা ভুল চিকিৎসায় হতে পারে।
৩. নরওয়েজিয়ান বা ক্রাস্টেড স্ক্যাবিস
এটি অত্যন্ত জটিল রূপ, যেখানে ত্বকে মোটা খোলস বা স্তর তৈরি হয় এবং মাইটের সংখ্যা প্রচুর থাকে। রোগপ্রতিরোধক্ষমতা কম এমন ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা যায়।
স্ক্যাবিসের লক্ষণ
তীব্র চুলকানি (বিশেষ করে রাতে); ছোট ছোট লালচে ফুসকুড়ি ও ফোস্কা; ত্বকে সর্পিল বা রেখার মতো দাগ, যাকে ‘নঁৎৎড়’ি বলে; ত্বক মোটা হয়ে যাওয়া (নোডুলার বা ক্রাস্টেড ক্ষেত্রে); ফোস্কা থেকে তরল নিঃসরণ; চুলকানোর ফলে ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ।
সংক্রমণ ছড়ানোর উপায়
স্ক্যাবিস সাধারণত সরাসরি ত্বক থেকে ত্বকে দীর্ঘ সময় ধরে সংস্পর্শে থাকলে ছড়ায়। একই বিছানায় ঘুমানো, কাপড়চোপড়, তোয়ালে, কম্বল ভাগ করে ব্যবহার করাও ঝুঁকিপূর্ণ। স্কুল, হোস্টেল, নার্সিং হোম বা শিশু সেবাকেন্দ্রের মতো পরিবেশে সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। দ্রুত হ্যান্ডশেক বা সংক্ষিপ্ত সংস্পর্শ থেকে সাধারণত ছড়ায় না।
ঝুঁকিপূর্ণ স্থান
স্ক্যাবিস মাইট সাধারণত শরীরের নিম্নোক্ত অংশে বাসা বাঁধেÑ
আঙুলের ফাঁকে; বগল, কনুই, কবজি, কোমর ও নাভির চারপাশ; যৌনাঙ্গ ও স্তন, নিতম্ব। শিশুদের ক্ষেত্রেÑ মুখ, হাতের তালু ও মাথার তালু।
জটিলতা
চুলকানির ফলে ত্বকে আঁচড় লেগে ফেটে গেলে সেখানে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হতে পারে (যেমন ইমপেটিগো)। এছাড়া দীর্ঘদিন সংক্রমণ থাকলে নোডুলার বা ক্রাস্টেড স্ক্যাবিসে রূপ নিতে পারে, যা চিকিৎসা কঠিন করে তোলে।
সতর্কতা ও ভুল চিকিৎসার ক্ষতি
আমাদের দেশে অনেকেই স্ক্যাবিস হলে ফার্মেসি থেকে স্টেরয়েডজাত মলম ব্যবহার করে থাকেন, যা রোগ লুকিয়ে রাখে এবং গভীরে প্রবেশ করে নোডুলার স্ক্যাবিসে রূপ নেয়। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এটি মারাত্মক হতে পারে।
চুলকানির সময় ঘন ঘন চামড়া চুলকালে বা খোঁচালে সেই জায়গায় ঘা হতে পারে, যা ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের দ্বার খুলে দেয়। অতএব আত্মচিকিৎসা নয়Ñ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই সঠিক পদক্ষেপ।
চিকিৎসা
চিকিৎসার মূল লক্ষ্য মাইট ও এর ডিম ধ্বংস করা। সাধারণত স্ক্যাবিসের চিকিৎসায় পারমেথ্রিন বা সালফারযুক্ত লোশন, ক্রিম ব্যবহৃত হয়। এগুলো গায়ে পুরোপুরি মেখে ৮-১৪ ঘণ্টা রেখে ধুয়ে ফেলতে হয়। সংক্রমিত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সদস্যদেরও চিকিৎসা নিতে হয়, যেন পুনরায় সংক্রমণ না ঘটে।
প্রতিরোধে করণীয়
স্ক্যাবিসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা; আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত পোশাক, বিছানাপত্র, তোয়ালে ইত্যাদি গরম পানিতে ধুয়ে রোদে শুকানো; ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা; ঘন ঘন হাত ধোয়া ও শরীর পরিষ্কার রাখা; শিশুসদন, স্কুল, হোস্টেল প্রভৃতিতে স্ক্যাবিস শনাক্ত হলে সমষ্টিগত চিকিৎসা নিশ্চিত করা।
স্ক্যাবিস কোনো মারাত্মক রোগ নয়, তবে অবহেলা করলে এটি পরিবার ও সমাজজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সঠিক পরিচর্যা, সচেতনতা ও চিকিৎসার মাধ্যমে এটি সহজেই প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। মনে রাখতে হবে, কোনো চর্মরোগে প্রথমেই নিজে ওষুধ ব্যবহার না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই সর্বোত্তম পথ।
[লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি]
মাহতাব হোসাইন মাজেদ
মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫
সম্প্রতি রাজশাহী ও কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খোসপাঁচড়া জাতীয় সংক্রামক ত্বক রোগ স্ক্যাবিসের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। এটি এক ধরনের ক্ষুদ্র মাইট বা উকুন জাতীয় পরজীবীর সংক্রমণে হয়। রোগটি অত্যন্ত চুলকানিযুক্ত এবং সংক্রামক। সঠিক সময় চিকিৎসা না নিলে এটি দ্রুত আশপাশের লোকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
স্ক্যাবিস কী?
স্ক্যাবিস হলো একটি চুলকানিযুক্ত ত্বকজনিত অবস্থা, যা সারকোপ্টেস স্ক্যাবিই নামক মাইটের সংক্রমণে ঘটে। এটি সংক্রমণ নয় বরং মাইট উপদ্রব, যা মানুষে মানুষের সরাসরি শারীরিক যোগাযোগে ছড়ায়। স্ত্রী মাইট ত্বকে গর্ত করে ডিম পাড়ে এবং এর বর্জ্য ও উপস্থিতি শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে উদ্দীপ্ত করে তীব্র চুলকানি ও প্রদাহ সৃষ্টি করে।
স্ক্যাবিসের ধরন
১. সাধারণ স্ক্যাবিস
সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এই ধরন। ত্বকে চুলকানি, ফুসকুড়ি, ফোস্কা ও লালচে দাগ দেখা যায়। শিশু, বৃদ্ধ ও গাদাগাদি পরিবেশে বসবাসকারী মানুষদের মধ্যে দ্রুত ছড়ায়।
২. নোডুলার স্ক্যাবিস
এটি স্ক্যাবিসের একটি জটিল রূপ, যেখানে ত্বকে শক্ত এবং বেদনাদায়ক গাঁট বা নোডিউল তৈরি হয়। এটি বেশি সময় ধরে সংক্রমণ থাকলে বা ভুল চিকিৎসায় হতে পারে।
৩. নরওয়েজিয়ান বা ক্রাস্টেড স্ক্যাবিস
এটি অত্যন্ত জটিল রূপ, যেখানে ত্বকে মোটা খোলস বা স্তর তৈরি হয় এবং মাইটের সংখ্যা প্রচুর থাকে। রোগপ্রতিরোধক্ষমতা কম এমন ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা যায়।
স্ক্যাবিসের লক্ষণ
তীব্র চুলকানি (বিশেষ করে রাতে); ছোট ছোট লালচে ফুসকুড়ি ও ফোস্কা; ত্বকে সর্পিল বা রেখার মতো দাগ, যাকে ‘নঁৎৎড়’ি বলে; ত্বক মোটা হয়ে যাওয়া (নোডুলার বা ক্রাস্টেড ক্ষেত্রে); ফোস্কা থেকে তরল নিঃসরণ; চুলকানোর ফলে ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ।
সংক্রমণ ছড়ানোর উপায়
স্ক্যাবিস সাধারণত সরাসরি ত্বক থেকে ত্বকে দীর্ঘ সময় ধরে সংস্পর্শে থাকলে ছড়ায়। একই বিছানায় ঘুমানো, কাপড়চোপড়, তোয়ালে, কম্বল ভাগ করে ব্যবহার করাও ঝুঁকিপূর্ণ। স্কুল, হোস্টেল, নার্সিং হোম বা শিশু সেবাকেন্দ্রের মতো পরিবেশে সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। দ্রুত হ্যান্ডশেক বা সংক্ষিপ্ত সংস্পর্শ থেকে সাধারণত ছড়ায় না।
ঝুঁকিপূর্ণ স্থান
স্ক্যাবিস মাইট সাধারণত শরীরের নিম্নোক্ত অংশে বাসা বাঁধেÑ
আঙুলের ফাঁকে; বগল, কনুই, কবজি, কোমর ও নাভির চারপাশ; যৌনাঙ্গ ও স্তন, নিতম্ব। শিশুদের ক্ষেত্রেÑ মুখ, হাতের তালু ও মাথার তালু।
জটিলতা
চুলকানির ফলে ত্বকে আঁচড় লেগে ফেটে গেলে সেখানে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হতে পারে (যেমন ইমপেটিগো)। এছাড়া দীর্ঘদিন সংক্রমণ থাকলে নোডুলার বা ক্রাস্টেড স্ক্যাবিসে রূপ নিতে পারে, যা চিকিৎসা কঠিন করে তোলে।
সতর্কতা ও ভুল চিকিৎসার ক্ষতি
আমাদের দেশে অনেকেই স্ক্যাবিস হলে ফার্মেসি থেকে স্টেরয়েডজাত মলম ব্যবহার করে থাকেন, যা রোগ লুকিয়ে রাখে এবং গভীরে প্রবেশ করে নোডুলার স্ক্যাবিসে রূপ নেয়। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এটি মারাত্মক হতে পারে।
চুলকানির সময় ঘন ঘন চামড়া চুলকালে বা খোঁচালে সেই জায়গায় ঘা হতে পারে, যা ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের দ্বার খুলে দেয়। অতএব আত্মচিকিৎসা নয়Ñ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই সঠিক পদক্ষেপ।
চিকিৎসা
চিকিৎসার মূল লক্ষ্য মাইট ও এর ডিম ধ্বংস করা। সাধারণত স্ক্যাবিসের চিকিৎসায় পারমেথ্রিন বা সালফারযুক্ত লোশন, ক্রিম ব্যবহৃত হয়। এগুলো গায়ে পুরোপুরি মেখে ৮-১৪ ঘণ্টা রেখে ধুয়ে ফেলতে হয়। সংক্রমিত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সদস্যদেরও চিকিৎসা নিতে হয়, যেন পুনরায় সংক্রমণ না ঘটে।
প্রতিরোধে করণীয়
স্ক্যাবিসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা; আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত পোশাক, বিছানাপত্র, তোয়ালে ইত্যাদি গরম পানিতে ধুয়ে রোদে শুকানো; ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা; ঘন ঘন হাত ধোয়া ও শরীর পরিষ্কার রাখা; শিশুসদন, স্কুল, হোস্টেল প্রভৃতিতে স্ক্যাবিস শনাক্ত হলে সমষ্টিগত চিকিৎসা নিশ্চিত করা।
স্ক্যাবিস কোনো মারাত্মক রোগ নয়, তবে অবহেলা করলে এটি পরিবার ও সমাজজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সঠিক পরিচর্যা, সচেতনতা ও চিকিৎসার মাধ্যমে এটি সহজেই প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। মনে রাখতে হবে, কোনো চর্মরোগে প্রথমেই নিজে ওষুধ ব্যবহার না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই সর্বোত্তম পথ।
[লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি]