alt

উপ-সম্পাদকীয়

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

মতিউর রহমান

: শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

আধুনিক বিশ্বে মনোযোগ এখন শুধু একটি মানসিক প্রক্রিয়া নয়, বরং একটি মূল্যবান অর্থনৈতিক সম্পদ। পণ্য ও সেবার চিরাচরিত অর্থনীতিকে ছাপিয়ে আজকের বিশ্ব পরিচালিত হচ্ছে মনোযোগ অর্থনীতি (অ্যাটেনশন ইকোনমি) এবং জ্ঞান পুঁজিবাদ (কগনিটিভ ক্যাপিট্যালিজম) দ্বারা। এই নতুন অর্থনৈতিক কাঠামোতে মানুষের মানসিক সম্পদ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মনোযোগ ও চিন্তাশক্তি, সরাসরি মুনাফার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।

ফেসবুক, টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলো তরুণদের মনোযোগের প্রতিটি মুহূর্তকে অর্থে রূপান্তরিত করছে, যার ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করছে শিক্ষাব্যবস্থা, নাগরিক সচেতনতা এবং সামগ্রিক আত্ম-উন্নয়নের ক্ষেত্রগুলো। জোনাথন ক্রেরি, জেমস উইলিয়ামস এবং জ্ঞান পুঁজিবাদের তত্ত্বের আলোকে এই গভীর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা বিশ্লেষণ করা যাক।

জোনাথন ক্রেরি তার আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ ‘২৪/৭ : লেট ক্যাপিটালিজম অ্যান্ড দ্য এন্ড অফ সিøপ’-এ দেখিয়েছেন, আধুনিক পুঁজিবাদ শুধু মানুষের শ্রম নয়, তাদের সময় ও বিশ্রামের উপরেও আগ্রাসন চালাচ্ছে। ঘুম, অবসর, বা নির্ভেজাল চিন্তার মতো ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলোও এখন কর্পোরেট প্ল্যাটফর্মগুলো দ্বারা প্রযুক্তিগতভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে।

টিকটকের মতো অ্যাপগুলো অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও দ্রুত পরিবর্তনশীল ভিডিওর মাধ্যমে তরুণদের মস্তিষ্কের ‘নভেলটি সিকিং’ অর্থাৎ নতুন কিছু খোঁজার প্রবণতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের মনোযোগকে আটকে রাখে। এসব প্ল্যাটফর্মে সময় কাটানো নিছক বিনোদন নয়, বরং নির্বিচারে তথ্য গ্রহণ এবং অবচেতন মনোযোগের শোষণ। এই প্রক্রিয়ায় তরুণদের মননশীল চিন্তাশক্তি, শিক্ষার প্রতি আগ্রহ ও নাগরিক দায়িত্ববোধ ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে।

জেমস উইলিয়ামস তার ‘স্ট্যান্ড আউট অব আউর লাইট’ বইয়ে আরও গভীরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে, আজকের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো শুধু তথ্যের সরবরাহকারী নয়, বরং মনোযোগের চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রক। তিনি বলেন, এই প্রযুক্তিগুলোর মূল লক্ষ্য হলো মানুষের অভ্যন্তরীণ লক্ষ্য থেকে তাদের মনোযোগ সরিয়ে কর্পোরেট স্বার্থের দিকে প্রবাহিত করা।

এর ফলে শিক্ষার্থীরা এখন বইয়ের পাতায় মনোযোগ না দিয়ে ক্ষুদ্র ভিডিওতে মগ্ন, সামাজিক আন্দোলনের পরিবর্তে ভাইরাল চ্যালেঞ্জে উৎসাহী এবং গভীর চিন্তার পরিবর্তে তাৎক্ষণিক বিনোদনে আসক্ত। ফলস্বরূপ, শিক্ষার প্রতি তাদের মনোযোগ ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে এবং তারা ধীরে ধীরে নাগরিক সমাজে সক্রিয় ভূমিকা পালনের সক্ষমতা হারাচ্ছে। উইলিয়ামস সতর্ক করেন, মনোযোগের এই বাণিজ্যিকীকরণ মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও নৈতিক ক্ষমতাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।

জ্ঞান পুঁজিবাদ ধারণা অনুযায়ী, বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তার চিরাচরিত উৎপাদনশীল পর্ব অতিক্রম করে মানুষের জ্ঞান, আবেগ এবং সামাজিক পারস্পরিক যোগাযোগের উপর ভিত্তি করে মূল্য তৈরি করছে। এই কাঠামোতে ব্যবহারকারীরা শুধু তাদের শারীরিক শ্রম দিয়ে নয়, বরং তাদের মনোযোগ, চিন্তা এবং সামাজিক সম্পর্ক দিয়েও অর্থনৈতিক মুনাফা তৈরি করছে।

টিকটক, ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো কোনো পণ্য বিক্রি করে না, বরং ব্যবহারকারীর প্রতিটি মুহূর্তের মনোযোগকে পণ্যে রূপান্তর করে। এখানে তরুণরা শুধু ভোক্তা নয়, বরং অবৈতনিক শ্রমিক, যাদের মানসিক কর্মকা- থেকে বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো লাভবান হচ্ছে।

মনোযোগ অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্র। শিক্ষা মূলত মনোযোগের দীর্ঘস্থায়ী চর্চা, গভীর চিন্তা এবং ধৈর্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু টিকটক বা ফেসবুকের দ্রুত পরিবর্তনশীল, আবেগনির্ভর এবং সংক্ষিপ্ত কনটেন্টের কারণে তরুণরা দীর্ঘ সময় ধরে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে পারছে না।

শ্রেণীকক্ষে তাদের মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে এবং জটিল বিষয় বুঝতে তারা চেষ্টাও করছে না। এভাবে তারা একসময় হয়ে উঠছে ফাঁপা জ্ঞানের অধিকারী, যারা তথ্য জানে কিন্তু তা বিশ্লেষণ করতে পারে না। এর ফলস্বরূপ, ভবিষ্যতে তারা নাগরিক সমাজের চিন্তাশীল ও দায়িত্বশীল অংশ হয়ে উঠতে ব্যর্থ হচ্ছে।

এই মনোযোগ অর্থনীতি তরুণদের সামাজিক বাস্তবতাকে মারাত্মকভাবে বিকৃত করছে। টিকটক, ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো এমন কনটেন্ট দেখায় যা সত্যের চেয়ে বেশি মনোযোগ আকর্ষণকারী। এতে তরুণরা যেসব তথ্য দেখে, তা তাদের সামাজিক বাস্তবতার এক বিকৃত প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়ায়।

তারা মনে করে, ভাইরাল হওয়া মানেই গুরুত্বপূর্ণ হওয়া। এর ফলস্বরূপ, তারা রাজনৈতিক বা সামাজিক বিষয়গুলোকে গভীরভাবে বোঝার পরিবর্তে শুধু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখায়। নাগরিক সমাজের জন্য এই প্রজন্ম হয়ে পড়ছে সংকটপূর্ণÑসচেতন কিন্তু সংগঠিত নয়, তথ্যবহুল কিন্তু কর্মক্ষম নয়।

এই সমস্যার মূলে রয়েছে প্ল্যাটফর্মগুলোর অর্থনৈতিক মডেল। টিকটক এবং ফেসবুকের আয়ের প্রধান উৎস হলো বিজ্ঞাপন, আর বিজ্ঞাপন আয় বাড়াতে প্রয়োজন মানুষকে দীর্ঘ সময় প্ল্যাটফর্মে ধরে রাখা। এই লক্ষ্যে তারা সহজতর স্ক্রলিং ইন্টারফেস, অত্যন্ত কার্যকর রেকমেন্ডেশন অ্যালগরিদম এবং পুশ নোটিফিকেশন ডিজাইন করেছে।

মনোবিজ্ঞান এবং আচরণগত অর্থনীতির গবেষণার মাধ্যমে এসব ডিজাইন এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে তরুণরা সহজেই আসক্ত হয়ে পড়ে। নতুন কিছু দেখার এবং তাৎক্ষণিক আনন্দ পাওয়ার প্রবণতাকে কাজে লাগিয়ে তারা তরুণদের মনোযোগের দুর্বলতাকে শোষণে পরিণত করেছে।

এই শোষণ থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন, কারণ আজকের তরুণদের সামাজিক জীবন, বন্ধুত্ব এবং সংস্কৃতি এই প্ল্যাটফর্মগুলোর সাথে গভীরভাবে জড়িত। টিকটক বা ফেসবুক ছাড়া তারা যেন সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

মনোযোগের এই বাণিজ্যিকীকরণ শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি একটি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বন্ধন তৈরি করেছে। তরুণরা যেন স্বেচ্ছায় নিজেদের মনোযোগ বিক্রি করছে, কারণ সামাজিক স্বীকৃতি, বিনোদন এবং পরিচয়ের ভিত্তি এখন এই প্ল্যাটফর্মগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

এই পরিস্থিতির ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে মানসিক স্বাস্থ্যে। ক্রমাগত মনোযোগ হারানো, সামাজিক তুলনা এবং সর্বদা ‘অন’ থাকার চাপ তরুণদের মধ্যে উদ্বেগ, হতাশা এবং আত্মসম্মানহীনতা তৈরি করছে। নিজেদের জীবনকে অন্যদের সাথে তুলনা করতে করতে তারা এক ধরনের মানসিক দ্বৈততায় ভুগছে।

জ্ঞান পুঁজিবাদ এই মানসিক সংকটকেও পণ্যে পরিণত করেছে। নানা ধরনের মেডিটেশন অ্যাপ, মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কনটেন্ট এবং সেলফ-হেল্প গ্রুপগুলো আবার একই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমেই বাজারজাত করা হচ্ছে। অর্থাৎ সংকট এবং তার সমাধান উভয়ই কর্পোরেট লাভের উৎসে পরিণত হয়েছে।

এই সংকট থেকে মুক্তির পথ শুধু ব্যক্তিগত ডিজিটাল ডিটক্স নয়। প্রয়োজন শিক্ষায় মৌলিক পরিবর্তন, যেখানে তরুণরা শুধু প্রযুক্তি ব্যবহার করতে নয়, প্রযুক্তিকে বিশ্লেষণ করতে শিখবে। নীতিগতভাবে এসব প্ল্যাটফর্মের ডিজাইন ও ডেটা নীতির পরিবর্তন আনা জরুরি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে তরুণদের মনোযোগ এবং চিন্তাশক্তি ফিরিয়ে আনতে হবে।

নাগরিক সমাজকে ডিজিটাল গণপরিসরকে আবারও অর্থপূর্ণ সংলাপ এবং সম্মিলিত কর্মের স্থানে পরিণত করতে হবে। সর্বোপরি, এমন একটি অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যেখানে মানুষের মন এবং চিন্তাকে পণ্য হিসেবে নয়, বরং মানবিক বিকাশের অংশ হিসেবে মূল্যায়ন করা হবে।

জোনাথন ক্রেরি সতর্ক করেন, আধুনিক পুঁজিবাদ মানুষের শেষ অবশিষ্ট ব্যক্তিগত ক্ষেত্রÑঘুম, অবসর এবং চিন্তাকেও দখল করতে চাইছে। উইলিয়ামস বলেন, প্রযুক্তিকে এমনভাবে ডিজাইন করতে হবে, যাতে তা মানুষের লক্ষ্য এবং মানসিক স্বাস্থ্যকে সমর্থন করে, কর্পোরেট লাভকে নয়।

মনোযোগ অর্থনীতি এবং জ্ঞান পুঁজিবাদ কোনো অনিবার্য বাস্তবতা নয়; এগুলো কিছু কর্পোরেট সিদ্ধান্ত এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের ফল। তরুণ প্রজন্মের মনোযোগ ফিরিয়ে আনা শুধু শিক্ষাগত বা প্রযুক্তিগত দায়িত্ব নয়, এটি একটি রাজনৈতিক এবং নৈতিক দায়িত্ব।

মনোযোগ অর্থনীতি এবং জ্ঞান পুঁজিবাদ তরুণদের মানসিক জীবনকে পণ্যে পরিণত করেছে। ঞরশঞড়শ এবং ঋধপবনড়ড়শ-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো এই শোষণের প্রতীক, যারা প্রতিটি মনোযোগের মুহূর্তকে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নগদায়িত করে। এর ফলে তরুণদের শিক্ষা ও নাগরিক জীবন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্রেরি, উইলিয়ামস এবং জ্ঞান পুঁজিবাদের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আমাদের এই শোষণের গভীর কাঠামো উন্মোচন করে।

তবে এই সমালোচনার মধ্যেই নিহিত রয়েছে প্রতিরোধের সম্ভাবনাও। সমালোচনামূলক চেতনা, নৈতিক প্রযুক্তি নকশা এবং শিক্ষার পুনর্গঠনই পারে তরুণদের মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে। আজকের সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে আগামী প্রজন্মের মানসিক স্বাধীনতা, শিক্ষার গুণগত মান এবং গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ।

[ লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী ]

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

একটি সফর, একাধিক সংকেত : কে পেল কোন বার্তা?

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

মতিউর রহমান

শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

আধুনিক বিশ্বে মনোযোগ এখন শুধু একটি মানসিক প্রক্রিয়া নয়, বরং একটি মূল্যবান অর্থনৈতিক সম্পদ। পণ্য ও সেবার চিরাচরিত অর্থনীতিকে ছাপিয়ে আজকের বিশ্ব পরিচালিত হচ্ছে মনোযোগ অর্থনীতি (অ্যাটেনশন ইকোনমি) এবং জ্ঞান পুঁজিবাদ (কগনিটিভ ক্যাপিট্যালিজম) দ্বারা। এই নতুন অর্থনৈতিক কাঠামোতে মানুষের মানসিক সম্পদ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মনোযোগ ও চিন্তাশক্তি, সরাসরি মুনাফার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।

ফেসবুক, টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলো তরুণদের মনোযোগের প্রতিটি মুহূর্তকে অর্থে রূপান্তরিত করছে, যার ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করছে শিক্ষাব্যবস্থা, নাগরিক সচেতনতা এবং সামগ্রিক আত্ম-উন্নয়নের ক্ষেত্রগুলো। জোনাথন ক্রেরি, জেমস উইলিয়ামস এবং জ্ঞান পুঁজিবাদের তত্ত্বের আলোকে এই গভীর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা বিশ্লেষণ করা যাক।

জোনাথন ক্রেরি তার আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ ‘২৪/৭ : লেট ক্যাপিটালিজম অ্যান্ড দ্য এন্ড অফ সিøপ’-এ দেখিয়েছেন, আধুনিক পুঁজিবাদ শুধু মানুষের শ্রম নয়, তাদের সময় ও বিশ্রামের উপরেও আগ্রাসন চালাচ্ছে। ঘুম, অবসর, বা নির্ভেজাল চিন্তার মতো ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলোও এখন কর্পোরেট প্ল্যাটফর্মগুলো দ্বারা প্রযুক্তিগতভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে।

টিকটকের মতো অ্যাপগুলো অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও দ্রুত পরিবর্তনশীল ভিডিওর মাধ্যমে তরুণদের মস্তিষ্কের ‘নভেলটি সিকিং’ অর্থাৎ নতুন কিছু খোঁজার প্রবণতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের মনোযোগকে আটকে রাখে। এসব প্ল্যাটফর্মে সময় কাটানো নিছক বিনোদন নয়, বরং নির্বিচারে তথ্য গ্রহণ এবং অবচেতন মনোযোগের শোষণ। এই প্রক্রিয়ায় তরুণদের মননশীল চিন্তাশক্তি, শিক্ষার প্রতি আগ্রহ ও নাগরিক দায়িত্ববোধ ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে।

জেমস উইলিয়ামস তার ‘স্ট্যান্ড আউট অব আউর লাইট’ বইয়ে আরও গভীরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে, আজকের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো শুধু তথ্যের সরবরাহকারী নয়, বরং মনোযোগের চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রক। তিনি বলেন, এই প্রযুক্তিগুলোর মূল লক্ষ্য হলো মানুষের অভ্যন্তরীণ লক্ষ্য থেকে তাদের মনোযোগ সরিয়ে কর্পোরেট স্বার্থের দিকে প্রবাহিত করা।

এর ফলে শিক্ষার্থীরা এখন বইয়ের পাতায় মনোযোগ না দিয়ে ক্ষুদ্র ভিডিওতে মগ্ন, সামাজিক আন্দোলনের পরিবর্তে ভাইরাল চ্যালেঞ্জে উৎসাহী এবং গভীর চিন্তার পরিবর্তে তাৎক্ষণিক বিনোদনে আসক্ত। ফলস্বরূপ, শিক্ষার প্রতি তাদের মনোযোগ ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে এবং তারা ধীরে ধীরে নাগরিক সমাজে সক্রিয় ভূমিকা পালনের সক্ষমতা হারাচ্ছে। উইলিয়ামস সতর্ক করেন, মনোযোগের এই বাণিজ্যিকীকরণ মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও নৈতিক ক্ষমতাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।

জ্ঞান পুঁজিবাদ ধারণা অনুযায়ী, বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তার চিরাচরিত উৎপাদনশীল পর্ব অতিক্রম করে মানুষের জ্ঞান, আবেগ এবং সামাজিক পারস্পরিক যোগাযোগের উপর ভিত্তি করে মূল্য তৈরি করছে। এই কাঠামোতে ব্যবহারকারীরা শুধু তাদের শারীরিক শ্রম দিয়ে নয়, বরং তাদের মনোযোগ, চিন্তা এবং সামাজিক সম্পর্ক দিয়েও অর্থনৈতিক মুনাফা তৈরি করছে।

টিকটক, ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো কোনো পণ্য বিক্রি করে না, বরং ব্যবহারকারীর প্রতিটি মুহূর্তের মনোযোগকে পণ্যে রূপান্তর করে। এখানে তরুণরা শুধু ভোক্তা নয়, বরং অবৈতনিক শ্রমিক, যাদের মানসিক কর্মকা- থেকে বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো লাভবান হচ্ছে।

মনোযোগ অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্র। শিক্ষা মূলত মনোযোগের দীর্ঘস্থায়ী চর্চা, গভীর চিন্তা এবং ধৈর্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু টিকটক বা ফেসবুকের দ্রুত পরিবর্তনশীল, আবেগনির্ভর এবং সংক্ষিপ্ত কনটেন্টের কারণে তরুণরা দীর্ঘ সময় ধরে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে পারছে না।

শ্রেণীকক্ষে তাদের মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে এবং জটিল বিষয় বুঝতে তারা চেষ্টাও করছে না। এভাবে তারা একসময় হয়ে উঠছে ফাঁপা জ্ঞানের অধিকারী, যারা তথ্য জানে কিন্তু তা বিশ্লেষণ করতে পারে না। এর ফলস্বরূপ, ভবিষ্যতে তারা নাগরিক সমাজের চিন্তাশীল ও দায়িত্বশীল অংশ হয়ে উঠতে ব্যর্থ হচ্ছে।

এই মনোযোগ অর্থনীতি তরুণদের সামাজিক বাস্তবতাকে মারাত্মকভাবে বিকৃত করছে। টিকটক, ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো এমন কনটেন্ট দেখায় যা সত্যের চেয়ে বেশি মনোযোগ আকর্ষণকারী। এতে তরুণরা যেসব তথ্য দেখে, তা তাদের সামাজিক বাস্তবতার এক বিকৃত প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়ায়।

তারা মনে করে, ভাইরাল হওয়া মানেই গুরুত্বপূর্ণ হওয়া। এর ফলস্বরূপ, তারা রাজনৈতিক বা সামাজিক বিষয়গুলোকে গভীরভাবে বোঝার পরিবর্তে শুধু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখায়। নাগরিক সমাজের জন্য এই প্রজন্ম হয়ে পড়ছে সংকটপূর্ণÑসচেতন কিন্তু সংগঠিত নয়, তথ্যবহুল কিন্তু কর্মক্ষম নয়।

এই সমস্যার মূলে রয়েছে প্ল্যাটফর্মগুলোর অর্থনৈতিক মডেল। টিকটক এবং ফেসবুকের আয়ের প্রধান উৎস হলো বিজ্ঞাপন, আর বিজ্ঞাপন আয় বাড়াতে প্রয়োজন মানুষকে দীর্ঘ সময় প্ল্যাটফর্মে ধরে রাখা। এই লক্ষ্যে তারা সহজতর স্ক্রলিং ইন্টারফেস, অত্যন্ত কার্যকর রেকমেন্ডেশন অ্যালগরিদম এবং পুশ নোটিফিকেশন ডিজাইন করেছে।

মনোবিজ্ঞান এবং আচরণগত অর্থনীতির গবেষণার মাধ্যমে এসব ডিজাইন এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে তরুণরা সহজেই আসক্ত হয়ে পড়ে। নতুন কিছু দেখার এবং তাৎক্ষণিক আনন্দ পাওয়ার প্রবণতাকে কাজে লাগিয়ে তারা তরুণদের মনোযোগের দুর্বলতাকে শোষণে পরিণত করেছে।

এই শোষণ থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন, কারণ আজকের তরুণদের সামাজিক জীবন, বন্ধুত্ব এবং সংস্কৃতি এই প্ল্যাটফর্মগুলোর সাথে গভীরভাবে জড়িত। টিকটক বা ফেসবুক ছাড়া তারা যেন সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

মনোযোগের এই বাণিজ্যিকীকরণ শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি একটি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বন্ধন তৈরি করেছে। তরুণরা যেন স্বেচ্ছায় নিজেদের মনোযোগ বিক্রি করছে, কারণ সামাজিক স্বীকৃতি, বিনোদন এবং পরিচয়ের ভিত্তি এখন এই প্ল্যাটফর্মগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

এই পরিস্থিতির ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে মানসিক স্বাস্থ্যে। ক্রমাগত মনোযোগ হারানো, সামাজিক তুলনা এবং সর্বদা ‘অন’ থাকার চাপ তরুণদের মধ্যে উদ্বেগ, হতাশা এবং আত্মসম্মানহীনতা তৈরি করছে। নিজেদের জীবনকে অন্যদের সাথে তুলনা করতে করতে তারা এক ধরনের মানসিক দ্বৈততায় ভুগছে।

জ্ঞান পুঁজিবাদ এই মানসিক সংকটকেও পণ্যে পরিণত করেছে। নানা ধরনের মেডিটেশন অ্যাপ, মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কনটেন্ট এবং সেলফ-হেল্প গ্রুপগুলো আবার একই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমেই বাজারজাত করা হচ্ছে। অর্থাৎ সংকট এবং তার সমাধান উভয়ই কর্পোরেট লাভের উৎসে পরিণত হয়েছে।

এই সংকট থেকে মুক্তির পথ শুধু ব্যক্তিগত ডিজিটাল ডিটক্স নয়। প্রয়োজন শিক্ষায় মৌলিক পরিবর্তন, যেখানে তরুণরা শুধু প্রযুক্তি ব্যবহার করতে নয়, প্রযুক্তিকে বিশ্লেষণ করতে শিখবে। নীতিগতভাবে এসব প্ল্যাটফর্মের ডিজাইন ও ডেটা নীতির পরিবর্তন আনা জরুরি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে তরুণদের মনোযোগ এবং চিন্তাশক্তি ফিরিয়ে আনতে হবে।

নাগরিক সমাজকে ডিজিটাল গণপরিসরকে আবারও অর্থপূর্ণ সংলাপ এবং সম্মিলিত কর্মের স্থানে পরিণত করতে হবে। সর্বোপরি, এমন একটি অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যেখানে মানুষের মন এবং চিন্তাকে পণ্য হিসেবে নয়, বরং মানবিক বিকাশের অংশ হিসেবে মূল্যায়ন করা হবে।

জোনাথন ক্রেরি সতর্ক করেন, আধুনিক পুঁজিবাদ মানুষের শেষ অবশিষ্ট ব্যক্তিগত ক্ষেত্রÑঘুম, অবসর এবং চিন্তাকেও দখল করতে চাইছে। উইলিয়ামস বলেন, প্রযুক্তিকে এমনভাবে ডিজাইন করতে হবে, যাতে তা মানুষের লক্ষ্য এবং মানসিক স্বাস্থ্যকে সমর্থন করে, কর্পোরেট লাভকে নয়।

মনোযোগ অর্থনীতি এবং জ্ঞান পুঁজিবাদ কোনো অনিবার্য বাস্তবতা নয়; এগুলো কিছু কর্পোরেট সিদ্ধান্ত এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের ফল। তরুণ প্রজন্মের মনোযোগ ফিরিয়ে আনা শুধু শিক্ষাগত বা প্রযুক্তিগত দায়িত্ব নয়, এটি একটি রাজনৈতিক এবং নৈতিক দায়িত্ব।

মনোযোগ অর্থনীতি এবং জ্ঞান পুঁজিবাদ তরুণদের মানসিক জীবনকে পণ্যে পরিণত করেছে। ঞরশঞড়শ এবং ঋধপবনড়ড়শ-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো এই শোষণের প্রতীক, যারা প্রতিটি মনোযোগের মুহূর্তকে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নগদায়িত করে। এর ফলে তরুণদের শিক্ষা ও নাগরিক জীবন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্রেরি, উইলিয়ামস এবং জ্ঞান পুঁজিবাদের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আমাদের এই শোষণের গভীর কাঠামো উন্মোচন করে।

তবে এই সমালোচনার মধ্যেই নিহিত রয়েছে প্রতিরোধের সম্ভাবনাও। সমালোচনামূলক চেতনা, নৈতিক প্রযুক্তি নকশা এবং শিক্ষার পুনর্গঠনই পারে তরুণদের মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে। আজকের সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে আগামী প্রজন্মের মানসিক স্বাধীনতা, শিক্ষার গুণগত মান এবং গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ।

[ লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী ]

back to top