রেজাউল করিম খোকন
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি ও শিল্পের সংযোগস্থলে এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করে নিতে শুরু করেছে রাবার শিল্প। অনেকেই এখনও এই খাতকে অবহেলার চোখে দেখলেও বাস্তবে এর রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা, যা সঠিক নীতিগত দিকনির্দেশনা, পরিকল্পিত বিনিয়োগ ও সরকারি সহায়তার মাধ্যমে বাস্তবায়ন সম্ভব। একবিংশ শতাব্দীর বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ যেমনÑ জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ সংকট, কর্মসংস্থানের অভাব এবং দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য রাবার শিল্প হতে পারে একটি কার্যকর হাতিয়ার।
রাবার একটি অর্থকরী ও বহুমুখী ব্যবহারযোগ্য সম্পদ, যা একদিকে পরিবেশ সুরক্ষায় ভূমিকা রাখে, অন্যদিকে জাতীয় ও বৈশ্বিক বাজারে বিপুল চাহিদাসম্পন্ন শিল্পপণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে উৎপাদিত উন্নতমানের রাবার বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে, যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি নতুন খাত হিসেবে গড়ে উঠছে।
রাবার গাছের কশ, যা ‘ল্যাটেক্স’ নামে পরিচিত, সেটি থেকেই মূল রাবার উৎপাদিত হয়। এই শিল্প মূলত বিদেশ থেকে আমদানি করা হলেও বর্তমানে তা দেশের নিজস্ব উৎপাদনে রূপ নিচ্ছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ব্রিটিশরা প্রথম রাবার চাষের প্রচলন ঘটায় বাংলাদেশে। সেই ঐতিহাসিক সূচনা এখন একটি বিস্তৃত কৃষিশিল্প খাতে পরিণত হতে চলেছে। রাবার উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশের জলবায়ু, ভূমি ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত উপযোগী হওয়ায় এটি দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।
বর্তমানে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, শেরপুর, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রাবার বাগান গড়ে উঠেছে। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে প্রায় এক লক্ষ একর জমিতে রাবার চাষ হচ্ছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন, প্রাতিষ্ঠানিক এবং সরকার-ইজারাকৃত জমিতে এই চাষ পরিচালিত হচ্ছে। স্বাধীনতার আগে দেশে রাবার প্রসেসিং কারখানার সংখ্যা ছিল মাত্র ১০-১৫টি; স্বাধীনতার পর এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৪০০-তে, যা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের হাত ধরে তৈরি হয়।
বিশ্বব্যাপী রাবার দিয়ে প্রায় ১,২০,০০০ ধরনের দ্রব্যসামগ্রী তৈরি হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ গাড়ির টায়ার ও টিউব, ফুটওয়্যারের সোল, হোস পাইপ, ফোম, খেলনা, চিকিৎসাসামগ্রী, শিল্প কারখানার যন্ত্রাংশ এবং গৃহস্থালী পণ্য। দেশের অভ্যন্তরে শতকরা ৬০ শতাংশ কাঁচা রাবার ব্যবহৃত হয় এবং বাকি ৪০ শতাংশ ভারত ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোতে রপ্তানি হয়।
রাবার গাছের গড় আয়ু ৩২ থেকে ৩৪ বছর। এই সময়ের মধ্যে গাছটি শুধু ল্যাটেক্স উৎপাদন করেই থেমে থাকে না, বরং মেয়াদ শেষে আসবাবপত্র তৈরির উপযোগী কাঠ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি গাছ থেকে প্রায় ৫-৮ ঘনফুট কাঠ পাওয়া যায়। এক সময় এসব গাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে বিএফআইডিসির উদ্যোগে উন্নতমানের দরজা, জানালা ও আসবাবপত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাংলাদেশে রাবার চাষ শুধু একটি কৃষিকাজ নয়Ñ এটি পরিবেশ রক্ষা, বনসৃজন, কার্বন শোষণ ও সামাজিক উন্নয়নের একটি যুগপৎ উপায়। এই গাছ সাধারণ গাছের তুলনায় তিনগুণ বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা কমানোর বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে রাবারকে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রাবার চাষের মাধ্যমে কার্বন ক্রেডিট বিক্রির সুযোগও তৈরি হতে পারে, যা উন্নত দেশগুলোর পরিবেশ তহবিল থেকে অর্থ আয়ের পথ সুগম করবে।
রাবার চাষে পাহাড়ি অনুর্বর জমি বিশেষভাবে উপযোগী। আমাদের দেশে বিপুল পরিমাণ ন্যাড়া পাহাড় রয়েছে, যেখানে বনবিভাগের আওতায়ও যথাযথ বনায়ন হয়নি। এসব এলাকায় রাবার চাষ শুরু হলে পরিবেশ রক্ষা, ভূমিক্ষয় প্রতিরোধ, খরা, অতিবৃষ্টি ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। দ্রুত বর্ধনশীল এই প্রজাতির মাধ্যমে দ্রুত বনায়নের লক্ষ্যও অর্জন সম্ভব হবে।
সামাজিক-অর্থনৈতিক দিক থেকে রাবার বাগানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে পাহাড়ি, গ্রামীণ ও প্রান্তিক নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। একটি ২৫ একরের রাবার বাগানে অন্তত ১০ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থান সম্ভবÑ এই পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে সহজেই অনুমান করা যায়, লক্ষাধিক একর জমিতে কত বিপুল পরিমাণ মানুষের জীবন-জীবিকা এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে।
তবে এ সম্ভাবনার পেছনে রয়েছে একাধিক চ্যালেঞ্জ। বিশ্ববাজারে দরপতন, অবাধ আমদানি, স্থানীয় বাজারে অস্বাভাবিক হারে ভ্যাট আরোপ, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিসহ একাধিক কারণে প্রান্তিক রাবার চাষিরা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। বর্তমানে মাঠপর্যায়ে বিক্রিত রাবারের মূল্য উৎপাদন খরচের তুলনায় অনেক কম, যা দীর্ঘমেয়াদে এই খাতকে বিপন্ন করে তুলছে। এতে শুধু চাষি নয়, শ্রমিক, রাবার বাগান মালিক এবং রপ্তানিকারকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
এ অবস্থায় বাংলাদেশ রাবার গার্ডেন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন জরুরি ভিত্তিতে কিছু দাবি উত্থাপন করেছে। এসবের মধ্যে রয়েছেÑরাবারের উপর ভ্যাট প্রত্যাহার, বাগান হস্তান্তর ও নবায়ন প্রক্রিয়া সহজীকরণ, ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা চালু, প্রক্রিয়াজাতকরণ প্ল্যান্ট স্থাপন, বাজারমূল্য সমন্বয় ও রপ্তানি সুযোগ বাড়ানো। এসব দাবির যৌক্তিকতা রয়েছে কারণ এ খাতের পুনরুজ্জীবন দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে গবেষণাভিত্তিক উদ্যোগও একান্ত প্রয়োজন। রাবার গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা গেলে উদ্ভাবনী পদ্ধতি ও প্রযুক্তিগত সহায়তার মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানো, রোগবালাই প্রতিরোধ এবং আন্তর্জাতিক মান অর্জন সম্ভব হবে। পাশাপাশি বিদেশ থেকে অভিজ্ঞ রাবার বিশেষজ্ঞ এনে দেশীয় জনবলের প্রশিক্ষণ দেওয়া, মানসম্মত চারা উৎপাদন এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার।
এছাড়া রাবার বাগানের চারপাশে বনজ ও ফলজ বৃক্ষ রোপণ এবং বাগানের ভিতরে মৎস্য, হাঁস-মুরগি, ছাগল, গরু পালনের মতো মিশ্র কৃষিকাজ চালু করে অর্থনৈতিক লাভের পরিধি বাড়ানো যেতে পারে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে এই বহুমুখী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে রাবার শিল্প একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ, পরিবেশবান্ধব এবং শ্রমঘন শিল্প খাতে পরিণত হবে।
বর্তমানে যেভাবে রাবার শিল্প উপেক্ষিত হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সম্পূর্ণরূপে আমদানি নির্ভর হয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশ একটি সম্ভাবনাময় খাত হারাবে, আর হাজার হাজার চাষি, শ্রমিক ও উদ্যোক্তা কর্মহীন হয়ে পড়বে। এই অবস্থা প্রতিরোধে এখনই প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, সরকারি সহায়তা ও প্রণোদনা।
রাবার শিল্প শুধু একটি কৃষিভিত্তিক খাত নয়, এটি পরিবেশ, অর্থনীতি, কর্মসংস্থান এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের এক সমন্বিত ক্ষেত্র। এই খাতকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা, কার্যকর ব্যবস্থাপনা ও সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছা। এখনই পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে এর প্রতিক্রিয়া সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশে রাবার শিল্পের সম্ভাবনা সীমাহীন। এ শিল্পকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে পরিবেশবান্ধব ও আত্মনির্ভরশীল একটি অর্থনৈতিক কাঠামো। তাই এখনই সময় সরকারের উচ্চপর্যায়ে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে রাবার শিল্প রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের। কারণ একটি সম্ভাবনাময় খাত যদি যথাযথ পরিচর্যা না পায়, তবে তা শুধু বিনষ্ট হয় নাÑ দেশও হারায় একটি টেকসই উন্নয়নের সম্ভাবনা।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]
রেজাউল করিম খোকন
শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি ও শিল্পের সংযোগস্থলে এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করে নিতে শুরু করেছে রাবার শিল্প। অনেকেই এখনও এই খাতকে অবহেলার চোখে দেখলেও বাস্তবে এর রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা, যা সঠিক নীতিগত দিকনির্দেশনা, পরিকল্পিত বিনিয়োগ ও সরকারি সহায়তার মাধ্যমে বাস্তবায়ন সম্ভব। একবিংশ শতাব্দীর বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ যেমনÑ জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ সংকট, কর্মসংস্থানের অভাব এবং দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য রাবার শিল্প হতে পারে একটি কার্যকর হাতিয়ার।
রাবার একটি অর্থকরী ও বহুমুখী ব্যবহারযোগ্য সম্পদ, যা একদিকে পরিবেশ সুরক্ষায় ভূমিকা রাখে, অন্যদিকে জাতীয় ও বৈশ্বিক বাজারে বিপুল চাহিদাসম্পন্ন শিল্পপণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে উৎপাদিত উন্নতমানের রাবার বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে, যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি নতুন খাত হিসেবে গড়ে উঠছে।
রাবার গাছের কশ, যা ‘ল্যাটেক্স’ নামে পরিচিত, সেটি থেকেই মূল রাবার উৎপাদিত হয়। এই শিল্প মূলত বিদেশ থেকে আমদানি করা হলেও বর্তমানে তা দেশের নিজস্ব উৎপাদনে রূপ নিচ্ছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ব্রিটিশরা প্রথম রাবার চাষের প্রচলন ঘটায় বাংলাদেশে। সেই ঐতিহাসিক সূচনা এখন একটি বিস্তৃত কৃষিশিল্প খাতে পরিণত হতে চলেছে। রাবার উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশের জলবায়ু, ভূমি ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত উপযোগী হওয়ায় এটি দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।
বর্তমানে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, শেরপুর, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রাবার বাগান গড়ে উঠেছে। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে প্রায় এক লক্ষ একর জমিতে রাবার চাষ হচ্ছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন, প্রাতিষ্ঠানিক এবং সরকার-ইজারাকৃত জমিতে এই চাষ পরিচালিত হচ্ছে। স্বাধীনতার আগে দেশে রাবার প্রসেসিং কারখানার সংখ্যা ছিল মাত্র ১০-১৫টি; স্বাধীনতার পর এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৪০০-তে, যা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের হাত ধরে তৈরি হয়।
বিশ্বব্যাপী রাবার দিয়ে প্রায় ১,২০,০০০ ধরনের দ্রব্যসামগ্রী তৈরি হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ গাড়ির টায়ার ও টিউব, ফুটওয়্যারের সোল, হোস পাইপ, ফোম, খেলনা, চিকিৎসাসামগ্রী, শিল্প কারখানার যন্ত্রাংশ এবং গৃহস্থালী পণ্য। দেশের অভ্যন্তরে শতকরা ৬০ শতাংশ কাঁচা রাবার ব্যবহৃত হয় এবং বাকি ৪০ শতাংশ ভারত ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোতে রপ্তানি হয়।
রাবার গাছের গড় আয়ু ৩২ থেকে ৩৪ বছর। এই সময়ের মধ্যে গাছটি শুধু ল্যাটেক্স উৎপাদন করেই থেমে থাকে না, বরং মেয়াদ শেষে আসবাবপত্র তৈরির উপযোগী কাঠ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি গাছ থেকে প্রায় ৫-৮ ঘনফুট কাঠ পাওয়া যায়। এক সময় এসব গাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে বিএফআইডিসির উদ্যোগে উন্নতমানের দরজা, জানালা ও আসবাবপত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাংলাদেশে রাবার চাষ শুধু একটি কৃষিকাজ নয়Ñ এটি পরিবেশ রক্ষা, বনসৃজন, কার্বন শোষণ ও সামাজিক উন্নয়নের একটি যুগপৎ উপায়। এই গাছ সাধারণ গাছের তুলনায় তিনগুণ বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা কমানোর বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে রাবারকে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রাবার চাষের মাধ্যমে কার্বন ক্রেডিট বিক্রির সুযোগও তৈরি হতে পারে, যা উন্নত দেশগুলোর পরিবেশ তহবিল থেকে অর্থ আয়ের পথ সুগম করবে।
রাবার চাষে পাহাড়ি অনুর্বর জমি বিশেষভাবে উপযোগী। আমাদের দেশে বিপুল পরিমাণ ন্যাড়া পাহাড় রয়েছে, যেখানে বনবিভাগের আওতায়ও যথাযথ বনায়ন হয়নি। এসব এলাকায় রাবার চাষ শুরু হলে পরিবেশ রক্ষা, ভূমিক্ষয় প্রতিরোধ, খরা, অতিবৃষ্টি ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। দ্রুত বর্ধনশীল এই প্রজাতির মাধ্যমে দ্রুত বনায়নের লক্ষ্যও অর্জন সম্ভব হবে।
সামাজিক-অর্থনৈতিক দিক থেকে রাবার বাগানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে পাহাড়ি, গ্রামীণ ও প্রান্তিক নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। একটি ২৫ একরের রাবার বাগানে অন্তত ১০ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থান সম্ভবÑ এই পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে সহজেই অনুমান করা যায়, লক্ষাধিক একর জমিতে কত বিপুল পরিমাণ মানুষের জীবন-জীবিকা এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে।
তবে এ সম্ভাবনার পেছনে রয়েছে একাধিক চ্যালেঞ্জ। বিশ্ববাজারে দরপতন, অবাধ আমদানি, স্থানীয় বাজারে অস্বাভাবিক হারে ভ্যাট আরোপ, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিসহ একাধিক কারণে প্রান্তিক রাবার চাষিরা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। বর্তমানে মাঠপর্যায়ে বিক্রিত রাবারের মূল্য উৎপাদন খরচের তুলনায় অনেক কম, যা দীর্ঘমেয়াদে এই খাতকে বিপন্ন করে তুলছে। এতে শুধু চাষি নয়, শ্রমিক, রাবার বাগান মালিক এবং রপ্তানিকারকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
এ অবস্থায় বাংলাদেশ রাবার গার্ডেন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন জরুরি ভিত্তিতে কিছু দাবি উত্থাপন করেছে। এসবের মধ্যে রয়েছেÑরাবারের উপর ভ্যাট প্রত্যাহার, বাগান হস্তান্তর ও নবায়ন প্রক্রিয়া সহজীকরণ, ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা চালু, প্রক্রিয়াজাতকরণ প্ল্যান্ট স্থাপন, বাজারমূল্য সমন্বয় ও রপ্তানি সুযোগ বাড়ানো। এসব দাবির যৌক্তিকতা রয়েছে কারণ এ খাতের পুনরুজ্জীবন দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে গবেষণাভিত্তিক উদ্যোগও একান্ত প্রয়োজন। রাবার গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা গেলে উদ্ভাবনী পদ্ধতি ও প্রযুক্তিগত সহায়তার মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানো, রোগবালাই প্রতিরোধ এবং আন্তর্জাতিক মান অর্জন সম্ভব হবে। পাশাপাশি বিদেশ থেকে অভিজ্ঞ রাবার বিশেষজ্ঞ এনে দেশীয় জনবলের প্রশিক্ষণ দেওয়া, মানসম্মত চারা উৎপাদন এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার।
এছাড়া রাবার বাগানের চারপাশে বনজ ও ফলজ বৃক্ষ রোপণ এবং বাগানের ভিতরে মৎস্য, হাঁস-মুরগি, ছাগল, গরু পালনের মতো মিশ্র কৃষিকাজ চালু করে অর্থনৈতিক লাভের পরিধি বাড়ানো যেতে পারে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে এই বহুমুখী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে রাবার শিল্প একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ, পরিবেশবান্ধব এবং শ্রমঘন শিল্প খাতে পরিণত হবে।
বর্তমানে যেভাবে রাবার শিল্প উপেক্ষিত হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সম্পূর্ণরূপে আমদানি নির্ভর হয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশ একটি সম্ভাবনাময় খাত হারাবে, আর হাজার হাজার চাষি, শ্রমিক ও উদ্যোক্তা কর্মহীন হয়ে পড়বে। এই অবস্থা প্রতিরোধে এখনই প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, সরকারি সহায়তা ও প্রণোদনা।
রাবার শিল্প শুধু একটি কৃষিভিত্তিক খাত নয়, এটি পরিবেশ, অর্থনীতি, কর্মসংস্থান এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের এক সমন্বিত ক্ষেত্র। এই খাতকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা, কার্যকর ব্যবস্থাপনা ও সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছা। এখনই পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে এর প্রতিক্রিয়া সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশে রাবার শিল্পের সম্ভাবনা সীমাহীন। এ শিল্পকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে পরিবেশবান্ধব ও আত্মনির্ভরশীল একটি অর্থনৈতিক কাঠামো। তাই এখনই সময় সরকারের উচ্চপর্যায়ে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে রাবার শিল্প রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের। কারণ একটি সম্ভাবনাময় খাত যদি যথাযথ পরিচর্যা না পায়, তবে তা শুধু বিনষ্ট হয় নাÑ দেশও হারায় একটি টেকসই উন্নয়নের সম্ভাবনা।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]