alt

উপ-সম্পাদকীয়

সংস্কৃতি ও অপরাধ

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

: বৃহস্পতিবার, ১৭ জুন ২০২১
image

লোকসংস্কৃতির কদর কমছে

সরকার ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করছে। বাজেটে শিল্প সংস্কৃতি খাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২০২১-২২ অর্থবছরে, তা কি যথেষ্ট, না অপ্রতুল? দেশে অপরাধ দিন দিন বেড়েই চলেছে। নতুন নতুন নেশার দ্রব্যে তরুণরা হয়ে পড়ছে আসক্ত। বিশেষ করে উঠতি বয়সের কিশোর, কিশোরী তরুণ-তরুণীরা জড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের অপরাধে। উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরা যে ধরনের অপরাধ সংগঠিত করছে তা লোমহর্ষক। টিক টিক ভিডিও তৈরির অন্তরালে তরুণরা জড়িয়ে পড়ছে নারী পাচারে। এখন শিশু কিশোরদের বিনোদনের মাধ্যম হলো ইন্টারনেট। ইন্টারনেট আধুনিক প্রযুক্তির একটি অন্যতম মাধ্যম। সারা বিশ্ব এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে একটি গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে, তাই ইন্টারনেট ব্যবহার থেকে বিরত থাকাটা হবে পিছিয়ে পড়ার শামিল, পৃথিবীর প্রতিটি দেশই নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে এই ইন্টারনেট জগতে ঢুকছে।

ইন্টারনেট জগতে তরুণরা প্রবেশ করছে ধার করা সংস্কৃতির মাধ্যমে। আর ধারা করা সংস্কৃতি দিয়ে বাংলা ভাষায় ওয়েব পেজে খোলা হয় নিজস্ব টিভি চ্যানেল। আর এসব কারণে মূল সংস্কৃতির ধারা থেকে বিচ্যুত নতুন প্রজন্ম জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। দেশের অপরাধ নিরোধকল্পে সুশীল সমাজ, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীরা প্রতিদিন নানা ধরনের বয়ান দিয়ে থাকেন। কি কারণে বা কিসের অভাবে দেশের উঠতি বয়সী প্রজন্ম অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে সেই কারণটি কি উদঘাটিত হয়েছে? এক সময় এদেশের মানুষের বিনোদনের অন্যতম উপাদান ছিল যাত্রা পালা, নাটক, বাউলগান, কবিগান, লোকসংগীত, পালাগানসহ বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক গান ও শিল্প চর্চা। বর্তমানে এই সব চর্চা নেমে এসেছে শূন্যের কোটায়। দেশে যখন বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা ছিল তখন অপরাধের হার কত ছিল। সেই পরিসংখ্যনটার সঙ্গে বর্তমানের পরিসংখ্যনটা একটু মিলানো দরকার।

পাকিস্তান ও ব্রিটিশ শাসনামলে দেশের সংস্কৃতির ধারাটিতে নিজস্ব আবহ বিদ্যমান ছিল অর্থা’ এখানে এই জনপদের সংস্কৃতিই অনুশীলন হতো, বর্তমানে বাঙালি সংস্কৃতির জায়গায় স্থান করে নিয়েছে ধর্মীয় সংস্কৃতি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে যে গ্রামটিতে একটি মসজিদ ছিল সেই গ্রামে গড়ে উঠেছে পাঁচ থেকে সাতটি মসজিদ। যে গ্রামে একটি দুর্গাপূজার মন্ডপ ছিল সেখানে মন্ডপ হয় দু-থেকে তিনটি। অনেকেই বলবেন মানুষ বেড়েছে তাই ধর্মীয় উপাসনালয় বেড়েছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্য ছিল প্রায় সাড়ে সাত কোটি বর্তমানে তা প্রায় ১৬ থেকে ১৭ কোটি। জনসংখ্যা যে অনুপাতে বৃদ্ধি পেয়েছে তার চেয়ে প্রায় চার থেকে পাঁচগুণ অধিক হারে বেড়েছে ধর্মীয় উপাসনালয় এবং ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৯৭২ সালে যে পরিমাণ দেশীয় সংস্কৃতি চর্চা হতো তা হ্রাস পেয়েছে কয়েক গুণ। ওই সময় বাংলাদেশের গ্রাম এবং নিভৃত পল্লী এলাকায় তরুণরা নিজস্ব উদ্যোগে যাত্রা এবং নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করত এখন তা আর কোন গ্রামেই হয় না। অপর দিকে বেড়েছে কয়েকগুণ ইসলামী জলসা, ধর্মসভা আয়োজন দেশের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শহরে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ রকম ধর্মচর্চা এবং ধর্মীয় সংস্কৃতি অনুশীলনের পরও কেন বাড়ছে অপরাধের সংখ্যা সেই সঙ্গে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে অপরাধের ধরন। ১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের পর বাঙলা জনপদে ধর্মীয় চর্চা এবং ধর্মীয় সংস্কৃতির অনুশীলনটা নিপুণভাবে অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে।

ধর্ম চর্চা কেন পারছে না নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে? হেফাজত নেতা সুনামগঞ্জের একটি উপজেলায় বক্তৃতা দেয়ার পর হিন্দু গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়। ধর্ম রক্ষার নামে রামুতে ঘটেছিল বিভৎস লীলা। দেশের বিগত চার দশকে ধর্মকে কেন্দ্র করে হানাহানির মাধ্যমে প্রায় কয়েক হাজার প্রাণ হারিয়েছে। দেশের মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ অবক্ষয় রোধের জন্য নাকি এই ধম একমাত্র উপায় ? সম্প্রতি সরকার দেশের ৫৬০টি উপজেলায় একটি করে মডেল মসজিদ এবং ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন করছেন। এই ইসলামিক সংস্কৃতিক কেন্দ্র গুলোতে কি মুল সংস্কৃতির চর্চা হবে নাকি ধর্মের নামে মৌলবাদী একটি গোষ্ঠী তৈরি হবে এই বিষয়টি ভাবা দরকার। ১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের পর দেশের প্রথম সেনাশাসক মে. জে. জিয়া বিসমিল্লাহকে সংবিধানে যুক্ত করেন। এর মাধ্যমে তিনি মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিটা নিজের পক্ষে নেন, অপরদিকে মে. জে. জিয়া একজিভিশন এবং উন্মুক্ত হাউজির প্রচলন ঘটান।

জিয়ার উত্তরসূরি লে. জে এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন, তিনিও পূর্বসূরির পদাঙ্ক অনুসরন করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বানান। লে. জে এরশাদ এদেশের সংস্কৃতির ১২টা বাজিয়েছেন, তিনি ভারতীয় সংস্কৃতিসহ বিদেশি সংস্কৃতির আমদানি করেন এদেশে। দুই সেনাশাসক যেভাবে ধর্মকে ব্যবহার করেছেন ঠিক তেমনি ভাবে ৯০ এর পরবর্তী সরকারগুলো তা অক্ষুণ্ন রেখেছে। ফলে দেশে একটি শ্রেণী পরিণত হয়েছে উগ্র ধর্মান্ধতায় আরেকটি শ্রেণী হয়েছে গেছে আলট্রা মর্ডানের নামে বিদেশি সংস্কৃতির ধারায়। এই দুই উগ্রবাদীদের কবলে পড়ে মূল বাঙালি সংস্কৃতির ধারাটি হারিয়ে যাচ্ছে। তাই দেখা যায়, দেশের স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোসহ সামাজিক সংগঠনগুলো এখন আর বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা করে না। তারাও বিদেশি সংস্কৃতির ধারা রোধকল্পে এখন স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় ধর্মীয় সংস্কৃতির চর্চা। ফলে সমাজে বাড়ছে বিদ্ধেষ।

বাঙলা জনপদের সংস্কৃতির ধারায় হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনকারী মানুষের বসবাস। সামাজিক সংহতিতে এ রকম চর্চার ফলে দেখা দিচ্ছে ফাটল। সামাজিক অবক্ষয় রোধে ধর্মীয় সংস্কৃতি চর্চা যে ভালো ফল বয়ে আনতে পারেনি তা স্পষ্ট হয়ে গেছে, ৪০ বছর আগের অপরাধ চিত্রের সঙ্গে বর্তমান অপরাধ চিত্র বিশ্লেষণ করলেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। মূল বাঙালি সংস্কৃতির চর্চার অভাবের আজকে তরুণ সমাজ বিপথগামী হয়েছে। তাই এই বিপথগামিতা রোধ করতে হলে বাঙলা জনপদের মূল সংস্কৃতির চর্চার বিকল্প নাই। বাংলা জনপদের শিল্প সাহিত্য চর্চার জন্য প্রতিটি উপজেলায় পর্যায়ে একটি করে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলা দরকার। উপজেলা স্তরের সংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোতে মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, বাঙলার প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা ও অনুশীলন। একটি করে গন মিলানায়তন গড়ে তোলা যেখানে যাত্রা, নাটক এবং স্ব-উপজেলাভিত্তিক আঞ্চলিক সংস্কৃতির চর্চা ব্যবস্থা থাকবে। এভাবে উঠতি বয়সের নতুন প্রজন্মকে মূল সংস্কৃতি চর্চার ধারায় নিয়ে আসতে পারলে দেশের অপরাধ কমে যাবে।

[লেখক : ব্যবসায়ী]

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

tab

উপ-সম্পাদকীয়

সংস্কৃতি ও অপরাধ

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

image

লোকসংস্কৃতির কদর কমছে

বৃহস্পতিবার, ১৭ জুন ২০২১

সরকার ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করছে। বাজেটে শিল্প সংস্কৃতি খাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২০২১-২২ অর্থবছরে, তা কি যথেষ্ট, না অপ্রতুল? দেশে অপরাধ দিন দিন বেড়েই চলেছে। নতুন নতুন নেশার দ্রব্যে তরুণরা হয়ে পড়ছে আসক্ত। বিশেষ করে উঠতি বয়সের কিশোর, কিশোরী তরুণ-তরুণীরা জড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের অপরাধে। উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরা যে ধরনের অপরাধ সংগঠিত করছে তা লোমহর্ষক। টিক টিক ভিডিও তৈরির অন্তরালে তরুণরা জড়িয়ে পড়ছে নারী পাচারে। এখন শিশু কিশোরদের বিনোদনের মাধ্যম হলো ইন্টারনেট। ইন্টারনেট আধুনিক প্রযুক্তির একটি অন্যতম মাধ্যম। সারা বিশ্ব এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে একটি গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে, তাই ইন্টারনেট ব্যবহার থেকে বিরত থাকাটা হবে পিছিয়ে পড়ার শামিল, পৃথিবীর প্রতিটি দেশই নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে এই ইন্টারনেট জগতে ঢুকছে।

ইন্টারনেট জগতে তরুণরা প্রবেশ করছে ধার করা সংস্কৃতির মাধ্যমে। আর ধারা করা সংস্কৃতি দিয়ে বাংলা ভাষায় ওয়েব পেজে খোলা হয় নিজস্ব টিভি চ্যানেল। আর এসব কারণে মূল সংস্কৃতির ধারা থেকে বিচ্যুত নতুন প্রজন্ম জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। দেশের অপরাধ নিরোধকল্পে সুশীল সমাজ, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীরা প্রতিদিন নানা ধরনের বয়ান দিয়ে থাকেন। কি কারণে বা কিসের অভাবে দেশের উঠতি বয়সী প্রজন্ম অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে সেই কারণটি কি উদঘাটিত হয়েছে? এক সময় এদেশের মানুষের বিনোদনের অন্যতম উপাদান ছিল যাত্রা পালা, নাটক, বাউলগান, কবিগান, লোকসংগীত, পালাগানসহ বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক গান ও শিল্প চর্চা। বর্তমানে এই সব চর্চা নেমে এসেছে শূন্যের কোটায়। দেশে যখন বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা ছিল তখন অপরাধের হার কত ছিল। সেই পরিসংখ্যনটার সঙ্গে বর্তমানের পরিসংখ্যনটা একটু মিলানো দরকার।

পাকিস্তান ও ব্রিটিশ শাসনামলে দেশের সংস্কৃতির ধারাটিতে নিজস্ব আবহ বিদ্যমান ছিল অর্থা’ এখানে এই জনপদের সংস্কৃতিই অনুশীলন হতো, বর্তমানে বাঙালি সংস্কৃতির জায়গায় স্থান করে নিয়েছে ধর্মীয় সংস্কৃতি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে যে গ্রামটিতে একটি মসজিদ ছিল সেই গ্রামে গড়ে উঠেছে পাঁচ থেকে সাতটি মসজিদ। যে গ্রামে একটি দুর্গাপূজার মন্ডপ ছিল সেখানে মন্ডপ হয় দু-থেকে তিনটি। অনেকেই বলবেন মানুষ বেড়েছে তাই ধর্মীয় উপাসনালয় বেড়েছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্য ছিল প্রায় সাড়ে সাত কোটি বর্তমানে তা প্রায় ১৬ থেকে ১৭ কোটি। জনসংখ্যা যে অনুপাতে বৃদ্ধি পেয়েছে তার চেয়ে প্রায় চার থেকে পাঁচগুণ অধিক হারে বেড়েছে ধর্মীয় উপাসনালয় এবং ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৯৭২ সালে যে পরিমাণ দেশীয় সংস্কৃতি চর্চা হতো তা হ্রাস পেয়েছে কয়েক গুণ। ওই সময় বাংলাদেশের গ্রাম এবং নিভৃত পল্লী এলাকায় তরুণরা নিজস্ব উদ্যোগে যাত্রা এবং নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করত এখন তা আর কোন গ্রামেই হয় না। অপর দিকে বেড়েছে কয়েকগুণ ইসলামী জলসা, ধর্মসভা আয়োজন দেশের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শহরে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ রকম ধর্মচর্চা এবং ধর্মীয় সংস্কৃতি অনুশীলনের পরও কেন বাড়ছে অপরাধের সংখ্যা সেই সঙ্গে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে অপরাধের ধরন। ১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের পর বাঙলা জনপদে ধর্মীয় চর্চা এবং ধর্মীয় সংস্কৃতির অনুশীলনটা নিপুণভাবে অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে।

ধর্ম চর্চা কেন পারছে না নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে? হেফাজত নেতা সুনামগঞ্জের একটি উপজেলায় বক্তৃতা দেয়ার পর হিন্দু গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়। ধর্ম রক্ষার নামে রামুতে ঘটেছিল বিভৎস লীলা। দেশের বিগত চার দশকে ধর্মকে কেন্দ্র করে হানাহানির মাধ্যমে প্রায় কয়েক হাজার প্রাণ হারিয়েছে। দেশের মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ অবক্ষয় রোধের জন্য নাকি এই ধম একমাত্র উপায় ? সম্প্রতি সরকার দেশের ৫৬০টি উপজেলায় একটি করে মডেল মসজিদ এবং ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন করছেন। এই ইসলামিক সংস্কৃতিক কেন্দ্র গুলোতে কি মুল সংস্কৃতির চর্চা হবে নাকি ধর্মের নামে মৌলবাদী একটি গোষ্ঠী তৈরি হবে এই বিষয়টি ভাবা দরকার। ১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের পর দেশের প্রথম সেনাশাসক মে. জে. জিয়া বিসমিল্লাহকে সংবিধানে যুক্ত করেন। এর মাধ্যমে তিনি মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিটা নিজের পক্ষে নেন, অপরদিকে মে. জে. জিয়া একজিভিশন এবং উন্মুক্ত হাউজির প্রচলন ঘটান।

জিয়ার উত্তরসূরি লে. জে এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন, তিনিও পূর্বসূরির পদাঙ্ক অনুসরন করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বানান। লে. জে এরশাদ এদেশের সংস্কৃতির ১২টা বাজিয়েছেন, তিনি ভারতীয় সংস্কৃতিসহ বিদেশি সংস্কৃতির আমদানি করেন এদেশে। দুই সেনাশাসক যেভাবে ধর্মকে ব্যবহার করেছেন ঠিক তেমনি ভাবে ৯০ এর পরবর্তী সরকারগুলো তা অক্ষুণ্ন রেখেছে। ফলে দেশে একটি শ্রেণী পরিণত হয়েছে উগ্র ধর্মান্ধতায় আরেকটি শ্রেণী হয়েছে গেছে আলট্রা মর্ডানের নামে বিদেশি সংস্কৃতির ধারায়। এই দুই উগ্রবাদীদের কবলে পড়ে মূল বাঙালি সংস্কৃতির ধারাটি হারিয়ে যাচ্ছে। তাই দেখা যায়, দেশের স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোসহ সামাজিক সংগঠনগুলো এখন আর বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা করে না। তারাও বিদেশি সংস্কৃতির ধারা রোধকল্পে এখন স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় ধর্মীয় সংস্কৃতির চর্চা। ফলে সমাজে বাড়ছে বিদ্ধেষ।

বাঙলা জনপদের সংস্কৃতির ধারায় হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনকারী মানুষের বসবাস। সামাজিক সংহতিতে এ রকম চর্চার ফলে দেখা দিচ্ছে ফাটল। সামাজিক অবক্ষয় রোধে ধর্মীয় সংস্কৃতি চর্চা যে ভালো ফল বয়ে আনতে পারেনি তা স্পষ্ট হয়ে গেছে, ৪০ বছর আগের অপরাধ চিত্রের সঙ্গে বর্তমান অপরাধ চিত্র বিশ্লেষণ করলেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। মূল বাঙালি সংস্কৃতির চর্চার অভাবের আজকে তরুণ সমাজ বিপথগামী হয়েছে। তাই এই বিপথগামিতা রোধ করতে হলে বাঙলা জনপদের মূল সংস্কৃতির চর্চার বিকল্প নাই। বাংলা জনপদের শিল্প সাহিত্য চর্চার জন্য প্রতিটি উপজেলায় পর্যায়ে একটি করে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলা দরকার। উপজেলা স্তরের সংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোতে মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, বাঙলার প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা ও অনুশীলন। একটি করে গন মিলানায়তন গড়ে তোলা যেখানে যাত্রা, নাটক এবং স্ব-উপজেলাভিত্তিক আঞ্চলিক সংস্কৃতির চর্চা ব্যবস্থা থাকবে। এভাবে উঠতি বয়সের নতুন প্রজন্মকে মূল সংস্কৃতি চর্চার ধারায় নিয়ে আসতে পারলে দেশের অপরাধ কমে যাবে।

[লেখক : ব্যবসায়ী]

back to top