alt

উপ-সম্পাদকীয়

টানেলের ওপারে যাওয়ার রোডম্যাপ চাই

শেখর ভট্টাচার্য

: সোমবার, ১৯ জুলাই ২০২১

এপ্রিল মাসে ভারত যখন করোনাভাইরাসের বিধ্বংসী দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে লড়াই করছে, এ সময়য়েই হিমালয় অঞ্চলের শহর হরিদ্বারে কুম্ভমেলায় লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ হিন্দু সমবেত হয়েছিল। তখন অনেকেই আশঙ্কা করেছিল, এই কুম্ভমেলা এক ‘সুপার-স্প্রেডার ইভেন্ট’, অর্থাৎ করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়ানোর এক বড় অনুষ্ঠানে পরিণত হবে। পরবর্তীতে দেখা গেছে, সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে। কুম্ভমেলা থেকে ফিরে আসা লোকজনকে পরীক্ষা করে কোভিড সংক্রমণ ধরা পড়ছে এবং তারা যে সম্ভবত আরও লোকজনের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে দিয়েছেÑসে বিষয়টিও পরে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এপ্রিল মাসের পুরোটা জুড়েই হরিদ্বারে চলছে কুম্ভমেলার আয়োজন- তার মধ্যে ১২, ১৪ ও ২৭ তারিখ ‘শাহী স্নান’ বা সবচেয়ে পুণ্য দিন। হিন্দুদের সবচেয়ে বড় এই ধর্মীয় জমায়েতে হরিদ্বারে গঙ্গার তীরে প্রতিদিন অন্তত সাত থেকে আট লক্ষ পুণ্যার্থী জড়ো হয়ে স্নান করেছেন- মাস্ক পরা, থার্মাল স্ক্রিনিং কিংবা কোভিড টেস্ট কোন কিছুরই বালাই ছিল না আগত পুণ্যার্থীদের।

এপ্রিল মাসে হরিদ্বারে কুম্ভমেলায় যোগ দেন প্রায় ৯০ লাখের বেশি তীর্থযাত্রী। ভারতের প্রখ্যাত রোগতত্ত্ববিদ ডা. ললিত কান্ত বলছেন, ‘মাস্ক না পরে তীর্থযাত্রীদের বড় বড় দল যখন নদীর তীরে দাঁড়িয়ে গঙ্গার বন্দনা করছে’, তখনই দ্রুত ভাইরাস সংক্রমণের এক আদর্শ পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে। ‘আমরা জানি যে গির্জায় কিংবা মন্দিরে যখন সমবেত মানুষ এক সঙ্গে কোরাসে গান গায়, সেটি তখন একটি ‘সুপার-স্প্রেডার ইভেন্টে’ পরিণত হয়। ‘প্রশ্ন হলো, কুম্ভমেলায় কী শুধু অতিসাধারণ ধর্মপ্রাণ হিন্দুরাই জড় হয়েছিলেন? শিক্ষা, কিংবা সচেতনতার অভাবে যাদের মধ্যে কা-জ্ঞান লোপ পেয়েছিল তারাই কি পুণ্য লাভের আশায় কুম্ভমেলায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। মোটেই না, কুম্ভমেলায় লাখ লাখ আবেগপ্রবণ, তথাকথিত শিক্ষিত ভারতীয় হিন্দু তীর্থ যাত্রীরাও রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় কারণে জড় হয়েছিলেন।

ধর্ম পালন, ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী তার চর্চা করার বিষয়ে কারও আপত্তি থাকার কারণ নেই। যে কোন উদার, আধুনিক মানুষ প্রত্যেক মানুষের বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনের ব্যাপারে অত্যন্ত সহানুভূতিশীল হয়ে থাকেন। মানুষ তার বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করবেন এটি হলো, গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকার। স্বাভাবিক সময়ে রাষ্ট্রযন্ত্রও এই আচার অনুষ্ঠান পালনে মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান। কিন্তু অস্বাভাবিক, অতিমারী বা মহামারীকালে যখন রোগ সংক্রমণ হয় মানুষের নিঃশ্বাস, প্রশ্বাস, স্পর্শ থেকে তখন নিশ্চয় অন্যের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে পরম প্রভুকে মানুষ অন্তর দিয়ে নিভৃতে ডাকার কথা বিবেচনা করবেন। ভারতীয় রাষ্ট্রযন্ত্র এবং ক্ষমতাসীনরা সংক্রামক এই ভয়াবহ অদৃশ্য ভাইরাসের সঙ্গে বাজি ধরেছিলেন। এই বাজি মূলত ধর্মপ্রাণ মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তী ইলেকশনে নিজেদের পক্ষে ভোট টানার জন্য। তারা কুম্ভমেলা আয়োজনের অনুমতি তো দিলেনই এর সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধির পালন করার জন্য কোন প্রটোকলকে বাধ্যতামূলক করতে পারলেন না। এর ফলাফল কিন্তু তারা হাতে নাতেই পেয়ে গেলেন। বাজিতে তারা হেরে গেলেন। এই বাজি ছিল, সচেতন ধর্মবসায়ীদের কা-জ্ঞানহীন বাজি। যে বাজিতে ভারত হারালো, লাখ লাখ মানুষকে।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালীন সময়ে ভারত যখন দিশাহারা, তখন ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও প্রায় ধসে পড়েছিল। হাসপাতালে শয্যা নেই। বেশিরভাগ হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাব। প্রতিদিন তিন, চার লাখ মানুষ সংক্রমিত হচ্ছেন। প্রাণহানির রেকর্ড প্রতিদিন ভাঙছে। শ্মশান, গোরস্তানে লাশের স্তূপ। সৎকারের জন্য মানুষের হাহাহাকার। এ রকম অবস্থা থেকে ভারত এখন কিছটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিনের সংক্রমণ এখন নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। মৃত্যু হারও অনেক কমেছে। কিন্তু আবেগ প্রবণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পূর্ব প্রস্তুতির যে মূল্য ভারতকে দিতে হয়েছে, সে মূল্যের কথা চিরদিন ভারতের সচেতন নাগরিকরা মনে রাখবেন।

ভারতের এপ্রিল, মে মাসের এই চরম বিপর্যয় থেকে আমাদের কি কিছু শিক্ষা নিয়েছি? আমার মনে হয় প্রতিবেশী এই দেশটি থেকে আমরা তেমন কিছু শিখতে পারিনি। শিখতে যে পারিনি, সাম্প্রতিক আমাদের কিছু সিদ্ধান্ত তার জাজ্বল্যমাণ প্রমাণ। আমাদের কোভিড সংক্রান্ত একটি জাতীয় কারিগরি কমিটি আছে। দেশের যোগ্যতম রোগতত্ব বিশেষজ্ঞ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এ কমিটির সদস্য। এই অদৃশ্য ভাইরাসের গতি প্রকৃতি সম্পর্কে তারাই সবচেয়ে ভালো জানেন বলে আমাদের মেনে নিতে হবে। তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান, বিশ্বের কোভিড পরিস্থিতি, দেশের ভাইরাসের গতি প্রকৃতি বিবেচনা করে তারা সরকারকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

দেশে করোনার সংক্রমণ গত ডিসেম্বরে কমে এলেও এ বছরের মার্চে ঊর্ধ্বমুখী হয়। গত প্রায় এক মাস ধরে পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক অবস্থায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে, সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় সবচেয়ে বেশি রোগী যেসব দেশে শনাক্ত হচ্ছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অষ্টম। মৃত্যুর তালিকাতেও তাই। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার গত ১ জুলাই থেকে সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণা করে। ঈদুল আজহার কথা বিবেচনা করে ১৫ জুলাই ভোর থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত আট দিন বিধিনিষেধ শিথিল করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এই শিথিল বিধিনিষেধ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মনে করে বিধিনিষেধ শিথিল করায় সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।’ তিনি আরও জানান, ‘জুনে এক লাখ ১২ হাজার ৭১৮ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিল। জুলাইয়ের ১৪ দিনে আমরা সমপরিমাণ রোগী শনাক্ত করতে পেরেছি। যদিও এই মাসের আরও ১৬ দিন বাকি আছে।’ বিধিনিষেধ শিথিল নিয়ে আপত্তি রয়েছে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটিরও। কমিটির একাধিক সদস্য শিথিলতার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তারা শঙ্কিত। তারা মনে করছেন এই শিথিলতার সুযোগে সংক্রমণ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা আঁচ করা মুশকিল।

সীমিত পরিসরে এ পর্যায়ের লকডাউন শুরু হয়েছিল ২৮ জুন। কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে কঠোর লকডাউন শুরু হয় ১ জুলাই থেকে এবং তা চলে শুরু হয়ে ১৪ জুলাই পর্যন্ত। এ সময়ে আমরা দেখেছি সর্বস্তরের মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা সত্ত্বেও নানা অজুহাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে ধীরে ধীরে কঠোর লকডাউনকে কোমল লকডাউন পরিণত করে ফেলেছে। জুন মাস ছিল, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও সর্বোচ্চ মৃত্যুর মাস। জুলাই মাস জুন মাসকে ছাড়িয়ে আরও বিভীষিকা ডেকে নিয়ে এসেছে। মৃত্যু ও সংক্রমণের হারের রেকর্ড প্রতিদিনই ভাঙছে। স্বাস্থ্যবিধি ও প্রতিরোধে ব্যবস্থা না নেয়া হলে আরও দুই সপ্তাহ এমন মৃত্যু চলতে পারে। এমনকি এ প্রবণতা টানা তিন সপ্তাহও গড়াতে পারে, কোভিড-সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি কমিটির সদস্যারা এরকমই পূর্বাভাস দিয়েছেন। কঠোর লকডাউনকে আমরা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারিনি তাই দৃশ্যমান কোন সুফলও আমরা পাইনি। এ রকম অবস্থায়, ১৫ জুলাই ভোর থেকে যে শিথিল লকডাউন শুরু হয়েছে সে শিথিলতা আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে পূর্বের অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে সচেতন নাগরিকরা শঙ্কিত না হয়ে পারছেন না।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বারবার বলছেন, আমরা লকডাউনের শিথিলতা চাই না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্ভাব্য নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত পরিস্থিতির দায় যাতে এড়াতে হয় এ জন্য নানা কথা বলে রাখছেন। স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘লকডাউন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একা দেয় না। আরও ১০টা মন্ত্রণালয় আছে। সবারটা মিলিয়ে একটা সিদ্ধান্ত সরকার জানিয়ে দেয়। আর সরকারকে তো আমরাই শুধু পরামর্শ দিচ্ছি না, অন্য মন্ত্রণালয়ও দিচ্ছে।’ এ রকম কথা সমন্বয়ের কথা নয়। এ রকম কথাতে নিবেদনের পরিমাণ খুব বেশি নেই। লকডাউনের শিথিলতার এই সময় আমরা দেখছি, স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে মানুষ নানা যানবাহনে হন্যে হয়ে ছুটছে, গ্রামের দিকে। শপিংমল থেকে শুরু করে কোথাও আমরা দেখছি না স্বাস্থ্যবিধি মেনে কর্মকা- চলতে। এ রকম অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে আমরা কোথায় গিয়ে পৌঁছাবো, মৃত্যু সংখ্যা কিংবা সংক্রমণের দিক থেকে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের মতো অবস্থার যদি সম্মুখীন হতে হয়, তাহলে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারব তো? দোষারোপের, দায় এড়ানোর পথ ছেড়ে সম্ভাব্য দুর্যোগের কথা ভেবে পরিকল্পনা করে রাখতে হবে। আমি এখন পর্যন্ত শুনিনি, দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য কোন রোডম্যাপের কথা। অনেক খুঁজেছি। আমরা নতুন নতুন অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছি তারপর ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমাদের প্রয়োজন সুস্পষ্ট পথনকশা বা রোডম্যাপ। যে রোডম্যাপ বলে দেবে, বিভিন্ন বাস্তবতায় আমরা এগোবে কেমন করে। টানেলের এপারে অন্ধকার ওপারে আলোর ঝরনাধারা। এ রোডম্যাপের টানেলের ওপারে যাওয়ার পথ দেখাবে। সবার চূড়ান্ত সহযোগিতায় ও সমন্বয়ে রোডম্যাপ ধরে আমরা, এগোবো। আমরা যেন, ভারতের মতো প্রস্তুতির অভাবে বিব্রত হয়ে না পড়ি। আমাদের হাতে কিন্তু সময় খুব বেশি নেই।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

tab

উপ-সম্পাদকীয়

টানেলের ওপারে যাওয়ার রোডম্যাপ চাই

শেখর ভট্টাচার্য

সোমবার, ১৯ জুলাই ২০২১

এপ্রিল মাসে ভারত যখন করোনাভাইরাসের বিধ্বংসী দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে লড়াই করছে, এ সময়য়েই হিমালয় অঞ্চলের শহর হরিদ্বারে কুম্ভমেলায় লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ হিন্দু সমবেত হয়েছিল। তখন অনেকেই আশঙ্কা করেছিল, এই কুম্ভমেলা এক ‘সুপার-স্প্রেডার ইভেন্ট’, অর্থাৎ করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়ানোর এক বড় অনুষ্ঠানে পরিণত হবে। পরবর্তীতে দেখা গেছে, সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে। কুম্ভমেলা থেকে ফিরে আসা লোকজনকে পরীক্ষা করে কোভিড সংক্রমণ ধরা পড়ছে এবং তারা যে সম্ভবত আরও লোকজনের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে দিয়েছেÑসে বিষয়টিও পরে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এপ্রিল মাসের পুরোটা জুড়েই হরিদ্বারে চলছে কুম্ভমেলার আয়োজন- তার মধ্যে ১২, ১৪ ও ২৭ তারিখ ‘শাহী স্নান’ বা সবচেয়ে পুণ্য দিন। হিন্দুদের সবচেয়ে বড় এই ধর্মীয় জমায়েতে হরিদ্বারে গঙ্গার তীরে প্রতিদিন অন্তত সাত থেকে আট লক্ষ পুণ্যার্থী জড়ো হয়ে স্নান করেছেন- মাস্ক পরা, থার্মাল স্ক্রিনিং কিংবা কোভিড টেস্ট কোন কিছুরই বালাই ছিল না আগত পুণ্যার্থীদের।

এপ্রিল মাসে হরিদ্বারে কুম্ভমেলায় যোগ দেন প্রায় ৯০ লাখের বেশি তীর্থযাত্রী। ভারতের প্রখ্যাত রোগতত্ত্ববিদ ডা. ললিত কান্ত বলছেন, ‘মাস্ক না পরে তীর্থযাত্রীদের বড় বড় দল যখন নদীর তীরে দাঁড়িয়ে গঙ্গার বন্দনা করছে’, তখনই দ্রুত ভাইরাস সংক্রমণের এক আদর্শ পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে। ‘আমরা জানি যে গির্জায় কিংবা মন্দিরে যখন সমবেত মানুষ এক সঙ্গে কোরাসে গান গায়, সেটি তখন একটি ‘সুপার-স্প্রেডার ইভেন্টে’ পরিণত হয়। ‘প্রশ্ন হলো, কুম্ভমেলায় কী শুধু অতিসাধারণ ধর্মপ্রাণ হিন্দুরাই জড় হয়েছিলেন? শিক্ষা, কিংবা সচেতনতার অভাবে যাদের মধ্যে কা-জ্ঞান লোপ পেয়েছিল তারাই কি পুণ্য লাভের আশায় কুম্ভমেলায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। মোটেই না, কুম্ভমেলায় লাখ লাখ আবেগপ্রবণ, তথাকথিত শিক্ষিত ভারতীয় হিন্দু তীর্থ যাত্রীরাও রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় কারণে জড় হয়েছিলেন।

ধর্ম পালন, ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী তার চর্চা করার বিষয়ে কারও আপত্তি থাকার কারণ নেই। যে কোন উদার, আধুনিক মানুষ প্রত্যেক মানুষের বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনের ব্যাপারে অত্যন্ত সহানুভূতিশীল হয়ে থাকেন। মানুষ তার বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করবেন এটি হলো, গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকার। স্বাভাবিক সময়ে রাষ্ট্রযন্ত্রও এই আচার অনুষ্ঠান পালনে মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান। কিন্তু অস্বাভাবিক, অতিমারী বা মহামারীকালে যখন রোগ সংক্রমণ হয় মানুষের নিঃশ্বাস, প্রশ্বাস, স্পর্শ থেকে তখন নিশ্চয় অন্যের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে পরম প্রভুকে মানুষ অন্তর দিয়ে নিভৃতে ডাকার কথা বিবেচনা করবেন। ভারতীয় রাষ্ট্রযন্ত্র এবং ক্ষমতাসীনরা সংক্রামক এই ভয়াবহ অদৃশ্য ভাইরাসের সঙ্গে বাজি ধরেছিলেন। এই বাজি মূলত ধর্মপ্রাণ মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তী ইলেকশনে নিজেদের পক্ষে ভোট টানার জন্য। তারা কুম্ভমেলা আয়োজনের অনুমতি তো দিলেনই এর সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধির পালন করার জন্য কোন প্রটোকলকে বাধ্যতামূলক করতে পারলেন না। এর ফলাফল কিন্তু তারা হাতে নাতেই পেয়ে গেলেন। বাজিতে তারা হেরে গেলেন। এই বাজি ছিল, সচেতন ধর্মবসায়ীদের কা-জ্ঞানহীন বাজি। যে বাজিতে ভারত হারালো, লাখ লাখ মানুষকে।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালীন সময়ে ভারত যখন দিশাহারা, তখন ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও প্রায় ধসে পড়েছিল। হাসপাতালে শয্যা নেই। বেশিরভাগ হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাব। প্রতিদিন তিন, চার লাখ মানুষ সংক্রমিত হচ্ছেন। প্রাণহানির রেকর্ড প্রতিদিন ভাঙছে। শ্মশান, গোরস্তানে লাশের স্তূপ। সৎকারের জন্য মানুষের হাহাহাকার। এ রকম অবস্থা থেকে ভারত এখন কিছটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিনের সংক্রমণ এখন নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। মৃত্যু হারও অনেক কমেছে। কিন্তু আবেগ প্রবণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পূর্ব প্রস্তুতির যে মূল্য ভারতকে দিতে হয়েছে, সে মূল্যের কথা চিরদিন ভারতের সচেতন নাগরিকরা মনে রাখবেন।

ভারতের এপ্রিল, মে মাসের এই চরম বিপর্যয় থেকে আমাদের কি কিছু শিক্ষা নিয়েছি? আমার মনে হয় প্রতিবেশী এই দেশটি থেকে আমরা তেমন কিছু শিখতে পারিনি। শিখতে যে পারিনি, সাম্প্রতিক আমাদের কিছু সিদ্ধান্ত তার জাজ্বল্যমাণ প্রমাণ। আমাদের কোভিড সংক্রান্ত একটি জাতীয় কারিগরি কমিটি আছে। দেশের যোগ্যতম রোগতত্ব বিশেষজ্ঞ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এ কমিটির সদস্য। এই অদৃশ্য ভাইরাসের গতি প্রকৃতি সম্পর্কে তারাই সবচেয়ে ভালো জানেন বলে আমাদের মেনে নিতে হবে। তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান, বিশ্বের কোভিড পরিস্থিতি, দেশের ভাইরাসের গতি প্রকৃতি বিবেচনা করে তারা সরকারকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

দেশে করোনার সংক্রমণ গত ডিসেম্বরে কমে এলেও এ বছরের মার্চে ঊর্ধ্বমুখী হয়। গত প্রায় এক মাস ধরে পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক অবস্থায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে, সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় সবচেয়ে বেশি রোগী যেসব দেশে শনাক্ত হচ্ছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অষ্টম। মৃত্যুর তালিকাতেও তাই। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার গত ১ জুলাই থেকে সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণা করে। ঈদুল আজহার কথা বিবেচনা করে ১৫ জুলাই ভোর থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত আট দিন বিধিনিষেধ শিথিল করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এই শিথিল বিধিনিষেধ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মনে করে বিধিনিষেধ শিথিল করায় সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।’ তিনি আরও জানান, ‘জুনে এক লাখ ১২ হাজার ৭১৮ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিল। জুলাইয়ের ১৪ দিনে আমরা সমপরিমাণ রোগী শনাক্ত করতে পেরেছি। যদিও এই মাসের আরও ১৬ দিন বাকি আছে।’ বিধিনিষেধ শিথিল নিয়ে আপত্তি রয়েছে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটিরও। কমিটির একাধিক সদস্য শিথিলতার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তারা শঙ্কিত। তারা মনে করছেন এই শিথিলতার সুযোগে সংক্রমণ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা আঁচ করা মুশকিল।

সীমিত পরিসরে এ পর্যায়ের লকডাউন শুরু হয়েছিল ২৮ জুন। কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে কঠোর লকডাউন শুরু হয় ১ জুলাই থেকে এবং তা চলে শুরু হয়ে ১৪ জুলাই পর্যন্ত। এ সময়ে আমরা দেখেছি সর্বস্তরের মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা সত্ত্বেও নানা অজুহাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে ধীরে ধীরে কঠোর লকডাউনকে কোমল লকডাউন পরিণত করে ফেলেছে। জুন মাস ছিল, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও সর্বোচ্চ মৃত্যুর মাস। জুলাই মাস জুন মাসকে ছাড়িয়ে আরও বিভীষিকা ডেকে নিয়ে এসেছে। মৃত্যু ও সংক্রমণের হারের রেকর্ড প্রতিদিনই ভাঙছে। স্বাস্থ্যবিধি ও প্রতিরোধে ব্যবস্থা না নেয়া হলে আরও দুই সপ্তাহ এমন মৃত্যু চলতে পারে। এমনকি এ প্রবণতা টানা তিন সপ্তাহও গড়াতে পারে, কোভিড-সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি কমিটির সদস্যারা এরকমই পূর্বাভাস দিয়েছেন। কঠোর লকডাউনকে আমরা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারিনি তাই দৃশ্যমান কোন সুফলও আমরা পাইনি। এ রকম অবস্থায়, ১৫ জুলাই ভোর থেকে যে শিথিল লকডাউন শুরু হয়েছে সে শিথিলতা আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে পূর্বের অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে সচেতন নাগরিকরা শঙ্কিত না হয়ে পারছেন না।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বারবার বলছেন, আমরা লকডাউনের শিথিলতা চাই না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্ভাব্য নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত পরিস্থিতির দায় যাতে এড়াতে হয় এ জন্য নানা কথা বলে রাখছেন। স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘লকডাউন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একা দেয় না। আরও ১০টা মন্ত্রণালয় আছে। সবারটা মিলিয়ে একটা সিদ্ধান্ত সরকার জানিয়ে দেয়। আর সরকারকে তো আমরাই শুধু পরামর্শ দিচ্ছি না, অন্য মন্ত্রণালয়ও দিচ্ছে।’ এ রকম কথা সমন্বয়ের কথা নয়। এ রকম কথাতে নিবেদনের পরিমাণ খুব বেশি নেই। লকডাউনের শিথিলতার এই সময় আমরা দেখছি, স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে মানুষ নানা যানবাহনে হন্যে হয়ে ছুটছে, গ্রামের দিকে। শপিংমল থেকে শুরু করে কোথাও আমরা দেখছি না স্বাস্থ্যবিধি মেনে কর্মকা- চলতে। এ রকম অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে আমরা কোথায় গিয়ে পৌঁছাবো, মৃত্যু সংখ্যা কিংবা সংক্রমণের দিক থেকে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের মতো অবস্থার যদি সম্মুখীন হতে হয়, তাহলে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারব তো? দোষারোপের, দায় এড়ানোর পথ ছেড়ে সম্ভাব্য দুর্যোগের কথা ভেবে পরিকল্পনা করে রাখতে হবে। আমি এখন পর্যন্ত শুনিনি, দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য কোন রোডম্যাপের কথা। অনেক খুঁজেছি। আমরা নতুন নতুন অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছি তারপর ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমাদের প্রয়োজন সুস্পষ্ট পথনকশা বা রোডম্যাপ। যে রোডম্যাপ বলে দেবে, বিভিন্ন বাস্তবতায় আমরা এগোবে কেমন করে। টানেলের এপারে অন্ধকার ওপারে আলোর ঝরনাধারা। এ রোডম্যাপের টানেলের ওপারে যাওয়ার পথ দেখাবে। সবার চূড়ান্ত সহযোগিতায় ও সমন্বয়ে রোডম্যাপ ধরে আমরা, এগোবো। আমরা যেন, ভারতের মতো প্রস্তুতির অভাবে বিব্রত হয়ে না পড়ি। আমাদের হাতে কিন্তু সময় খুব বেশি নেই।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

back to top