অভিজিৎ বড়ুয়া
বর্তমান সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সফলতা প্রশংসনীয়। বর্তমান ভূমি মন্ত্রণালয়ের ডিজিটালাইজেশনের উদ্যোগ ও ব্যবস্থা গ্রহণের কারণে ভূমি-সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। যুগোপযুগী বিভিন্ন প্রদক্ষেপ, আইন ও ব্যবস্থাপনার সংস্কার ভূমি মন্ত্রণালয়ের আধুনিক চিন্তাধারার পরিচায়ক।
কিন্তু তারপরেও কিছু বিষয় এই সব সফলতাকে ম্লান করে। যেমন একটি আইন যা জমির ভোগ-দখল-সংক্রান্ত সেটি ব্রিটিশ আমলের, ১৮৮৫ সালে প্রণয়ন করা হয়েছিল, তার আজও কোন সংস্কার হয়নি। ‘ভূমি-সংক্রান্ত ১৯০৮ সালের তামাদি আইনের ২৮ ধারা অনুযায়ী যদি কেউ বিনা বাধায় কারও জমি একাধারে ১২ বছর দখলে রাখতে পারে বা ভোগদখল করে রাখতে পারে তবে তিনি ভূমির মালিকানা দাবি করে আদালতে মামলা করতে পারেন। দখলদার যদি আদালতে বিষয়টি প্রমাণ করতে পারেন তবে তিনি ওই জমির মালিকানা পেতে পারেন।’ যে আইনের কারণে কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ নিরীহ জনগণ তার মালিকানাধীন ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, বিভিন্ন ভূমি দুর্বৃত্তদের কারণে। এই আইনের সুযোগে একজন সাধারণ নাগরিক উত্তরাধিকার সূত্রে জমির মালিক হলেও এবং আরএস/বিএস/নামজারি খতিয়ান অনুসারে জমির মালিক হলেও এবং খাজনাদি যথাসময়ে পরিশোধ করলেও, দুর্বৃত্তদের দখলের কারণে ভূমির মালিকানা হতে বঞ্চিত হয়। অসাধু আইন ব্যবসার সঙ্গে সংপৃক্ত ব্যক্তি, দুর্বৃত্ত, প্রভাবশালী ব্যক্তি, অসাধু রাজনৈতিক ব্যক্তির সংযোগে এরা ১৯০৮ সালের তামাদি আইনের ২৮ ধারার আশ্রয়ে, আইনকে ব্যবহার করে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে ব্যবহার করে, পেশী শক্তির বলে উত্তরাধিকার সূত্রে জমির প্রকৃত মালিককে তার ভূমি হতে উৎখাত ও উচ্ছেদ করে জমির দখল নেয়। আদালতে এখন যত মামলা রয়েছে তার ৭০ শতাংশ জমি-সংক্রান্ত। যার বেশিরভাগই জমির দখল বিষয়ক মামলা। আর এসব মামলা চলতে থাকে বছরের পর বছর। নিষ্পত্তি হওয়ার হারও উল্লেখযোগ্য নয়।
আমরা যদি ভারতের দিকে লক্ষ্য করি, ভারতের তামাদি আইন ১৯৩৬-র ৩৬ নং বলবত রয়েছে। ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভূমি সংস্কার ব্যবস্থার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে। পাকিস্তান জমি বা সম্পত্তি আইন পাকিস্তানে একটি প্রাদেশিক বিষয়। প্রদেশগুলো সম্পত্তির মালিকানা সম্পর্কে আইন তৈরি করেছে। এ বিষয়ে পাকিস্তানের সংবিধানের ২৩ অনুচ্ছেদে ঘোষণা করা হয়েছে যে; ‘প্রত্যেক নাগরিকের পাকিস্তানের অংশে সম্পত্তি অর্জন, ধারণ এবং নিষ্পত্তি করার অধিকার থাকবে।’ সম্পত্তির অধিকার পাকিস্তানের সংবিধান, ১৯৭৩-এর অধীনে সুরক্ষিত। ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৩, ২৪, ১৭২ এবং ১৭৩ পাকিস্তান ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার বিষয়ে আইন। অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তানে প্রয়োজনে ভূমি-সংক্রান্ত আইন পরিবর্তন করা হয়েছে।
আমরা আলোচনার সাপেক্ষে যদি বলি, পার্শ্ববর্তী কোন দেশ বাংলাদেশের ভূমি দখল করে আর ১২ বছর পর ওই ভূমির মালিকানা দাবি করে তাহলে বাংলাদেশ কি সে দাবি মেনে নেবে? না মেনে নেবে না, কারণ তা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। কারণ একটি রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি বা স্তম্ভ হলো নিজ ভূখন্ড, জনগণ বা নাগরিক, সরকার, সার্বভৌমত্ব ক্ষমতা। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র ‘ভূমি-সংক্রান্ত ১৯০৮ সালের তামাদি আইনের ধারা অনুযায়ী তার নাগরিকের ভূমি মালিকানার অধিকার ক্ষুণ্ন করছে। নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভ। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনসহ জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষায় এই তিনটি অঙ্গের ভূমিকা অনন্য। জনগণ ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিত করতে এদের মধ্যে ভারসাম্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভূমিমন্ত্রী বলেন, “সরকারি জমি অবৈধ দখল দন্ডনীয় ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করে শিগগিরই আইন সংশোধন করা হচ্ছে। একজনের জমি আরেকজন জোরজবরদস্তি করে দখল করে রাখবে, তা হতে দেয়া যায় না। জমি দখল, দুর্নীতি ও জমি-সংক্রান্ত মামলা কমাতে এ আইন কার্যকর ভূমিকা রাখবে।” জমি দখলের সঙ্গে জড়িতরা যত ক্ষমতাবানই হোন না কেন, আইনটি হলে তারা ছাড় পাবেন না বলেও মন্তব্য করেন ভূমিমন্ত্রী।
একজনের নামে থাকা জমি ১২ বছর ধরে অন্যজনের ভোগদখলে থাকলেই সেই জমি তার হয়ে যাবে, এমন আইনে পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দখলদার যাতে জমির মালিক না হয়ে যায়, সেজন্য ‘ভূমির ব্যবহারস্বত্ব গ্রহণ আইন, ২০২০’ নামে নতুন আইন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রস্তাবিত আইনের খসড়া তৈরি করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। স্টেকহোল্ডারদের মতামতের পর তা চূড়ান্ত করা হবে। খসড়াটি ভেটিংয়ের জন্য শিগগিরই আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সেখান থেকে যাচাই-বাছাই শেষে মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর আইনটি পাসের জন্য সংসদে উত্থাপন করা হবে। রূপকল্প-২০৪১ এর আলোকে ‘উন্নত বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে ‘ভূমির ব্যবহারস্বত্ব গ্রহণ আইন, ২০২০’ অতি দ্রুত পাস করা জরুরি। কারণ ‘ভূমি-সংক্রান্ত ১৯০৮ সালের তামাদি আইনের সুযোগ নিয়ে ১৯৭০-৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যে সব ভূমি অফিস ও রেকর্ড পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, সেসব পুড়ে যাওয়া রেকর্ডকে জালিয়াতি করে নতুন নকল দলিল সৃজিত করে কতিপয় দুর্বৃত্ত সাধারণ নাগরিকের জমি দখল করছে। স্বয়ং ভূমিমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকায় এরূপ দুর্নীতি ও সৃজিত দলিল-সংক্রান্ত মামলা ও ঘটনা প্রচুর। তাছাড়া একজন বর্গা চাষি জমি চাষাবাদের সূত্র ধরে দীর্ঘসময়ের পর ওই জমি তার দখলি জমি দাবি করে মামলা করছে বা একজন নাগরিক দীর্ঘদিন গ্রামে না থাকা বা শহরে বসবাস করা বা বিদেশে বসবাসের সুযোগে কোন কোন দুর্বৃত্ত ওই নাগরিকের জমি বা বসতভিটা দখল করে নিচ্ছে।
ভূমি মন্ত্রনালয়ের ডিজিটালাইজেশনের উদ্যোগ ও ব্যবস্থা গ্রহণ সময়ের দাবি। ২০১৮ সালের একটি ব্লগ পোস্টে বিশ্বব্যাংকের ভূমি বিশেষজ্ঞ ক্লস ডেইনিংগার বলেন, বিশ্বের এক তৃতীয়াংশেরও কম দেশ ডিজিটাল রেকর্ড সংরক্ষণ করে। ইউরোপের দি ইউরোপিয়ান ই-জাস্টিস পোর্টালে ভূমি নিবন্ধন তালিকা সংরক্ষিত। ইউরোগ্রাফিক্স : ইউরোপের যত ন্যাশনাল ম্যাপিং, ক্যাডেস্টার এবং ভূমি রেজিস্ট্রি কর্তৃপক্ষ আছে তাদের সবার তথ্য এক সঙ্গে পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। ইউরোপিয়ান ল্যান্ড রেজিস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন : ইউরোপের সবকটি জাতীয় জমি নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের এই জোট ২০১৮ সালে একটি জরিপ করেছে, ইউরোপে ভূমি-সংক্রান্ত জাতীয় কর্তৃপক্ষের যে নেটওয়ার্ক আছে তার সদস্যদের বিবরণ রয়েছে এখানে।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় ক্যাডেস্টারে জমির দাম, মালিকানা এবং আবাসনের তালিকার জন্য রয়েছে ইউনিফাইড স্টেট রিয়াল এস্টেট রেজিস্টার। সম্পত্তি মালিকের নামসহ তথ্য রয়েছে রোসরিস্ত্র ওয়েবসাইটে। যুক্তরাষ্ট্রে ৩১০০টির বেশি জায়গায় ভূমি রেকর্ড সংরক্ষিত থাকে। এই তথ্য সবার জন্য উন্মুক্ত। কানাডায় আবাসন রেকর্ডগুলো রাখা হয় প্রাদেশিক পর্যায়ে এবং সেখানে ১০টি প্রদেশেই অনলাইন ব্যবস্থা রয়েছে। অর্থাৎ পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্র ডিজিটাল রেকর্ড সংরক্ষণ করে আসছে। বাংলাদেশ সবে শুরু করেছে। যার স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘ পাবলিক সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। জাতিসংঘ জনসেবা পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রথম বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ভূমি মন্ত্রণালয়।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো যেখানে ‘ভূমিসংক্রান্ত ১৯০৮ সালের তামাদি আইন’ বিদ্যমান, যার ফলে সাধারণ নিরীহ নাগরিক তার বৈধ সম্পদ বেদখলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত, সে পেক্ষাপটে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সব অর্জন ম্লান। আদালতে এখন যত মামলা রয়েছে তার ৭০ শতাংশ জমি-সংক্রান্ত। যার বেশিরভাগই জমির দখলবিষয়ক মামলা। আর এসব মামলা চলতে থাকে বছরের পর বছর। নিষ্পত্তি হওয়ার হারও উল্লেখযোগ্য নয়। সুতরাং এইরূপ একটি আইন রেখে ভূমি মন্ত্রণালয়ের এত অর্জন ম্লান। দেশে জমির ভোগ-দখলসংক্রান্ত আইনটি ব্রিটিশ আমলের। ১৮৮৫ সালে প্রণয়ন করা হয়েছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশে অনেক আইনের পরিবর্তন হলেও এ আইন আগের মতোই রয়ে গেছে। রূপকল্প-২০৪১ এর আলোকে ‘উন্নত বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে এই আইনের যথাযথ যুক্তিসংগত পরিবর্তন আনা এবং ‘ভূমির ব্যবহারস্বত্ব গ্রহণ আইন, ২০২০’ পাস করা সময়ের দাবি। স্বাধীন সার্বভৌম দেশে ‘ভূমি-সংক্রান্ত ১৯০৮ সালের তামাদি আইন” কতটুকু যুক্তি সংগত?
[লেখক : প্রাবন্ধিক]
অভিজিৎ বড়ুয়া
সোমবার, ১৭ জানুয়ারী ২০২২
বর্তমান সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সফলতা প্রশংসনীয়। বর্তমান ভূমি মন্ত্রণালয়ের ডিজিটালাইজেশনের উদ্যোগ ও ব্যবস্থা গ্রহণের কারণে ভূমি-সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। যুগোপযুগী বিভিন্ন প্রদক্ষেপ, আইন ও ব্যবস্থাপনার সংস্কার ভূমি মন্ত্রণালয়ের আধুনিক চিন্তাধারার পরিচায়ক।
কিন্তু তারপরেও কিছু বিষয় এই সব সফলতাকে ম্লান করে। যেমন একটি আইন যা জমির ভোগ-দখল-সংক্রান্ত সেটি ব্রিটিশ আমলের, ১৮৮৫ সালে প্রণয়ন করা হয়েছিল, তার আজও কোন সংস্কার হয়নি। ‘ভূমি-সংক্রান্ত ১৯০৮ সালের তামাদি আইনের ২৮ ধারা অনুযায়ী যদি কেউ বিনা বাধায় কারও জমি একাধারে ১২ বছর দখলে রাখতে পারে বা ভোগদখল করে রাখতে পারে তবে তিনি ভূমির মালিকানা দাবি করে আদালতে মামলা করতে পারেন। দখলদার যদি আদালতে বিষয়টি প্রমাণ করতে পারেন তবে তিনি ওই জমির মালিকানা পেতে পারেন।’ যে আইনের কারণে কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ নিরীহ জনগণ তার মালিকানাধীন ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, বিভিন্ন ভূমি দুর্বৃত্তদের কারণে। এই আইনের সুযোগে একজন সাধারণ নাগরিক উত্তরাধিকার সূত্রে জমির মালিক হলেও এবং আরএস/বিএস/নামজারি খতিয়ান অনুসারে জমির মালিক হলেও এবং খাজনাদি যথাসময়ে পরিশোধ করলেও, দুর্বৃত্তদের দখলের কারণে ভূমির মালিকানা হতে বঞ্চিত হয়। অসাধু আইন ব্যবসার সঙ্গে সংপৃক্ত ব্যক্তি, দুর্বৃত্ত, প্রভাবশালী ব্যক্তি, অসাধু রাজনৈতিক ব্যক্তির সংযোগে এরা ১৯০৮ সালের তামাদি আইনের ২৮ ধারার আশ্রয়ে, আইনকে ব্যবহার করে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে ব্যবহার করে, পেশী শক্তির বলে উত্তরাধিকার সূত্রে জমির প্রকৃত মালিককে তার ভূমি হতে উৎখাত ও উচ্ছেদ করে জমির দখল নেয়। আদালতে এখন যত মামলা রয়েছে তার ৭০ শতাংশ জমি-সংক্রান্ত। যার বেশিরভাগই জমির দখল বিষয়ক মামলা। আর এসব মামলা চলতে থাকে বছরের পর বছর। নিষ্পত্তি হওয়ার হারও উল্লেখযোগ্য নয়।
আমরা যদি ভারতের দিকে লক্ষ্য করি, ভারতের তামাদি আইন ১৯৩৬-র ৩৬ নং বলবত রয়েছে। ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভূমি সংস্কার ব্যবস্থার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে। পাকিস্তান জমি বা সম্পত্তি আইন পাকিস্তানে একটি প্রাদেশিক বিষয়। প্রদেশগুলো সম্পত্তির মালিকানা সম্পর্কে আইন তৈরি করেছে। এ বিষয়ে পাকিস্তানের সংবিধানের ২৩ অনুচ্ছেদে ঘোষণা করা হয়েছে যে; ‘প্রত্যেক নাগরিকের পাকিস্তানের অংশে সম্পত্তি অর্জন, ধারণ এবং নিষ্পত্তি করার অধিকার থাকবে।’ সম্পত্তির অধিকার পাকিস্তানের সংবিধান, ১৯৭৩-এর অধীনে সুরক্ষিত। ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৩, ২৪, ১৭২ এবং ১৭৩ পাকিস্তান ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার বিষয়ে আইন। অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তানে প্রয়োজনে ভূমি-সংক্রান্ত আইন পরিবর্তন করা হয়েছে।
আমরা আলোচনার সাপেক্ষে যদি বলি, পার্শ্ববর্তী কোন দেশ বাংলাদেশের ভূমি দখল করে আর ১২ বছর পর ওই ভূমির মালিকানা দাবি করে তাহলে বাংলাদেশ কি সে দাবি মেনে নেবে? না মেনে নেবে না, কারণ তা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। কারণ একটি রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি বা স্তম্ভ হলো নিজ ভূখন্ড, জনগণ বা নাগরিক, সরকার, সার্বভৌমত্ব ক্ষমতা। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র ‘ভূমি-সংক্রান্ত ১৯০৮ সালের তামাদি আইনের ধারা অনুযায়ী তার নাগরিকের ভূমি মালিকানার অধিকার ক্ষুণ্ন করছে। নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভ। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনসহ জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষায় এই তিনটি অঙ্গের ভূমিকা অনন্য। জনগণ ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিত করতে এদের মধ্যে ভারসাম্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভূমিমন্ত্রী বলেন, “সরকারি জমি অবৈধ দখল দন্ডনীয় ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করে শিগগিরই আইন সংশোধন করা হচ্ছে। একজনের জমি আরেকজন জোরজবরদস্তি করে দখল করে রাখবে, তা হতে দেয়া যায় না। জমি দখল, দুর্নীতি ও জমি-সংক্রান্ত মামলা কমাতে এ আইন কার্যকর ভূমিকা রাখবে।” জমি দখলের সঙ্গে জড়িতরা যত ক্ষমতাবানই হোন না কেন, আইনটি হলে তারা ছাড় পাবেন না বলেও মন্তব্য করেন ভূমিমন্ত্রী।
একজনের নামে থাকা জমি ১২ বছর ধরে অন্যজনের ভোগদখলে থাকলেই সেই জমি তার হয়ে যাবে, এমন আইনে পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দখলদার যাতে জমির মালিক না হয়ে যায়, সেজন্য ‘ভূমির ব্যবহারস্বত্ব গ্রহণ আইন, ২০২০’ নামে নতুন আইন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রস্তাবিত আইনের খসড়া তৈরি করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। স্টেকহোল্ডারদের মতামতের পর তা চূড়ান্ত করা হবে। খসড়াটি ভেটিংয়ের জন্য শিগগিরই আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সেখান থেকে যাচাই-বাছাই শেষে মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর আইনটি পাসের জন্য সংসদে উত্থাপন করা হবে। রূপকল্প-২০৪১ এর আলোকে ‘উন্নত বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে ‘ভূমির ব্যবহারস্বত্ব গ্রহণ আইন, ২০২০’ অতি দ্রুত পাস করা জরুরি। কারণ ‘ভূমি-সংক্রান্ত ১৯০৮ সালের তামাদি আইনের সুযোগ নিয়ে ১৯৭০-৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যে সব ভূমি অফিস ও রেকর্ড পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, সেসব পুড়ে যাওয়া রেকর্ডকে জালিয়াতি করে নতুন নকল দলিল সৃজিত করে কতিপয় দুর্বৃত্ত সাধারণ নাগরিকের জমি দখল করছে। স্বয়ং ভূমিমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকায় এরূপ দুর্নীতি ও সৃজিত দলিল-সংক্রান্ত মামলা ও ঘটনা প্রচুর। তাছাড়া একজন বর্গা চাষি জমি চাষাবাদের সূত্র ধরে দীর্ঘসময়ের পর ওই জমি তার দখলি জমি দাবি করে মামলা করছে বা একজন নাগরিক দীর্ঘদিন গ্রামে না থাকা বা শহরে বসবাস করা বা বিদেশে বসবাসের সুযোগে কোন কোন দুর্বৃত্ত ওই নাগরিকের জমি বা বসতভিটা দখল করে নিচ্ছে।
ভূমি মন্ত্রনালয়ের ডিজিটালাইজেশনের উদ্যোগ ও ব্যবস্থা গ্রহণ সময়ের দাবি। ২০১৮ সালের একটি ব্লগ পোস্টে বিশ্বব্যাংকের ভূমি বিশেষজ্ঞ ক্লস ডেইনিংগার বলেন, বিশ্বের এক তৃতীয়াংশেরও কম দেশ ডিজিটাল রেকর্ড সংরক্ষণ করে। ইউরোপের দি ইউরোপিয়ান ই-জাস্টিস পোর্টালে ভূমি নিবন্ধন তালিকা সংরক্ষিত। ইউরোগ্রাফিক্স : ইউরোপের যত ন্যাশনাল ম্যাপিং, ক্যাডেস্টার এবং ভূমি রেজিস্ট্রি কর্তৃপক্ষ আছে তাদের সবার তথ্য এক সঙ্গে পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। ইউরোপিয়ান ল্যান্ড রেজিস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন : ইউরোপের সবকটি জাতীয় জমি নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের এই জোট ২০১৮ সালে একটি জরিপ করেছে, ইউরোপে ভূমি-সংক্রান্ত জাতীয় কর্তৃপক্ষের যে নেটওয়ার্ক আছে তার সদস্যদের বিবরণ রয়েছে এখানে।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় ক্যাডেস্টারে জমির দাম, মালিকানা এবং আবাসনের তালিকার জন্য রয়েছে ইউনিফাইড স্টেট রিয়াল এস্টেট রেজিস্টার। সম্পত্তি মালিকের নামসহ তথ্য রয়েছে রোসরিস্ত্র ওয়েবসাইটে। যুক্তরাষ্ট্রে ৩১০০টির বেশি জায়গায় ভূমি রেকর্ড সংরক্ষিত থাকে। এই তথ্য সবার জন্য উন্মুক্ত। কানাডায় আবাসন রেকর্ডগুলো রাখা হয় প্রাদেশিক পর্যায়ে এবং সেখানে ১০টি প্রদেশেই অনলাইন ব্যবস্থা রয়েছে। অর্থাৎ পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্র ডিজিটাল রেকর্ড সংরক্ষণ করে আসছে। বাংলাদেশ সবে শুরু করেছে। যার স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘ পাবলিক সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। জাতিসংঘ জনসেবা পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রথম বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ভূমি মন্ত্রণালয়।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো যেখানে ‘ভূমিসংক্রান্ত ১৯০৮ সালের তামাদি আইন’ বিদ্যমান, যার ফলে সাধারণ নিরীহ নাগরিক তার বৈধ সম্পদ বেদখলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত, সে পেক্ষাপটে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সব অর্জন ম্লান। আদালতে এখন যত মামলা রয়েছে তার ৭০ শতাংশ জমি-সংক্রান্ত। যার বেশিরভাগই জমির দখলবিষয়ক মামলা। আর এসব মামলা চলতে থাকে বছরের পর বছর। নিষ্পত্তি হওয়ার হারও উল্লেখযোগ্য নয়। সুতরাং এইরূপ একটি আইন রেখে ভূমি মন্ত্রণালয়ের এত অর্জন ম্লান। দেশে জমির ভোগ-দখলসংক্রান্ত আইনটি ব্রিটিশ আমলের। ১৮৮৫ সালে প্রণয়ন করা হয়েছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশে অনেক আইনের পরিবর্তন হলেও এ আইন আগের মতোই রয়ে গেছে। রূপকল্প-২০৪১ এর আলোকে ‘উন্নত বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে এই আইনের যথাযথ যুক্তিসংগত পরিবর্তন আনা এবং ‘ভূমির ব্যবহারস্বত্ব গ্রহণ আইন, ২০২০’ পাস করা সময়ের দাবি। স্বাধীন সার্বভৌম দেশে ‘ভূমি-সংক্রান্ত ১৯০৮ সালের তামাদি আইন” কতটুকু যুক্তি সংগত?
[লেখক : প্রাবন্ধিক]