alt

উপ-সম্পাদকীয়

কখন ও কেমন হবে করোনার শেষটা

নাজমুল হুদা খান

: বুধবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২২
image

করোনা যুদ্ধের তৃতীয় বছরে পা রেখেছে বিশ্ব। ইতোমধ্যে এ অতিমারীতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ঘটেছে প্রায় ৫৫ লাখ মানুষের। রকেটের গতিতে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে করোনার ওমিক্রন ধরন। যদিও বলা হচ্ছে এ ধরনটির রোগের তীব্রতা, হাসপাতালমুখিতা ও মৃত্যুর হার তেমন একটা আশঙ্কার নয়, তথাপি কখন কীভাবে থামবে এর গতি এর ভবিষ্যদ্বাণী এখনই করা যাচ্ছে না। তাই বিশ্ববাসীর মনে এখন একটাই প্রশ্ন করোনা অতিমারীর শেষটা কখন এবং কেমন হবে?

এ নিয়ে বিজ্ঞানী, গবেষক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন সংস্থা ও গোত্রের ভিন্ন ভিন্ন অনুমান ও মতামত রয়েছে। তা কোন কোন ক্ষেত্রে যেমন নিরাশার, তেমনি আশার আলো ও দেখায়। সত্যিটা হচ্ছে, সব অতিমারীরই শেষ আছে; ইতিহাস তাই সাক্ষ্য দেয়। ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসের বিভিন্ন ধরন বিশ্ববাসীকে আক্রান্ত করেছে। তা ডেল্টা ধরনের মতো যেমন বিধ্বংসী তেমনি নিছক সর্দি কাশির রূপেও আবির্ভূত হয়েছে। এ রোগ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি অস্ত্র প্রয়োগ থেকে শুরু করে হালের ভ্যাকসিন সবকিছুই এ অতিমারীর বিরুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় প্রতিরোধ বুহ্য গড়ে তুলেছে। ইতোমধ্যে আমাদের শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থাও অনেকটা শিখে গেছে এ ভাইরাসটির নানা কৌশল।

কারণ বিশ্বের সিংহভাগ মানুষই হয় আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছে কিংবা ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছে। সুতরাং ভাইরাসটি এর শেষ যাত্রার হিসেবটি যে দ্রুতই সাঁঙ্গ করবে তাতে সন্দেহ নেই। করোনা জাতীয় ভাইরাসে সংঘটিত অতিমারীর ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই যে, সবচেয়ে প্রাণঘাতী এবং অতিমারীর জনক স্প্যানিশ ফ্লুর স্থায়িত্ব ছিল ১৯১৮ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত দুই বছর, রাশিয়ান ফ্লু (১৯৬৮-৭০), সার্স ( ২০০৩-৪) এবং সোয়াইন ফ্লু (২০০৯-১০) সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ সবকটির স্থায়িত্বই ছিল ২-৩ বছর। প্রায় সবগুলো অতিমারীরই গড়ে ২-৩টি ঢেউ প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ববাসী; এবং সবগুলো ঢেউয়ের প্রথম দিকে মানুষের মৃত্যু হয়েছে বেশি। তবে আশার কথা হচ্ছে, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে দ্রুততার সঙ্গে যেমন সফল ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও প্রয়োগ সম্ভব হয়েছে; অন্যান্য ফ্লুর ক্ষেত্রে কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।

স্প্যানিশ ফ্লুর কোন ভ্যাকসিন ছিল না, এশিয়ান ফ্লু প্রতিরোধে শুধুমাত্র সামরিক বাহিনীর সদস্যদের কাছে সীমিত সংখ্যাক এবং হংকং ফ্লুর ২ কোটি ভ্যাকসিন যখন যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত সম্পন্ন করেছে; ততদিনে অতিমারীর তীব্রতা কমতে শুরু করেছে এবং ভ্যাকসিনের চাহিদা কমে গেছে। তবে কোভিড ভ্যাকসিন দ্রুত আবিষ্কার হলেও পৃথিবীর বহু দেশ এখনও ৮০ ভাগ মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনার মতো পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন পায়নি; তাই ভ্যকসিন স্বল্পতা এবং স্বাস্থ্যবিধি পালনে অবহেলা ইত্যাদি কারণে করোনা অতিমারী আরও কিছুটা দীর্ঘায়িত হওয়ার আশংকা করছেন গবেষক, বিজ্ঞানী, অণুজীব ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগন। নেচার ম্যাগাজিন বলেছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্থানীয়ভাবে ঊহফবসরপ হিসেবে করোনার থেকে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।

করোনার পূর্বে যতগুলো ফ্লু জাতীয় অতিমারীর আবির্ভাব হয়েছিল প্রায় সবক’টিই প্রাণঘাতী থেকে ক্রমান্বয়ে মৌসুমী ঠান্ডা কাশিতে পরিণত হয়েছে। করোনার বেলাতেও একই পরিনতি ঘটবে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। উপরন্তু প্রকৃতিও শেষ পর্যন্ত ভাইরাসের এমন সব ধরন সমূহকে টিকিয়ে রাখে, যারা আশ্রয়দাতাদের কম ক্ষতি সাধন করে থাকে। গবেষণালব্ধ তথ্য উপাত্ত থেকে দেখা যায় যে, শতকরা ২০ শতাংশ ঠান্ডা, সর্দি ও কাশি চারটি বিভিন্ন ধরনের করোনাভাইরাস কর্তৃক সংঘটিত হয়।

বর্তমান করোনাভাইরাস বা সার্স কোভি-২ একই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত হবে বলে ভাইরাস অণুজীব বিশেষজ্ঞগনের মতামত। স্প্যানিশ ফ্লু তে পৃথিবীর এক-তৃতিয়াংশ মানুষ আক্রান্ত হয় এবং মৃত্যুবরণ করে প্রায় ১০ কোটি। এই পৃথিবীর সবচেয়ে বিভীষিকাময় ভাইরাসও ২ বছরের মাথায় ১৯২০ সালে তীব্রতা হারিয়ে সাধারন ফ্লু তে পরিণত হয়। সুতরাং করোনাভাইরাসের একই পরিণতি হবে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও প্রয়োগের পর গত বছরের শেষ দিক থেকে দেশে দেশে করোনা রোগীর সংক্রমণ, তীব্রতা ও মৃত্যুর হার কমে আসতে শুরু করে। এটি বিশ্ববাসীর জন্য আশার আলো বলছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ।

১২ বছরের উপরে বয়সী ছেলেমেয়েদের দেহে সফলভাবে টিকা প্রদান শুরুর পর ৫ বছর এমনকি ৬ মাস বয়সী শিশুদের টীকার আওতায় আনার প্রচেষ্টা চলছে। সফলভাবে এটি সম্পন্ন হলে দেশে দেশে দ্রুতই করোনা প্রতিরোধক হার্ড ইমিউনিটি লাভ করবে বিশ্ববাসী। তাছাড়া করোনা চিকিৎসায় নানাবিধ নতুন নতুন আবিষ্কার ও অন্তর্ভুক্তি প্রতিরোধ মিছিলে নতুন জোয়ার আনবে বলে বিশেষজ্ঞদের দৃঢ় বিশ্বাস। ওমিক্রন এবং অদূর ভবিষ্যতে নতুন কোন বিধ্বংসী ধরনের আবির্ভাবই কেবল বিশ্ববাসীকে সাধারণ জীবনযাত্রায় ফিরে যাওয়ার অন্তরায় হতে পারে।

করোনার অন্ধকার গুহার শেষ প্রান্তে আলোর রশ্মি যেমন দেখা দিচ্ছে, তেমনি সাধারন জীবনাচারে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে শঙ্কা যে নেই তা নয়। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা হ্রাস, আশানুরূপভাবে ভ্যাকসিনের প্রতিরোধ বুহ্য গঠনে সময়সীমার কমতি, ভ্যাকসিন সরবরাহে ঘাটতি এবং করোনার নতুন নতুন ধরনের উদ্ভব এ আশার আলোকে স্তিমিত করে দিতে পারে।

গবেষকগণ বলছেন, করোনা পৃথিবী থেকে একেবারে বিদায় নিবে তেমনটির সম্ভাবনা কম। এমনটা হতে পারে যে, কতক দেশ হার্ড ইমিউনিটি লাভে সক্ষম হবে। কিছু কিছু দেশে বিভিন্ন প্রদেশ বা অঞ্চলের মানুষ করোনা প্রতিরোধে হার্ড ইমিউনিটি লাভ করবে। ভ্যাকসিন প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা এবং জনগণের ভ্যাকসিন গ্রহণে অনাগ্রহ কিছু কিছু দেশে হার্ড ইমিউনিটি লাভে সফলতার ঘাটতি দেখা দেবে। উপরন্ত নতুন ধরন উদ্ভবের বিষয়টিতো রয়েছেই। এহেন পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানীগণ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, উত্তর আমেরিকা এবং পশ্চিম ইউরোপের কিছু দেশ দ্রুত সময়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার দিকে যেতে সক্ষম হবে। নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য কিছু দেশও সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে। অধিকাংশ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশসমূহে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার বিষয়টি দীর্ঘায়িত হবে।

তবে জনস্বাস্থ্য বিষয়সমূহে উন্নতি ও সমৃদ্ধি; স্বাস্থ্যবিধির যথাযথ প্রয়োগও মেনে চলা; অধিকাংশ জনগণকে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসা এবং করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার নতুন নতুন উদ্ভাবনা করোনা রোগীদের উপসর্গে তীব্রতা হ্রাস, হাসপাতালমুখিতা ও মৃত্যু হ্রাসে সহায়তা করছে এবং করবে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশসমূহের জন্য এ সব ব্যবস্থাপনাই করোনা যুদ্ধের সফল সমাপ্তি এনে দিতে পারে।

গত ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বিশ্ববাসীকে আশার কথা শুনিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ২০২২ সালই হতে পারে করোনা যুদ্ধের শেষ পর্যায়। যদিও তিনি ওমিক্রন এবং ডেল্টা সুনামীর আশঙ্কার পুনরাবৃত্তি করে ভ্যাকসিন ও নতুন চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় বিশ্ববাসীকে সমতা ও সংহতি শক্তিশালীকরণ এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন। করোনা নামক শত্রুকে যুদ্ধের ময়দানে রেখে, প্রতিরোধ ব্যবস্থায় অবহেলা করে করোনার দীর্ঘস্থায়ী করা এবং নতুনভাবে সংক্রমণে সহায়তা ও মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ারই নামান্তর। বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় শীর্ষ সংস্থাসমূহ ও গবেষকগণের এ আশঙ্কা আমাদের মনে রাখতে হবে এবং করোনা প্রতিরোধের সব ব্যবস্থা গ্রহণ ও এ বিষয়ে আরও সচেতন আচরণ আবশ্যক।

[লেখক : সহকারী পরিচালক,

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল]

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

কখন ও কেমন হবে করোনার শেষটা

নাজমুল হুদা খান

image

বুধবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২২

করোনা যুদ্ধের তৃতীয় বছরে পা রেখেছে বিশ্ব। ইতোমধ্যে এ অতিমারীতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ঘটেছে প্রায় ৫৫ লাখ মানুষের। রকেটের গতিতে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে করোনার ওমিক্রন ধরন। যদিও বলা হচ্ছে এ ধরনটির রোগের তীব্রতা, হাসপাতালমুখিতা ও মৃত্যুর হার তেমন একটা আশঙ্কার নয়, তথাপি কখন কীভাবে থামবে এর গতি এর ভবিষ্যদ্বাণী এখনই করা যাচ্ছে না। তাই বিশ্ববাসীর মনে এখন একটাই প্রশ্ন করোনা অতিমারীর শেষটা কখন এবং কেমন হবে?

এ নিয়ে বিজ্ঞানী, গবেষক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন সংস্থা ও গোত্রের ভিন্ন ভিন্ন অনুমান ও মতামত রয়েছে। তা কোন কোন ক্ষেত্রে যেমন নিরাশার, তেমনি আশার আলো ও দেখায়। সত্যিটা হচ্ছে, সব অতিমারীরই শেষ আছে; ইতিহাস তাই সাক্ষ্য দেয়। ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসের বিভিন্ন ধরন বিশ্ববাসীকে আক্রান্ত করেছে। তা ডেল্টা ধরনের মতো যেমন বিধ্বংসী তেমনি নিছক সর্দি কাশির রূপেও আবির্ভূত হয়েছে। এ রোগ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি অস্ত্র প্রয়োগ থেকে শুরু করে হালের ভ্যাকসিন সবকিছুই এ অতিমারীর বিরুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় প্রতিরোধ বুহ্য গড়ে তুলেছে। ইতোমধ্যে আমাদের শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থাও অনেকটা শিখে গেছে এ ভাইরাসটির নানা কৌশল।

কারণ বিশ্বের সিংহভাগ মানুষই হয় আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছে কিংবা ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছে। সুতরাং ভাইরাসটি এর শেষ যাত্রার হিসেবটি যে দ্রুতই সাঁঙ্গ করবে তাতে সন্দেহ নেই। করোনা জাতীয় ভাইরাসে সংঘটিত অতিমারীর ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই যে, সবচেয়ে প্রাণঘাতী এবং অতিমারীর জনক স্প্যানিশ ফ্লুর স্থায়িত্ব ছিল ১৯১৮ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত দুই বছর, রাশিয়ান ফ্লু (১৯৬৮-৭০), সার্স ( ২০০৩-৪) এবং সোয়াইন ফ্লু (২০০৯-১০) সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ সবকটির স্থায়িত্বই ছিল ২-৩ বছর। প্রায় সবগুলো অতিমারীরই গড়ে ২-৩টি ঢেউ প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ববাসী; এবং সবগুলো ঢেউয়ের প্রথম দিকে মানুষের মৃত্যু হয়েছে বেশি। তবে আশার কথা হচ্ছে, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে দ্রুততার সঙ্গে যেমন সফল ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও প্রয়োগ সম্ভব হয়েছে; অন্যান্য ফ্লুর ক্ষেত্রে কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।

স্প্যানিশ ফ্লুর কোন ভ্যাকসিন ছিল না, এশিয়ান ফ্লু প্রতিরোধে শুধুমাত্র সামরিক বাহিনীর সদস্যদের কাছে সীমিত সংখ্যাক এবং হংকং ফ্লুর ২ কোটি ভ্যাকসিন যখন যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত সম্পন্ন করেছে; ততদিনে অতিমারীর তীব্রতা কমতে শুরু করেছে এবং ভ্যাকসিনের চাহিদা কমে গেছে। তবে কোভিড ভ্যাকসিন দ্রুত আবিষ্কার হলেও পৃথিবীর বহু দেশ এখনও ৮০ ভাগ মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনার মতো পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন পায়নি; তাই ভ্যকসিন স্বল্পতা এবং স্বাস্থ্যবিধি পালনে অবহেলা ইত্যাদি কারণে করোনা অতিমারী আরও কিছুটা দীর্ঘায়িত হওয়ার আশংকা করছেন গবেষক, বিজ্ঞানী, অণুজীব ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগন। নেচার ম্যাগাজিন বলেছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্থানীয়ভাবে ঊহফবসরপ হিসেবে করোনার থেকে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।

করোনার পূর্বে যতগুলো ফ্লু জাতীয় অতিমারীর আবির্ভাব হয়েছিল প্রায় সবক’টিই প্রাণঘাতী থেকে ক্রমান্বয়ে মৌসুমী ঠান্ডা কাশিতে পরিণত হয়েছে। করোনার বেলাতেও একই পরিনতি ঘটবে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। উপরন্তু প্রকৃতিও শেষ পর্যন্ত ভাইরাসের এমন সব ধরন সমূহকে টিকিয়ে রাখে, যারা আশ্রয়দাতাদের কম ক্ষতি সাধন করে থাকে। গবেষণালব্ধ তথ্য উপাত্ত থেকে দেখা যায় যে, শতকরা ২০ শতাংশ ঠান্ডা, সর্দি ও কাশি চারটি বিভিন্ন ধরনের করোনাভাইরাস কর্তৃক সংঘটিত হয়।

বর্তমান করোনাভাইরাস বা সার্স কোভি-২ একই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত হবে বলে ভাইরাস অণুজীব বিশেষজ্ঞগনের মতামত। স্প্যানিশ ফ্লু তে পৃথিবীর এক-তৃতিয়াংশ মানুষ আক্রান্ত হয় এবং মৃত্যুবরণ করে প্রায় ১০ কোটি। এই পৃথিবীর সবচেয়ে বিভীষিকাময় ভাইরাসও ২ বছরের মাথায় ১৯২০ সালে তীব্রতা হারিয়ে সাধারন ফ্লু তে পরিণত হয়। সুতরাং করোনাভাইরাসের একই পরিণতি হবে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও প্রয়োগের পর গত বছরের শেষ দিক থেকে দেশে দেশে করোনা রোগীর সংক্রমণ, তীব্রতা ও মৃত্যুর হার কমে আসতে শুরু করে। এটি বিশ্ববাসীর জন্য আশার আলো বলছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ।

১২ বছরের উপরে বয়সী ছেলেমেয়েদের দেহে সফলভাবে টিকা প্রদান শুরুর পর ৫ বছর এমনকি ৬ মাস বয়সী শিশুদের টীকার আওতায় আনার প্রচেষ্টা চলছে। সফলভাবে এটি সম্পন্ন হলে দেশে দেশে দ্রুতই করোনা প্রতিরোধক হার্ড ইমিউনিটি লাভ করবে বিশ্ববাসী। তাছাড়া করোনা চিকিৎসায় নানাবিধ নতুন নতুন আবিষ্কার ও অন্তর্ভুক্তি প্রতিরোধ মিছিলে নতুন জোয়ার আনবে বলে বিশেষজ্ঞদের দৃঢ় বিশ্বাস। ওমিক্রন এবং অদূর ভবিষ্যতে নতুন কোন বিধ্বংসী ধরনের আবির্ভাবই কেবল বিশ্ববাসীকে সাধারণ জীবনযাত্রায় ফিরে যাওয়ার অন্তরায় হতে পারে।

করোনার অন্ধকার গুহার শেষ প্রান্তে আলোর রশ্মি যেমন দেখা দিচ্ছে, তেমনি সাধারন জীবনাচারে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে শঙ্কা যে নেই তা নয়। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা হ্রাস, আশানুরূপভাবে ভ্যাকসিনের প্রতিরোধ বুহ্য গঠনে সময়সীমার কমতি, ভ্যাকসিন সরবরাহে ঘাটতি এবং করোনার নতুন নতুন ধরনের উদ্ভব এ আশার আলোকে স্তিমিত করে দিতে পারে।

গবেষকগণ বলছেন, করোনা পৃথিবী থেকে একেবারে বিদায় নিবে তেমনটির সম্ভাবনা কম। এমনটা হতে পারে যে, কতক দেশ হার্ড ইমিউনিটি লাভে সক্ষম হবে। কিছু কিছু দেশে বিভিন্ন প্রদেশ বা অঞ্চলের মানুষ করোনা প্রতিরোধে হার্ড ইমিউনিটি লাভ করবে। ভ্যাকসিন প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা এবং জনগণের ভ্যাকসিন গ্রহণে অনাগ্রহ কিছু কিছু দেশে হার্ড ইমিউনিটি লাভে সফলতার ঘাটতি দেখা দেবে। উপরন্ত নতুন ধরন উদ্ভবের বিষয়টিতো রয়েছেই। এহেন পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানীগণ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, উত্তর আমেরিকা এবং পশ্চিম ইউরোপের কিছু দেশ দ্রুত সময়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার দিকে যেতে সক্ষম হবে। নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য কিছু দেশও সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে। অধিকাংশ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশসমূহে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার বিষয়টি দীর্ঘায়িত হবে।

তবে জনস্বাস্থ্য বিষয়সমূহে উন্নতি ও সমৃদ্ধি; স্বাস্থ্যবিধির যথাযথ প্রয়োগও মেনে চলা; অধিকাংশ জনগণকে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসা এবং করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার নতুন নতুন উদ্ভাবনা করোনা রোগীদের উপসর্গে তীব্রতা হ্রাস, হাসপাতালমুখিতা ও মৃত্যু হ্রাসে সহায়তা করছে এবং করবে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশসমূহের জন্য এ সব ব্যবস্থাপনাই করোনা যুদ্ধের সফল সমাপ্তি এনে দিতে পারে।

গত ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বিশ্ববাসীকে আশার কথা শুনিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ২০২২ সালই হতে পারে করোনা যুদ্ধের শেষ পর্যায়। যদিও তিনি ওমিক্রন এবং ডেল্টা সুনামীর আশঙ্কার পুনরাবৃত্তি করে ভ্যাকসিন ও নতুন চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় বিশ্ববাসীকে সমতা ও সংহতি শক্তিশালীকরণ এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন। করোনা নামক শত্রুকে যুদ্ধের ময়দানে রেখে, প্রতিরোধ ব্যবস্থায় অবহেলা করে করোনার দীর্ঘস্থায়ী করা এবং নতুনভাবে সংক্রমণে সহায়তা ও মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ারই নামান্তর। বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় শীর্ষ সংস্থাসমূহ ও গবেষকগণের এ আশঙ্কা আমাদের মনে রাখতে হবে এবং করোনা প্রতিরোধের সব ব্যবস্থা গ্রহণ ও এ বিষয়ে আরও সচেতন আচরণ আবশ্যক।

[লেখক : সহকারী পরিচালক,

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল]

back to top