মোহাম্মদ আবু নোমান
সুখবর! গত ৯ জানুয়ারি রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে ঢাকা ওয়াসা আয়োজিত ‘বিল কালেকশন অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম একটি ‘দারুণ’ সুখবর শুনিয়েছেন। খবরটি হলো- ‘চলতি বছরে মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাবে’। মন্ত্রী বলেন, ‘গত একযুগে আমাদের গড় আয় ম্যাজিকের মতো বৃদ্ধি পেয়েছে...।’ কী আনন্দ! মন্ত্রী মহোদয়ের মাথাপিছু আয়ের হিসাবের সাথে জনগণের অভাব-অনটনের হিসাবের যোজন-যোজন ফারাক লক্ষণীয় নয় কী? এটা কি সৎলোকের আয়; না দুর্নীতিবাজ, ধান্দাবাজ, ঘুষখোর, লুটেরা, বা বেগমপাড়ার বাসিন্দাদের মাথাপিছু আয়? উক্ত খবরে সাধারণ মানুষের খুশি হওয়ার কিছু আছে কী?
এখনো মানুষ অভাব-অনটনে জর্জরিত হয়ে ভিটেমাটি বিক্রি করে, পরিবারের মায়া ত্যাগ করে একটু স্বচ্ছলতার আশায় নিজের জীবনকে বাজি রেখে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এখনো যে দেশের অনেক মানুষ তিন বেলা পেটপুড়ে খেতে পায় না। ডিগ্রি বা মাস্টার্স পাস হকার বা ফেরিওয়ালা বেশুমার। খাদ্যের অভাবে মা সন্তানের মুখে বিষ ঢেলে নিজেও বিষপান করছে, রেললাইনে ঝাঁপ দিচ্ছে। সে দেশে শুধু ‘সূচক’ কাজির কাগজে-কলমে নয়, আগে সর্বসাধারণের বেঁচে থাকার ন্যূনতম জীবন-মানের পর্যায় থাকাই কাম্য।
একজন দুর্নীতি করে মাসে আয় করে ১ লাখ টাকা, আর একজন কষ্ট করে আয় করে মাসে ১০ হাজার টাকা। উভয়ের মাসিক আয় ১১০০০০ হাজার টাকা। গড় আয় ৫৫০০০ হাজার টাকা। এটাই হলো বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের হিসাব। নানা ফন্দিফিকিরে দেশের কোটি কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে। নানা কৌশলে দেশ থেকে পাচার হচ্ছে। কয়েকজন পি কে হালদার, সাহেদ, মোতাজজেরুল ইসলাম ওরফে মিঠুদের সিন্ডিকেট, পাপিয়া-সম্রাটদের গং, এনু-রুপন বা রুবেল-বরকত ভ্রাতৃদ্বয়দের আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার দৃষ্টান্ত কারো অজানা নয়; কিন্তু অজানা শুধু কীভাবে আপনি-আমি অজান্তেই দিন দিন ধনী হয়ে উঠছি!
বর্তমানে একজন শ্রমজীবী, কাজের বুয়া, গার্মেন্ট ও কারখানার কর্মী, পরিবহন শ্রমিক, দোকান কর্মচারী, বেসরকারী বা প্রাইভেট চাকরিজীবী, নন এমপিও শিক্ষকদের আর্থিক অবস্থা খুবই শোচনীয়। দেশের পরিসংখ্যানে অর্থনীতি সচল, কিন্তু মধ্যবিত্তরা অচল। মাথাপিছু আয় বাড়ানোর চেয়ে দ্রব্যমূল্যের দাম কমান। মধ্যম ও নিম্নবিত্তের আয়ের মানুষগুলোকে বাঁচান। নইলে কাগজ-কলমের উন্নয়ন খুব একটা কাজে আসবে না।
বেশিরভাগ প্রাইভেট কোম্পানির বেতন বাড়েনি, অনেকের জব নেই। রাজনীতিবিদ ও সরকারি লোকজন ছাড়া কেউ নিশ্চিন্তে নেই। ৯০ ভাগ মানুষ সরকারি সুবিধার বাইরে এরপরও মাথাপিছু আয় বাড়ে কীভাবে? সূচক বা পরিসংখ্যান যদি তৈরি হয় ‘অ্যাজেন্ডা’ বাস্তবায়নের জন্য, অর্থাৎ, সরকারকে ভালো দেখানো বা গরিবি কম করে দেখানো, পরিসংখ্যান সেখানে গোয়েবলসের মতোই কাজ করে। মধ্যম ও নিম্নবিত্তের মাথাপিছু হিসাব করুন? পুরো দেশের মাথাপিছু আয় দেখে লাভ কী? পাপিয়া-সম্রাটদের আয়ের সাথে, রাস্তার পাশে ভাপাপিঠা বিক্রেতা কুলসুমের আয় হিসাব করা মিস জাজমেন্ট নয় কী?
বিভিন্ন পরিসংখ্যানে এসেছে, সমাজে ধনী দরিদ্রের ব্যবধান বেড়েছে। যাচ্ছেতাই করে ১০০ জনের অধিকার তছরুপ করে, দুই-একজনের শতকোটি টাকার মালিক হবার অসম, নিষ্ঠুর, অমানবিক হিংস্র প্রতিযোগিতা চলছে। এসব মাথাপিছু আয় সাধারণ জনগণের কাছে অকার্যকর, কষ্টদায়ক। গরিব আর মধ্যবিত্তরা উপলব্ধি করছেন জীবন কত কষ্টের। শতজনের সুখ কেড়ে নিয়ে দুই-চারজন তার সুখ একশগুণ বাড়াতে পারে, কিন্তু তাতে কমে যায় সুখীর সংখ্যা। তবে একশজনের সম্পদ একজন কেড়ে নিলে বাড়বে জিডিপির [ভেল্কিবাজির] অংক।
মধ্যম ও নিম্নবিত্তরা কি খেয়ে পরিবার নিয়ে দিন কাটাচ্ছে খোঁজ নিলে মাথাপিছু আয় নিয়ে আর নাচানাচি থাকবে না। ওষুধ, ডাক্তার, চাল, ডাল, পেয়াজ, সয়াবিন তেল কিনতে গিয়ে গরিব হচ্ছে মানুষ, আর সরকার পরিসংখ্যানের বিভ্রম নিয়ে সুখে বিভর। মাথাপিছু যে আয় [জিডিপি] বেড়েছে তা চোখে দেখা যায় না, তবে মাথার সামনে যে ব্যয় বেড়েছে তা কারো দেখা অজানা নয়। মাথাপিছু ব্যয় কত বেড়েছে, মাথাপিছু ঋণ কতো, সেটাও পরিসংখ্যানে আনতে হবে। মাথাপিছু আয়ের হিসাবের সাথে জনগণের অভাব-অনটনের হিসাবের আকাশ-পাতাল ফারাক। ধনীদের মাথাপিছু আয় যদি আলাদাভাবে প্রকাশ করা হতো তাহলে প্রকৃত চিত্র ধরা পড়তো। ১ কোটি ‘মাথা’ আর ১৯ কোটি ‘পিছু’। এই যদি হয় ‘মাথাপিছু’ আয়, তাহলে এটা হচ্ছে একটা নিঠুরতম এভারেজ রসিকতা! টাকার এ রোবোটিক হিসাবের নির্মম সত্য হলো- কেউ খেয়ে দেয়ে, উপভোগ করে রেখে যায় তার অদেখা ১৪ পুরুষের জন্য! আর কেউ তার শিশু সন্তানকে খেতে দিতে না পেরে আত্মহত্যা করে।
মন্ত্রীর পক্ষ থেকে মাথাপিছু আয়ের সুসংবাদ দেয়া হলেও, ইতিপূর্বে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) যৌথভাবে করা একটি জরিপ এসেছে, করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ দেশের ১৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ বা সোয়া ৩ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, একদিকে দেশের এক বড়সংখ্যক মানুষ যখন আরও দরিদ্র হচ্ছেন, সেই সময়ে দেশের মানুষের গড় আয় বাড়ছে। তাহলে মাথাপিছু আয় কার বেড়েছে? প্রশ্নটা এখানেই।
মন্ত্রী মহোদয়ের বাণী, ‘চলতি বছরে মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাবে’। নিঃসন্দেহে ভালো খবর কিন্তু সমস্যা করেছে জাতিসংঘের আরেকটি সংস্থার প্রতিবেদন। ইতোপূর্বে জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক বৈশ্বিক সুখ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- বিশ্বের সুখী দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ ১০ ধাপ পিছিয়ে গেছে। তাহলে কি জিডিপির সঙ্গে সুখের সম্পর্কটি ব্যাপক গোলমেলে। প্রবৃদ্ধি বাড়লে সুখ বা সন্তোষও বাড়বে; কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র একেবারেই উল্টো। এ দেশে একদিকে হরহর করে প্রবৃদ্ধি বাড়ে, অন্যদিকে সুখ কমে।
প্রচন্ড রৌদ্রের মধ্যে টিসিবির গাড়ি আসার আগে শত শত মানুষ একটু কম দামে কেনার জন্য যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন বোঝা যায় দেশের মাথাপিছু আয় কার কত টাকা হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতির প্রভাবে যারা তাদের পরিবারের ভরণ-পোষণ দিতে না পেরে আত্মহত্যা করছে, তারা কি এই জিডিপির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত? একজন সামর্থ্যবান যদি একটি আস্ত মুরগি একা খেয়ে থাকেন। অন্যদিকে তার বাড়ির পাশেই অন্য একজন অভাবের কারণে না খেয়ে মারা যান। এখন অর্থনীতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী পাশের বাড়ির লোকটি গরিব নন। কারণ হিসাবে উনি অর্ধেক মুরগি খেয়েই মারা গেছেন। হিসাবেও কোনো ভুল নেই। গল্পের ঘোড়া আকাশে উড়ে। বাস্তবের ঘোড়াটি রাস্তার পাশে ক্ষুধায়, তৃষ্ণায়, অবহেলায়, অনাদরে মৃত্যুর প্রহর গুনে।
মহামারিতে প্রতিটা জরিপই বলছে, কোভিডের মধ্যে বেকারত্ব, দারিদ্র্য বেড়েছে এবং আয় কমেছে। ব্র্যাকের জরিপে দেখা যায়, সোয়া পাঁচ কোটি মানুষের দৈনিক আয় ২ ডলারের নিচে নেমে এসেছে। বিবিএস জরিপ বলছে, করোনায় সারা দেশের মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশ। বিআইডিএস জরিপ অনুযায়ী, পোশাক, চামড়া, নির্মাণসহ বিভিন্ন খাতের ৮০ শতাংশ শ্রমিকেরই মজুরি কমেছে। পিপিআরসি এবং ব্র্যাকের জরিপ বলছে, গত করোনাকালীন সময়ে আড়াই কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। একই সময়ে প্রকাশিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের ফলাফল হচ্ছে, মহামারির মধ্যে দেশের ৫০ শতাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠানই ৭৬ শতাংশের ওপরে শ্রমিক ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছে। এত কিছুর পরও ‘চলতি বছরে মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাবে’। তার মানে আয়-রোজগার কাদের বাড়ছে, কিছুটা আন্দাজ করাই যায়। তাহলে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও উচ্চ দুর্নীতি পাশাপাশি চলছে?
বর্তমানে কতিপয় [সবাই নয়] সরকারি কর্মকর্তা, আমলা, নেতা, মন্ত্রী আর তাদের যারা চাটুকর এবং দুর্নীতির সাথে যারা জড়িত তাদের আয় সহস্রগুণ বেড়েছে। যারা সরকারি কর্মকর্তা আছেন তাদের বেতন [কারো উপরি আয়] ঠিক চলছে। যেমন আগে সরকারি কর্মকর্তা যার বেতন ছিল ৫০-৬০ হাজার তাদের বেতন কিন্তু কমেনি; কিন্তু যারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তাদের বেতন ২০-৩০ হাজার থেকে কমে এখন ১৫-২০ হাজার টাকা হয়ে গেছে। কার আমলে মানব উন্নয়ন সূচক কত বেড়েছে তা সাধারণ মানুষের দেখার বিষয় নয়। কে কত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করলো তাও সাধারণের জেনে লাভ নেই। জনগণ নিজে সারাদিন খেটে দু’মুঠো ডাল-ভাত খেয়ে আর নিজের পরিবার পরিজনের নিরাপত্তা নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়।
যারা নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে অবৈধ অর্থ উপার্জন করছে, তাদের রয়েছে ভবিষ্যতের শঙ্কা, রাজেনৈতিক অস্থিরতা তথা রাজনৈতিক শঙ্কা, দেশের নিম্ন জীবনযাত্রার মানে অনাগ্রহ, আর সবচেয়ে বড় কথা দেশপ্রেমের অভাব। দেশ রসাতলে যায় যাক, সপরিবারে এক সময় বিদেশ পাড়ি দিতে পারলেই হলো। সবকিছু দেখে বলতে হয়, সব সরকারেরই শাসকশ্রেণী এ দেশের কেউ নয়। তারা সেই ইংরেজদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তারাও এদেশ লুটে তাদের দেশে নিয়ে যেত, আজ এরাও লুটে তাদের দেশেই পাঠাচ্ছে। মাথাপিছু আয়ের হিসাবটা বরাবরই লেজেগোবরে। এ হিসাবে সোনালী, জনতা ও ফারমার্স ব্যাংক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, হল-মার্ক, যুবক, ডেসটিনি, ই-ভ্যালি এমনকি শেয়ারবাজার লুটেরাদের কুক্ষিগত সম্পদকেও সমাজের দশজনের গড় সম্পদ বলে হিসাব করা হয়। এতে হকার, রিকশাচালক, গার্মেন্টস শ্রমিক, বেকার সবাইকে মধ্যবিত্ত দেখায়। আর মাঝখান থেকে লুটেরাদের ফুলে-ফেঁপে ওঠার দৃশ্যটা ঢাকা পড়ে যায়।
স্বাধীনতাপরবর্তী গত পাঁচ দশকে আমরা আরো বড় লক্ষ্যে পৌঁছে যেতাম, যদি আমরা দুর্নীতিটা দূর করতে পারতাম! মাথাপিছু আয় বাড়ার খবরটি নিঃসন্দেহে ভালো খবর। সরকারকে আয়ের বৈষম্যের ব্যাপারটিও লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের লক্ষ্য হতে হবে সুষম সামাজিক উন্নয়ন। অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার সাথে সাথে বাংলাদেশ একটি সামাজিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত হোক- এটাই আমাদের কামনা।
মোহাম্মদ আবু নোমান
বৃহস্পতিবার, ২০ জানুয়ারী ২০২২
সুখবর! গত ৯ জানুয়ারি রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে ঢাকা ওয়াসা আয়োজিত ‘বিল কালেকশন অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম একটি ‘দারুণ’ সুখবর শুনিয়েছেন। খবরটি হলো- ‘চলতি বছরে মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাবে’। মন্ত্রী বলেন, ‘গত একযুগে আমাদের গড় আয় ম্যাজিকের মতো বৃদ্ধি পেয়েছে...।’ কী আনন্দ! মন্ত্রী মহোদয়ের মাথাপিছু আয়ের হিসাবের সাথে জনগণের অভাব-অনটনের হিসাবের যোজন-যোজন ফারাক লক্ষণীয় নয় কী? এটা কি সৎলোকের আয়; না দুর্নীতিবাজ, ধান্দাবাজ, ঘুষখোর, লুটেরা, বা বেগমপাড়ার বাসিন্দাদের মাথাপিছু আয়? উক্ত খবরে সাধারণ মানুষের খুশি হওয়ার কিছু আছে কী?
এখনো মানুষ অভাব-অনটনে জর্জরিত হয়ে ভিটেমাটি বিক্রি করে, পরিবারের মায়া ত্যাগ করে একটু স্বচ্ছলতার আশায় নিজের জীবনকে বাজি রেখে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এখনো যে দেশের অনেক মানুষ তিন বেলা পেটপুড়ে খেতে পায় না। ডিগ্রি বা মাস্টার্স পাস হকার বা ফেরিওয়ালা বেশুমার। খাদ্যের অভাবে মা সন্তানের মুখে বিষ ঢেলে নিজেও বিষপান করছে, রেললাইনে ঝাঁপ দিচ্ছে। সে দেশে শুধু ‘সূচক’ কাজির কাগজে-কলমে নয়, আগে সর্বসাধারণের বেঁচে থাকার ন্যূনতম জীবন-মানের পর্যায় থাকাই কাম্য।
একজন দুর্নীতি করে মাসে আয় করে ১ লাখ টাকা, আর একজন কষ্ট করে আয় করে মাসে ১০ হাজার টাকা। উভয়ের মাসিক আয় ১১০০০০ হাজার টাকা। গড় আয় ৫৫০০০ হাজার টাকা। এটাই হলো বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের হিসাব। নানা ফন্দিফিকিরে দেশের কোটি কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে। নানা কৌশলে দেশ থেকে পাচার হচ্ছে। কয়েকজন পি কে হালদার, সাহেদ, মোতাজজেরুল ইসলাম ওরফে মিঠুদের সিন্ডিকেট, পাপিয়া-সম্রাটদের গং, এনু-রুপন বা রুবেল-বরকত ভ্রাতৃদ্বয়দের আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার দৃষ্টান্ত কারো অজানা নয়; কিন্তু অজানা শুধু কীভাবে আপনি-আমি অজান্তেই দিন দিন ধনী হয়ে উঠছি!
বর্তমানে একজন শ্রমজীবী, কাজের বুয়া, গার্মেন্ট ও কারখানার কর্মী, পরিবহন শ্রমিক, দোকান কর্মচারী, বেসরকারী বা প্রাইভেট চাকরিজীবী, নন এমপিও শিক্ষকদের আর্থিক অবস্থা খুবই শোচনীয়। দেশের পরিসংখ্যানে অর্থনীতি সচল, কিন্তু মধ্যবিত্তরা অচল। মাথাপিছু আয় বাড়ানোর চেয়ে দ্রব্যমূল্যের দাম কমান। মধ্যম ও নিম্নবিত্তের আয়ের মানুষগুলোকে বাঁচান। নইলে কাগজ-কলমের উন্নয়ন খুব একটা কাজে আসবে না।
বেশিরভাগ প্রাইভেট কোম্পানির বেতন বাড়েনি, অনেকের জব নেই। রাজনীতিবিদ ও সরকারি লোকজন ছাড়া কেউ নিশ্চিন্তে নেই। ৯০ ভাগ মানুষ সরকারি সুবিধার বাইরে এরপরও মাথাপিছু আয় বাড়ে কীভাবে? সূচক বা পরিসংখ্যান যদি তৈরি হয় ‘অ্যাজেন্ডা’ বাস্তবায়নের জন্য, অর্থাৎ, সরকারকে ভালো দেখানো বা গরিবি কম করে দেখানো, পরিসংখ্যান সেখানে গোয়েবলসের মতোই কাজ করে। মধ্যম ও নিম্নবিত্তের মাথাপিছু হিসাব করুন? পুরো দেশের মাথাপিছু আয় দেখে লাভ কী? পাপিয়া-সম্রাটদের আয়ের সাথে, রাস্তার পাশে ভাপাপিঠা বিক্রেতা কুলসুমের আয় হিসাব করা মিস জাজমেন্ট নয় কী?
বিভিন্ন পরিসংখ্যানে এসেছে, সমাজে ধনী দরিদ্রের ব্যবধান বেড়েছে। যাচ্ছেতাই করে ১০০ জনের অধিকার তছরুপ করে, দুই-একজনের শতকোটি টাকার মালিক হবার অসম, নিষ্ঠুর, অমানবিক হিংস্র প্রতিযোগিতা চলছে। এসব মাথাপিছু আয় সাধারণ জনগণের কাছে অকার্যকর, কষ্টদায়ক। গরিব আর মধ্যবিত্তরা উপলব্ধি করছেন জীবন কত কষ্টের। শতজনের সুখ কেড়ে নিয়ে দুই-চারজন তার সুখ একশগুণ বাড়াতে পারে, কিন্তু তাতে কমে যায় সুখীর সংখ্যা। তবে একশজনের সম্পদ একজন কেড়ে নিলে বাড়বে জিডিপির [ভেল্কিবাজির] অংক।
মধ্যম ও নিম্নবিত্তরা কি খেয়ে পরিবার নিয়ে দিন কাটাচ্ছে খোঁজ নিলে মাথাপিছু আয় নিয়ে আর নাচানাচি থাকবে না। ওষুধ, ডাক্তার, চাল, ডাল, পেয়াজ, সয়াবিন তেল কিনতে গিয়ে গরিব হচ্ছে মানুষ, আর সরকার পরিসংখ্যানের বিভ্রম নিয়ে সুখে বিভর। মাথাপিছু যে আয় [জিডিপি] বেড়েছে তা চোখে দেখা যায় না, তবে মাথার সামনে যে ব্যয় বেড়েছে তা কারো দেখা অজানা নয়। মাথাপিছু ব্যয় কত বেড়েছে, মাথাপিছু ঋণ কতো, সেটাও পরিসংখ্যানে আনতে হবে। মাথাপিছু আয়ের হিসাবের সাথে জনগণের অভাব-অনটনের হিসাবের আকাশ-পাতাল ফারাক। ধনীদের মাথাপিছু আয় যদি আলাদাভাবে প্রকাশ করা হতো তাহলে প্রকৃত চিত্র ধরা পড়তো। ১ কোটি ‘মাথা’ আর ১৯ কোটি ‘পিছু’। এই যদি হয় ‘মাথাপিছু’ আয়, তাহলে এটা হচ্ছে একটা নিঠুরতম এভারেজ রসিকতা! টাকার এ রোবোটিক হিসাবের নির্মম সত্য হলো- কেউ খেয়ে দেয়ে, উপভোগ করে রেখে যায় তার অদেখা ১৪ পুরুষের জন্য! আর কেউ তার শিশু সন্তানকে খেতে দিতে না পেরে আত্মহত্যা করে।
মন্ত্রীর পক্ষ থেকে মাথাপিছু আয়ের সুসংবাদ দেয়া হলেও, ইতিপূর্বে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) যৌথভাবে করা একটি জরিপ এসেছে, করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ দেশের ১৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ বা সোয়া ৩ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, একদিকে দেশের এক বড়সংখ্যক মানুষ যখন আরও দরিদ্র হচ্ছেন, সেই সময়ে দেশের মানুষের গড় আয় বাড়ছে। তাহলে মাথাপিছু আয় কার বেড়েছে? প্রশ্নটা এখানেই।
মন্ত্রী মহোদয়ের বাণী, ‘চলতি বছরে মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাবে’। নিঃসন্দেহে ভালো খবর কিন্তু সমস্যা করেছে জাতিসংঘের আরেকটি সংস্থার প্রতিবেদন। ইতোপূর্বে জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক বৈশ্বিক সুখ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- বিশ্বের সুখী দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ ১০ ধাপ পিছিয়ে গেছে। তাহলে কি জিডিপির সঙ্গে সুখের সম্পর্কটি ব্যাপক গোলমেলে। প্রবৃদ্ধি বাড়লে সুখ বা সন্তোষও বাড়বে; কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র একেবারেই উল্টো। এ দেশে একদিকে হরহর করে প্রবৃদ্ধি বাড়ে, অন্যদিকে সুখ কমে।
প্রচন্ড রৌদ্রের মধ্যে টিসিবির গাড়ি আসার আগে শত শত মানুষ একটু কম দামে কেনার জন্য যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন বোঝা যায় দেশের মাথাপিছু আয় কার কত টাকা হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতির প্রভাবে যারা তাদের পরিবারের ভরণ-পোষণ দিতে না পেরে আত্মহত্যা করছে, তারা কি এই জিডিপির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত? একজন সামর্থ্যবান যদি একটি আস্ত মুরগি একা খেয়ে থাকেন। অন্যদিকে তার বাড়ির পাশেই অন্য একজন অভাবের কারণে না খেয়ে মারা যান। এখন অর্থনীতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী পাশের বাড়ির লোকটি গরিব নন। কারণ হিসাবে উনি অর্ধেক মুরগি খেয়েই মারা গেছেন। হিসাবেও কোনো ভুল নেই। গল্পের ঘোড়া আকাশে উড়ে। বাস্তবের ঘোড়াটি রাস্তার পাশে ক্ষুধায়, তৃষ্ণায়, অবহেলায়, অনাদরে মৃত্যুর প্রহর গুনে।
মহামারিতে প্রতিটা জরিপই বলছে, কোভিডের মধ্যে বেকারত্ব, দারিদ্র্য বেড়েছে এবং আয় কমেছে। ব্র্যাকের জরিপে দেখা যায়, সোয়া পাঁচ কোটি মানুষের দৈনিক আয় ২ ডলারের নিচে নেমে এসেছে। বিবিএস জরিপ বলছে, করোনায় সারা দেশের মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশ। বিআইডিএস জরিপ অনুযায়ী, পোশাক, চামড়া, নির্মাণসহ বিভিন্ন খাতের ৮০ শতাংশ শ্রমিকেরই মজুরি কমেছে। পিপিআরসি এবং ব্র্যাকের জরিপ বলছে, গত করোনাকালীন সময়ে আড়াই কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। একই সময়ে প্রকাশিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের ফলাফল হচ্ছে, মহামারির মধ্যে দেশের ৫০ শতাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠানই ৭৬ শতাংশের ওপরে শ্রমিক ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছে। এত কিছুর পরও ‘চলতি বছরে মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাবে’। তার মানে আয়-রোজগার কাদের বাড়ছে, কিছুটা আন্দাজ করাই যায়। তাহলে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও উচ্চ দুর্নীতি পাশাপাশি চলছে?
বর্তমানে কতিপয় [সবাই নয়] সরকারি কর্মকর্তা, আমলা, নেতা, মন্ত্রী আর তাদের যারা চাটুকর এবং দুর্নীতির সাথে যারা জড়িত তাদের আয় সহস্রগুণ বেড়েছে। যারা সরকারি কর্মকর্তা আছেন তাদের বেতন [কারো উপরি আয়] ঠিক চলছে। যেমন আগে সরকারি কর্মকর্তা যার বেতন ছিল ৫০-৬০ হাজার তাদের বেতন কিন্তু কমেনি; কিন্তু যারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তাদের বেতন ২০-৩০ হাজার থেকে কমে এখন ১৫-২০ হাজার টাকা হয়ে গেছে। কার আমলে মানব উন্নয়ন সূচক কত বেড়েছে তা সাধারণ মানুষের দেখার বিষয় নয়। কে কত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করলো তাও সাধারণের জেনে লাভ নেই। জনগণ নিজে সারাদিন খেটে দু’মুঠো ডাল-ভাত খেয়ে আর নিজের পরিবার পরিজনের নিরাপত্তা নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়।
যারা নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে অবৈধ অর্থ উপার্জন করছে, তাদের রয়েছে ভবিষ্যতের শঙ্কা, রাজেনৈতিক অস্থিরতা তথা রাজনৈতিক শঙ্কা, দেশের নিম্ন জীবনযাত্রার মানে অনাগ্রহ, আর সবচেয়ে বড় কথা দেশপ্রেমের অভাব। দেশ রসাতলে যায় যাক, সপরিবারে এক সময় বিদেশ পাড়ি দিতে পারলেই হলো। সবকিছু দেখে বলতে হয়, সব সরকারেরই শাসকশ্রেণী এ দেশের কেউ নয়। তারা সেই ইংরেজদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তারাও এদেশ লুটে তাদের দেশে নিয়ে যেত, আজ এরাও লুটে তাদের দেশেই পাঠাচ্ছে। মাথাপিছু আয়ের হিসাবটা বরাবরই লেজেগোবরে। এ হিসাবে সোনালী, জনতা ও ফারমার্স ব্যাংক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, হল-মার্ক, যুবক, ডেসটিনি, ই-ভ্যালি এমনকি শেয়ারবাজার লুটেরাদের কুক্ষিগত সম্পদকেও সমাজের দশজনের গড় সম্পদ বলে হিসাব করা হয়। এতে হকার, রিকশাচালক, গার্মেন্টস শ্রমিক, বেকার সবাইকে মধ্যবিত্ত দেখায়। আর মাঝখান থেকে লুটেরাদের ফুলে-ফেঁপে ওঠার দৃশ্যটা ঢাকা পড়ে যায়।
স্বাধীনতাপরবর্তী গত পাঁচ দশকে আমরা আরো বড় লক্ষ্যে পৌঁছে যেতাম, যদি আমরা দুর্নীতিটা দূর করতে পারতাম! মাথাপিছু আয় বাড়ার খবরটি নিঃসন্দেহে ভালো খবর। সরকারকে আয়ের বৈষম্যের ব্যাপারটিও লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের লক্ষ্য হতে হবে সুষম সামাজিক উন্নয়ন। অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার সাথে সাথে বাংলাদেশ একটি সামাজিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত হোক- এটাই আমাদের কামনা।