alt

উপ-সম্পাদকীয়

কোন পথে আগামী ভারত

গৌতম রায়

: শুক্রবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২২

কোভিডের তৃতীয় ঢেউ এসে ভারতের আর্থ-সামাজিক অবস্থার যে ভয়ঙ্কর পর্যায় তৈরি করেছে-তা নিয়ে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছে সঠিক খবরটি সঠিক সময়ে পৌঁছচ্ছে, এমনটা জোর গলায় বলতে পারা যায় না। একথা ঠিক যে, কোভিডের প্রথম বা দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়কালে অপরিকল্পিত লকডাউনের কারণে যে ধরনের সংকট তৈরি হয়েছিল, হঠাৎ করে দেখলে এই তৃতীয় ঢেউয়ের সময়কালের সঙ্গে তার কিন্তু আকাশ-পাতাল ফারাক দেখা যাবে। আমাদের চোখে পড়বে, অপরিকল্পিত লকডাউনের কারণে যে পরিযায়ী শ্রমিকদের ভেতর একটা ভয়ঙ্কর রকমের সংকট নেমে এসেছিল, তার মোকাবিলায় ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কখনো কোনো রকম পরিকল্পিত ভাবনা নেয়া হয়নি। বিভিন্ন রাজ্য সরকার গুলি ও তাদের নিজের নিজের রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফিরিয়ে আনবার জন্য যে ধরনের বাস্তব পরিকল্পনা দরকার, তা নিতে সক্ষম হননি।

বামপন্থিরা তাদের সীমিত পরিসরে ভেতরে চেষ্টা করেছেন। সর্বক্ষেত্রে সফল হয়েছেন এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। কিন্তু তবু তারা যে চেষ্টা করেছেন। সেটাই কিন্তু সেই সময় নিরিখে অনেকটা ছিল। সেই চেষ্টাটাই কিন্তু অবাম রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে ছিল না।

প্রথম বা দ্বিতীয় ঢেউয়ের এই যে পরিস্থিতি, তার সঙ্গে এই বর্তমান তৃতীয় ধাপের সময়কালের পরিস্থিতির তফাতটা হলো এই যে; একদম কেন্দ্রীয়ভাবে লকডাউন ঘোষিত হয়নি এই তৃতীয় ঢেউয়ের সময়কালে। বিভিন্ন রাজ্যে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন দিন হচ্ছে লকডাউন। নানা টালবাহানার পর বিভিন্ন জায়গায় লোকাল ট্রেনগুলো চালু হলেও এই তৃতীয় ঢেউয়ের সময়কালে সেই লোকাল ট্রেনগুলোর চলাচল অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। যদি আমরা পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিত দেখি, তাহলে আমাদের মনে রাখা দরকার যে, পশ্চিমবঙ্গের অসংগঠিত শ্রমিকদের একটা বড় অংশ কিন্তু রেল ও পরিবহন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে যে হকারি, তার ওপর নির্ভর করে জীবন নির্বাহ করে। দীর্ঘদিন ধরেই কেন্দ্রীয় সরকারের পরিচালনাধীন রেলমন্ত্রণালয় রেলকে কেন্দ্র করে যে হকারি ব্যবস্থা, সেটাকে তুলে দেয়ার জন্য তৎপর হয়েছে। কোভিডের আগের থেকেই এই তৎপরতা কেন্দ্রীয় সরকারের শুরু করেছে। কোভিড চলাকালীন তৎপরতা অত্যন্ত বেশি রকমের সক্রিয় হয়েছে, এবং তা এখন প্রয়োগের দিকে নিয়ে যেতে কেন্দ্রীয় সরকার ভয়ঙ্কর রকমভাবে এগিয়ে চলেছে।

ভারত সরকারের রাজনৈতিক পদক্ষেপের দরুন পশ্চিমবঙ্গের অসংগঠিত শিল্পের সঙ্গে জড়িত একটা বড় অংশের মানুষ, অর্থনৈতিক সংকটের ভেতরেই, রুটি-রুজির একটা বড় রকমের সংকটের জায়গায় এসে পড়েছেন। এই সংকটকে ঘিরে বামপন্থি রাজনীতিকরা তাদের নানা ধরনের প্রচার কর্মসূচি নিচ্ছেন। প্রতিবাদ করছেন। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে বামপন্থিদের ক্ষমতা এখন এতটাই সীমাবদ্ধ যে, এটাকে প্রতিরোধ করার জন্য যে ধরনের রাজনৈতিক আন্দোলন করা দরকার, সেটা তারা করতে পারছেন না।

তবে তাদের এই আন্দোলনগুলো র একটা গুরুত্ব এই ক্ষেত্রে অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হলো অ-বাম, অ-বিজেপি রাজনৈতিক দলগুলো এই কর্মসংকোচনের কর্মকান্ড কে ঘিরে সেভাবে রাজনৈতিক কোন আন্দোলনের পথেই যায়নি। প্রতিরোধের জন্য ভাবনা চিন্তা তো দূরের কথা। কেন রেলকে হকারমুক্ত করার নাম করে, রেলে হকারি করে, বা রেলস্টেশনে হকারি করে, যে একটা বড় অংশের অসংগঠিত শ্রমিকদের পেটের ভাত জোগাড় হয়, সেই মানুষদের ভাতের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের রেলমন্ত্রক, সংসদে আজ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের কোন সাংসদ তা নিয়ে একটি প্রশ্ন পর্যন্ত করেননি।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি দীর্ঘদিন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল পরিচালনাধীন সরকারের রেল মন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায়, তিনি কিন্তু আজ পর্যন্ত রেল হকারদের এই গণহারে পেশা থেকে উচ্ছেদ করার চেষ্টার বিরুদ্ধে একটা শব্দ উচ্চারণ করেননি। এইরকম একটা পরিস্থিতির ভেতর দিয়েই কোভিডের এই তৃতীয় ঝড়ের সময়কালে বাজার অর্থনীতির উগ্র সমর্থক কেন্দ্রীয় সরকার, ভারতের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক, সব প্রেক্ষাপটেই একটা কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে চাইছেন।

যেমন সংকট তেতাল্লিশের মন্বন্তর সময়কালে ব্রিটিশ তৈরি করেছিল, ফজলুল হকের মন্ত্রিসভার মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তৈরি করেছিলেন। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্মের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হেনস্তা করতে ১৯৭৪ সালে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করে পা আমেরিকা সাহায্যে বাংলাদেশের মাটিতে সংগঠিত করেছিল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, তেমনই একটা সংকট ভারতের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে তৈরি করার লক্ষ্যে কিন্তু কেন্দ্রে আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির নেতৃত্বাধীন নরেন্দ্র মোদি সরকার গোটা দেশের বুকে নামিয়ে আনতে চলেছে।

অতি সাম্প্রতিক খবর হলো; উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনের মুখে এলাহাবাদ, যেটাকে ‘প্রয়াগরাজ’ নামকরণ করে একটা ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার উগ্র প্রয়োগ ভূমি হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে গোটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি, সেই এলাহাবাদে রেলের নিয়োগ কেন্দ্র করে, ছাত্রদের উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথের পুলিশ যেভাবে মোকাবিলা করতে চেয়েছে, যার ভিডিওচিত্র সামাজিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, তা দেখলে আমাদের শিউরে উঠতে হয়।

উত্তরপ্রদেশের বিধানসভাসহ পাঞ্জাব, গুজরাট ইত্যাদি রাজ্য বিধানসভার ভোট দরজায় কড়া নাড়ছে। কৃষি আইন সংশোধন ঘিরে নরেন্দ্র মোদি সরকারের যে ভয়ঙ্কর মানবতাবিরোধী অবস্থান, তার বিরুদ্ধে প্রায় এক বছর ধরে গোটা দেশের কৃষক সমাজ, বিশেষ করে উত্তর ভারতের কৃষক সমাজের সম্মিলিত প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, যার দরুন আইন দুটি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। এই আন্দোলনের প্রভাব কিন্তু কেবল পাঞ্জাব নয়, উত্তরপ্রদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেও অত্যন্ত উত্তপ্ত করে রেখেছে। সাধারণ মানুষ, যাদের কোনো না কোনোভাবে কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে সংযোগ, যারা একটা সময়ে নানা ধরনের প্রভাব প্রতিপত্তি প্ররোচনা ইত্যাদির দরুন বিজেপির ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির প্রতি আসক্ত হয়েছিল, সেসব মানুষ ও কিন্তু এখন বিজেপির প্রতি ভয়ঙ্কর রকমের বিরক্ত হয়ে উঠেছেন।

আগামী নির্বাচনে এই অংশের মানুষ কি অবস্থান নেবে তা নিয়ে কিন্তু বিজেপিসহ গোটা রাজনৈতিক হিন্দু সম্প্রদায়ের শিবিরের ভেতরে মাথাব্যথা খুব তীব্র হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এই রকম একটা পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের জায়গায় পৌঁছে দিয়ে, ভোট বৈতরণী পার হতে চাইছে রাজনৈতিক হিন্দুরা। মন্দির মসজিদের রাজনীতির বাইরে উত্তরপ্রদেশে কোন ও অ-বাম রাজনৈতিক দলই কিন্তু পা ফেলতে পারছে না।

বামপন্থিরা মন্দির মসজিদ রাজনীতি কখনোই করেন না। তবুও তারা উত্তরপ্রদেশে এককভাবে লড়বার প্রশ্নে যে অবস্থান নেয়ার আভাস দিচ্ছেন, তা ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির পক্ষে কতখানি সহায়ক হবে, তা নিয়ে খুব বেশি রকমের সংশয়ের পরিবেশ ইতোমধ্যেই তৈরি হয়েছে সিপিআই (এম) তাদের কেন্দ্রীয় স্তরে আলোচনায় ঠিক করেছে, বিভিন্ন রাজ্যে, সেই সেই রাজ্যের প্রাদেশিক শাখা, সেখানকার রাজনীতির নানা ধরনের সমীকরণ মাথায় রেখে, নিজের নিজের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। সিপিআই (এম) এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এই সিদ্ধান্ত নেয়ার ফলে উত্তরপ্রদেশে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে মুলায়ম সিং যাদব, অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে সিপিআই (এম) এর একটা নির্বাচনী সখ্যতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমশ উজ্জ্বল হচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গে এই সিপিআই (এম) ই কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়ে ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। সেই সময়েই কেরালা বিধানসভা নির্বাচনে, সেই রাজ্যের সিপিআই (এম) লড়েছিল কংগ্রেস দলের বিরুদ্ধে। আবার উত্তরপ্রদেশের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে বামপন্থিদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনা ক্রমশ উঠে আসছে। বামপন্থিদের এই অবস্থান ভারতবর্ষের বুকে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে লড়াইয়ের প্রশ্নে, রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে মোকাবিলা করার প্রশ্নে, কতখানি ইতিবাচক হবে ঘোরতর সংশয় রয়েছে।

ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে কংগ্রেস খাতায়-কলমে যাই অবস্থানই নিক না কেন, প্রয়োগজনিত ক্ষেত্রে তাদের ঢালাও প্রশংসাপত্র দেয়া যায় না, মনটাই বলতে হয়। আবার অল্প কিছুদিন আগেই আমরা দেখেছি, একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে মূলায়ম সিং যাদব এবং আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের অন্তরঙ্গ কথোপকথনের সময়কালের ছবি। সেটি সামাজিক গণমাধ্যমে ছবি ছড়িয়ে পড়ে। মূলায়ম, অখিলেশ এবং তাদের সমাজবাদী পার্টির যে ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের কাগুজে প্রচার রয়েছে, তা ঘিরে সংসারটা আরও তীব্র হয়েছে। কারণ; এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের প্রায় বিদায়লগ্নে উত্তরপ্রদেশ এবং দিল্লি লাগোয়া মুজাফফরনগরে যে ভয়াবহ সামাজিক, ধর্মীয় মেরুকরণের ভিত্তিতে আরএসএসের সংঘটিত দাঙ্গা হয়েছিল, সেই দাঙ্গা দমনে সেই সময়ে উত্তরপ্রদেশের ক্ষমতায় থাকা অখিলেশ যাদবের নেতৃত্বাধীন সমাজবাদী পার্টির সরকার আদৌ কোনো ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেনি। সংখ্যালঘু মুসলমানদের জান-মালের নিরাপত্তার প্রশ্নে অখিলেশ যাদব সরকারের চরম ব্যর্থতা মুজাফফরনগর দাঙ্গার সময় আমরা প্রায় প্রতিদিন লক্ষ করেছিলাম। আর এই মুজাফফরনগর দাঙ্গাকে কিন্তু এক ধরনের ইনভেস্টমেন্টের মতো কাজে লাগিয়ে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনকে ব্যবহার করেছিল আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি।

একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকার তৈরি করার পেছনে মুজাফফরনগর দাঙ্গার একটা বড় ভূমিকা আছে। সেই পরিবেশ তৈরি করে দেয়ার ক্ষেত্রে অখিলেশ যাদবের যে অবদান রয়েছে, তাকে আমরা কখনো কোনো অবস্থাতেই অস্বীকার করতে পারি না।

ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের জমি উত্তরাধিকার ঘিরে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট, বিজেপি দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর, যে রায় দান করে, সেই সময় অখিলেশ যাদব, মুলায়ম সিং যাদব স, মাজবাদী পার্টির নেতারা নীরব ভূমিকা পালন করেছিলেন। সংখ্যালঘুর অধিকার অধিকার রক্ষা করার ব্যাপারে মূলায়ম সিং যাদব অতীতে যে ধরনের কথা প্রচারের স্বার্থে বলতেন, বাবরি মসজিদের জমি বিতর্কে কোর্টের রায়দানের পর কিন্তু সেই ধরনের কোন কথা তার মুখ দিয়ে, বা তার পুত্র অখিলেশ যাদবের মুখ দিয়ে আর আমরা শুনতে পাইনি।

পবিত্র মসজিদের জমি র কর্তৃত্ব রাম মন্দিরের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়ার পর, পরিপূর্ণ ইসলামবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মসজিদকে স্থানান্তরিত করার জন্য যে আলাদা জায়গায় জমির সংস্থানের কথা সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়, সেই সম্পর্কেও কিন্তু মুলায়ম সিং যাদব বা তার দলের উচ্চস্তরের নেতাদের কারো মুখ থেকে একটা শব্দ আমরা শুনতে পাওয়া যায়নি।

ভারত সরকারের রাজনৈতিক পদক্ষেপের দরুন পশ্চিমবঙ্গের অসংগঠিত শিল্পের সঙ্গে জড়িত একটা বড় অংশের মানুষ, অর্থনৈতিক সংকটের ভেতরেই, রুটি-রুজির একটা বড় রকমের সংকটের জায়গায় এসে পড়েছেন

পবিত্র ইসলামে মসজিদ স্থানান্তরের কোন স্থান নেই। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদের জন্য বিকল্প জমির যে কথা বলেছেন, সে কথা কেবল ইসলামবিরোধী নয়, বা মুসলিম পার্সোনাল ল কে অমান্য করছে তাই নয়, ১৯৪৭ সালে ইংরেজদের কাছ থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়কালে সংখ্যালঘুর অধিকার সংরক্ষণজনিত যে অঙ্গীকার ভারতের তৎকালীন জাতীয় স্তরের নেতারা করেছিলেন, সেই অঙ্গীকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়েছে সেই রায়ে। অথচ এ সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর ভারতের প্রায় সবকটি রাজনৈতিক দলের মতোই মূলায়ম সিং যাদব ও আশ্চর্যজনক নীরবতা পালন করে গিয়েছেন।

উত্তরপ্রদেশ জুড়ে এই রায়কে ঘিরে মুসলমান সমাজের ভেতরে যে ধরনের নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, সেই অন্ধকার অবস্থা থেকে মুসলমান সমাজকে বের করে এনে, তাদের সামাজিক সুস্থতার জন্য একটি শব্দও কিন্তু সমাজবাদী পার্টি উচ্চারণ করেনি।

তাই আজকের দিনে দাঁড়িয়ে উত্তরপ্রদেশের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের মুখে উগ্র হিন্দু সন্ত্রাসী আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির মোকাবিলায় এই সমাজবাদী পার্টির প্রকৃত কতখানি আন্তরিক ভূমিকা পালন করবে, তা ঘিরে কিন্তু ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ বিবেক যথেষ্ট সংশয়ী। করোনার তৃতীয় ঢেইয়ের ভেতরে গোটা দেশের গরিব মানুষ যখন অর্থনৈতিকভাবে আরও বেশি বেশি করে একটা প্রান্তিক জায়গায় এসে দাঁড়াচ্ছে, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের গোল্লায় পাঠানোর জন্য যখন বাজার অর্থনীতির উগ্র সমর্থক কেন্দ্রের বিজেপি সরকার চেষ্টার ত্রুটি করছে না, এইরকম একটা সময়ে উত্তরপ্রদেশ সহ পাঞ্জাব, গুজরাট, গোয়া ইত্যাদি যে পাঁচটি রাজ্যের ভোট হতে চলেছে, তা ভারতের আগামী দিনের রাজনীতিকে কতখানি প্রভাবিত করবে, তা ভাবা দরকার।

বিজেপি যদি উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখন্ডে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারে, তাহলে আগামী ২০২৪ এ ভারতের লোকসভা নির্বাচনে একটা মাইলেজ পেতে পারে বলে ধারণা করতে পারা যায়। আর যদি উত্তরপ্রদেশের তারা ক্ষমতাচ্যুত হয়, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপির ফিরে আসা ঘিরে এখনি একটা সংশয়ের পরিবেশ তৈরি হবে। আর এ সংশয়ের পরিবেশ যে ইতোমধ্যেই তৈরি হচ্ছে-তা নিয়ে কিন্তু আরএসএসের মধ্যে কোনো সংশয় রয়েছে বলে মনে হয় না।

আরএসএস ইতোমধ্যেই মোদির বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে। এমনকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, সেই স্বপ্নের পেছনে একটা আরএসএসের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত নেই, একথা কিন্তু জোর দিয়ে বলতে পারা যায় না। কারণ; বিজেপি যদি একক ক্ষমতায় ২০২৪ এ ফিরে আসতে না পারে, সে ক্ষেত্রে অটলবিহারী বাজপাইয়ের সময়কালের মতো নীতিহীন, সুবিধাবাদী জোট করা, আর সেই জোটের নেতৃত্ব দেয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ... এই পাটিগণিত কিন্তু আরএসএস ইতোমধ্যেই অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে ভাবতে শুরু করেছে।

মূলায়ম সিং যাদবের সঙ্গে যেমন সরসঙ্গপ্রধান মোহন ভাগবতের ঘনিষ্ঠতার ছবি আমরা দেখেছি, তেমনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার নানা কথিত অকথিত কাহিনী এবং রাজনৈতিক বিচার-বিশ্লেষণ আমাদের চোখে উঠে আসছে। মমতা কিন্তু আজ পর্যন্ত বিজেপির বিরুদ্ধে যত কথাই বলুন না কেন, সঙ্ঘের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি। এই সমস্ত প্রেক্ষিত কে মাথায় রেখেই কিন্তু আমাদের রাজনীতির আগামী দিনের হালহকিকতের ভাবনা ভেবে রাখা দরকার।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

কোন পথে আগামী ভারত

গৌতম রায়

শুক্রবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২২

কোভিডের তৃতীয় ঢেউ এসে ভারতের আর্থ-সামাজিক অবস্থার যে ভয়ঙ্কর পর্যায় তৈরি করেছে-তা নিয়ে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছে সঠিক খবরটি সঠিক সময়ে পৌঁছচ্ছে, এমনটা জোর গলায় বলতে পারা যায় না। একথা ঠিক যে, কোভিডের প্রথম বা দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়কালে অপরিকল্পিত লকডাউনের কারণে যে ধরনের সংকট তৈরি হয়েছিল, হঠাৎ করে দেখলে এই তৃতীয় ঢেউয়ের সময়কালের সঙ্গে তার কিন্তু আকাশ-পাতাল ফারাক দেখা যাবে। আমাদের চোখে পড়বে, অপরিকল্পিত লকডাউনের কারণে যে পরিযায়ী শ্রমিকদের ভেতর একটা ভয়ঙ্কর রকমের সংকট নেমে এসেছিল, তার মোকাবিলায় ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কখনো কোনো রকম পরিকল্পিত ভাবনা নেয়া হয়নি। বিভিন্ন রাজ্য সরকার গুলি ও তাদের নিজের নিজের রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফিরিয়ে আনবার জন্য যে ধরনের বাস্তব পরিকল্পনা দরকার, তা নিতে সক্ষম হননি।

বামপন্থিরা তাদের সীমিত পরিসরে ভেতরে চেষ্টা করেছেন। সর্বক্ষেত্রে সফল হয়েছেন এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। কিন্তু তবু তারা যে চেষ্টা করেছেন। সেটাই কিন্তু সেই সময় নিরিখে অনেকটা ছিল। সেই চেষ্টাটাই কিন্তু অবাম রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে ছিল না।

প্রথম বা দ্বিতীয় ঢেউয়ের এই যে পরিস্থিতি, তার সঙ্গে এই বর্তমান তৃতীয় ধাপের সময়কালের পরিস্থিতির তফাতটা হলো এই যে; একদম কেন্দ্রীয়ভাবে লকডাউন ঘোষিত হয়নি এই তৃতীয় ঢেউয়ের সময়কালে। বিভিন্ন রাজ্যে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন দিন হচ্ছে লকডাউন। নানা টালবাহানার পর বিভিন্ন জায়গায় লোকাল ট্রেনগুলো চালু হলেও এই তৃতীয় ঢেউয়ের সময়কালে সেই লোকাল ট্রেনগুলোর চলাচল অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। যদি আমরা পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিত দেখি, তাহলে আমাদের মনে রাখা দরকার যে, পশ্চিমবঙ্গের অসংগঠিত শ্রমিকদের একটা বড় অংশ কিন্তু রেল ও পরিবহন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে যে হকারি, তার ওপর নির্ভর করে জীবন নির্বাহ করে। দীর্ঘদিন ধরেই কেন্দ্রীয় সরকারের পরিচালনাধীন রেলমন্ত্রণালয় রেলকে কেন্দ্র করে যে হকারি ব্যবস্থা, সেটাকে তুলে দেয়ার জন্য তৎপর হয়েছে। কোভিডের আগের থেকেই এই তৎপরতা কেন্দ্রীয় সরকারের শুরু করেছে। কোভিড চলাকালীন তৎপরতা অত্যন্ত বেশি রকমের সক্রিয় হয়েছে, এবং তা এখন প্রয়োগের দিকে নিয়ে যেতে কেন্দ্রীয় সরকার ভয়ঙ্কর রকমভাবে এগিয়ে চলেছে।

ভারত সরকারের রাজনৈতিক পদক্ষেপের দরুন পশ্চিমবঙ্গের অসংগঠিত শিল্পের সঙ্গে জড়িত একটা বড় অংশের মানুষ, অর্থনৈতিক সংকটের ভেতরেই, রুটি-রুজির একটা বড় রকমের সংকটের জায়গায় এসে পড়েছেন। এই সংকটকে ঘিরে বামপন্থি রাজনীতিকরা তাদের নানা ধরনের প্রচার কর্মসূচি নিচ্ছেন। প্রতিবাদ করছেন। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে বামপন্থিদের ক্ষমতা এখন এতটাই সীমাবদ্ধ যে, এটাকে প্রতিরোধ করার জন্য যে ধরনের রাজনৈতিক আন্দোলন করা দরকার, সেটা তারা করতে পারছেন না।

তবে তাদের এই আন্দোলনগুলো র একটা গুরুত্ব এই ক্ষেত্রে অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হলো অ-বাম, অ-বিজেপি রাজনৈতিক দলগুলো এই কর্মসংকোচনের কর্মকান্ড কে ঘিরে সেভাবে রাজনৈতিক কোন আন্দোলনের পথেই যায়নি। প্রতিরোধের জন্য ভাবনা চিন্তা তো দূরের কথা। কেন রেলকে হকারমুক্ত করার নাম করে, রেলে হকারি করে, বা রেলস্টেশনে হকারি করে, যে একটা বড় অংশের অসংগঠিত শ্রমিকদের পেটের ভাত জোগাড় হয়, সেই মানুষদের ভাতের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের রেলমন্ত্রক, সংসদে আজ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের কোন সাংসদ তা নিয়ে একটি প্রশ্ন পর্যন্ত করেননি।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি দীর্ঘদিন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল পরিচালনাধীন সরকারের রেল মন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায়, তিনি কিন্তু আজ পর্যন্ত রেল হকারদের এই গণহারে পেশা থেকে উচ্ছেদ করার চেষ্টার বিরুদ্ধে একটা শব্দ উচ্চারণ করেননি। এইরকম একটা পরিস্থিতির ভেতর দিয়েই কোভিডের এই তৃতীয় ঝড়ের সময়কালে বাজার অর্থনীতির উগ্র সমর্থক কেন্দ্রীয় সরকার, ভারতের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক, সব প্রেক্ষাপটেই একটা কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে চাইছেন।

যেমন সংকট তেতাল্লিশের মন্বন্তর সময়কালে ব্রিটিশ তৈরি করেছিল, ফজলুল হকের মন্ত্রিসভার মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তৈরি করেছিলেন। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্মের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হেনস্তা করতে ১৯৭৪ সালে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করে পা আমেরিকা সাহায্যে বাংলাদেশের মাটিতে সংগঠিত করেছিল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, তেমনই একটা সংকট ভারতের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে তৈরি করার লক্ষ্যে কিন্তু কেন্দ্রে আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির নেতৃত্বাধীন নরেন্দ্র মোদি সরকার গোটা দেশের বুকে নামিয়ে আনতে চলেছে।

অতি সাম্প্রতিক খবর হলো; উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনের মুখে এলাহাবাদ, যেটাকে ‘প্রয়াগরাজ’ নামকরণ করে একটা ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার উগ্র প্রয়োগ ভূমি হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে গোটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি, সেই এলাহাবাদে রেলের নিয়োগ কেন্দ্র করে, ছাত্রদের উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথের পুলিশ যেভাবে মোকাবিলা করতে চেয়েছে, যার ভিডিওচিত্র সামাজিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, তা দেখলে আমাদের শিউরে উঠতে হয়।

উত্তরপ্রদেশের বিধানসভাসহ পাঞ্জাব, গুজরাট ইত্যাদি রাজ্য বিধানসভার ভোট দরজায় কড়া নাড়ছে। কৃষি আইন সংশোধন ঘিরে নরেন্দ্র মোদি সরকারের যে ভয়ঙ্কর মানবতাবিরোধী অবস্থান, তার বিরুদ্ধে প্রায় এক বছর ধরে গোটা দেশের কৃষক সমাজ, বিশেষ করে উত্তর ভারতের কৃষক সমাজের সম্মিলিত প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, যার দরুন আইন দুটি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। এই আন্দোলনের প্রভাব কিন্তু কেবল পাঞ্জাব নয়, উত্তরপ্রদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেও অত্যন্ত উত্তপ্ত করে রেখেছে। সাধারণ মানুষ, যাদের কোনো না কোনোভাবে কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে সংযোগ, যারা একটা সময়ে নানা ধরনের প্রভাব প্রতিপত্তি প্ররোচনা ইত্যাদির দরুন বিজেপির ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির প্রতি আসক্ত হয়েছিল, সেসব মানুষ ও কিন্তু এখন বিজেপির প্রতি ভয়ঙ্কর রকমের বিরক্ত হয়ে উঠেছেন।

আগামী নির্বাচনে এই অংশের মানুষ কি অবস্থান নেবে তা নিয়ে কিন্তু বিজেপিসহ গোটা রাজনৈতিক হিন্দু সম্প্রদায়ের শিবিরের ভেতরে মাথাব্যথা খুব তীব্র হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এই রকম একটা পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের জায়গায় পৌঁছে দিয়ে, ভোট বৈতরণী পার হতে চাইছে রাজনৈতিক হিন্দুরা। মন্দির মসজিদের রাজনীতির বাইরে উত্তরপ্রদেশে কোন ও অ-বাম রাজনৈতিক দলই কিন্তু পা ফেলতে পারছে না।

বামপন্থিরা মন্দির মসজিদ রাজনীতি কখনোই করেন না। তবুও তারা উত্তরপ্রদেশে এককভাবে লড়বার প্রশ্নে যে অবস্থান নেয়ার আভাস দিচ্ছেন, তা ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির পক্ষে কতখানি সহায়ক হবে, তা নিয়ে খুব বেশি রকমের সংশয়ের পরিবেশ ইতোমধ্যেই তৈরি হয়েছে সিপিআই (এম) তাদের কেন্দ্রীয় স্তরে আলোচনায় ঠিক করেছে, বিভিন্ন রাজ্যে, সেই সেই রাজ্যের প্রাদেশিক শাখা, সেখানকার রাজনীতির নানা ধরনের সমীকরণ মাথায় রেখে, নিজের নিজের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। সিপিআই (এম) এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এই সিদ্ধান্ত নেয়ার ফলে উত্তরপ্রদেশে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে মুলায়ম সিং যাদব, অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে সিপিআই (এম) এর একটা নির্বাচনী সখ্যতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমশ উজ্জ্বল হচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গে এই সিপিআই (এম) ই কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়ে ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। সেই সময়েই কেরালা বিধানসভা নির্বাচনে, সেই রাজ্যের সিপিআই (এম) লড়েছিল কংগ্রেস দলের বিরুদ্ধে। আবার উত্তরপ্রদেশের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে বামপন্থিদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনা ক্রমশ উঠে আসছে। বামপন্থিদের এই অবস্থান ভারতবর্ষের বুকে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে লড়াইয়ের প্রশ্নে, রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে মোকাবিলা করার প্রশ্নে, কতখানি ইতিবাচক হবে ঘোরতর সংশয় রয়েছে।

ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে কংগ্রেস খাতায়-কলমে যাই অবস্থানই নিক না কেন, প্রয়োগজনিত ক্ষেত্রে তাদের ঢালাও প্রশংসাপত্র দেয়া যায় না, মনটাই বলতে হয়। আবার অল্প কিছুদিন আগেই আমরা দেখেছি, একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে মূলায়ম সিং যাদব এবং আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের অন্তরঙ্গ কথোপকথনের সময়কালের ছবি। সেটি সামাজিক গণমাধ্যমে ছবি ছড়িয়ে পড়ে। মূলায়ম, অখিলেশ এবং তাদের সমাজবাদী পার্টির যে ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের কাগুজে প্রচার রয়েছে, তা ঘিরে সংসারটা আরও তীব্র হয়েছে। কারণ; এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের প্রায় বিদায়লগ্নে উত্তরপ্রদেশ এবং দিল্লি লাগোয়া মুজাফফরনগরে যে ভয়াবহ সামাজিক, ধর্মীয় মেরুকরণের ভিত্তিতে আরএসএসের সংঘটিত দাঙ্গা হয়েছিল, সেই দাঙ্গা দমনে সেই সময়ে উত্তরপ্রদেশের ক্ষমতায় থাকা অখিলেশ যাদবের নেতৃত্বাধীন সমাজবাদী পার্টির সরকার আদৌ কোনো ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেনি। সংখ্যালঘু মুসলমানদের জান-মালের নিরাপত্তার প্রশ্নে অখিলেশ যাদব সরকারের চরম ব্যর্থতা মুজাফফরনগর দাঙ্গার সময় আমরা প্রায় প্রতিদিন লক্ষ করেছিলাম। আর এই মুজাফফরনগর দাঙ্গাকে কিন্তু এক ধরনের ইনভেস্টমেন্টের মতো কাজে লাগিয়ে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনকে ব্যবহার করেছিল আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি।

একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকার তৈরি করার পেছনে মুজাফফরনগর দাঙ্গার একটা বড় ভূমিকা আছে। সেই পরিবেশ তৈরি করে দেয়ার ক্ষেত্রে অখিলেশ যাদবের যে অবদান রয়েছে, তাকে আমরা কখনো কোনো অবস্থাতেই অস্বীকার করতে পারি না।

ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের জমি উত্তরাধিকার ঘিরে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট, বিজেপি দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর, যে রায় দান করে, সেই সময় অখিলেশ যাদব, মুলায়ম সিং যাদব স, মাজবাদী পার্টির নেতারা নীরব ভূমিকা পালন করেছিলেন। সংখ্যালঘুর অধিকার অধিকার রক্ষা করার ব্যাপারে মূলায়ম সিং যাদব অতীতে যে ধরনের কথা প্রচারের স্বার্থে বলতেন, বাবরি মসজিদের জমি বিতর্কে কোর্টের রায়দানের পর কিন্তু সেই ধরনের কোন কথা তার মুখ দিয়ে, বা তার পুত্র অখিলেশ যাদবের মুখ দিয়ে আর আমরা শুনতে পাইনি।

পবিত্র মসজিদের জমি র কর্তৃত্ব রাম মন্দিরের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়ার পর, পরিপূর্ণ ইসলামবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মসজিদকে স্থানান্তরিত করার জন্য যে আলাদা জায়গায় জমির সংস্থানের কথা সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়, সেই সম্পর্কেও কিন্তু মুলায়ম সিং যাদব বা তার দলের উচ্চস্তরের নেতাদের কারো মুখ থেকে একটা শব্দ আমরা শুনতে পাওয়া যায়নি।

ভারত সরকারের রাজনৈতিক পদক্ষেপের দরুন পশ্চিমবঙ্গের অসংগঠিত শিল্পের সঙ্গে জড়িত একটা বড় অংশের মানুষ, অর্থনৈতিক সংকটের ভেতরেই, রুটি-রুজির একটা বড় রকমের সংকটের জায়গায় এসে পড়েছেন

পবিত্র ইসলামে মসজিদ স্থানান্তরের কোন স্থান নেই। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদের জন্য বিকল্প জমির যে কথা বলেছেন, সে কথা কেবল ইসলামবিরোধী নয়, বা মুসলিম পার্সোনাল ল কে অমান্য করছে তাই নয়, ১৯৪৭ সালে ইংরেজদের কাছ থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়কালে সংখ্যালঘুর অধিকার সংরক্ষণজনিত যে অঙ্গীকার ভারতের তৎকালীন জাতীয় স্তরের নেতারা করেছিলেন, সেই অঙ্গীকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়েছে সেই রায়ে। অথচ এ সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর ভারতের প্রায় সবকটি রাজনৈতিক দলের মতোই মূলায়ম সিং যাদব ও আশ্চর্যজনক নীরবতা পালন করে গিয়েছেন।

উত্তরপ্রদেশ জুড়ে এই রায়কে ঘিরে মুসলমান সমাজের ভেতরে যে ধরনের নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, সেই অন্ধকার অবস্থা থেকে মুসলমান সমাজকে বের করে এনে, তাদের সামাজিক সুস্থতার জন্য একটি শব্দও কিন্তু সমাজবাদী পার্টি উচ্চারণ করেনি।

তাই আজকের দিনে দাঁড়িয়ে উত্তরপ্রদেশের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের মুখে উগ্র হিন্দু সন্ত্রাসী আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির মোকাবিলায় এই সমাজবাদী পার্টির প্রকৃত কতখানি আন্তরিক ভূমিকা পালন করবে, তা ঘিরে কিন্তু ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ বিবেক যথেষ্ট সংশয়ী। করোনার তৃতীয় ঢেইয়ের ভেতরে গোটা দেশের গরিব মানুষ যখন অর্থনৈতিকভাবে আরও বেশি বেশি করে একটা প্রান্তিক জায়গায় এসে দাঁড়াচ্ছে, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের গোল্লায় পাঠানোর জন্য যখন বাজার অর্থনীতির উগ্র সমর্থক কেন্দ্রের বিজেপি সরকার চেষ্টার ত্রুটি করছে না, এইরকম একটা সময়ে উত্তরপ্রদেশ সহ পাঞ্জাব, গুজরাট, গোয়া ইত্যাদি যে পাঁচটি রাজ্যের ভোট হতে চলেছে, তা ভারতের আগামী দিনের রাজনীতিকে কতখানি প্রভাবিত করবে, তা ভাবা দরকার।

বিজেপি যদি উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখন্ডে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারে, তাহলে আগামী ২০২৪ এ ভারতের লোকসভা নির্বাচনে একটা মাইলেজ পেতে পারে বলে ধারণা করতে পারা যায়। আর যদি উত্তরপ্রদেশের তারা ক্ষমতাচ্যুত হয়, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপির ফিরে আসা ঘিরে এখনি একটা সংশয়ের পরিবেশ তৈরি হবে। আর এ সংশয়ের পরিবেশ যে ইতোমধ্যেই তৈরি হচ্ছে-তা নিয়ে কিন্তু আরএসএসের মধ্যে কোনো সংশয় রয়েছে বলে মনে হয় না।

আরএসএস ইতোমধ্যেই মোদির বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে। এমনকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, সেই স্বপ্নের পেছনে একটা আরএসএসের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত নেই, একথা কিন্তু জোর দিয়ে বলতে পারা যায় না। কারণ; বিজেপি যদি একক ক্ষমতায় ২০২৪ এ ফিরে আসতে না পারে, সে ক্ষেত্রে অটলবিহারী বাজপাইয়ের সময়কালের মতো নীতিহীন, সুবিধাবাদী জোট করা, আর সেই জোটের নেতৃত্ব দেয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ... এই পাটিগণিত কিন্তু আরএসএস ইতোমধ্যেই অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে ভাবতে শুরু করেছে।

মূলায়ম সিং যাদবের সঙ্গে যেমন সরসঙ্গপ্রধান মোহন ভাগবতের ঘনিষ্ঠতার ছবি আমরা দেখেছি, তেমনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার নানা কথিত অকথিত কাহিনী এবং রাজনৈতিক বিচার-বিশ্লেষণ আমাদের চোখে উঠে আসছে। মমতা কিন্তু আজ পর্যন্ত বিজেপির বিরুদ্ধে যত কথাই বলুন না কেন, সঙ্ঘের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি। এই সমস্ত প্রেক্ষিত কে মাথায় রেখেই কিন্তু আমাদের রাজনীতির আগামী দিনের হালহকিকতের ভাবনা ভেবে রাখা দরকার।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

back to top