মিথুশিলাক মুরমু
বর্তমান সরকার ‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন ২০২১’ প্রণয়ন করতে চলেছে। ইতোমধ্যেই আইনের মাধ্যমে ২২টি অপরাধকে চিহ্নিত করেছে- জাল দলিল বানানো; মালিকানার অতিরিক্ত জমির দলিল সম্পাদনা করা; মালিকানার অতিরিক্ত জমি লিখে নেয়া; পূর্ব বিক্রয় বা হস্তান্তর গোপন করে জমি বিক্রি করা; বায়নাকৃত জমি নিয়ে পুনরায় চুক্তিবদ্ধ হওয়া; ভুল বুঝিয়ে দানপত্র তৈরি; সহউত্তরাধিকারীকে বঞ্চিত করে নিজ নামে অধিক জমির দলিল তৈরি; সহউত্তরাধিকারীকে বঞ্চিত করে নিজের প্রাপ্যতার অধিক জমি বিক্রি করা; জমির অবৈধ দখল; সহউত্তরাধিকারীর জমি জোরপূর্বক দখলে রাখা; অবৈধভাবে মাটি কাটা, বালি উত্তোলন ইত্যাদি; জলাবদ্ধতা তৈরি করা; বিনা অনুমতিতে ভূমির ওপরের স্তরের (টপ সয়েল) মাটি কাটা; অধিগ্রহণের আগে জমির মূল্য বাড়ানোর উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত মূল্যে দলিল নিবন্ধন করা; জনসাধারণের ব্যবহার্য, ধর্মীয় বা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জমি দখল করা; বিনা অনুমতিতে পাহাড় বা টিলার পাদদেশে বসতি স্থাপন; রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার কর্তৃক জমি, ফ্ল্যাট হস্তান্তর ইত্যাদি সম্পর্কিত অপরাধ; সরকারি-বেসরকারি স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের জমি বেআইন দখল করা; নদী-হাওর, বিল ও অন্যান্য জলাভূমির শ্রেণী পরিবর্তন করা; অবৈধ দখল গ্রহণ ও দখল বজায় রাখতে পেশিশক্তি প্রদর্শন করা; সন্নিকটবর্তী ভূমি মালিকের ভূমির ক্ষতিসাধন ও এ-সংক্রান্ত অপরাধ সংঘটনের সহায়তা বা প্ররোচনা দেওয়া। উপরিউক্ত প্রায় সবগুলোই আদিবাসীদের ক্ষেত্রে অহরহ ঘটে চলেছে।
সংবিধানে তিন ধরনের মালিকানা রয়েছে- রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায়ী মালিকানা এবং ব্যক্তিগত মালিকানা তবে নেই যৌথ মালিকানা। আদিবাসীরা বিশেষত পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসকারীদের মধ্যে যৌথ মালিকানা প্রথা প্রচলিত রয়েছে, যা এই ভূমি আইনেও অনুপস্থিত। যৌথ মালিকানার বিষয়টিকে উপেক্ষা করে আইন প্রণীত হলে পাহাড়ে অশান্তি আরো বাড়বে, আইনের ফাঁক দিয়ে ভূমিলিপ্সুরা স্বার্থ হাসিল পিছপা হবে না।
উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী তানোর থানার জুমারপাড়াতে শতাব্দীকাল থেকে আদিবাসী সাঁওতালরা সরকারি খাস জমিতে বসবাস করে আসছে। তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত ওই আদিবাসী গ্রাম থেকে কেউই কলেজের দ্বার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রামের বাসিন্দা জানালেন, সাম্প্রতিকালে স্থানীয় বৃহত্তর সম্প্রদায়ের একজন ভূমিদস্যু জায়গাটির জাল দলিল তৈরি করে যুগের পর যুগ থাকা বসতভিটা থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদের পাঁয়তারা চালাচ্ছে। বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর গ্রামের সদলবলে টিএনও অফিসে আবেদন নিয়ে হাজির হলে তিনি এসি ল্যান্ডের কাছে তাদের মধ্য দিয়ে একটি নোট প্রেরণ করেন।
টিএনও মহোদয় অবহিত হতে চেয়েছেন, জুমারপাড়াতে বসবাসরত আদিবাসী সাঁওতালদের বসতভিটার দালিলিক অবস্থা সম্পর্কে, অদ্যাবধি এসি ল্যান্ড রহস্যজনক ভূমিকা পালন করছেন। আদিবাসী সাঁওতালরা এখন এক প্রকার আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে দিনাতিপাত করছেন। একই অবস্থা চাঁপাইনবাবগঞ্জের পার্শ্ববর্তী কোল পল্লিতেও- বিলবৈলঠা, চাত্রা, বানাইগ্রাম এবং পার্শ্ববর্তী বাবুডাইং, শান্তিপাড়া, চিকনা, সিধনা, বসতপুর প্রায় সবকটি গ্রামের কোল আদিবাসীদের ঘরবাড়ি খাসজমিতেই গড়ে উঠেছে। সরকারি খাস বসতভিটাগুলো স্থানীয় সুযোগ-সন্ধানীরা পত্তন করে নিচ্ছে, যা হওয়ার কথা ছিল আদিবাসী কোল সম্প্রদায়ের। যেখানে পূর্বপুরুষের কবর রয়েছে, নাড়িপোতা রয়েছে এবং রয়েছে তাদের অতীতের স্মৃতিবিজড়িত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ঐতিহ্য।
ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর চতুর্থ অধ্যায় বাস্তু-ধারা ৬ বলা হয়েছে, ‘বাস্তু হইতে উচ্ছেদ, ইত্যাদি চলিবে না: পল্লি এলাকায় মনিব কর্তৃক বাস্তু হিসেবে ব্যবহৃত কোন জমি কোন অফিসার, আদালত বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষ দ্বারা আটক, ক্রোক, বাজেয়াপ্তকরণ বা বিক্রয়সহ সব আইনগত প্রক্রিয়া হইতে অব্যাহতি পাইবে এবং ঐরূপ জমির মনিবকে কোন উপায়েই উক্ত জমি হইতে বঞ্চিত বা বেদখল বা উচ্ছেদ করা যাইবে না।’
২০১৪ খ্রিস্টাব্দে ভূমি সংস্কার আইন ২০১৪- তে রয়েছে, ‘পল্লি এলাকায় বাস্তুভিটা হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার উপযুক্ত কোন খাসজমি পাওয়া গেলে সরকার উক্ত জমি বন্দোবস্ত দেয়ার সময় ভূমিহীন মুক্তিযোদ্ধা বা তাহার পরিবার, ভূমিহীন কৃষক ও শ্রমিকদের অগ্রাধিকার প্রদান করিবেন।’ আদিবাসীরা ভূমিহীন, সহায়-সম্বলহীন দীর্ঘদিন যাবৎ সরকারের খাসজমিতে বসবাস করে আসছে, আর এখন যদি তাদেরকে চলে যেতে হয়; তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় তারা সীমান্ত অতিক্রম করবে। আদিবাসী কোল পল্লিতে স্থানীয় অধিবাসীদের অবাধ যাতায়াত, খাসজমি হওয়ায় তাদের ঘরবাড়ির সংলগ্ন ঘর নির্মাণ করে স্বাভাবিক জীবনচক্র ব্যাহত হচ্ছে এবং এভাবেই ধীরে ধীরে মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।
বিশেষত উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের প্রতারণার অনেক অভিজ্ঞতা, গল্প-কাহিনী রয়েছে। ২ (সাঁওতালী ভাষায় ‘বার’) বিঘা জমি বিক্রি করতে গিয়ে ১২ (বাংলা ভাষায় ‘বার’) বিঘা জমি হস্তান্তর হয়ে গেছে। ব্রিটিশ সরকারের প্রণীত আইনানুযায়ী, আদিবাসীদের জায়গা-জমি বিক্রয়ে এডিসি রাজস্বের কাছ থেকে অনুমতি সাপেক্ষে অ-আদিবাসীদের কাছে বিক্রয় করা যায়। এরূপ ক্ষেত্রে অনেক প্রতারণা, জাল-জালিয়াতির ঘটনা আদিবাসী পল্লিগুলোতে ঘূর্ণায়মান হচ্ছে। জমি বিক্রয়ের অর্ধেক দাম পরিশোধের পরে দিনের পর দিন ধরনা দেয়ার পরও ক্রয়কারী ক্ষমতাশালীরা নিরীহ আদিবাসীদের পৈতৃক সম্পত্তির দাম থেকে বঞ্চিত করে। সম্পত্তি হস্তান্তরের পর
কেউ-ই তাদের মূল্য দেয় না। সম্পদ-সম্পত্তির বঞ্চনা করুণ ইতিহাস আদিবাসী পল্লিতে উপস্থিত হলেই শোনা যায়।
১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রথম পর্বের সমাপ্তি ঘটেছে। ১১ ফেব্রুয়ারি ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দে জন্ম হওয়া বাবা তিলকা মাজহী (মুরমু)-এর নেতৃত্বে বনভূমি কেটে ফসলি জমি তৈরি করে জমির উৎপাদিত ফসল ভোগ-দখল ও স্বাধীন জীবনযাপনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হস্তক্ষেপ করে। শুরু হয় গেরিলা স্টাইলে যুদ্ধ, রক্তের হলিখেলা এবং হত্যা। ধৃত তিলকা মাজহীকে সামর্থবান ঘোড়ার সঙ্গে রশিতে বেঁধে টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরানো হয় এবং রক্তাক্ত অবস্থায় বিশালাকায় বটগাছে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। তিলকা মাজহীর মৃত্যুর ৭০ বছর পর ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে আবারও সাঁওতালসহ আদিবাসীরা জমির দাবিতে, উৎপাদিত ফসল ভোগ এবং স্থানীয় মহাজন-জোতদারদের প্রতারণা থেকে বাঁচতে ৩০ জুন মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছিলেন উত্তসূরি সিধু-কানু, ফুলো-জানো, চাঁদ-ভাইরো’রা। সেদিন ব্রিটিশ সরকারের কানে সাঁওতালসহ আদিবাসীদের ন্যায়ত দাবি পৌঁছায়নি, আর যখন পৌঁছিয়েছিলো, তখন সময় ছিল না। ইতোমধ্যেই হাজার হাজার সাঁওতাল নারী-পুরুষের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ভাগলপুরের মাটি।
দেশের আদিবাসীদের অন্যতম দাবি হচ্ছে ভূমি কমিশন। ভূমিকে কেন্দ্র করেই আদিবাসীরা স্থানান্তরিত, উচ্ছেদিত, উদ্বাস্তু হচ্ছে। এ যাবৎ যত হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে, প্রায় প্রতিটির সঙ্গে ভূমির সম্পর্ক বিদ্যমান। ভূমির স্বচ্ছতা সম্ভবপর হলেই আদিবাসীদের বেদনাবিধুর জীবন সংগ্রাম ঘুঁচে যাবে, মুছে যাবে চোখের নোনা জল; একজন নাগরিক হিসেবেই সম্মানের সঙ্গে বসবাস করবে এই বাংলাদেশে।
[লেখক : কলামিস্ট]
মিথুশিলাক মুরমু
শুক্রবার, ২০ মে ২০২২
বর্তমান সরকার ‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন ২০২১’ প্রণয়ন করতে চলেছে। ইতোমধ্যেই আইনের মাধ্যমে ২২টি অপরাধকে চিহ্নিত করেছে- জাল দলিল বানানো; মালিকানার অতিরিক্ত জমির দলিল সম্পাদনা করা; মালিকানার অতিরিক্ত জমি লিখে নেয়া; পূর্ব বিক্রয় বা হস্তান্তর গোপন করে জমি বিক্রি করা; বায়নাকৃত জমি নিয়ে পুনরায় চুক্তিবদ্ধ হওয়া; ভুল বুঝিয়ে দানপত্র তৈরি; সহউত্তরাধিকারীকে বঞ্চিত করে নিজ নামে অধিক জমির দলিল তৈরি; সহউত্তরাধিকারীকে বঞ্চিত করে নিজের প্রাপ্যতার অধিক জমি বিক্রি করা; জমির অবৈধ দখল; সহউত্তরাধিকারীর জমি জোরপূর্বক দখলে রাখা; অবৈধভাবে মাটি কাটা, বালি উত্তোলন ইত্যাদি; জলাবদ্ধতা তৈরি করা; বিনা অনুমতিতে ভূমির ওপরের স্তরের (টপ সয়েল) মাটি কাটা; অধিগ্রহণের আগে জমির মূল্য বাড়ানোর উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত মূল্যে দলিল নিবন্ধন করা; জনসাধারণের ব্যবহার্য, ধর্মীয় বা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জমি দখল করা; বিনা অনুমতিতে পাহাড় বা টিলার পাদদেশে বসতি স্থাপন; রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার কর্তৃক জমি, ফ্ল্যাট হস্তান্তর ইত্যাদি সম্পর্কিত অপরাধ; সরকারি-বেসরকারি স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের জমি বেআইন দখল করা; নদী-হাওর, বিল ও অন্যান্য জলাভূমির শ্রেণী পরিবর্তন করা; অবৈধ দখল গ্রহণ ও দখল বজায় রাখতে পেশিশক্তি প্রদর্শন করা; সন্নিকটবর্তী ভূমি মালিকের ভূমির ক্ষতিসাধন ও এ-সংক্রান্ত অপরাধ সংঘটনের সহায়তা বা প্ররোচনা দেওয়া। উপরিউক্ত প্রায় সবগুলোই আদিবাসীদের ক্ষেত্রে অহরহ ঘটে চলেছে।
সংবিধানে তিন ধরনের মালিকানা রয়েছে- রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায়ী মালিকানা এবং ব্যক্তিগত মালিকানা তবে নেই যৌথ মালিকানা। আদিবাসীরা বিশেষত পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসকারীদের মধ্যে যৌথ মালিকানা প্রথা প্রচলিত রয়েছে, যা এই ভূমি আইনেও অনুপস্থিত। যৌথ মালিকানার বিষয়টিকে উপেক্ষা করে আইন প্রণীত হলে পাহাড়ে অশান্তি আরো বাড়বে, আইনের ফাঁক দিয়ে ভূমিলিপ্সুরা স্বার্থ হাসিল পিছপা হবে না।
উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী তানোর থানার জুমারপাড়াতে শতাব্দীকাল থেকে আদিবাসী সাঁওতালরা সরকারি খাস জমিতে বসবাস করে আসছে। তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত ওই আদিবাসী গ্রাম থেকে কেউই কলেজের দ্বার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রামের বাসিন্দা জানালেন, সাম্প্রতিকালে স্থানীয় বৃহত্তর সম্প্রদায়ের একজন ভূমিদস্যু জায়গাটির জাল দলিল তৈরি করে যুগের পর যুগ থাকা বসতভিটা থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদের পাঁয়তারা চালাচ্ছে। বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর গ্রামের সদলবলে টিএনও অফিসে আবেদন নিয়ে হাজির হলে তিনি এসি ল্যান্ডের কাছে তাদের মধ্য দিয়ে একটি নোট প্রেরণ করেন।
টিএনও মহোদয় অবহিত হতে চেয়েছেন, জুমারপাড়াতে বসবাসরত আদিবাসী সাঁওতালদের বসতভিটার দালিলিক অবস্থা সম্পর্কে, অদ্যাবধি এসি ল্যান্ড রহস্যজনক ভূমিকা পালন করছেন। আদিবাসী সাঁওতালরা এখন এক প্রকার আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে দিনাতিপাত করছেন। একই অবস্থা চাঁপাইনবাবগঞ্জের পার্শ্ববর্তী কোল পল্লিতেও- বিলবৈলঠা, চাত্রা, বানাইগ্রাম এবং পার্শ্ববর্তী বাবুডাইং, শান্তিপাড়া, চিকনা, সিধনা, বসতপুর প্রায় সবকটি গ্রামের কোল আদিবাসীদের ঘরবাড়ি খাসজমিতেই গড়ে উঠেছে। সরকারি খাস বসতভিটাগুলো স্থানীয় সুযোগ-সন্ধানীরা পত্তন করে নিচ্ছে, যা হওয়ার কথা ছিল আদিবাসী কোল সম্প্রদায়ের। যেখানে পূর্বপুরুষের কবর রয়েছে, নাড়িপোতা রয়েছে এবং রয়েছে তাদের অতীতের স্মৃতিবিজড়িত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ঐতিহ্য।
ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর চতুর্থ অধ্যায় বাস্তু-ধারা ৬ বলা হয়েছে, ‘বাস্তু হইতে উচ্ছেদ, ইত্যাদি চলিবে না: পল্লি এলাকায় মনিব কর্তৃক বাস্তু হিসেবে ব্যবহৃত কোন জমি কোন অফিসার, আদালত বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষ দ্বারা আটক, ক্রোক, বাজেয়াপ্তকরণ বা বিক্রয়সহ সব আইনগত প্রক্রিয়া হইতে অব্যাহতি পাইবে এবং ঐরূপ জমির মনিবকে কোন উপায়েই উক্ত জমি হইতে বঞ্চিত বা বেদখল বা উচ্ছেদ করা যাইবে না।’
২০১৪ খ্রিস্টাব্দে ভূমি সংস্কার আইন ২০১৪- তে রয়েছে, ‘পল্লি এলাকায় বাস্তুভিটা হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার উপযুক্ত কোন খাসজমি পাওয়া গেলে সরকার উক্ত জমি বন্দোবস্ত দেয়ার সময় ভূমিহীন মুক্তিযোদ্ধা বা তাহার পরিবার, ভূমিহীন কৃষক ও শ্রমিকদের অগ্রাধিকার প্রদান করিবেন।’ আদিবাসীরা ভূমিহীন, সহায়-সম্বলহীন দীর্ঘদিন যাবৎ সরকারের খাসজমিতে বসবাস করে আসছে, আর এখন যদি তাদেরকে চলে যেতে হয়; তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় তারা সীমান্ত অতিক্রম করবে। আদিবাসী কোল পল্লিতে স্থানীয় অধিবাসীদের অবাধ যাতায়াত, খাসজমি হওয়ায় তাদের ঘরবাড়ির সংলগ্ন ঘর নির্মাণ করে স্বাভাবিক জীবনচক্র ব্যাহত হচ্ছে এবং এভাবেই ধীরে ধীরে মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।
বিশেষত উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের প্রতারণার অনেক অভিজ্ঞতা, গল্প-কাহিনী রয়েছে। ২ (সাঁওতালী ভাষায় ‘বার’) বিঘা জমি বিক্রি করতে গিয়ে ১২ (বাংলা ভাষায় ‘বার’) বিঘা জমি হস্তান্তর হয়ে গেছে। ব্রিটিশ সরকারের প্রণীত আইনানুযায়ী, আদিবাসীদের জায়গা-জমি বিক্রয়ে এডিসি রাজস্বের কাছ থেকে অনুমতি সাপেক্ষে অ-আদিবাসীদের কাছে বিক্রয় করা যায়। এরূপ ক্ষেত্রে অনেক প্রতারণা, জাল-জালিয়াতির ঘটনা আদিবাসী পল্লিগুলোতে ঘূর্ণায়মান হচ্ছে। জমি বিক্রয়ের অর্ধেক দাম পরিশোধের পরে দিনের পর দিন ধরনা দেয়ার পরও ক্রয়কারী ক্ষমতাশালীরা নিরীহ আদিবাসীদের পৈতৃক সম্পত্তির দাম থেকে বঞ্চিত করে। সম্পত্তি হস্তান্তরের পর
কেউ-ই তাদের মূল্য দেয় না। সম্পদ-সম্পত্তির বঞ্চনা করুণ ইতিহাস আদিবাসী পল্লিতে উপস্থিত হলেই শোনা যায়।
১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রথম পর্বের সমাপ্তি ঘটেছে। ১১ ফেব্রুয়ারি ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দে জন্ম হওয়া বাবা তিলকা মাজহী (মুরমু)-এর নেতৃত্বে বনভূমি কেটে ফসলি জমি তৈরি করে জমির উৎপাদিত ফসল ভোগ-দখল ও স্বাধীন জীবনযাপনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হস্তক্ষেপ করে। শুরু হয় গেরিলা স্টাইলে যুদ্ধ, রক্তের হলিখেলা এবং হত্যা। ধৃত তিলকা মাজহীকে সামর্থবান ঘোড়ার সঙ্গে রশিতে বেঁধে টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরানো হয় এবং রক্তাক্ত অবস্থায় বিশালাকায় বটগাছে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। তিলকা মাজহীর মৃত্যুর ৭০ বছর পর ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে আবারও সাঁওতালসহ আদিবাসীরা জমির দাবিতে, উৎপাদিত ফসল ভোগ এবং স্থানীয় মহাজন-জোতদারদের প্রতারণা থেকে বাঁচতে ৩০ জুন মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছিলেন উত্তসূরি সিধু-কানু, ফুলো-জানো, চাঁদ-ভাইরো’রা। সেদিন ব্রিটিশ সরকারের কানে সাঁওতালসহ আদিবাসীদের ন্যায়ত দাবি পৌঁছায়নি, আর যখন পৌঁছিয়েছিলো, তখন সময় ছিল না। ইতোমধ্যেই হাজার হাজার সাঁওতাল নারী-পুরুষের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ভাগলপুরের মাটি।
দেশের আদিবাসীদের অন্যতম দাবি হচ্ছে ভূমি কমিশন। ভূমিকে কেন্দ্র করেই আদিবাসীরা স্থানান্তরিত, উচ্ছেদিত, উদ্বাস্তু হচ্ছে। এ যাবৎ যত হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে, প্রায় প্রতিটির সঙ্গে ভূমির সম্পর্ক বিদ্যমান। ভূমির স্বচ্ছতা সম্ভবপর হলেই আদিবাসীদের বেদনাবিধুর জীবন সংগ্রাম ঘুঁচে যাবে, মুছে যাবে চোখের নোনা জল; একজন নাগরিক হিসেবেই সম্মানের সঙ্গে বসবাস করবে এই বাংলাদেশে।
[লেখক : কলামিস্ট]