alt

উপ-সম্পাদকীয়

দুর্নীতি ও দোষারোপের রাজনীতি

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: শনিবার, ২১ মে ২০২২

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল দুদকের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে তাদের মহাসচিবের স্বাক্ষরিত একটি চিঠি কমিশনের সচিব মো. মাহবুব হোসেনের হাতে তুলে দেন। দুটি সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দুদকে অভিযোগ দাখিল করেছে বিএনপি। বিএনপির অভিযোগ হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার সঙ্গে একজন মন্ত্রীর কথোপকথনে অপরাধমূলক কর্মকান্ডের তথ্য-উপাত্ত বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও দুদক নির্লিপ্ত, কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। অন্যটি হলো সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ছোট ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরের দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ। বিএনপি মনে করে স্পর্শকাতর দুর্নীতি নিয়ে দুদক চুপ থাকে, কোন ব্যবস্থা নেয় না। তাদের আরও অভিযোগ হচ্ছে, দুর্নীতি দমন কমিশনে যারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে চান তাদের হেনস্তা করা হয়। দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতেও দুদককে বিএনপির তরফ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে।

দুদকে বিএনপির এমন অভিযোগ দাখিল করায় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ হাল্কা রসের সৃষ্টি করে বলেছেন, বিএনপি নাটক করতেই দুর্নীতি দমন কমিশনে গিয়েছে। তার কথা অনুযায়ী ক্ষমতা থাকাকালীন বিএনপি দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমগ্ন ছিল এবং হাওয়া ভবন ছিল দুর্নীতির আখড়া, হাওয়া ভবনের লুটপাটের জন্যই দেশ বিএনপির আমলে বহুবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও বলেছেন, বিএনপি নিজেদের দুর্নীতি আড়াল করার জন্যই দুদকে গিয়ে এই মহড়া দিয়েছে।

তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, বিএনপি এবং বিএনপির নেতাদের দুর্নীতির খতিয়ানও নাকি সরকারের কাছে রয়েছে। নেতাদের কথা শুনলে বিস্মিত হওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না- দুর্নীতির খতিয়ান থাকা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট নেতাদের আইনের আওতায় না এনে কেন প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে তার কোন ব্যাখ্যা নেই। বিএনপির দুর্নীতিবাজ নেতাদের না ধরার পেছনে বর্তমান সরকারের অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কথা মনে পড়ে যায়; জিয়াউর রহমান তার সামরিক শাসনামলে সেনা কর্মকর্তাদের দুর্নীতি করার সুযোগ করে দিতেন বলে পত্রিকায় পড়েছিলাম। দুর্নীতিগ্রস্ত কোন সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের অবাধ্য হচ্ছে মনে হলেই তাকে ডেকে নিয়ে তার দুর্নীতির নথিটি পড়তে দিতেন। বিরোধীদলীয় কোন নেতাকে স্তব্ধ করার এমন কৌশল রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগও হয়ত খেলছে।

বিএনপি বহুদিন ধরে বলে আসছে, মেগা প্রজেক্টের অন্তরালে মেগা দুর্নীতি। মেগা প্রকল্পগুলোর দুয়েকটিতে দুর্নীতির কিছু চিত্র মিডিয়ায় প্রকাশও পেয়েছে- বালিশের দর, বালিশ ওপরে তোলার খরচ নিয়ে বহুদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাসিঠাট্টাও হয়েছে। আমাদের দেশে নির্মাণ ব্যয় অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি- এমন অভিযোগ হরহামেশাই শোনা যায়। এই সব অভিযোগের কোন জুতসই উত্তর বর্তমান সরকারের কারও কাছ থেকে কখনো শোনা যায়নি। দেশের বাইরে বর্তমান সরকারের আমলে অর্থ পাচার নিয়ে বিএনপি’র অভিযোগ থামছেই না। বিএনপি মনে করে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী এবং আমলারা দুর্নীতি করে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছেন। কিন্তু বর্তমান সরকারের নেতারা অভিযোগের জবাব না দিয়ে বিএনপির আমলে যে আরও বেশি দুর্নীতি হয়েছে তার ফিরিস্তি দিতে থাকেন। তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের জিরো টলারেন্সের কথা জোর দিয়ে বলা হলেও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের কোন নজির জনগণের নিকট দৃশ্যমান হচ্ছে না।

মেগা প্রকল্পে মেগা দুর্নীতি করার সুযোগ যে নেই তা প্রথম উচ্চারণ করলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব আহমদ কায়কাউস এফবিসিসিআই-এর একটি সেমিনারে। যমুনা ব্রিজে শতভাগ দুর্নীতি মুক্ত কাজ হয়েছে বলে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জোর দিয়ে বলেছেন সত্য, কিন্তু তা বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারেননি। সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ভাইকে আওয়ামী লীগ সরকার গ্রেপ্তার করেছে, তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। দ্বিতীয়ত বিদেশে পাচার করা টাকা যে আনা সহজ নয়, তা আমি আমার আরেকটি লেখায় বিশদভাবে উল্লেখ করেছি। খালেদা জিয়ার ছেলে কোকো রহমানের পাচার করা অর্থ ছাড়া আর কোন পাচার করা টাকা আজ পর্যন্ত কোন সরকার ফেরত আনতে পেরেছে বলে আমার জানা নেই। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত উপমহাদেশের প্রত্যেকটি সরকার নির্বাচনের আগে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, কিন্তু ইমরান খান, নরেন্দ্র মোদি বা গোতাবায়া রাজাপক্ষ কেউই পাচার করা অর্থ ফেরত এনে কোন নজির স্থাপন করতে পারেননি।

ব্রিটিশ আমল থেকেই দুর্নীতি হয়ে আসছে। ১৮৬৯ সনে প্রকাশিত এক অজ্ঞাতপরিচয় লেখকের ‘মিয়াজান দারোগার একরারনামা’ বইটিতে দুর্নীতির যে চিত্র আঁকা হয়েছে তা অভূতপূর্ব। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক পরিচালিত দুর্নীতির ধারণা সূচকে ২০১৮ সনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৩তম, ২০১৯ সনে ছিল ১৪তম, ২০২০ সনে দুই ধাপ নিচে নেমে হয়েছে ১২তম। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশের চেয়ে আরও বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হচ্ছে কম্বোডিয়া, উত্তর কোরিয়া এবং আফগানিস্তান। অবশ্য বিএনপি’র আমলে বাংলাদেশের অবস্থান আরও খারাপ ছিলো- ২০০১ থেকে ২০০৫ সন পর্যন্ত টানা ৫ বছর বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল। জনগণের জন্য দুর্ভাগ্য হচ্ছে, কোন সরকারই নিজেদের দুর্নীতির কথা স্বীকার করে না, টিআইবির প্রতিবেদন প্রকাশের পর সেই প্রতিবেদনকে শুধু অস্বীকারই করা হয় না, সব সরকারের আমলে চ্যালেঞ্জও করা হয়েছে। প্রতিবেদন সরকারের বিপক্ষে ছিলো বলে বিএনপির শাসনামলে টিআইবি বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছিল।

খালেদা জিয়া, খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান, আরাফাত রহমান কোকোর দুর্নীতিও বিএনপি স্বীকার করে না, তাদের ফাঁসানো হয়েছে বলে বিএনপির বিশ্বাস। ২০০৭ সনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং তার স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে ‘সম্পদের তথ্য গোপন ও মিথ্যা বিবরণী দেওয়ার’ অভিযোগে যে মামলা করা হয় তার শুনানির তারিখ ধার্য হওয়ায় বিএনপি ক্ষোভ প্রকাশ করছে। বিএনপির বক্তব্য হচ্ছে, ডা. জোবাইদা একজন অরাজনৈতিক চিকিৎসক, তাকে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় জড?ানো সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং প্রতিহিংসামূলক। বিএনপির কথায় মনে হচ্ছে শুধু রাজনৈতিক ব্যক্তিরাই দুর্নীতি করে থাকে। সব সরকারের আমলই দেখা গেছে, বিরোধী দলের কোন নেতার বিরুদ্ধে মামলা হলেই তা ষড়যন্ত্র বলে নাকচ করা হয়। অবশ্য বিরোধী দলের নেতাদের নিস্তেজ রাখার জন্য রাজনৈতিক অভিসন্ধি থেকে মামলা যে হয় না, তা কিন্তু নয়।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের জিরো টলারেন্সের কথা জোর দিয়ে বলা হলেও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের কোন নজির জনগণের নিকট দৃশ্যমান হচ্ছে না

শুধু রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে নয়, সাধারণ মানুষও এমন মামলায় মারাত্মকভাবে হেনস্তার শিকার হয়। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হলেই তাকে ক্ষমতাসীন সরকারের দুরভিসন্ধী বলে হাল্কা করার এই চেষ্টাও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগ নেতাদের দুর্নীতি প্রকাশ পেতে থাকবে, আওয়ামী লীগও বিএনপির মতো বলবে রাজনৈতিক কারণে তাদের ফাঁসানো হচ্ছে, বিএনপির মতো আওয়ামী লীগের কর্মীরা তা বিশ্বাসও করবে। তবে বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের ক্ষমতায় এসে সরকারের টাকা আত্মসাৎ করার প্রয়োজন হয় বলে মনে হয় না, দলীয় কমিটিগুলোর পদ আর নির্বাচনে মনোনয়ন বিক্রি করে যে আয় করেন, তাও দেশে রাখার জায়গা পান না। দেশে দুর্নীতি রোধের একটি পথ আছে এবং তা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন বিএনপির সব দুর্নীতিবাজকে এবং বিএনপি ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের সব দুর্নীতিবাজকে ধরে বিচারের সম্মুখীন করবে।

দেশে দুর্নীতি এবং দুর্নীতিমূলক কাজ প্রতিরোধের লক্ষ্যে দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিচালনার জন্য ২০০৪ সনে সাবেক ‘দুর্নীতি দমন ব্যুরো’ বিলুপ্ত করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বর্তমান দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিষ্ঠা করেই বিএনপি নিজেদের লোক দিয়ে দুর্নীতি কমিশন গঠন করে; অথচ দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কার্যপরিচালনা করবে মর্মে সংশ্লিষ্ট আইনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সরকারের এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে বিরোধী দলে থাকাকালীন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি অভিযোগ করেই যাচ্ছে। বিরোধী দল এবং সরকারের মধ্যে পারস্পরিক দোষারোপের বেড়াজালে দুদকও দুর্নীতি থেকে মুক্ত থাকতে পারছে না। একটি অপরাধ হালকা করার জন্য অতীতের অনুরূপ আরেকটি অপরাধের তুলনামূলক উদাহরণ দেয়ার সংস্কৃতি থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে বের হয়ে আসতে হবে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

দুর্নীতি ও দোষারোপের রাজনীতি

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শনিবার, ২১ মে ২০২২

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল দুদকের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে তাদের মহাসচিবের স্বাক্ষরিত একটি চিঠি কমিশনের সচিব মো. মাহবুব হোসেনের হাতে তুলে দেন। দুটি সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দুদকে অভিযোগ দাখিল করেছে বিএনপি। বিএনপির অভিযোগ হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার সঙ্গে একজন মন্ত্রীর কথোপকথনে অপরাধমূলক কর্মকান্ডের তথ্য-উপাত্ত বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও দুদক নির্লিপ্ত, কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। অন্যটি হলো সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ছোট ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরের দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ। বিএনপি মনে করে স্পর্শকাতর দুর্নীতি নিয়ে দুদক চুপ থাকে, কোন ব্যবস্থা নেয় না। তাদের আরও অভিযোগ হচ্ছে, দুর্নীতি দমন কমিশনে যারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে চান তাদের হেনস্তা করা হয়। দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতেও দুদককে বিএনপির তরফ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে।

দুদকে বিএনপির এমন অভিযোগ দাখিল করায় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ হাল্কা রসের সৃষ্টি করে বলেছেন, বিএনপি নাটক করতেই দুর্নীতি দমন কমিশনে গিয়েছে। তার কথা অনুযায়ী ক্ষমতা থাকাকালীন বিএনপি দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমগ্ন ছিল এবং হাওয়া ভবন ছিল দুর্নীতির আখড়া, হাওয়া ভবনের লুটপাটের জন্যই দেশ বিএনপির আমলে বহুবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও বলেছেন, বিএনপি নিজেদের দুর্নীতি আড়াল করার জন্যই দুদকে গিয়ে এই মহড়া দিয়েছে।

তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, বিএনপি এবং বিএনপির নেতাদের দুর্নীতির খতিয়ানও নাকি সরকারের কাছে রয়েছে। নেতাদের কথা শুনলে বিস্মিত হওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না- দুর্নীতির খতিয়ান থাকা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট নেতাদের আইনের আওতায় না এনে কেন প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে তার কোন ব্যাখ্যা নেই। বিএনপির দুর্নীতিবাজ নেতাদের না ধরার পেছনে বর্তমান সরকারের অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কথা মনে পড়ে যায়; জিয়াউর রহমান তার সামরিক শাসনামলে সেনা কর্মকর্তাদের দুর্নীতি করার সুযোগ করে দিতেন বলে পত্রিকায় পড়েছিলাম। দুর্নীতিগ্রস্ত কোন সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের অবাধ্য হচ্ছে মনে হলেই তাকে ডেকে নিয়ে তার দুর্নীতির নথিটি পড়তে দিতেন। বিরোধীদলীয় কোন নেতাকে স্তব্ধ করার এমন কৌশল রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগও হয়ত খেলছে।

বিএনপি বহুদিন ধরে বলে আসছে, মেগা প্রজেক্টের অন্তরালে মেগা দুর্নীতি। মেগা প্রকল্পগুলোর দুয়েকটিতে দুর্নীতির কিছু চিত্র মিডিয়ায় প্রকাশও পেয়েছে- বালিশের দর, বালিশ ওপরে তোলার খরচ নিয়ে বহুদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাসিঠাট্টাও হয়েছে। আমাদের দেশে নির্মাণ ব্যয় অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি- এমন অভিযোগ হরহামেশাই শোনা যায়। এই সব অভিযোগের কোন জুতসই উত্তর বর্তমান সরকারের কারও কাছ থেকে কখনো শোনা যায়নি। দেশের বাইরে বর্তমান সরকারের আমলে অর্থ পাচার নিয়ে বিএনপি’র অভিযোগ থামছেই না। বিএনপি মনে করে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী এবং আমলারা দুর্নীতি করে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছেন। কিন্তু বর্তমান সরকারের নেতারা অভিযোগের জবাব না দিয়ে বিএনপির আমলে যে আরও বেশি দুর্নীতি হয়েছে তার ফিরিস্তি দিতে থাকেন। তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের জিরো টলারেন্সের কথা জোর দিয়ে বলা হলেও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের কোন নজির জনগণের নিকট দৃশ্যমান হচ্ছে না।

মেগা প্রকল্পে মেগা দুর্নীতি করার সুযোগ যে নেই তা প্রথম উচ্চারণ করলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব আহমদ কায়কাউস এফবিসিসিআই-এর একটি সেমিনারে। যমুনা ব্রিজে শতভাগ দুর্নীতি মুক্ত কাজ হয়েছে বলে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জোর দিয়ে বলেছেন সত্য, কিন্তু তা বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারেননি। সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ভাইকে আওয়ামী লীগ সরকার গ্রেপ্তার করেছে, তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। দ্বিতীয়ত বিদেশে পাচার করা টাকা যে আনা সহজ নয়, তা আমি আমার আরেকটি লেখায় বিশদভাবে উল্লেখ করেছি। খালেদা জিয়ার ছেলে কোকো রহমানের পাচার করা অর্থ ছাড়া আর কোন পাচার করা টাকা আজ পর্যন্ত কোন সরকার ফেরত আনতে পেরেছে বলে আমার জানা নেই। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত উপমহাদেশের প্রত্যেকটি সরকার নির্বাচনের আগে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, কিন্তু ইমরান খান, নরেন্দ্র মোদি বা গোতাবায়া রাজাপক্ষ কেউই পাচার করা অর্থ ফেরত এনে কোন নজির স্থাপন করতে পারেননি।

ব্রিটিশ আমল থেকেই দুর্নীতি হয়ে আসছে। ১৮৬৯ সনে প্রকাশিত এক অজ্ঞাতপরিচয় লেখকের ‘মিয়াজান দারোগার একরারনামা’ বইটিতে দুর্নীতির যে চিত্র আঁকা হয়েছে তা অভূতপূর্ব। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক পরিচালিত দুর্নীতির ধারণা সূচকে ২০১৮ সনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৩তম, ২০১৯ সনে ছিল ১৪তম, ২০২০ সনে দুই ধাপ নিচে নেমে হয়েছে ১২তম। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশের চেয়ে আরও বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হচ্ছে কম্বোডিয়া, উত্তর কোরিয়া এবং আফগানিস্তান। অবশ্য বিএনপি’র আমলে বাংলাদেশের অবস্থান আরও খারাপ ছিলো- ২০০১ থেকে ২০০৫ সন পর্যন্ত টানা ৫ বছর বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল। জনগণের জন্য দুর্ভাগ্য হচ্ছে, কোন সরকারই নিজেদের দুর্নীতির কথা স্বীকার করে না, টিআইবির প্রতিবেদন প্রকাশের পর সেই প্রতিবেদনকে শুধু অস্বীকারই করা হয় না, সব সরকারের আমলে চ্যালেঞ্জও করা হয়েছে। প্রতিবেদন সরকারের বিপক্ষে ছিলো বলে বিএনপির শাসনামলে টিআইবি বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছিল।

খালেদা জিয়া, খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান, আরাফাত রহমান কোকোর দুর্নীতিও বিএনপি স্বীকার করে না, তাদের ফাঁসানো হয়েছে বলে বিএনপির বিশ্বাস। ২০০৭ সনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং তার স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে ‘সম্পদের তথ্য গোপন ও মিথ্যা বিবরণী দেওয়ার’ অভিযোগে যে মামলা করা হয় তার শুনানির তারিখ ধার্য হওয়ায় বিএনপি ক্ষোভ প্রকাশ করছে। বিএনপির বক্তব্য হচ্ছে, ডা. জোবাইদা একজন অরাজনৈতিক চিকিৎসক, তাকে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় জড?ানো সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং প্রতিহিংসামূলক। বিএনপির কথায় মনে হচ্ছে শুধু রাজনৈতিক ব্যক্তিরাই দুর্নীতি করে থাকে। সব সরকারের আমলই দেখা গেছে, বিরোধী দলের কোন নেতার বিরুদ্ধে মামলা হলেই তা ষড়যন্ত্র বলে নাকচ করা হয়। অবশ্য বিরোধী দলের নেতাদের নিস্তেজ রাখার জন্য রাজনৈতিক অভিসন্ধি থেকে মামলা যে হয় না, তা কিন্তু নয়।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের জিরো টলারেন্সের কথা জোর দিয়ে বলা হলেও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের কোন নজির জনগণের নিকট দৃশ্যমান হচ্ছে না

শুধু রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে নয়, সাধারণ মানুষও এমন মামলায় মারাত্মকভাবে হেনস্তার শিকার হয়। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হলেই তাকে ক্ষমতাসীন সরকারের দুরভিসন্ধী বলে হাল্কা করার এই চেষ্টাও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগ নেতাদের দুর্নীতি প্রকাশ পেতে থাকবে, আওয়ামী লীগও বিএনপির মতো বলবে রাজনৈতিক কারণে তাদের ফাঁসানো হচ্ছে, বিএনপির মতো আওয়ামী লীগের কর্মীরা তা বিশ্বাসও করবে। তবে বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের ক্ষমতায় এসে সরকারের টাকা আত্মসাৎ করার প্রয়োজন হয় বলে মনে হয় না, দলীয় কমিটিগুলোর পদ আর নির্বাচনে মনোনয়ন বিক্রি করে যে আয় করেন, তাও দেশে রাখার জায়গা পান না। দেশে দুর্নীতি রোধের একটি পথ আছে এবং তা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন বিএনপির সব দুর্নীতিবাজকে এবং বিএনপি ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের সব দুর্নীতিবাজকে ধরে বিচারের সম্মুখীন করবে।

দেশে দুর্নীতি এবং দুর্নীতিমূলক কাজ প্রতিরোধের লক্ষ্যে দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিচালনার জন্য ২০০৪ সনে সাবেক ‘দুর্নীতি দমন ব্যুরো’ বিলুপ্ত করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বর্তমান দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিষ্ঠা করেই বিএনপি নিজেদের লোক দিয়ে দুর্নীতি কমিশন গঠন করে; অথচ দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কার্যপরিচালনা করবে মর্মে সংশ্লিষ্ট আইনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সরকারের এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে বিরোধী দলে থাকাকালীন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি অভিযোগ করেই যাচ্ছে। বিরোধী দল এবং সরকারের মধ্যে পারস্পরিক দোষারোপের বেড়াজালে দুদকও দুর্নীতি থেকে মুক্ত থাকতে পারছে না। একটি অপরাধ হালকা করার জন্য অতীতের অনুরূপ আরেকটি অপরাধের তুলনামূলক উদাহরণ দেয়ার সংস্কৃতি থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে বের হয়ে আসতে হবে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

back to top