alt

উপ-সম্পাদকীয়

বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধে সচেতনতা জরুরি

সুব্রত বিশ্বাস

: বৃহস্পতিবার, ১৬ জুন ২০২২

প্রতিনিয়ত পরিবর্তীত হচ্ছে পৃথিবী। এই পরিবর্তনের ধারায় কখনও সিডর, কখনও সুনামি, কখনও আইলা, কখনও হারিকেন, কখনও নার্গিস, কখনও ফনি, কখনও ভূমিকম্প, কখনও অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, সর্বশেষ আম্পান, বিভিন্ন রকমের রোগ-বালাই দুর্যোগ আকারে দেখা দিচ্ছে। মারা যাচ্ছে মানুষ, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মাঠের পর মাঠ ফসল। বাড়ছে খাদ্য সংকট। ঘরবাড়ি মিশে যাচ্ছে মাটির সঙ্গে। ফলে মানুষ হারাচ্ছে তার মাথা গোজার ঠাঁই। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে জলবায়ুর কুপ্রভাব বিশ্বে মরুকরণ একটি অন্যতম সমস্যা।

প্রি তবছর ১৭ জুন পালন করা হয় বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস। বিশ্বের জলভূমির প্রায় ৭০% ইতোমধ্যেই হয়ে পড়েছে মরুকবলিত। এর পরিমাণ পৃথিবীর মোট ভূমির চার ভাগের এক ভাগ। নিষ্কাষণে অব্যবস্থা ও লবণাক্ততার ফলে সেচের আওতাধীন আবাদি জমির বিশাল অংশ আজ অবক্ষয়ের সম্মুখীন। সুতারাং মরুকরণ ভবিষ্যত পৃথিবীর জন্য এক বিশাল হুমকি। এজন্য প্রয়োজন মরুকরণ বিস্তার রোধ।

মরুকরণ যেমনিভাবে বিশ্বব্যাপী মাথা ব্যথার কারণ, তেমনি আমাদেরও উদ্বেগের যথেষ্ঠ কারণ রয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দিন দিন আমাদের ফসলি জমি কমে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। একই সঙ্গে কমছে গাছ-পালা, বন-জঙ্গল। তার চেয়ে বড় বিষয় আমাদের নদী হলো শুকিয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য জলাধারের অবস্থাও সংকটাপন্ন। দিন দিন যেমন আমাদের ফসলি জমি কমছে, একই সঙ্গে খরায় উর্বরতা হারাচ্ছে জমি। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ তিনটি দেশের একটি বাংলাদেশ। এ অবস্থায় পরিবেশের প্রতি আমাদের মনোযোগী হওয়া আবশ্যক।

জাতিসংঘের এক গবেষণা বলছে ২০ বছর পর মানবজাতির যাবতীয় চাহিদা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। সেই সময়ে বর্তমানের প্রায় ৫০% বেশি খাদ্যের প্রয়োজন হবে। জাতিসংঘ আশঙ্কা করছে তখনকার চাহিদামতো প্রয়োজনীয় খাদ্য ও অন্যান্য উপাদানের ঘাটতি দেখা দিয়ে সেটা সংকট সৃষ্টি করতে পারে। সেই সংকট গতি নিয়ে চলে যেতে পারে সংঘর্ষের দিকে। আর এ সংকটের একমাত্র কারণ হবে মরুকরণ ও খরা।

মরুকরণ এতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না হলেও এখন এটি পরিবেশ বিজ্ঞানীদের যথেষ্ঠ ভাবিয়ে তুলেছে। সম্প্রতি আমাদের দেশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আম্পান, সিডর, আইলা, নার্গিসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগ এই ভাবনাকে আরো প্রবল করে তুলেছে।

মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামল দেশটি হয়তো একদিন হারিয়ে যেতে পারে মরুভূমির ধূসর বালির গহ্বরে। বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থা বিশ্লেষন করে বিশ্লেষকরা এটাই আশঙ্কা করছেন। তারা বলেছেন মরুকরণের প্রধান দুটি বিষয় হচ্ছে একটি বিস্তৃত এলাকা ছেড়ে যদি সেখানকার মাটি অনুর্বর হতে থাকে এবং যদি নদী-নালা, খাল বিল শুকিয়ে যেতে থাকে ও বৃষ্টির অভাব ঘটে। বিগত কয়েক দশক ধরে এ লক্ষণগুলো বেশিভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে বাংলাদেশে।

এ পরিস্থিতিতে কৃষিজমি সংরক্ষণ, কৃষিকাজে জৈবসার ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিতকরণে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রচারণা, অপরিকল্পিত নগরায়ন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা, নদীর পানিপ্রবাহে যথাযথ উদ্যোগ, খাল-বিল ও জলাভূমিসমূহ সংরক্ষণে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন তারা।

অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে দেশের কৃষিজমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে। সাধারণ হিসাবে মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণ যদি পাঁচ ভাগ থাকে তাহলে তা উর্বর মাটি। দেশের কৃষিজমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বর্তমানে এক শতাংশ। রাসায়নিক সার ব্যবহার ও শাকসবজির বদলে ধান চাষ বেশি হওয়ায় মাটি গুণাগুণ হারিয়ে অনুর্বর হয়ে পড়ছে।

বর্ষা বা শীত মৌসুমে ধঞ্চে, কলাই প্রভৃতি চাষ করলে কৃষি জমির ঊর্বরতা বাড়াতো। কিন্তু এখন দীর্ঘ দিনের সেই প্রথাগত চাষ বন্ধ। জমির অনুর্বরতা ঠেকাতে জৈব চাষের প্রতি কৃষকদের উৎসাহিত করা উচিত। কিন্তু তা সময়সাপেক্ষ হওয়ায় সবাই ঝুঁকছে রাসায়নিক সারের দিকে। এভাবে চলতে থাকলে একদিন দেশের কৃষিজমি পুরোপরি অনুর্বর হয়ে পড়বে; যা মরুকরণে ঝুঁকির একটি প্রধান দিক।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে খরাকবলিত হয়ে ক্রমান্বয়ে ভূমির অবক্ষয় হচ্ছে। বিশেষত রাজশাহী অঞ্চল এই সমস্যা কবলিত অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত। অত্যান্ত জরুরি হলেও বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস এদেশে বিশেষ গুরুত্ব বিস্তার করতে পারেনি। তবে মরুকরণ রোধে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সরকারের পরিবেশবান্ধব বৃক্ষ রোপণ কার্যক্রম বিশেষভাবে গৃহীত হয়েছে; যা প্রশংসার দাবিদার। মরুকরণ বিস্তার রোধে অধিক বৃক্ষ রোপণই হচ্ছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

যেসব বৃক্ষ পানি ধরে রাখে এবং জমির মান অক্ষুন্ন রাখতে পারে সেসব বৃক্ষ রোপণ করার ব্যাপারে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা সবাইকে পরামর্শ দিচ্ছেন। বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস পালনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কনভেনশনে গৃহীত মূল প্রস্তাবে বৃক্ষরোপণ এবং বিকল্প জ্বালানি সৃষ্টির ওপর জোর দেয়া হয়েছে।

এক হিসাবে বলা হয়েছে- গত একশ বছরের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা ০.৭৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা এভাবে বাড়তে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা ০.৫০ থেকে ১.৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা যদি এভাবে বেড়ে যায়, তাহলে মানুষের নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে আমাদের। এতে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা, সুপেয় পানি ও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি তাদের অধিকার, গৃহায়ন ও অন্যান্য অবকাঠামোগত সুবিধা হুমকির মুখে পড়বে।

জাতিসংঘ এ দিবসটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পালনের আহবান জানালেও বাংলাদেশে দিবসটি গুরুত্বের সঙ্গে পালন হচ্ছে না। অথচ অনেক গুরুত্বহীন দিবসও সাড়ম্বরে পালিত হতে দেখা যায়। বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনায় বাংলাদেশে দিবসটির তাৎপর্যময় উদযাপন প্রত্যাশা করি।

বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করুক। খরা ও মরুময়তা প্রতিরোধসহ কৃষিজমি রক্ষায় ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র যার যার অবস্থান থেকে সক্রিয় হোক- এ প্রত্যাশা থাকল।

[লেখক : কাউন্সিলর, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়]

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধে সচেতনতা জরুরি

সুব্রত বিশ্বাস

বৃহস্পতিবার, ১৬ জুন ২০২২

প্রতিনিয়ত পরিবর্তীত হচ্ছে পৃথিবী। এই পরিবর্তনের ধারায় কখনও সিডর, কখনও সুনামি, কখনও আইলা, কখনও হারিকেন, কখনও নার্গিস, কখনও ফনি, কখনও ভূমিকম্প, কখনও অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, সর্বশেষ আম্পান, বিভিন্ন রকমের রোগ-বালাই দুর্যোগ আকারে দেখা দিচ্ছে। মারা যাচ্ছে মানুষ, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মাঠের পর মাঠ ফসল। বাড়ছে খাদ্য সংকট। ঘরবাড়ি মিশে যাচ্ছে মাটির সঙ্গে। ফলে মানুষ হারাচ্ছে তার মাথা গোজার ঠাঁই। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে জলবায়ুর কুপ্রভাব বিশ্বে মরুকরণ একটি অন্যতম সমস্যা।

প্রি তবছর ১৭ জুন পালন করা হয় বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস। বিশ্বের জলভূমির প্রায় ৭০% ইতোমধ্যেই হয়ে পড়েছে মরুকবলিত। এর পরিমাণ পৃথিবীর মোট ভূমির চার ভাগের এক ভাগ। নিষ্কাষণে অব্যবস্থা ও লবণাক্ততার ফলে সেচের আওতাধীন আবাদি জমির বিশাল অংশ আজ অবক্ষয়ের সম্মুখীন। সুতারাং মরুকরণ ভবিষ্যত পৃথিবীর জন্য এক বিশাল হুমকি। এজন্য প্রয়োজন মরুকরণ বিস্তার রোধ।

মরুকরণ যেমনিভাবে বিশ্বব্যাপী মাথা ব্যথার কারণ, তেমনি আমাদেরও উদ্বেগের যথেষ্ঠ কারণ রয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দিন দিন আমাদের ফসলি জমি কমে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। একই সঙ্গে কমছে গাছ-পালা, বন-জঙ্গল। তার চেয়ে বড় বিষয় আমাদের নদী হলো শুকিয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য জলাধারের অবস্থাও সংকটাপন্ন। দিন দিন যেমন আমাদের ফসলি জমি কমছে, একই সঙ্গে খরায় উর্বরতা হারাচ্ছে জমি। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ তিনটি দেশের একটি বাংলাদেশ। এ অবস্থায় পরিবেশের প্রতি আমাদের মনোযোগী হওয়া আবশ্যক।

জাতিসংঘের এক গবেষণা বলছে ২০ বছর পর মানবজাতির যাবতীয় চাহিদা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। সেই সময়ে বর্তমানের প্রায় ৫০% বেশি খাদ্যের প্রয়োজন হবে। জাতিসংঘ আশঙ্কা করছে তখনকার চাহিদামতো প্রয়োজনীয় খাদ্য ও অন্যান্য উপাদানের ঘাটতি দেখা দিয়ে সেটা সংকট সৃষ্টি করতে পারে। সেই সংকট গতি নিয়ে চলে যেতে পারে সংঘর্ষের দিকে। আর এ সংকটের একমাত্র কারণ হবে মরুকরণ ও খরা।

মরুকরণ এতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না হলেও এখন এটি পরিবেশ বিজ্ঞানীদের যথেষ্ঠ ভাবিয়ে তুলেছে। সম্প্রতি আমাদের দেশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আম্পান, সিডর, আইলা, নার্গিসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগ এই ভাবনাকে আরো প্রবল করে তুলেছে।

মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামল দেশটি হয়তো একদিন হারিয়ে যেতে পারে মরুভূমির ধূসর বালির গহ্বরে। বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থা বিশ্লেষন করে বিশ্লেষকরা এটাই আশঙ্কা করছেন। তারা বলেছেন মরুকরণের প্রধান দুটি বিষয় হচ্ছে একটি বিস্তৃত এলাকা ছেড়ে যদি সেখানকার মাটি অনুর্বর হতে থাকে এবং যদি নদী-নালা, খাল বিল শুকিয়ে যেতে থাকে ও বৃষ্টির অভাব ঘটে। বিগত কয়েক দশক ধরে এ লক্ষণগুলো বেশিভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে বাংলাদেশে।

এ পরিস্থিতিতে কৃষিজমি সংরক্ষণ, কৃষিকাজে জৈবসার ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিতকরণে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রচারণা, অপরিকল্পিত নগরায়ন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা, নদীর পানিপ্রবাহে যথাযথ উদ্যোগ, খাল-বিল ও জলাভূমিসমূহ সংরক্ষণে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন তারা।

অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে দেশের কৃষিজমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে। সাধারণ হিসাবে মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণ যদি পাঁচ ভাগ থাকে তাহলে তা উর্বর মাটি। দেশের কৃষিজমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বর্তমানে এক শতাংশ। রাসায়নিক সার ব্যবহার ও শাকসবজির বদলে ধান চাষ বেশি হওয়ায় মাটি গুণাগুণ হারিয়ে অনুর্বর হয়ে পড়ছে।

বর্ষা বা শীত মৌসুমে ধঞ্চে, কলাই প্রভৃতি চাষ করলে কৃষি জমির ঊর্বরতা বাড়াতো। কিন্তু এখন দীর্ঘ দিনের সেই প্রথাগত চাষ বন্ধ। জমির অনুর্বরতা ঠেকাতে জৈব চাষের প্রতি কৃষকদের উৎসাহিত করা উচিত। কিন্তু তা সময়সাপেক্ষ হওয়ায় সবাই ঝুঁকছে রাসায়নিক সারের দিকে। এভাবে চলতে থাকলে একদিন দেশের কৃষিজমি পুরোপরি অনুর্বর হয়ে পড়বে; যা মরুকরণে ঝুঁকির একটি প্রধান দিক।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে খরাকবলিত হয়ে ক্রমান্বয়ে ভূমির অবক্ষয় হচ্ছে। বিশেষত রাজশাহী অঞ্চল এই সমস্যা কবলিত অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত। অত্যান্ত জরুরি হলেও বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস এদেশে বিশেষ গুরুত্ব বিস্তার করতে পারেনি। তবে মরুকরণ রোধে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সরকারের পরিবেশবান্ধব বৃক্ষ রোপণ কার্যক্রম বিশেষভাবে গৃহীত হয়েছে; যা প্রশংসার দাবিদার। মরুকরণ বিস্তার রোধে অধিক বৃক্ষ রোপণই হচ্ছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

যেসব বৃক্ষ পানি ধরে রাখে এবং জমির মান অক্ষুন্ন রাখতে পারে সেসব বৃক্ষ রোপণ করার ব্যাপারে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা সবাইকে পরামর্শ দিচ্ছেন। বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস পালনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কনভেনশনে গৃহীত মূল প্রস্তাবে বৃক্ষরোপণ এবং বিকল্প জ্বালানি সৃষ্টির ওপর জোর দেয়া হয়েছে।

এক হিসাবে বলা হয়েছে- গত একশ বছরের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা ০.৭৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা এভাবে বাড়তে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা ০.৫০ থেকে ১.৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা যদি এভাবে বেড়ে যায়, তাহলে মানুষের নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে আমাদের। এতে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা, সুপেয় পানি ও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি তাদের অধিকার, গৃহায়ন ও অন্যান্য অবকাঠামোগত সুবিধা হুমকির মুখে পড়বে।

জাতিসংঘ এ দিবসটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পালনের আহবান জানালেও বাংলাদেশে দিবসটি গুরুত্বের সঙ্গে পালন হচ্ছে না। অথচ অনেক গুরুত্বহীন দিবসও সাড়ম্বরে পালিত হতে দেখা যায়। বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনায় বাংলাদেশে দিবসটির তাৎপর্যময় উদযাপন প্রত্যাশা করি।

বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করুক। খরা ও মরুময়তা প্রতিরোধসহ কৃষিজমি রক্ষায় ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র যার যার অবস্থান থেকে সক্রিয় হোক- এ প্রত্যাশা থাকল।

[লেখক : কাউন্সিলর, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়]

back to top